ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শান্তিনিকেতন ডায়েরি: পর্ব ৯


    নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (October 29, 2021)
     

    স্মৃতির শান্তিনিকেতন

    মানুষ চলে যায়। তাঁর স্মৃতি যেই মহার্ঘ হয়ে ওঠে, তাঁকে ধরে রাখার বিচিত্র উদ্যোগ শুরু হয়ে যায়। তারই অন্যতম, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের নামে কিছু একটার নামকরণ। ব্রাহ্ম ভাবধারায় দীক্ষিত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আশ্রমে মূর্তি অথবা ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে মত দিয়ে গিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে তাই তার প্রতিষ্ঠিতা-আচার্যের কোনও মূর্তিও চোখে পড়ে না, যার সামনে নতজানু হয়ে তাঁর বন্দনা করা যায়। গৌতম বুদ্ধ, সুজাতা ও মহাত্মা গান্ধীর যে-ভাস্কর্য কলাভবনে চোখে পড়ে, তা ব্যক্তিপূজার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়নি। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রিয়জনের স্মৃতি ধরে রাখতে শান্তিনিকেতন অনেক সময় তার প্রথা ভেঙেছে।

    রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় বহু প্রিয়জনকে অকালে হারিয়েছিলেন। মহর্ষির মৃত্যুদিনে, তাঁর স্মরণে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত হয় মহর্ষি-স্মরণ। আশ্রমবন্ধু মহাত্মা গান্ধীর স্মরণে, নিজে হাতে নিজেদের কাজ করে, প্রতি বছর ১০ মার্চ আশ্রমের সকলে পালন করেন ‘গান্ধী-পুণ্যাহ’। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতিথিতে অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্র-সপ্তাহের বক্তৃতামালা। কবির নানা গুণের অধিকারী পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে শ্রীনিকেতনে প্রতি বছর বসে একবেলার এক শিল্পমেলা, যার নাম ‘রথীন্দ্রমেলা’।

    আশ্রমের রাস্তাঘাট, বাড়িঘর আর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর দিকে তাকানো যাক। উইলিয়ম পিয়ারসন, চার্লস এন্ড্রুজ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর রতনলাল টাটার নামে শান্তিনিকেতনে রয়েছে তিনটি পল্লি। ১৯১৭-য় রবীন্দ্রনাথ জাপান ও আমেরিকার দীর্ঘ ভ্রমণ শেষ করে আশ্রমে ফিরে এলে শিক্ষক নেপালচন্দ্র রায়ের তত্ত্বাবধানে একটি নতুন রাস্তা কবির জন্যে তৈরি হয়। পরে রাস্তাটি পরিচিত হয়ে যায় ‘নেপাল রোড’ হিসেবে। নেপাল রোডের পাশেই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ‘গৌরপ্রাঙ্গণ’, যার নামকরণ হয়েছে আশ্রমের প্রাক্তন ছাত্র এবং পরবর্তীকালে শিক্ষক গৌরগোপাল ঘোষের নামে। গৌরপ্রাঙ্গণ-সংলগ্ন এলাকাটিতে রয়েছে কয়েকটি দালান, যা কয়েকজন ব্যক্তির নামে চিহ্নিত। ঠাকুর পরিবারের বন্ধু রায়পুরের জমিদার লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের অর্থানুকূল্যে ও সুরেন্দ্রনাথ করের নকশায় নির্মিত ঘড়ি-ঘরের নাম ‘সিংহসদন’। তার দু’পাশে দুটি দ্বিতল ভবন— পূর্ব এবং পশ্চিম তোরণ। তার দু’পাশে প্রাচীন শান্তিনিকেতনের দুই ছাত্রাবাস। পূর্ব তোরণের পাশে রবীন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াত পুত্র শমীন্দ্রনাথের নামে নির্মিত ‘শমীন্দ্রকুটির’। পশ্চিম তোরণের পাশে অবস্থিত রবীন্দ্রনাথের জামাতা সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের নামে নিবেদিত ‘সত্য কুটির’। সিংহসদনের দু’পাশে দুটি ছাতা। তার একটির পিছনে আশ্রমবিদ্যালয়ের প্রথম যুগের শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায়কে মনে রেখে ‘সতীশ কুটির’ আর পূর্বে অবস্থিত ছাতার পিছনে রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ও আশ্রমবিদ্যালয়ের প্রথম যুগের শিক্ষক মোহিতচন্দ্র সেনের নামে গড়ে ওঠা ‘মোহিত কুটির’। পুরনো মূল কাঁচা বাড়িগুলি যদিও এখন আর নেই। সিংহসদনের উল্টোদিকেই এক সময় ছিল ব্রহ্মবিদ্যালয়ের আদি কুটির, যা ভেঙে ফেলে পরে নির্মিত হয় একটি পাঠাগার। আদি কুটিরে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিছুদিন ছিলেন। শমীন্দ্রনাথের নামে ওই পাঠাগারের নামকরণ হয় ‘শমীন্দ্র শিশু পাঠাগার’।

    দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দীপেন্দ্রনাথের চিতাভস্ম সংরক্ষিত হয়েছে এই ‘দীপেন্দ্র-স্মৃতি’তে
    ছবি সৌজন্যে: লেখক

    রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসবাসের জন্য শান্তিনিকেতন গৃহের অদূরে নতুনবাড়ির পাশে ‘দেহলি’ বলে এক দোতলা বাড়ি করেছিলেন। ১৯০২-এ রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনীর মৃত্যু হয়। তার ছয় দশক পর ওই বাড়িতে খুব ছোট শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় চালু হলে তার নাম হয় ‘মৃণালিনী আনন্দপাঠশালা’। উল্টোদিকের ছাত্রীনিবাসের নামও মৃণালিনীর নামে। পাঠভবন ছাত্রাবাসে চারটি কুটিরের নাম রাখা হয়েছে আশ্রমের চার প্রাক্তন শিক্ষক জগদানন্দ রায়, নেপালচন্দ্র রায়, অজিতকুমার চক্রবর্তী আর তেজেশ্চন্দ্র সেনের নামে— ‘জগৎ-কুটির’, ‘নেপাল কুটির’, ‘অজিত কুটির’ আর ‘তেজেশ কুটির’। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে বিড়লা আর গোয়েঙ্কাদের অর্থানুকূল্যে নির্মিত দুটি ছাত্রীনিবাসের নাম হয়েছিল ওই দুই পরিবারের নামেই। যেমন রতন টাটার অনুদানে তৈরি হওয়া বিশ্বভারতীর প্রাচীন অতিথিনিবাসের নাম হয়ে যায় ‘রতনকুঠি’। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর নামে রাখা হয়েছে কলাভবনের গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালার নাম, ‘নন্দন’। তাঁর নামেই চালু রয়েছে কলাভবনের বার্ষিক শিল্পমেলা, ‘নন্দনমেলা’ও। শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে সমাবর্তনের বেদিটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতীর প্রথম আচার্য জওহরলাল নেহরুর নামে পরিচিত ‘জওহর-বেদি’ হিসেবে। তার পাশেই লর্ড কারমাইকেল আশ্রমে আসার সময় নির্মিত একটি বেদির নাম হয়েছে ‘কারমাইকেল বেদি’।

    অনেক পরে, ‘নিপ্পনভবন’ প্রতিষ্ঠার পর, কালো গ্রানাইটের এক বিশাল প্রস্তরখণ্ড দিয়ে নির্মিত হয়েছে বিশ্বভারতীর জাপানি শিল্পী আরাই কাম্পোর স্মরণে এক স্মৃতিফলক। সেখানে খোদিত হয়েছে, আরাইকে লিখে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা ও কাজুও আজুমার অনুবাদে জাপানি কবি শিওইদে হিদেওর লেখা একটি অণু-কবিতা।রবীন্দ্রনাথের সহযোগী উইলিয়ম পিয়ারসন সচেষ্ট হয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে একটি হাসপাতাল তৈরি করার। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণের পর এই হাসপাতালের নাম হয় ‘পিয়ারসন মেমোরিয়াল হসপিটাল’। রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর নীচুবাংলায় যে সাদাসিধে টালির চালের বাড়িতে থাকতেন, তা পরিচিত ‘দ্বিজবিরাম’ হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের পুত্র ও আশ্রমের ছাত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিতে শিশু-ছাত্রীদের আবাসের নাম হয় ‘সন্তোষালয়’।

