ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নীলা-নীলাব্জ : পর্ব ৬


    অনুপম রায় (September 16, 2024)
     

    নেশা

    রাত দশটা। পার্ক স্ট্রিট আর রাসেল স্ট্রিটের মোড়ে এক তরুণী এলাকা কাঁপিয়ে বমি করছে। পাশে জলের বোতল হাতে দাঁড়িয়ে নীলা। মুখ নীচু করে মাঝে মাঝে কীসব বলছে। সেই শুনে তরুণী মাথা ঝাঁকিয়ে আবার ওয়াক তুলছে। নিজের হাতের উপরেই বমি করে ফেলছে। তারপর সেই হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে গিয়ে চুলে বমি মাখাচ্ছে। এমন দৃশ্যে একটি কালো গাড়ি এসে দাঁড়ায়। দুজন যুবক নামে। বমনরত তরুণীর মুখ টিসু দিয়ে দ্রুত মুছিয়ে দিয়ে চ্যাংদোলা করে গাড়িতে তোলে। নীলাকে হাত নেড়ে ভোঁ করে গাড়ি নিয়ে রাতের কলকাতায় মিলিয়ে যায়। নীলা বিরক্ত মুখে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে, এমন সময়ে পেছন থেকে, ‘কী ম্যাডাম? পায়ে পড়েছে?’

    নীলা চমকে ওঠে। ‘ওহ্‌, তুমি!’

    নীলাব্জ : আমি দেখছিলাম পুরো ঘটনাটাই ওইদিকের ফুটপাথ থেকে। ছেলেদুটো কে? কিডন্যাপ করল নাকি?

    নীলা : ধ্যাত। মেয়েটির ভাই আর ভাইয়ের বন্ধু। ওর শরীরটা খারাপ করছিল তাই…

    নীলাব্জ : তা, তুমি গেলে না ওদের সঙ্গে?

    নীলা : আমি ফিরব উত্তরে আর ওরা যাচ্ছে দক্ষিণে। তোমার এত প্রশ্ন কেন? আর তুমিই বা মাঝরাতে এখানে আমাকে ফলো করছ কেন?

    নীলাব্জ : আরে না, না! ফলো কেন করব? এই বেঙ্গল ক্লাবে একটা…

    নীলা : সব ঢপের কথা তোমার।

    নীলাব্জ : মাইরি বলছি। আমাদের…

    নীলা : বাদ দাও। গোটা পায়ে বমির স্প্রে পয়েন্টিং হয়ে গেছে। একটা কোথাও বসে ধুতে হবে।

    নীলাব্জ : এই তো বেঙ্গল ক্লাবেই চলো, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

    দুজনে বেঙ্গল ক্লাব যায়। নীলা সোজা টয়লেটে চলে গিয়ে কিছুটা ফ্রেশ হয়ে বেরোয়। বাইরে একটা পার্টি চলছিল। নীলাব্জ তাদেরই একজন অতিথিকে অতিমাত্রায় হাত নেড়ে কিছু বোঝাচ্ছিল।

    নীলা : ধন্যবাদ, তাহলে আজ আসি?

    নীলাব্জ : আরে আসি কী বলছ, একটা ড্রিঙ্ক নিয়ে তারপর যেয়ো।

    নীলা : আরে অন্য কার পার্টিতে এরকম ভাবে…

    নীলাব্জ : ছাড়ো তো ওসব। আমার চেনা এরা। উকিল, জজ-ফজদের পার্টি। চলো আমরা ওই ঘরটাতে গিয়ে বসি।

    নীলা প্রতিবাদ করার আগেই, নীলাব্জ এগিয়ে যায়। নীলাও বাধ্য হয় পিছু-পিছু যেতে।

    নীলাব্জ : এই ঘরটা ভাল না? এসিতে বসে এক পেগ, এক পেগ খেয়ে বেরিয়ে যাব।

    নীলা : আমি খাব না। আমার দেড় পেগের নেশার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে তানিয়া। প্রতিবার বমি। আর একদিন বলুক, আমি কিছুতেই আর ওর সাথে মদ খাব না।

    নীলাব্জ : শুনছি সব, এক পেগ বলে দিই আগে…

    নীলা : তুমি কি কমিশান পাও লোককে এখানে মদ খাইয়ে?

    নীলাব্জ : উফ! তুমি না… ও দাদা, একবার শুনুন দা।

    বেয়ারা আসে। হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয় এটাই লাস্ট অর্ডার। ওদের বার বন্ধ করতে হবে এরপর। অর্ডার নিয়ে চলে যায়।

    নীলা : শান্তি?  

    নীলাব্জ : আরে, অদ্ভুত করছ তুমি! মাল খেতে ভালবাসো না, নাকি?

    নীলা : বাসি, তবে আজকে আমার নেশাটা চটকে দিয়েছে দায়িত্বজ্ঞানহীন আমার বন্ধুটি। ওর বমি মেখে-মেখেই আমার জীবনটা কেটে যাবে। প্রতি পুজোতে বমি, প্রতি নিউ ইয়ারে বমি, জন্মদিনে বমি…

    নীলাব্জ : ওর সঙ্গে নেশা করো না, সহজ ব্যাপার।

    নীলা : আমি নেশাই করতে চাই না।

    নীলাব্জ : এ কী কথা বলছ! তাহলে মানুষ কী করবে আর?

    নীলা : মানে? নেশা করা ছাড়া মানুষের আর কোনও কাজ নেই?

    বলতে-বলতেই দুটি পাত্র এসে যায়। সঙ্গে একটু চিপস, বাদাম আর এক প্লেট কাবাব।

    নীলাব্জ : চিয়ার্স। বন্ধু পায়ে একটু বমি করেছে বলে নেশা ব্যান করে দিয়ো না।  

    নীলা : না নীলাব্জ, ব্যান করার কথা বলছি না। কিন্তু যদি নেশা করে কেউ সামলাতে না পারে, তার নেশা করার দরকার কী? সে তো একটা নুইস্যান্স…

    নীলাব্জ : কিন্তু নেশাটা তো মানুষ করছেই যাতে সে একটু বেসামাল হয়। স্বাভাবিকের থেকে একটু আলাদা। একটা তুরীয় মেজাজ।

    নীলা : নিকুচি করেছে তোমার তুরীয় মেজাজের। ওই মেজাজ করে রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছে, ভুলভাল বকছে, বউকে পেটাচ্ছে, গালাগালি দিচ্ছে! এইসব করার জন্যই নেশা?

    নীলাব্জ : আহ্‌, তুমি বড্ড এক্সট্রিমে চলে যাও। দু’পেগ নিয়ে ঝিম মেরে একটু বসে থাকা। মনটা একটু উড়ু-উড়ু, সব কিছু একটু বেশি করে ভাল লাগা। এগুলোর জন্য তো নেশা লাগে!

    নীলা : নাহলে সম্ভব না বলছ?

    নীলাব্জ : আলবাত সম্ভব না। হালকা নেশা করে থাকলে তোমার দুনিয়াটাই রঙিন। নেশা করে জ্যোৎস্না দেখো আর খালি মুখে জ্যোৎস্না দেখো, তফাতটা বুঝতে পারবে।

    নীলা : এসব তোমার ফালতু রোম্যান্টিসিজম। নেশা করে-করে মানুষ মারা যাচ্ছে আর তুমি নেশার স্বপক্ষে যুক্তি দিচ্ছ। চারিদিকে ক্যান্সার বাড়ছে হু হু করে। প্রতিটা পাড়াতে নেশা মুক্তি কেন্দ্র। ফ্যামিলি শেষ হয়ে যাচ্ছে। নেশা করে খুন করতে পর্যন্ত মানুষের হাত কাঁপে না।

    নীলাব্জ : নেশা না করলে মানুষ খুন করে না বলছ?

    নীলা : এক্স্যাক্টলি তা নয়। কিন্তু হিংস্রতা যেন বেড়ে যায়। প্রবণতা বেড়ে যায়। আর Requiem for a dream দেখোনি? নেশা করে মানুষের কী হতে পারে? একটা নির্ভরতা যখন তৈরি হয়ে যায়, তখন মানুষ নেশার দাস। ঘরবাড়ি বেচে দেয় মানুষ।

    নীলাব্জ : আরে নেশা করতে মানুষ বাধ্য হচ্ছে। আমাদের সমাজ মানুষকে বাধ্য করছে।

    নীলা : বাধ্য করছে? তোমাকে কে বাধ্য করছে? আমাকে জোর করে টেনে এনে এই শহরের হাইফাই ক্লাবে বসে মদ খাওয়াচ্ছ আর বলছ সমাজ তোমাকে বাধ্য করছে?

    নীলাব্জ : আরে বাবা! আমাকে না। আমি স্বেচ্ছায় খাচ্ছি কিন্তু সবাই নয়।

    নীলা : কোন সবাই?

    দুজন যুবক নামে। বমনরত তরুণীর মুখ টিসু দিয়ে দ্রুত মুছিয়ে দিয়ে চ্যাংদোলা করে গাড়িতে তোলে। নীলাকে হাত নেড়ে ভোঁ করে গাড়ি নিয়ে রাতের কলকাতায় মিলিয়ে যায়। নীলা বিরক্ত মুখে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে, এমন সময়ে পেছন থেকে, ‘কী ম্যাডাম? পায়ে পড়েছে?’

    নীলাব্জ : শহরের নর্দমা যারা পরিষ্কার করতে নামে, তাদের কিন্তু সকালে কাজে যাওয়ার আগে নেশাটা করে নিতে হয়। শ্মশানের ডোমদের দেখেছ? নেশা না করলে ওরা ওই কাজটাই করতে পারবে না। যারা দৈহিক শ্রম করে, সারাদিন ভূতের মতো খাটে, তাদের সন্ধের পর একটা আলাদা দুনিয়া দেয় নেশা। বাধ্য হয়ে নেশা করছে ওরা…

    নীলা : মানুষের এই যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় বের করতে হবে। হয়তো মেশিন দিয়ে করাতে হবে এই কাজ। কিন্তু তাই বলে তুমি নেশা করা কে সমর্থন করতে পারো না। যখন লিভার পচে, হার্ট অ্যাট্যাক হয়ে, ক্যান্সারে মানুষগুলো মরে যায়, তাদের পরিবারের কী হয় একবার ভেবে দেখেছ?

    নীলাব্জ : তুমি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছ। শরীরের ক্ষতি তো কত কিছু থেকে হয়। ফাস্ট ফুড ক্ষতি করছে না? সফট ড্রিঙ্ক ক্ষতি করে না? সেগুলো তো বিজ্ঞাপন করে বিক্রি করা হচ্ছে। তাহলে গাঁজা, চরস কেন লুকিয়ে-চুরিয়ে খেতে হবে? বাই দ্য ওয়ে, আমার কাছে কিছু ভাল চরস আছে। রোল করাই আছে, খাবে?

    নীলা : তুমি সম্পূর্ণ উন্মাদ। না, আমি ড্রাগস করি না।

    নীলাব্জ : আরে গাঁজা, চরস কবে থেকে ড্রাগস হল? আমাদের এখানে তো বলে শিবের প্রসাদ। তুমি দু’তিন টান দাও, দেখবে একটা হালকা হ্যালু মতো হবে। তোমার এই সারাক্ষণ টেনশন, খিটখিটে ভাব কেটে যাবে। কত আর্টিস্ট গাঁজা না টানলে ওই শিল্পগুলোই হত না। স্বয়ং গিন্সবার্গ গাঁজা লিগাল করার জন্য বিপ্লব করেছে ১৯৬৪-’৬৫-র সময়ে। আজকে দেখো, আমেরিকার কতো রাজ্যে গাঁজা বৈধ। মিষ্টির দোকানের মতো রাস্তায়-রাস্তায় গাঁজার দোকান।

    নীলা বিচলিত হয় না। ‘নেশার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক নেই। এটা ব্যক্তিগত চয়েস। রবি ঠাকুর কি গাঁজা টেনে ‘গীতাঞ্জলি’ লিখেছিলেন? আর আশ্চর্য ছেলে তুমি নীলাব্জ! সমাজের একটা প্রিভিলেজড জায়গাতে বসে তুমি নেশা প্রোমোট করছ?’

    নীলাব্জ : আমি? নেশা তো প্রোমোট করছে দেশের সরকার, দেশের সুপারস্টাররা। দুনিয়া চলছে ড্রাগ বেচার টাকায়। নির্বাচন লড়া হয় ড্রাগের টাকায়। চারিদিকে পানমশলার নামে গুটকা, তামাক বিক্রি করা হচ্ছে। গরিব মানুষ সেই নেশা করছে। আসক্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে। তামাক চিবিয়ে পিক ফেলে-ফেলে গোটা দেশ নোংরা করছে। আমাদের হাওড়া ব্রিজ নড়িয়ে দিয়েছে এমন পিক ফেলেছে। আইটিসি-র শেয়ার দেশে কে কিনে রেখেছে? দেখবে LIC! ১৫% শেয়ার LIC-র কাছে। আবার সেই LIC-ই কিন্তু তামাক ব্যবহারকারীর থেকে বেশি প্রিমিয়াম চার্জ করে। আর তুমি বলছ আমি নেশা প্রোমোট করছি? আমাদের সরকার চায় আমরা নেশা করি। নেশা করে উলটে পড়ে থাকি। নেশা করে মরে যাই।

    নীলা : একটা সামান্য তর্ককে ঘুরিয়ে একটা রাজনৈতিক অ্যাঙ্গেল দিতে তুমি ওস্তাদ। তুমি যতই বাজে বকো, আমি নেশাকে কোনওদিন জাস্টিফাই করতে পারব না। মানুষ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নেশা করে, তুমি কি অন্ধ?

    নীলাব্জ : মানুষ শেষ হোক। তোমার কী? সব মানুষ বেঁচে থাকুক, কে চাইছে? যুদ্ধ বেচে দেশ চলছে আর তুমি নেশা নিয়ে ভাবছ। হাজার-হাজার বছর ধরে মানুষ নেশা করছে। প্রতিটা সভ্যতায় মানুষ নেশা করেছে। যারা বেশি করেছে বা কপাল খারাপ, তারা টসকে গেছে। বাকিরা তো চালিয়ে গেছে। দেশের হিরোগুলো কী খাচ্ছে, ওই গুটকা? মনে তো হয় না। এলাইচি বলে খুল্লামখুল্লা বড় রাস্তায় বিক্রি করছে, ওটা কি আদৌ এলাচ? কেসার বা জাফরান বলে বিক্রি করছে ওটা কেসার? ওগুলোর দাম জানো কত হওয়া উচিত যদি খাঁটি হয়? আর এরা গরিব মানুষের জন্য মাত্র এক টাকায় কেমিক্যাল মেশানো জিনিস বিক্রি করছে। এই কেমিক্যালগুলো নন-ফুড গ্রেড অর্থাৎ অখাদ্য জিনিস…

    নীলা : তোমার লজিকটা কী? সরকার চায় আমরা নেশা করে মরে যাই, তাই এসো আমরা সবাই নেশা করি?  

    নীলাব্জ : আমি বলছি আমরা এত ভেবে কিছু করতে পারব না। নেশাটাকে ট্যাবু বানিয়ে দিয়ো না। যে যার মতো একটু হালকা নেশা করে থাকি না? জীবনের জটিলতা ভুলে। কাজ করব না বা শরীরের যত্ন নেব না, তা তো বলছি না। সবাইকে শিল্প করতে হবে তাও বলছি না। শুধুমাত্র বিনোদনের জায়গা থেকেই। এই ধরো পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে একটা ঝাঁ-চকচকে গাঁজার দোকান। ক্যালিফোর্নিয়াতে যেমন। সেখানে একটু গাঁজার কেক, কুকি এইসব…

    নীলা : তোমার সত্যিই নেশা হয়ে গেছে। (ঠক করে গেলাসটা টেবিলে রাখে) আমি চললাম। তুমি এই পার্ক স্ট্রিট মোড়ে গাঁজার গাছ পুঁতে ফিরো। 

    নীলাব্জ : আরে তুমি দেখে নিয়ো, কিছুদিন বাদে একটা ব্যবসার মডেল পেয়ে গেলেই লাইসেন্স নিয়ে আমাদের পাড়ায়-পাড়ায় গাঁজা, চরস বিক্রি করবে দেশনেতারা… আরে সত্যি চললে না কি?

    নীলা : আগে যাও বা টুকটাক মদটা খেতাম, আজকের পর থেকে সেটাও ছেড়ে দিলাম। বাই।

    নীলাব্জ : যাহ্‌!

    নীলা গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে যায়। নীলাব্জ কাঁটা দিয়ে কাবাবের একটা ছোট টুকরোকে গাঁথার বৃথা চেষ্টা করতে থাকে। বেয়ারা একটু দূরে প্যাঁচার মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে। ভাবটা এই যে, এবার আপনি আসুন!

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook