আষাঢ় বিকেলের আকাশ— শরৎকালের ভূমিকা হয়ে আছে। বৃষ্টির জলে ধোয়া শুভ্র মেঘ দেখা যাচ্ছে। কাঁসরের শব্দ। ধাতু ও কাঠের রথ বের করেছে ছেলেমেয়ের দল। পুকুরপাড় দিয়ে রথ এগোচ্ছে। দেবদারু পাতার গোছা আর রঙিন কাগজের শেকল দিয়ে বানানো রথের ছায়া পড়েছে জলে। বাঁশবন ও সুপুরি গাছের মাথা রূপালি ও ধূসর রঙে ছেয়ে আছে।
ট্রেনপথে এগোচ্ছি নবদ্বীপের দিকে। বাড়ি থেকে আধঘন্টার পথ। চারপাশে ঢালুজমি ফসলপূর্ণা। আশৈশব নিজের বাড়ির কাছেই রথমেলা দেখে এসেছি। ছেড়ে যাওয়া নদী, বাঁকের পাশে মেলা।
নানারকম মানুষ ও ছোট-ছোট কাঁচা মাটির পুতুলের সন্ধানে, এখন অন্যান্য মেলার দিকে মন ঘুরিয়ে রাখি। ট্রেন সহায় এমন উদ্দেশহারা বা হঠাৎ ঠিকের গন্তব্যে বেরিয়ে পড়লে, নিজেকে কালকূটের আত্মীয় অথবা সুধীর চক্রবর্তীর ছাত্র বলে মনে হয়।
আরও পড়ুন: সম্প্রীতির নিদর্শন হয়ে রয়েছে রাজা রাজেন মল্লিকের রথ! লিখছেন সৃজন দে সরকার
ধানজমি অন্ধকার। নবদ্বীপে নেমে পোড়ামাতলা কাছে রেখে মেলায় যাই। অফুরন্ত থই-থই মানুষের ভিড়। রথে-রথে ছয়লাপ। জলের কীর্তন আকাশ ছুঁয়েছে। দশদিকে মেঘের শ্রীখোলে টান লেগেছে। চৈতন্যের পায়ের ছাপ একদা এই পথে, ভাবতেই শরীর রোমাঞ্চিত কদমফুল। সত্যিকারের আবেশ ও ভাব দেখি মানুষের মুখেচোখে। হরিধ্বনির মতো মানুষজন। এইসব সহজ-মানুষ ট্রেনের কামরা ভর্তি করে এসেছে মেলার দিকে। ট্রেনে এক অন্ধ দম্পতি উঠেছিল গান গেয়ে ভিক্ষা করতে, তারা একটি কলমের আমগাছ ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখছিল। যে যুবক বাড়ির মাটিতে গাছ পুঁতবে বলে নিয়ে যাচ্ছে, সে অন্ধজনকে গাছের নাম বলল— আম্রপালী।
ওই বিগ্রহ সত্যি-সত্যি এই আধেক বৃষ্টির পর, আধেক আলোর মেলা।

শিশুদের হাতে অবাধে এমন ভালবাসা আর কে পায়, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা ছাড়া! অভিভাবকদের সামান্য সাহায্য নিয়ে, নিজেদের প্রাণ উজাড় করে বিগ্রহের শ্রী গড়েছে ছেলেমেয়ের দল। কেউ ফুল দিয়ে, কেউ পাতা দিয়ে, কেউ শোলা দিয়ে, কেউ পটের ছবি দিয়ে কেউ-বা টুনি আলো দিয়ে সাজিয়ে এনেছে নিজস্ব রথ। পলকহীন চোখ মেলে, মাটির জগন্নাথ জগৎবাড়ির জানালা-দরজা দেখছে। একটু-একটু কেঁপে উঠছে শিশুদের হাতের কম্পনে। পেতলের থালায় নকুলদানা প্রসাদ। রজনীগন্ধার মালা, ধূপের গন্ধে মালপোয়া ভাজা— পাঁপাড়ের মিশ্রিত ঘ্রাণে, প্রাণ আমর্ম শৈশবে পৌঁছয়।
পুতুল এসেছে হরেক রকমের। বেশিরভাগই বৈষ্ণব লীলার পুতুল। জগন্নাথ, চৈতন্য, রাধাকৃষ্ণ ছাড়া রয়েছে কিছু কার্টুন-চরিত্র। অনেক পুতুলই লাবণ্যহীন। ঘর সাজানো মাটির জিনিস বেশি। চোখে পড়ল গঙ্গাজলের মতো একা বৃদ্ধাকে। মুখে পানের রস। ধবধবে সাদা থানকাপড় পরনে। আঁচলের কাছটা মাটি লেগে সামান্য মলিন। মাথায় একটা কালোছাতা বাঁধা। বিরাট এক ঝুড়িতে যত্ন করে খড় পাতা, সেখানে সারি-সারি ঘুমন্ত পুতুল শুইয়ে রাখা। একবার দেখতেই চোখ টেনে নিল।


পুতুলগুলোর মুখচোখে কী অপূর্ব শ্রী। বুঝতে পারলাম এই সুহাসিনী বৃদ্ধা পুতুল গড়ার গতানুগতিক কারিগর নন, তিনি শিল্পী। পুতুলের গায়ে নিজস্ব চিন্তাভাবনার লতাপাতা এঁকেছেন। একটা বাঘের পিঠে বসা শিকারী পুতুলের চোখে দর্প, মাটির হাতিঘোড়া যেন অচিন দেশের রাজার হাতিশালা, ঘোড়াশালা থেকে বেরিয়ে এসেছে। আর আছে অসংখ্য ছোট-ছোট মাটির পাখি। খুদে-খুদে একেবারে। কিন্তু কী যে তার সৌন্দর্যের বিভা, না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। সামান্য দামে বিকোচ্ছে এইসব আন্তরিক পুতুল। মন ভরে স্তদ্ধ হয়ে দেখি— মাটির সংসার।
অগ্রদ্বীপ মেলায় চৈত্রমাসে, খোঁজ পেয়েছিলাম এমনই এক শিল্পীর। নাম— বৃন্দাবন কর্মকার। কাঠের পুতল গড়েন। নিম কাঠ দিয়ে চৈতন্য, গণেশ-জননী, কালী, যশোদা— কৃষ্ণ গড়েন। এদের দু’জনের একেবার দেখা হলে বেশ। বৃন্দাবন খেতে বসতেন এই বৃদ্ধার কাছে। কলাপাতায় লাউশুক্তো খাওয়া হত।
রথের মেলার এইসব সহজ-কুহকে পূর্ণ হয়ে আছে মন। বৃদ্ধার ঝাঁকার পাখি শূন্য হয়ে এল। আকাশে এবারে ঘন-গম্ভীর মেঘ। পথঘাট রাধারানী গল্পের মতো। আমি মনে-মনে সারাটা সন্ধে তাকিয়ে আছি অপরূপ পক্ষীকূলের দিকে।