ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং : পর্ব ৬২


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (November 25, 2024)
     

    কোন আলোতে

    ইরানের মানবাধিকার কর্মী আত্মহত্যা করলেন। বলেছিলেন, অমুক দিন সন্ধে সাড়ে সাতটার মধ্যে এই এই চারজন রাজনৈতিক বন্দি মুক্তি না পেলে, খামেনেই-এর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আমি আত্মহত্যা করব। তা-ই করলেন, উঁচু থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মারা যাওয়ার আগে বলে গেছেন, কাউকে তার মতপ্রকাশের জন্য বন্দি করা যায় না। এও বলেছেন, ইরানের প্রতিটি নাগরিকের প্রতিবাদ জানানোর অধিকার আছে। কথাগুলো নতুন নয়, খুব চমকপ্রদও নয়, কিন্তু নাগাড়ে, অনবরত, শ্বাস না নিয়ে বলে যেতে হয়, এই হল পৃথিবীর মুশকিল। এই প্রতিবাদী মানুষটি, কিয়ানুশ সানজারি, বহুদিন ধরে ইরানে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন এবং ইরানের সরকার বহুদিন ধরে তাঁকে গ্রেফতার ও অত্যাচার করে চলেছে। ১৯৯১ থেকে ২০০৭ বারে বারে তাঁকে ধরপাকড়ের পর তিনি ইরান ছেড়ে নরওয়ে যান, তারপর আমেরিকা, কিন্তু ২০১৬-য় ফিরে আসেন, অসুস্থ মা-কে দেখাশোনার প্রয়োজনে। তখুনি তাঁকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, অবশ্য কয়েক বছর পর ছেড়ে দেওয়া হয় অসুস্থতার কারণে, কিন্তু তখন তাঁকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়, বিছানায় বেঁধে রাখা হয়। যখন সেখানে তাঁকে ইঞ্জেকশন দিয়ে চোয়াল-টোয়াল সব অবশ করে দেওয়া হল এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন আর জ্ঞান ফিরলে দেখলেন তাঁর হাত ও পা শেকল দিয়ে খাটের সঙ্গে বাঁধা, তাঁর ভাষায় সেটা ছিল তাঁর জীবনে সবচেয়ে হতাশার সময়। তিনি বুঝলেন, তাঁর দেশ তাঁর জীবনটা পরিকল্পিত ভাবে নরক করে দিচ্ছে, তাঁর যৌবনটাকে শেকলবদ্ধ করে পিষছে। ১৭ বছর বয়স থেকে তিনি প্রতিবাদ করছেন, ২০ বছরের বেশি সময় ধরে কর্তৃপক্ষ তাঁকে নিগ্রহ করছে, একবার দু’বছরের কারাদণ্ডের সময় তাঁকে ন’মাস সলিটারি সেল-এ রাখা হয়। তখন তিনি ‘শ্বেত অত্যাচার’-এর সম্মুখীনও হন।

    ‘হোয়াইট টর্চার’ হল এমন অত্যাচার, যেখানে চেষ্টা করা হবে কয়েদির সমস্ত ইন্দ্রিয়কে বঞ্চিত করতে। সেখানে দেওয়াল-মেঝে-সিলিং সাদা, কোথাও কোনও রঙের চিহ্নমাত্র নেই। দেওয়াল শব্দরোধী, ফলে কোনও আওয়াজই তার কানে আসবে না। বাইরের প্রহরীরাও সারাক্ষণ নিশ্চুপ, তাদের জুতোর তলায় পর্যন্ত এমন জিনিস লাগানো যাতে পায়চারিরও কোনও শব্দ পাওয়া যাবে না। দেওয়াল-টেওয়াল সমস্তই মসৃণ, যাতে কোনও স্পর্শের অনুভূতি বিশেষ না হয়ে ওঠে। আর তাকে খেতে দেওয়া হবে শুধু সাদা প্লেটে সাদা ভাত, এবং তারও খুব একটা স্বাদ থাকবে না। ফলে মাসের পর মাস নিজের হাত-পা ছাড়া আর কিচ্ছু না দেখতে পেয়ে, নিজের স্বর ছাড়া কোনও শব্দ শুনতে না পেয়ে, কোনও ঘ্রাণ কোনও স্বাদ কোনও স্পর্শ না পেয়ে, কোনওরকম ইন্দ্রিয়ের উদ্দীপনা না পেতে পেতে, বন্দি প্রায় উন্মাদ হয়ে যাবে, অনেক সময়ে তার আত্মপরিচয়ের সংকটও ঘটবে। বেশ কয়েকটা দেশ নাকি এভাবে নিগ্রহ করে, কিন্তু ইরান এ-বিষয়ে প্রধান মস্তান। কিয়ানুশ-কে অনেকবার ইলেকট্রিক শকও দেওয়া হয়েছে, তাঁর মনে হয়েছে এ তাঁর স্মৃতি লোপ করে দেওয়ার চক্রান্ত। অর্থাৎ কর্তৃপক্ষের প্রকল্প হল: প্রতিবাদ যখন করেছ, তোমার স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ সমস্তটা রগড়ে মুছে দেব।

    কিয়ানুশ তাঁর অস্তিত্বটাই নাশ করে দিয়েছেন ৪২ বছর বয়সে, এই কর্তাদের অন্যায়ের বিপক্ষে তাঁর অন্তিম ও চূড়ান্ত প্রতিবাদ হিসেবে। কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে এঁরা ধরায় আসেন, কে জানে। টুইটারে প্রতিবাদ অনেকেই জানান, কিন্তু অমুক সময়ের মধ্যে আমার দাবি না মানলে আমি মরে যাব, এমন তুমুল কথা কেউই বলেন না। সে-কথা বলা ও নিখুঁতভাবে তা রাখা, আর শেষকালে লিখে যাওয়া ‘মনে রাখতে হবে কেউ মৃত্যুকে ভালবেসে মরে না, জীবনকে ভালবেসেই মরে’, আর ‘আশা রাখি একদিন ইরানের মানুষ জাগ্রত হবে ও দাসত্ব মোচন করবে’, এর জন্য যে-প্রাণবস্তু লাগে, ঈশ্বরের কারখানায় তা ক্রমশ অমিল হচ্ছে। ইরানের মতো রাষ্ট্রের নাছোড় ও গোঁয়ার অত্যাচারের ফলে অবশ্য বেপরোয়া প্রতিবাদীরা জন্ম নিচ্ছেন, যাঁরা নারী হয়ে চুল কেটে ফেলছেন বা হিজাব পরছেন না, কিংবা কিয়ানুশের মতো সমস্ত ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে-পুড়িয়ে জীবনটা ঢেলে দিচ্ছেন সমষ্টির কল্যাণার্থে, কিন্তু তবু তাঁদের প্রত্যেকের এই পথ নির্বাচনের জন্য আলাদা করে স্তম্ভিত হতে হয়। সবাই তো নোবেল শান্তি পুরস্কার পাবেন না, ইতিহাসের পাতাতেও সকলের নাম উঠবে না। অনেক ক্ষেত্রেই বড়জোর এক লাইনের খবর হবে, ‘পাঁচজন প্রতিবাদীকে গুলি, তিনজনকে ফাঁসি’। তবু তাঁরা জীবন দিয়ে দিচ্ছেন, এবং জীবন্ত মুহূর্তগুলোর অধিকাংশই কাটাচ্ছেন চাবুকের প্রহারে বা প্রহারের আতঙ্কে। ওয়েব সিরিজ লেপ্টেজুপ্টে বাঁচাবাঁচির লেপ থেকে সামান্য চোখ বের করে আমরা যখন এঁদের চলন নিয়ে মুহূর্তেকও ভাবি, বিস্ময়ে হতভম্ব তো হই বটেই, নিজেদেরও খুব ভাল প্রাণী মনে হয় না। ধুলোভর্তি পৃথিবীতে তাহলে এমন লোকও আছে, আত্মত্যাগকে যে দৈনিক ব্যায়াম করে নিয়েছে? যার দায়িত্ববোধ তাকে নিজের চেয়ে অন্যকে অহরহ বেশি গুরুত্ব দিতে শিখিয়েছে? যে-সমাজ কোনওদিন আসবে কি না সন্দেহ, এলেও তা দেখে যেতে পারার সম্ভাবনা সূদূরপরাহত, সেই সমাজ গড়ার জন্যে সে, ভবিষ্যতের কিছু অনাগত মানুষের সুবিধে ও স্বাধীনতার জন্য সে, নিজেকে লুপ্ত করে দিতে রাজি?

    ধুলোভর্তি পৃথিবীতে তাহলে এমন লোকও আছে, আত্মত্যাগকে যে দৈনিক ব্যায়াম করে নিয়েছে? যার দায়িত্ববোধ তাকে নিজের চেয়ে অন্যকে অহরহ বেশি গুরুত্ব দিতে শিখিয়েছে? যে-সমাজ কোনওদিন আসবে কি না সন্দেহ, এলেও তা দেখে যেতে পারার সম্ভাবনা সূদূরপরাহত, সেই সমাজ গড়ার জন্যে সে, ভবিষ্যতের কিছু অনাগত মানুষের সুবিধে ও স্বাধীনতার জন্য সে, নিজেকে লুপ্ত করে দিতে রাজি?

    আমাদের চারপাশে কিছু মানুষ আত্মনাশ করেন, ব্যক্তিগত জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে। সে-বেদনা প্রকাণ্ড, তবু তা আমরা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারি। কারণ আমাদের দিনটা তো কেটে যায় নিজেদের আকাঙ্ক্ষা কীভাবে ঠোক্কর খেল ও থেঁতলে গেল সেই হিসেব করতে করতে। কিন্তু প্রেম না পাওয়ার কষ্ট, নিঃসঙ্গতার কষ্ট, প্রকাশ্যে অপমানিত হওয়ার কষ্ট বা দারিদ্রের কষ্ট কিছুটা মাপতে পারলেও, আমরা বুঝতে পারি না কোন কাতরতায় একজন মানুষ সমাজে স্বৈরাচার থাকার কষ্ট কিংবা সাম্য না থাকার কষ্টকে সত্তার একেবারে ভেতরে বিঁধতে দিতে পারে। কেন আরও হাজারটা লোকের স্বাধীনতাহীনতা তার মধ্যে এমন ক্ষরণ ঘটায় যে সে তীব্র আন্দোলন করে জেলে যায়। কেন সে বলে মিশা আমিনির গ্রেফতারের প্রতিবাদে যাঁরা বন্দি হয়েছেন তাঁদের না ছাড়লে আমি মরে যাব! ইচ্ছে করলে আমেরিকা চলে যাওয়ার সুযোগ থাকতেও কেন সে ইরানের একটা বাড়ির মাথা থেকে লাফিয়ে পড়ে! নিজের মতো করেই নিজের জাতকে দেশকে গোষ্ঠীকে ভালবাসা খুব কম জিনিস না। দেশের বেদনায় নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া এক অতিমানুষিক সিদ্ধান্ত। আমাদের অশেষ সৌভাগ্য, দেশে-দেশে কালে-কালে এমন কিছু অতিমানব জীবন কাটান বা জীবন দেন। তাঁদের কারও কথা আমরা জানতে পারি অসংখ্য খবরের মধ্যে অন্যতম খবর হিসেবে, একটু অন্যমনা হয়ে যাই, অন্তত আশ্চর্য হই, তারপরে সেই বুদ্বুদ মিলিয়ে যায়। কিয়ানুশকে একবার পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে, প্রথম প্রশ্নটা করার আগেই কুড়িটা থাপ্পড় মেরেছিল। সেই অপমান ও আঘাতের বিরুদ্ধে এই মানুষদের গোটা প্রকল্পটাই হল, একটা প্রাণের মধ্যে সহস্র প্রাণ ভরে নিয়ে আকুল ইতিবাচক দৌড়, যাতে মাথার খুলিটা ফেটে চৌচির হয়ে গেলে, বা টুঁটি নীল হয়ে দম বন্ধ হয়ে গেলে, শেষ দৃষ্টি থেকে শ্বাস থেকে রক্তকণিকা থেকে আরও কিছু স্ফুলিঙ্গ জন্মায়, যা আঙুল বাড়িয়ে বহু প্রাণকে ছুঁতে পারে। আমাদের প্রতিটি ভুলে যাওয়া বা মুখ ব্যাঁকানো বা এই খবর সরিয়ে থ্রিলারে ব্যস্ত হয়ে পড়া তাঁদের আরেকবার, বার বার মৃত্যু ঘটায়। খামেইনি ভাবছেন, যাক, আপদ গেল। আমরাও যদি স্বল্প চুকচুক সেরে চানাচুরের কাছেই ফিরে যাই, তা কিয়ানুশের চেয়ে, আমাদের অধিক দুর্ভাগ্য।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook