‘সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী’

Scene of Jhinder Bandi

সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রর মধ্যিখানে চিত্রনাট্যের ভূমিকা ও অনুষঙ্গ নিয়ে আলোচনা বিস্তর। কালজয়ী থেকে আধুনিক— সময়বিশেষে বিভিন্ন সাহিত্য ও তার চলচ্চিত্রায়ন নিয়ে বারে বারেই তুলনা হয়েছে। ‘ঝিন্দের বন্দী’-ও তার ব্যতিক্রম নয়। সম্পূর্ণ নাটকীয় উপাদানে ভরপুর এই সাহিত্য প্রথমে ইংরেজি টেক্সট থেকে বাংলায় রূপান্তরিত, তারপর চলচ্চিত্রায়ন। পাঠক আর দর্শকের প্রত্যাশা কোথাও ভিন্ন, আবার কোথাও বা আগে সাহিত্য-পাঠের রসাস্বাদন হয়ে গিয়েছে বলে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে প্রত্যাশার পাল্লা বেশি ভারী হয়ে যায়। ‘ঝিন্দের বন্দী’ সাহিত্যগুণে যেমন জনপ্রিয় হয়েছিল, পাশাপাশি উত্তমকুমার আর সৌমিত্রর যুগলবন্দি আপামর জনমানসে তৈরি করেছিল বাড়তি উৎসাহ। আজও বাংলা সিনেমার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হলে প্রথম সারিতে এসে যায় ‘ঝিন্দের বন্দী’-র নাম।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘Historical Fiction’ আর ‘Fictionised History’ নিয়ে ভাবনার কথা আমরা দেখেছি ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-র ভূমিকায়। এরপর সাহিত্য থেকে যখন সিনেমার পর্দায় ‘ঝিন্দের বন্দী’ উঠে আসে, প্রথম যে সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়, তা হল অর্থনৈতিক। স্বাভাবিকভাবেই, যে কোনও সিনেমার সিনেমা হয়ে ওঠার পিছনে এটা একটা বড় প্রশ্ন থাকে। উপন্যাস, তার কাঠামো, ঘাত-প্রতিঘাত— এগুলো নিয়ে আলোচনা অন্য প্রেক্ষিতের, কিন্তু সিনেমার ভাষা, সিনেমার সজ্জা এবং প্রযুক্তিগত দিক (সেই সময়ের নিরিখে) খানিক হলেও বেশি আলোচনার দাবি রাখে, কারণ একটা ভিন জায়গা, সেখানকার আন্দোলিত রাজনীতি, টানাপোড়েন— তাকে বাঙালি দর্শকের জন্য প্রস্তুত করা সহজ কথা না। সিনেমা বানানোর পর প্রায় ৬৪ বছর অতিক্রান্ত, তার পরেও কেবল উত্তম-সৌমিত্রর বাইরেও এই চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলার একাধিক জায়গা থেকে যায়। ‘আমি তো ঝিন্দের রাজা নই, বরং ঝিন্দের বন্দী’— এই সংলাপ কোথাও গিয়ে ‘রক্তকরবী’-র কিছু পরে লেখা এই উপন্যাসে কোনও নতুন রূপকের খোঁজ দেয়?

একটি জাতির শিল্পচর্চা যখন রূপকের আড়ালে অসম সময়কে বাস্তব করে তোলে, তখন তা হয়ে ওঠে ইতিহাসের চেয়েও আরও বেশি কিছু। এই কথাটিই মনে আসে, যখন তপন সিংহ নির্মিত ১৯৬১ সালের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘ঝিন্দের বন্দী’ প্রসঙ্গে। এটি কেবল একটি সিনেমা নয়, এটি বাংলা সিনেমার দুই মহীরুহ— উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যেকার এক প্রজন্মান্তরের শৈল্পিক সংঘর্ষের এক অনন্য দলিল, একথা দর্শকমাত্রই বলে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে, খানিক নৈর্ব্যক্তিকভাবে এই চলচ্চিত্রকে যখন দেখি, তখন ক্রমান্বয়ে আলোচনার নানা পরত খুলে যায়।

‘ঝিন্দের বন্দী’-র এক দৃশ্যে উত্তমকুমার ও অন্যান্য অভিনেতারা…

আরও পড়ুন : তপন সিংহ-র ‘নির্জন সৈকতে’ যে-কারণে এগিয়ে ছিল সময়ের থেকে!
লিখছেন সোহিনী দাশগুপ্ত…

‘দ্য প্রিজনার অফ জেন্ডা’-র বাঙালি অভিযোজন এই ছবি, কিন্তু তা নিছক সাহেবি সাহসিকতার গল্প হয়ে থাকেনি। বরং তা পরিণত হয়েছে এমন এক কল্পজগতে, যেখানে রাজনীতি, প্রেম, আত্মত্যাগ, এবং ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব একাকার হয়ে গিয়েছে। এর মূল আকর্ষণ ছিল অবশ্যই রূপোলি পর্দার দুই তারকার মুখোমুখি দ্বৈরথ, কিন্তু আসলে পর্দার চরিত্রে নয়, বরং ক্যামেরার পিছনে লুকিয়ে থাকা সেই দৃষ্টি, যা আজও খুঁজে ফিরছে বাংলা সিনেমার উত্তরাধিকার-প্রশ্নের উত্তর।

ছবির কেন্দ্রে রয়েছে গৌরীশঙ্কর রায় (উত্তমকুমার), এক ব্রিটিশ শিক্ষিত যুবক, যিনি তাঁর নাগরিক আর অন্য ভাবনা থেকে বাস্তবের অরাজক রাজনীতির রাজ্যে এসে পড়েন। রাজা শঙ্কর সিং (উত্তমকুমার দ্বৈত ভূমিকায়) অপহরণ, প্রাসাদের অন্তর্ঘাত, আর ষড়যন্ত্রের ছায়া— সব মিলিয়ে এক অলীক নাট্যশালা। আর এই নাটকের সবচেয়ে রহস্যময় মুখ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ময়ূরবাহন— এক সূক্ষ্ম অথচ তীক্ষ্ণ ষড়যন্ত্রকারীর চরিত্রে, যা তাঁর অভিনয়-জীবনের প্রথম খলনায়ক চরিত্র বলা যেতে পারে। রানি কস্তুরীবাঈয়ের চরিত্রে অরুন্ধতী দেবী, উদিত সিংয়ের ভূমিকায় তরুণকুমার প্রমুখ অসাধারণ অভিনয় করলেও, মূল চলচ্চিত্র আজও পরিচিত উত্তমকুমার আর সৌমিত্র একইসঙ্গে আছেন বলেই।

‘ঝিন্দের বন্দী’ সিনেমার শক্তি কেবল গল্প বলার ভঙ্গিতেই নয়, বরং তার চরিত্র নির্মাণে, দৃষ্টিভঙ্গির নাটকীয়তায়, এবং সর্বোপরি দুই তারকার অভিনয়-দ্বৈরথে নিহিত। উত্তমের ব্যক্তিত্ব ছিল নিঃসন্দেহে রাজকীয়— তাঁর গলার স্বর, শারীরিক ভঙ্গি, চোখের ভাষা, সবই যেন ক্যামেরার জন্য জন্ম নেওয়া। অপরদিকে, সৌমিত্রের অভিনয় ছিল মননশীল, স্থির এবং কৌশলভিত্তিক। তাঁর অভিনয়ে ছিল না কোনও বাড়াবাড়ি, কিন্তু প্রতিটি দৃষ্টিতে লুকিয়ে ছিল হিসেবি হিসেব।

এই দুই বিপরীত শৈলীর সংঘর্ষের সবচেয়ে বড় নিদর্শন সেই তলোয়ার-যুদ্ধের দৃশ্য— যা কেবল এক যুদ্ধের উপস্থাপনা নয়, বরং তা হয়ে ওঠে বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতীকী মুহূর্ত। ক্যামেরার সামনে, তারা দুইজন দুই বিপরীত মেরু— একজন রাজা, আর একজন রাজাকে অপসারণকারী।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নতুনভাবে চিনেছিল বাঙালি ময়ুরবাহন চরিত্র মারফত

কিন্তু ক্যামেরার পিছনে? দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগে— এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কি শুধুই চরিত্রের, না কি তা প্রসারিত শিল্পজগতের শক্তি-সম্পর্কেও? এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু উপন্যাস বা পরবর্তীতে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে ছিল না। তা ছিল একরকম অনিবার্য ঘটনা। উত্তমকুমারের স্টারডম যেখানে সব আলো নিজের দিকে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেখানে বিপ্রতীপে সৌমিত্র তাঁর প্রখর অভিনয়ের শক্তিতে এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। সেই লড়াইয়ে হার-জিত নয়, ছিল কেবল আভিজাত্যের আলোকচ্ছটা।

চলচ্চিত্রের কারিগরি দিক থেকেও ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছিল এক অনন্য নজির। দৃষ্টিনন্দন সেট, সুশৃঙ্খল আলোকচিত্র, এবং বিশেষত বিমল মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরা, যা কখনও প্রশস্ত রাজপ্রাসাদের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়, আবার কখনও আবদ্ধ ঘরের নিঃসঙ্গ চিত্র তুলে ধরে। সেই সময়ের বন্দি আর মুক্তি যেন ক্যামেরার মধ্য দিয়েই এক ধারাবাহিক ভাষ্য হয়ে উঠেছে। ছবির সংগীত পরিচালনা করেছিলেন আলি আকবর খান, যার সৃষ্টি কখনও রাজসিক, কখনও বিষণ্ণ, আবার কখনও উত্তেজনাপূর্ণ। প্রতিটি আবহ যেন চরিত্রদের মনের ভেতরকার গতিবিধির সুরেলা প্রতিফলন।

দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগে— এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কি শুধুই চরিত্রের, না কি তা প্রসারিত শিল্পজগতের শক্তি-সম্পর্কেও? এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু উপন্যাস বা পরবর্তীতে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে ছিল না। তা ছিল একরকম অনিবার্য ঘটনা। উত্তমকুমারের স্টারডম যেখানে সব আলো নিজের দিকে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেখানে বিপ্রতীপে সৌমিত্র তাঁর প্রখর অভিনয়ের শক্তিতে এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। সেই লড়াইয়ে হার-জিত নয়, ছিল কেবল আভিজাত্যের আলোকচ্ছটা।

এই চলচ্চিত্রটির আরেকটি বিশেষ দিক হল এর ভাষা ও সংলাপ। চিত্রনাট্য একাধারে নাটকীয় আবার পরিমিত, যা প্রতিটি চরিত্রকে তাদের নিজস্ব ছায়ায় দাঁড়াতে দেয়। গৌরীশঙ্করের সংলাপে ছিল আত্মবিশ্বাস, সৌমিত্রের ময়ূরবাহনের কথায় ছিল ছলনাময় ঈঙ্গিত— কিন্তু পরিমিতির মোড়কে তার দ্রুত বদল। যে খলনায়ক আসলে নায়ক হওয়ার ক্ষমতা রাখলেও, কেবল নীতি আর মূল্যবোধের প্রশ্নে জনমানসে বিতাড়িত হয়, সেই চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা সহজ কাজ ছিল না। ‘ঝিন্দের বন্দী’ মুক্তির পরে বাংলা সিনেমা যেন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায়। একদিকে পুরনো স্টারডমের জাদু, অন্যদিকে নতুন ধারার সূক্ষ্ম বাস্তবতা। উত্তমকুমার হয়তো রাজকীয়তার প্রতীক, কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন দর্শক-মননে ভাবনার নতুন দিগন্ত। এই দ্বৈততা বাংলা সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছে এবং আজও তা দর্শকদের মধ্যে আলোড়ন তোলে, যে কোনও সময়ে বাংলা সিনেমার আলোচনায় সংরূপগত বা নির্মাণশৈলীর নিরিখে এই ছায়াছবিটি এসে যায় আলোচনার পরিসরে।

একটি দৃশ্যে তরুণকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

অনেকে বলেন, এই সিনেমা দুই অভিনেতার মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু এ নেহাতই বাণিজ্যিক ধুয়ো ছাড়া আর কিছুই না। আরও গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, এটি আসলে দুই রকম অভিনয়-শৈলীর সহাবস্থানের অনন্য দলিল। উত্তমের ক্যারিশমা আর সৌমিত্রর অন্তর্দৃষ্টি— এই দুই ধারার মেলবন্ধনেই তো সৃষ্টি হয় শ্রেষ্ঠ শিল্প।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন আমরা বাংলা চলচ্চিত্রের উত্তরাধিকারের দিকে তাকাই, তখন ‘ঝিন্দের বন্দী’ এক স্মরণীয় অধ্যায়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিল্পে কোনও কিছু চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু কিছু মুহূর্ত সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে কিংবদন্তি হয়ে ওঠে। সেই কিংবদন্তির জন্ম হয়েছিল এক তরবারির আঘাতে, দুই শিল্পীর দক্ষতায় এবং এক পরিচালকের গভীর দৃষ্টিভঙ্গিতে।

‘ঝিন্দের বন্দী’ শুধুমাত্র একটি ক্লাসিক সিনেমা নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক দলিল, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাংলা সিনেমার গর্ব কীভাবে দুই তারকার আলোকচ্ছটায় ধরা দিয়েছিল। সেখানেই সিনেমা হয়ে উঠেছিল ইতিহাস।