    জাপানি শিল্পী আরাই কাম্পোর স্মরণে এক স্মৃতিফলক
    ছবি সৌজন্যে: লেখক

    রবীন্দ্রনাথ চিন থেকে প্রাণিত হয়ে শান্তিনিকেতনে এক চা-চক্রের প্রবর্তন করেন। প্রতিদিন আশ্রমের সকলে মিলে চা খাওয়ার জন্য শান্তিনিকেতনের আশ্রম-মাঠের পূর্বে একটি দ্বিতল, অষ্টভুজাকৃতি ভবন নির্মিত হয়। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর স্ত্রী ছিলেন চা-সংস্কৃতির অনুরাগী। এই চা-ভবন, ‘দিনান্তিকা’য়, তাই রয়ে গিয়েছে তাঁর নামের ছায়া।

    বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে ‘দেশিকোত্তম’ ছাড়াও দেওয়া হয় দুটি পুরস্কার। শিল্পের ক্ষেত্রে উৎকর্ষের জন্য গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের নামে যথাক্রমে ‘গগন পুরস্কার’ ও ‘অবনী পুরস্কার’ আর কৃষিক্ষেত্রে উৎকর্ষের জন্যে কৃষিবিজ্ঞানী রথীন্দ্রনাথের নামে ‘রথীন্দ্র পুরস্কার’।

    শান্তিনিকেতনের উত্তর পূর্বপল্লিতে আমার বাড়ির বাগানে আমি এনে রেখেছিলাম আমার প্রিয় জাপানি গুরু এবং বিশ্বভারতীর নিপ্পনভবনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আজুমা কাজুওর চিতাভস্ম। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন আমার বাবা, বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যাপক মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মূলত ছিলেন একজন ভৌগোলিক, যিনি আমাকে পাথর আর খনিজ চিনিয়েছিলেন। আমি তাঁর চিতাভস্ম বাগানে এনে এক স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠা করেছি। হাসপাতালে বাবা বারবার জল চেয়েও পাননি। তাঁর চিতাভস্ম দিয়ে এক স্মারক নির্মাণ করার সময় আমি বেছে নিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গের নদীর এক পাথর। তার উপর খোদাই করে বানিয়ে নিয়েছিলাম এক ক্ষুদ্র জলাধার, যাতে সারা বছর জল থাকবে। যেখানে জলের খোঁজে পাখি আর কীটপতঙ্গরা আসবে। এই পাথরের নীচেই রাখা আমার হারিয়ে যাওয়া পিতৃদেবের চিতাভস্ম। এই ভাবনার সময় আমি জানার চেষ্টা করেছিলাম, শান্তিনিকেতনে দেহাবশেষ সংরক্ষণের ঐতিহ্য। দেখা গেল বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহে রয়েছে মহর্ষি ও রবীন্দ্রনাথের দেহাবশেষ। রথীন্দ্রনাথ বাবার চিতাভস্ম সংরক্ষণ করতে চাননি। তিনি চাননি বাবার দেহাবশেষ পূজার উপলক্ষ হয়ে উঠুক। কিন্তু কোনও কারণে তা আর নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়নি। দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দীপেন্দ্রনাথের চিতাভস্ম সংরক্ষিত হয়েছে নীচুবাংলোয়, এক কংক্রিটের জলাধারের নীচে। এর নাম এখন ‘দীপেন্দ্র-স্মৃতি’। পাঠভবনে অমর্ত্য সেনের (এমনকী আমারও) ইংরেজির শিক্ষক ললিতকুমার মজুমদার অবনপল্লিতে নিজের বাড়ির বাগানের এক কোণায় রেখেছিলেন তাঁর প্রয়াত স্ত্রীর চিতাভস্ম।শান্তিনিকেতনে অপর্ণা সেন তাঁদের বাড়ির বাগানের এক মন্দিরে রেখেছেন তাঁর বাবা, মা আর দিদার চিতাভস্ম।

    যে-কোনও বিচ্ছেদের পর স্মৃতি পিছু নেবেই। সেই স্মৃতি উদযাপনের বিষাদ, আনন্দ আর স্বাধীনতাও থাকবে। তবে, হারিয়ে যাওয়া মনের মানুষকে খুঁজে পাবার সহজ আর সুন্দর এক পথও দেখিয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ‘স্মরণ’ কবিতায়—
    ‘যখন রব না আমি মর্তকায়ায়
    তখন স্মরিতে যদি হয় মন
    তবে তুমি এসো এই নিভৃতছায়ায়
    যেথা এই চৈত্রের শালবন।’

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook