মেহের আলির দুর্গ

লোকে বলে লোকটার নাম মেহের আলি। তাকে জিজ্ঞেস করলে সে নামধাম বলে না, দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে ‘কেন? কী করবি নাম জেনে? মারবি?’

মারবে কি, লোকে ভয়ে পিছিয়ে যায়। পাগলকে ভয় না করে উপায় আছে?

লোকটা এমনিতে নিরস্ত্র, কিন্তু চারপাশে ছোট-বড় পাথর ছড়িয়ে আছে অজস্র। তুলে ছুড়ে মারলেই হল। কত বছর ধরে এই দুর্গে আছে কেউ বলতে পারে না, কী করে, কী খায় তাও কেউ জানে না। টুরিস্টদের ছুড়ে দেওয়া, ফেলে দেওয়া খাবার ছাড়া এখানে আর কিছু তো পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, আর মেহের আলিকে দুর্গের বাইরে যেতেও কেউ কোনওদিন দেখেনি। অথচ লোকটার কিন্তু সুঠাম চেহারা। দেখলেই মনে হয় ব্যায়াম-ট্যায়াম করে। এরকম পাগলরা সাধারণত যত দিন যায় শুকিয়ে যায়, এর অন্তত গত তিরিশ বছরে চেহারার কোনও বদল হয়নি। প্রবীণরা অবশ্য বলেন, পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে মেহের আলির ওই ক’টা চুল দাড়িই পাকা। আরও রহস্যজনক ব্যাপার তার গায়ের গন্ধ। এই ধরনের পাগলদের গায়ে যা দুর্গন্ধ হয়, ধারেকাছে যাওয়া যায় না। মেহের আলির গা থেকে আতরের খুশবু আসে। কেউ কেউ অবশ্য বলে, দুর্গের ভেতরে যে তিন-চারশো বছরের পুরনো তালাও আছে, যেটা এখন বর্ষাকালে ভরে থাকে আর গরমকালে শুকনো খটখটে হয়ে যায়, সেখানে ওকে মহানন্দে সাঁতার কাটতে দেখেছে। এমনকী, কনকনে শীতেও। কিন্তু লোকটা আতর পায় কোত্থেকে? চারশো তালি মারা একটা বস্তার মতো আলখাল্লাই দেখা যায় বারো মাস। মাঝে মাঝে সেটা পর্যন্ত ত্যাগ করে উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায় আর বেড়াতে আসা পুরুষ-মহিলাদের অপ্রস্তুতে ফেলে। এদিকে ব্যাটার আতর জোটে!

আরও পড়ুন : ‘আপনাদের ভালবাসা দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায়’, কার্তিক বলে ফেলেছিল একদিন! পৃথ্বী বসুর গল্প ‘টোটো কোম্পানি’….

এইসব কারণেই লোকে বলে, মেহের আলি আসলে অশরীরী। ওকে কেউ কোনওদিন ছুঁয়ে দেখেনি, কেনই বা ছুঁতে যাবে? ফলে গুজবটা আর গুজব থাকেনি। এ তল্লাটের লোকে কথাটা বিশ্বাস করে তো বটেই, যারা দূর দূর থেকে এই দুর্গ দেখতে আসে তারাও বাড়ি ফিরে গল্প করে ‘ওখানে দিনদুপুরে ভূত ঘুরে বেড়ায়। নিজের চোখে দেখে এলাম।’ এমনিতে এমনটা রটে গেলে দুর্গে লোক আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা, সেটা ঘটার আশঙ্কায় গুজব ছড়াতেই প্রশাসনের তৎপর হয়ে পাগলটাকে তাড়িয়ে ছাড়ার কথা। কিন্তু মেহের আলির বেলায় এত বছরেও সেসব কিছু হয়নি, কারণ রটে গেছে— এই ভূত কারও ক্ষতি করে না। দূর থেকে খাবার-টাবার ছুড়ে দিলে খেয়ে নেয়। রেগে গেলে একটু চোখ লাল করে গালাগালি দেয় বটে, কিন্তু কাছে আসে না, তাড়াও করে না। গাইডদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান, তারা উলটে মেহের আলিকে দুর্গের লাল দরওয়াজা, হারেম, হামাম, তয়খানা, অন্দরমহল, নাচমহল ইত্যাদির মতোই একটা দ্রষ্টব্য বানিয়ে ফেলেছে। দুর্গের মেন গেটে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার যে বোর্ডটা আছে, তাতেও বিশেষ আকর্ষণের মধ্যে মেহের আলির কথা লিখে দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল, যখন বছরদশেক আগে পুরনো রং চটে যাওয়া বোর্ডটা বদলানো হল। কিন্তু শেষমেশ এক বড় অফিসারের আপত্তিতে হয়নি। অরবিন্দ যোশী বলেছিলেন, ‘হম লোগ সাইন্টিফিক কাম করতে হ্যাঁয়। হম ইয়াহাঁ পে ভূত হ্যায় বোলকে বোর্ড লগায়েঙ্গে? ইজ ইট আ জোক?’ তিনি অবশ্য বেশিদিন টেকেননি। দুর্গের ভেতরেই খোঁড়াখুঁড়ি করতে গিয়ে কনুইটা কীসে লেগে একটুখানি কেটে গিয়েছিল। তা থেকে ইনফেকশন হয়ে, পেকে গিয়ে শেষে মারা গেলেন। কেউ কেউ বলে উনি নাকি ভারি একগুঁয়ে লোক ছিলেন, কেটেছিল জং ধরা একটা বর্শার ফলায়, কিছুতেই অ্যান্টি-টিটেনাস ইঞ্জেকশন নেননি। তাই মরতে হল। কিন্তু বেশিরভাগ লোকের ধারণা, উনি মরেছেন মেহের আলির অভিশাপে।

দুর্গের ভেতরে একটা ফুটবল মাঠের মতো ঘর আছে, যেখানে ঠা ঠা দুপুরেও একফোঁটা আলো ঢোকে না, বৃষ্টিহীন বৈশাখেও ছাদ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ে। বাদুড়দের প্রিয় আস্তানা সেটা। সেখানেই বিরাট বড় বড় লাইটের ব্যবস্থা করে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করতে যাচ্ছিলেন মিস্টার যোশী। যেদিন কাজ শুরু, সেদিন মেহের আলি লম্ফঝম্প শুরু করল ‘তফাত যাও, তফাত যাও। খবরদার এখানে ঢুকবে না।’

মিস্টার যোশী খুব তেরিয়া লোক। আলো জ্বালতেই কয়েকশো বাদুড়ের উড়ে যেতে গিয়ে গায়ে উঠে পড়া আর মেহেরের তাণ্ডবে তাঁর কর্মচারীরা ভয় পেয়ে গেলেও তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ‘কেন ঢুকব না? কেয়া হ্যায় ইসকে অন্দর জো তুম ছুপা রহে হো?’

মেহের আলি বীভৎস হেসে বলেছিল ‘সাবধান করে দিচ্ছি রে ব্যাটা। এখানে বেগম, শাহজাদীরা সব গোসল করত, তারপর দাসীদের দিয়ে সাজগোজ করাত। মরদদের ঢোকা বারণ ছিল। এইখানে ঢুকে জেনানাদের উপর নজর দিবি শালা? ধম্মে সইবে না রে।’

যোশী পাগলকে পাত্তা দিতে রাজি ছিলেন না, ‘হাঁ, জ্যায়সে তু ইয়হি পে থা তব। চল হট।’

‘আমি ছিলাম না তো কি তুই ছিলিস আঁটকুড়ির ব্যাটা?’ কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল মেহের আলি। তার ওরকম রুদ্রমূর্তি অনেককাল কেউ দেখেনি। ‘তোর মরণ হবে। তুই ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে মারা যাবি রে। কোনও ওষুধ কাজ করবে না। তুই বউ-বেটিদের দিকে নজর দিচ্ছিস, ভগবান তোর সব্বোনাশ করবেন’, আঙুল তুলে অভিশাপ দিয়েছিল সে।

যোশী মুখ ভেংচে বলেছিলেন ‘অবে যাঃ! তেরা অল্লাহ মেরা কুছ নহি বিগড় সকতা। ইয়ে দেখ রহা হ্যায়?’ শার্টের নিচ থেকে পৈতেটা বের করে দেখিয়েছিলেন।

মেহের আলি ওখানে গিয়ে বসলেই তার হৃদয়ে গান আসে, কানে বেজে ওঠে ঘুঙুর। আতরের খুশবুতে ভরে ওঠে দিনের বেলা পায়রার পায়খানায় ভরে থাকা সেই চক। সেই খুশবু মেহের বুক ভরে টেনে নেয়, তারপর শুরু করে আলাপ। ততক্ষণে কারা যেন তবলা, পাখোয়াজ, তানপুরা, সেতার ইত্যাদি নিয়ে এসে বসে পড়ে সঙ্গত করতে। দূর থেকে যে ঘুঙুরের আওয়াজ মেহেরের কানে আসছিল, সে আওয়াজ কাছিয়ে আসে। তারপর কোত্থেকে এক পরমাসুন্দরী নর্তকী এসে দাঁড়ায় চকের ঠিক মাঝখানে, ফোয়ারার সামনে। বলে ‘তো উস্তাদজি, আজ কেয়া খয়াল হ্যায়?’

তাতে আছাড়িপিছাড়ি হেসেছিল মেহের আলি। একা বসে থাকতে থাকতে সে হাসির কথা মনে পড়লে এখনও হাত-পা কাঁপে রজত রায়ের। যোশীর অধীনস্থ হিসাবে রজত সেদিন ওখানে উপস্থিত ছিল। চিৎকার চেঁচামেচি, আলো, আওয়াজে তখন বাদুড়গুলো যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। তার মধ্যে মেহেরের সে কী হাসি, বাপ রে! সে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর যোশীজি রাগে ফুলছেন। রজতের হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। যাদের পাথর কাটতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারাও কাজ করবে না বলে ফিসফাস করছিল। কিন্তু যোশীজি কড়া লোক। মেহেরের হাসি আর থামেই না দেখে রাগের চোটে তিনি এক শ্রমিকের হাত থেকে গাঁইতি নিয়ে তেড়ে যাচ্ছিলেন, তখনই একটা ছুঁচলো পাথরে খোঁচা খেয়ে কনুই কেটে গেল। জং ধরা বর্শা-টর্শা নয়। রজত নিজের চোখে দেখেছিল। রক্ত বেরচ্ছে দেখে সকলে যোশীজিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেহের হাসি থামিয়ে বলল ‘হিন্দুস্থান কে দো পয়গম্বর, রাম ঔর কৃষ্ণ। কে তোকে বাঁচাবে রে শালা? এ পাপ করবি তো কেউ বাঁচাবে না।’ বলে হা হা করে হাসতে হাসতে, লাফাতে লাফাতে কোনদিকে যেন চলে গেল। দূর থেকে বারবার শোনা যেতে লাগল সে চিৎকার করে বলছে ‘হিন্দুস্থান কে দো পয়গম্বর, রাম ঔর কৃষ্ণ… হিন্দুস্থান কে দো পয়গম্বর, রাম ঔর কৃষ্ণ… হিন্দুস্থান কে দো পয়গম্বর…’

যোশীর হাতে তখন রুমাল-টুমাল বেঁধে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে, তার মধ্যেই তিনি গজরাচ্ছেন ‘সালা জবান কাট লেনা চাহিয়ে ইস পাগল কা। রামজি কা নাম লেতা হ্যায়! ইসকে নিচে জরুর কোঈ মন্দির থা। ইস লিয়ে খোদনে নহি দেতা। ইতনে সালোঁ সে ছুপা কে রখখা হ্যায় সালা। নিকালকে হি ছোড়ুঙ্গা ম্যায়।’

যোশীজি খুব লেখাপড়া করা লোক। বিদেশের কোন ইউনিভার্সিটি থেকে যেন পাশ-টাশ করে এসেছেন। তিনি কি আর ভুল বলতে পারেন? রজত তাই বিশ্বাস না করে পারেনি। তবে এ-তল্লাটেই জন্মে, এসব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে নিজের আগ্রহে বইপত্তর ঘেঁটেও এমন কোনও ইঙ্গিত সে পায়নি। কোনওদিন বাপ-ঠাকুর্দার মুখেও এমন কথা শোনেনি। বরাবরই তো শুনে এসেছে, দুর্গটা সেই মোগল আমলে তৈরি। এমনকী, দাদু ইন্দুকান্তি রায়ের ট্রাংকে একখানা ফারসি দলিল ছিল, সেটা নাকি সম্রাট জাহাঙ্গীরের অধীন শাসকের দেওয়া রজতদের বাড়ির জমিটার পাট্টা। দাদু তাঁর বাবার থেকে অল্পস্বল্প ফারসি শিখেছিলেন। কয়েক লাইন পড়ে শুনিয়েছিলেন। সেখানে রজতের পূর্বপুরুষ অঘোরকান্তি রায়ের নাম আছে বটে। তবে অত কথায় কাজ নেই। চাকরি হল চাকরি, সেখানে বাবু যা বলেন, সেটাই শেষ কথা। তবে যোশীজির ওই জেনানাদের গোসলখানার নিচটা খুঁড়ে মন্দির বের করা আর হয়ে উঠল না। রজতের ধারণা মেহের আলির অভিশাপ দেওয়ার ঠিক পরেই ওরকম রক্তপাতে যোশীজি ভয় পেয়েছিলেন, বাইরে যতই হম্বিতম্বি করুন। তাই সেদিনের মতো কাজ তো বন্ধ করেনই, পরের কয়েকদিনও ওদিকে যাওয়ার নাম করেননি। তারপর তো ঘা-টা পাকতে শুরু করল, যোশীজি ক’দিনের মধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি হলেন, আর ফিরলেন না।

ব্যাপারটা রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল, ফলে তারপর থেকে যত অফিসার এসেছেন কেউ আর যোশীজির স্বপ্ন পূরণ করার দিকে এগোননি। রজতও ইতিমধ্যে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। টিকে আছে মেহের আলি। দিনের বেলা দুর্গে লোকের যাতায়াত এত বেড়ে গেছে ইদানীং, যে সে মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়। কিন্তু রাত নামলেই এই শূন্য দুর্গ তার সাম্রাজ্য। দুর্গের গেট বন্ধ হয়ে যায় সূর্যাস্তের সময়ে— শীতকালে বিকেল সাড়ে পাঁচটায়, অন্য সময়ে ছটায়। আকাশি-নীল ইউনিফর্ম পরা সিকিউরিটি এজেন্সির লোকেরাও সব বাড়ি চলে যায়, পাহারা দেওয়ার মতো কিছু তো নেই। আছে কেবল শূন্য দুর্গটা, আর সাজানো বাগান। লোকে তাই দেখতেই আসে। যখন চাঁদ ওঠে, তখন দুর্গের সবচেয়ে ওপরে, খাসমহলের ছাদে দুই হাত পিছনে দিয়ে গম্ভীর মুখে ধীরে ধীরে পায়চারি করে সুপ্রাচীন মেহের আলি। হাওয়ায় তার লম্বা চুল-দাড়ি ওড়ে, মাঝে মাঝে সে দাঁড়িয়ে পড়ে তাকায় বহুদূর। তর্জনী তুলে কাকে যেন শুনিয়ে শুনিয়ে চিৎকার করে বলে ‘ওই যতদূর চাঁদের আলো, ততদূর তোমার মেহরবানি।’ এই তুমিটা কে? সেকথা বোঝা যেত, যদি মেহের আলির পরিচয় জানা যেত। কিন্তু এই ছোট্ট শহরের সবচেয়ে প্রবীণ লোকটাও তাকে ওই দুর্গে ওই চেহারাতেই দেখে আসছে বরাবর। সে কোথা থেকে এল? কেউ জানে না। সবার চেয়ে প্রবীণ অথচ অমন জোয়ান মরদ! তাকে যে সকলে অশরীরী মনে করবে, এতে আর আশ্চর্য কী? অমাবস্যার রাত্তিরে যদি কোনও দুঃসাহসী দুর্গে ঢুকে পড়ে, তাহলে মেহেরের কাণ্ড দেখে তার আর সন্দেহ থাকবে না যে সে প্রেতই। কারণ সেদিন সে সন্ধে নামতেই হনহনিয়ে হেঁটে বেড়ায় দুর্গের এ-কোণ থেকে ও-কোণ। তারপর ঠিক যখন দূরের গির্জা থেকে ভেসে আসে ঢং ঢং করে বারোটা ঘণ্টার আওয়াজ, মেহের ধীর পায়ে গিয়ে বসে দুর্গের ঠিক মাঝখানের খোলা চত্বরে, যেখানে দিনের বেলায় ঠা ঠা রোদে টুরিস্টদের গাইডরা বলে, ‘এখানে ফোয়ারা ছিল। সন্ধেবেলায় নাচগানের আসর বসত।’

মেহের আলি ওখানে গিয়ে বসলেই তার হৃদয়ে গান আসে, কানে বেজে ওঠে ঘুঙুর। আতরের খুশবুতে ভরে ওঠে দিনের বেলা পায়রার পায়খানায় ভরে থাকা সেই চক। সেই খুশবু মেহের বুক ভরে টেনে নেয়, তারপর শুরু করে আলাপ। ততক্ষণে কারা যেন তবলা, পাখোয়াজ, তানপুরা, সেতার ইত্যাদি নিয়ে এসে বসে পড়ে সঙ্গত করতে। দূর থেকে যে ঘুঙুরের আওয়াজ মেহেরের কানে আসছিল, সে আওয়াজ কাছিয়ে আসে। তারপর কোত্থেকে এক পরমাসুন্দরী নর্তকী এসে দাঁড়ায় চকের ঠিক মাঝখানে, ফোয়ারার সামনে। বলে ‘তো উস্তাদজি, আজ কেয়া খয়াল হ্যায়?’ দুঃসাহসী দুই যুবক-যুবতী একবার সন্ধেবেলা বাঁশি দিয়ে সব দর্শককে বের করে দেওয়ার মুহূর্তে অসংখ্য ঘরের একটায় লুকিয়ে পড়ে দুর্গে থেকে গিয়েছিল রাতে কী হয় দেখবে বলে। তারা স্বচক্ষে দেখেছে— উন্মাদ উস্তাদ হয়ে গেল। দেখেছিল! অমাবস্যার ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে কী করে দেখল? এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেনি বলেই ওদের কথা বন্ধুরা বিশ্বাস করেনি পরদিন কলেজে, তবে দুর্গে রাত কাটানোর জন্যে বাজি জেতার টাকা ওরা দু’জন আদায় করে ছেড়েছিল। আজও দূর বিদেশে বসে সালমা আর তার বর অনিমেষ আলোচনা করে, এখনকার মতো তখন স্মার্টফোন থাকলে ওই অপূর্ব দৃশ্যের ভিডিও তুলে রাখা যেত। তাহলে তো আর কেউ অবিশ্বাস করতে পারত না। প্রতিবার শেষমেশ অনিমেষ বলে ‘যাক গে, ভালই হয়েছে। ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে গেলে তো আর সকালটা ওইভাবে হত না।’ বলতেই এই মাঝবয়সেও লজ্জায় লাল হয়ে উঠে যেতে চায় সালমা, আর অনিমেষ জাপটে ধরে। ঠিক যেভাবে পরদিন সকালে তাদের অন্দরমহলে আবিষ্কার করেছিল মেহের। প্রথমে ঘুম ভাঙে সালমার। চোখ খুলতেই মুখের ওপর ঝুঁকে পড়া মেহের আলির মুখ দেখে তার আঁতকে ওঠার কথা ছিল, কিন্তু সেই সকালে লোকটার মুখে ছিল অলৌকিক হাসি। কার মতো যেন হাসিটা? বাইকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কিছুতেই মনে করতে পারছিল না সালমা, কিন্তু বাড়ি ঢুকতেই বাবার ছবিতে চোখ পড়ে সে শিউরে উঠেছিল। ছোট থেকে কয়েকশোবার ওই দুর্গে গেছে। মায়ের সঙ্গেও গেছে। কিন্তু কখনও তো বুঝতে পারেনি, ওই পাগলটাকে তার বাবার মতো দেখতে!

যেমন ভাবা তেমনই কাজ। এরপর থেকে দুর্গের এদিকে ওদিকে ছোটবড় পাথরে নানা ঠাকুরের নাম লেখা হতে লাগল। মেহের আলি দূর থেকে দেখল, তেড়ে খিস্তি পর্যন্ত করল। কিন্তু যারা লিখছে তাদের হাতে দু-একবার চড়থাপ্পড় খাওয়ার পর গুটিয়ে গেল। দুর্গে লোকসমাগম বেড়ে গেল আরও। দূর দূর থেকে লোকে আসে পুজো দিতে। তয়খানা আর তয়খানা নেই, এখন বড়সড় মন্দির। মন্দিরের ভেতরে বিগ্রহ, বিগ্রহের রোজ পুজো, পুজোর জন্য পুরোহিত, পুরোহিতের জন্য ঘণ্টা, ভক্তদের ভেট, বিশেষ তিথিতে বিশেষ পুজো— কালে কালে সবই হল।

অনিমেষের ঘুম ভেঙেছিল দু’জনের মাথায় হাত রেখে মেহের আলির মন্ত্রোচ্চারণের বিনবিন শব্দে। আর সকলে যা-ই বলুক, অনিমেষ কোনওদিনই তাকে ভূতপ্রেত বলে ভাবেনি। সে বরাবরই মনে করত লোকটা বদ্ধ পাগল। পাগলদের ঠান্ডা-গরম বোধ থাকে না, লাজলজ্জা থাকে না— ঠাকুমা বলত। মেহের আলি তো ঠিক তাই। সবাই খামোকা ভয় পায়। অবশ্য পাগলের ধারেকাছে না যাওয়াই ভাল, তাই লোকটাকে সমঝেই চলেছে অনিমেষ। কিন্তু সেই সকালে আলখাল্লা পরা চেহারাটা দেখে তার মনে হয়েছিল এ কোনও ফকির, না দরবেশ— কী যেন বলে? কী যে আওড়াচ্ছিল— অনিমেষ বোঝেনি। কিন্তু সুরটা চেনা চেনা। যা হোক, বাইক চালাতে চালাতে সে গুনগুনিয়ে উঠেছিল ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’। আগেরদিন সন্ধেবেলা দুর্গে ঢোকার সময় পর্যন্ত কিন্তু সালমাকে স্রেফ ভাল লাগত, চুমু-টুমু খাওয়াও চলত। কিন্তু সিরিয়াস হওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না। সালমা বলেছে, ওরও ছিল না। আগে তো কেরিয়ার। তার ওপর এ-বিয়ে করতে গেলে যে দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যাবে, তা না বোঝার মতো নির্বোধ ওরা ছিল না। কিন্তু সেই সকালে মনে হল— লাগলই বা যুদ্ধ। ‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।’ তারপর… সেটা অন্য গল্প।

ওসব যুদ্ধবিগ্রহের খবর মেহের আলির কানে পৌঁছয় না। হাবভাব দেখে কখনও মনে হয়, সে দুর্গের চৌকিদার, কখনও মনে হয় বাদশাহ। কিন্তু আসলে বোধহয় সামান্য একটা খ্যাপা ছাড়া কিছুই নয়। নইলে তার কড়া নজর টপকে তয়খানায় একখানা ইয়াব্বড় সিঁদুর মাখানো পাথর এল কোথা থেকে? চোখে পড়তেই সে তয়খানায় পুজো করতে ঢোকা লোকগুলোকে তেড়ে গাল দিতে শুরু করেছিল, দু-একজন ঘাবড়েও গিয়েছিল। তারা সব স্থানীয় লোক, মনে ভয়ডর বেশি। তাদের দাদারা একেবারেই পাত্তা দেয়নি মেহের আলিকে। ‘ইয়ে কৌন হ্যায়’ প্রশ্ন করে তারা যা উত্তর পেয়েছিল, তাতে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে মেহেরকে বের করে দিতে একটুও ভাবতে হয়নি। লোকটাকে ছোঁয়া গেল, ঘাড়ধাক্কা দেওয়া গেল এবং আর পাঁচজন বুড়োর মতোই সে মার খেয়ে পড়ে গেল, হাত-পা কেটেকুটে রক্ত বেরল দেখে, স্থানীয়দেরও বুকে বল এল। যাক! এ তাহলে ভূতপ্রেত-দত্যিদানো নয়। গায়ে আসুরিক শক্তি-টক্তিও নেই। লোকে কেবল ভয় পেয়ে পেয়ে এর নামে অদ্ভুতুড়ে গল্প ছড়িয়েছে আর একে একটা বিরাট কিছু বানিয়েছে। যত্তসব!

যেমন ভাবা তেমনই কাজ। এরপর থেকে দুর্গের এদিকে ওদিকে ছোটবড় পাথরে নানা ঠাকুরের নাম লেখা হতে লাগল। মেহের আলি দূর থেকে দেখল, তেড়ে খিস্তি পর্যন্ত করল। কিন্তু যারা লিখছে তাদের হাতে দু-একবার চড়থাপ্পড় খাওয়ার পর গুটিয়ে গেল। দুর্গে লোকসমাগম বেড়ে গেল আরও। দূর দূর থেকে লোকে আসে পুজো দিতে। তয়খানা আর তয়খানা নেই, এখন বড়সড় মন্দির। মন্দিরের ভেতরে বিগ্রহ, বিগ্রহের রোজ পুজো, পুজোর জন্য পুরোহিত, পুরোহিতের জন্য ঘণ্টা, ভক্তদের ভেট, বিশেষ তিথিতে বিশেষ পুজো— কালে কালে সবই হল।

ছুটিতে বাড়ি এসে বহু বছর পরে রজতের একবার দুর্গটা দেখে আসার ইচ্ছে হল। গিয়ে তাজ্জব। মার্বেলের মেঝের মন্দিরের চকচকে অ্যালুমিনিয়াম রেলিং দেওয়া সিঁড়ির সবচেয়ে ওপরের ধাপে দাঁড়িয়ে গাইড আগত দর্শনার্থীদের বোঝাচ্ছে— এই মন্দির তৈরি হয়েছিল দেড় হাজার বছর আগে।

মেহের আলি থাকতে এসব হতে পারল? না কি সে এতদিনে মারা গেছে? মন্দির ঘিরে তৈরি হওয়া দোকানগুলোয় জিজ্ঞেস করে সুবিধা হল না।

‘কে, সেই পাগলটা? দেখছি না ক’দিন।’

‘অরে উয়ো বুডঢা? ভাগ গয়া সালা। মন্দির সে বহোত পরেশানি থা না উসকো।’

‘না না, মরেনি। ও কইমাছের প্রাণ। এত সহজে মরে? এই তো দেখলাম ক’দিন আগে। এত ভিড়ভাট্টায় ভয় পেয়ে কোথায় পালিয়ে-টালিয়ে গেছে…’

এরকম সব উত্তর শুনে রজত যখন সিঁড়ি দিয়ে বাগানে নেমে আসছে, হঠাৎ চোখ পড়ল বাদুড়দের আস্তানাটার দিকে। অন্য অনেক জায়গার ভোল পালটে গেলেও ওখানে ঢোকার সাহস এখনও কারও হয়নি। বরাবরের মতো বাদুড়ের ডানা ঝাপটানো ছাড়া জায়গাটা থম মেরে আছে। ডিসেম্বরের দুপুরের মিঠে রোদেও ঘরটা প্রায়ান্ধকার। মনে হল, কে যেন বসে আছে ভেতরে। চোখ কুঁচকে রজত এগিয়ে গেল। হ্যাঁ ঠিকই। একটু চোখ সয়ে যেতেই দেখা গেল ঘরের ঠিক মাঝখানে একখানা পাথরে ঠেস দিয়ে বাবু হয়ে বসে আছে মেহের আলি। তার চারপাশ দিয়ে বাদুড়েরা ওড়াউড়ি করছে, কখনও গায়ে বসছে, সে নিশ্চল।

দেখে গা ছমছম করে উঠল। পূজারীদের হাতে মার খাওয়ার বৃত্তান্ত শোনা থাকলেও। কে জানে, কোন ভরসায় কীসের টানে, জীবনে প্রথমবার রজত ডেকে ফেলল ‘মেহের আলি, কী করছ এখানে?’

কথাটা কানে গেল কি না বোঝা গেল না। একেবারে নড়নচড়ন নেই, অন্ধকারে চোখগুলোও দেখা যাচ্ছে না। লোকটা বসে বসে ঘুমচ্ছে না তো? সাধারণ লোক গায়ে বাদুড় নিয়ে ঘুমতে পারে না, কিন্তু পাগলের অসাধ্য কী? রজত পিছন ফিরতে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা কথা মনে হতে বুকটা ধক করে উঠল। লোকটা মরে যায়নি তো? অসম্ভব নয়। মরার বয়স তো নিশ্চয়ই হয়েছে, আর দেখারও কেউ নেই। এই বিরাট দুর্গের সবচেয়ে অন্ধকার ঘরটায় ঘুরতে এসে কেউ ঢোকেও না। হয়তো ক’দিন আগেই মরে গেছে হার্ট ফেল করে, কেউ টের পায়নি? এখন কী করা উচিত? সিকিউরিটি গার্ডগুলোকে ডেকে আনা উচিত? তারা কি কিছু করবে? বেওয়ারিশ লাশ সৎকারের দায়িত্ব নেবে কে? হয়তো সবটা রজতের ঘাড়েই চেপে যাবে। অত ঝক্কি পোয়ানো পোষাবে না।

রজত চলেই যাচ্ছিল, পিছন ফিরতেই শুনল আকাশবাণীর মতো কে যেন বলল ‘সব মিথ্যে, সব মিথ্যে।’

রজত ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল মেহের আলি হেঁটে বেরিয়ে আসছে। যাক, লোকটা তাহলে মরেনি। বেরিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে যেভাবে রজতের চোখে চোখ রাখল, মনে হল রজতকে সে বিলক্ষণ চেনে। দুই কাঁধে হাত রেখে প্রশান্ত হেসে বলল ‘সব মিথ্যে রে বাপ, সব মিথ্যে।’

হাসলেও তার দুই চোখের কোলে আর দাড়িগোঁফের জঙ্গলে ঝুলে থাকা জলের কণা রজতের চোখ এড়ায়নি। না চাইতেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ‘এখন কী হবে?’

মেহের দু’হাতে রজতের মুখখানা ধরে দুই গালে চকাম চকাম করে চুমু খেয়ে চমকে দিল। তারপর হাত উলটে বলল,

জো খোদায় মসজিদ বসতু হৈ

ঔর মুলুক কেহিকেরা।

তীরথ মূরত রাম নিবাসী

বাহর করে কো হেরা।।

শিউরে উঠল রজত। এই লাইনগুলো তার কলেজজীবন থেকে প্রিয়। কবীর বলছেন, খোদা যদি মসজিদেই বাস করেন, তবে বাকি জগৎটা কার? তীর্থ, মূর্তি— এসবেই যদি রাম থাকেন, তবে বাইরেটা কে দেখে? কিন্তু রজতকে এটা বললে যে সে বুঝবে, একথা মেহের আলি ভাবল কেন? সে কি মানুষের মনের কথা পড়তে পারে! তাহলে কি সত্যিই…

যতক্ষণে সম্বিত ফিরল, ততক্ষণে মেহের আলি উধাও।

পরদিন পূর্ণিমা। এই উঁচু-নিচু শহরে দুর্গের বেশ নিচে, বেশ দূরে থাকা বাড়িগুলো থেকে পূর্ণিমায় দুর্গটাকে দেখায় ঝলমলে নতুন প্রাসাদের মতো। অতি গভীর রাতে সেদিন প্রচণ্ড আর্তনাদে কেঁপে উঠে ঘুম ছুটে গেল সেইসব বাড়ির বাচ্চা-বুড়ো সকলের। বেরিয়ে এসে দেখল, একটা মানুষ দুর্গের ছাদের উঁচু আলসের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত ছড়িয়ে আকাশে মুখ তুলে একটানা কেঁদে চলেছে। সন্দেহ নেই লোকটা মেহের আলি, কিন্তু ওটা কি কান্না? অকালবৃদ্ধা রামদুলারির মনে হল— তাঁর ষোড়শী মেয়ে রুক্মিণী যখন বাচ্চা হতে গিয়ে তাঁরই কোলে মাথা রেখে মারা গেল, তখন ঠিক এই আওয়াজ বেরচ্ছিল গলা দিয়ে। বুক কেঁপে উঠল এককালের দুঁদে উকিল শুভ্রকান্তি মুখার্জির। এই গর্জন তিনি শুনেছিলেন বিয়াল্লিশ বছর আগে এক নিরপরাধ ড্রাইভারের মুখে, যখন তার মনিব আর নিজের মক্কেল মিস্টার বাজোরিয়াকে বাঁচাতে, লোকটাকে তারই মেয়ের ধর্ষণ আর খুনের মামলায় দোষী প্রমাণ করে ফাঁসির সাজা পাইয়ে দিয়েছিলেন শুভ্রকান্তি। রাত বারোটায় এক পেল্লাই ফ্ল্যাটে বিরিয়ানি ডেলিভারি করে এসে সবে শুয়েছিল পিন্টু মন্ডল। সে ভাবল, ‘শালা, এবার থেকে ঝড়বৃষ্টির রাতে টিপ না দিলে কাস্টমারের ওপর এরম চেল্লাব।’

তবে বাকি রাত আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারলেন না ঘনশ্যাম অধিকারী। মাসখানেক ধরে প্রস্তুতি চলছে। পুজোপাঠ হয়েছে, পাড়ায় পাড়ায় মিটিং করা হয়েছে, মিছিল বেরিয়েছে জনমত গঠন করতে। বাইরে থেকে শহরে এনে জড়ো করা হয়েছে হাজার দুয়েক করিতকর্মা লোক। দু-দিন আগেই দুর্গের গেটে মিটিং করে সকলকে তাতিয়ে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ৬ তারিখ এই দেড় হাজার বছরের পুরনো মন্দির দেবতার হাতে ফিরে আসবে। কারও সাধ্যি নেই ঠেকায়। আজ ৫ তারিখ, পরদিন সকাল সকাল ঘিরে ফেলা হবে দুর্গটা। তারপর পুলিসের নাম-কা-ওয়াস্তে ব্যারিকেড টপকে, সিকিউরিটির গোবেচারাগুলোকে ভাগিয়ে দিয়ে দখল নেওয়া হবে। সূর্য ডোবার আগেই কাজটা শেষ করতে হবে। কাল এই শহরের ইতিহাস বদলে দেওয়ার দিন, দেওয়ানগড়ের দুর্গাশঙ্কর উপাধ্যায় নগর হয়ে ওঠার দিন। তার ঠিক আগেই ওই পাগলটা এরকম বিকট চিৎকার ছাড়া শুরু করল! ছেলেপুলে ভয় পেয়ে গেলে মুশকিল। যা সব ব্যাকডেটেড, কুসংস্কারাচ্ছন্ন পাবলিক এরা— এটাকে শুভ কাজে কুলক্ষণ ভেবে বেঁকে বসলে সব মাটি। তার ওপর যদি কালও এরকম মেজাজে থাকে খ্যাপাটা, তাহলে যে কী হবে! দু-হাজার লোকের সামনে একটা লোক অবশ্য নস্যি, কিন্তু ওর লম্ফঝম্পে ঘনশ্যামের নিজের না হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। পকেটে সর্বিট্রেট রাখতে হবে। দুনিয়াসুদ্ধ সবাই ম্যানেজ হয়ে গেল, এই পাগলটার এত কীসের রাগ কে জানে?

ভোরের আলো না ফুটতে দুর্গের মেন গেটে পৌঁছে গেল যত রাজ্যের টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা। ছাদে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখল মেহের আলি। সারারাত সে ঘুময়নি। গোসলখানার বাদুড়দের সঙ্গে সারারাত জ্বলেছে তার চোখও, পরামর্শ হয়েছে। সূর্য পূর্বদিকের বাড়িঘরের পিছন থেকে মুখ দেখাতেই মেহের হেঁকে বলল ‘ওই যতদূর সূর্যের আলো, ততদূর তোমার মেহরবানি। তাই তো? তো ভগবান, ইয়া খুদা, আজ দেখি তোমার কেরামতি।’

হাত-পা নেড়ে আরও অনেককিছু সে বলল, কিন্তু সেসব ছাদে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও শোনা যেত না। কারণ ততক্ষণে চতুর্দিক থেকে লোক জড়ো হয়ে গেছে দুর্গের ঠিক বাইরে, মাইকে স্লোগান দেওয়া চলছে। হুঙ্কার দিচ্ছে জনতা— আজ ভগবানেরই একদিন কি তাঁর শত্তুরদেরই একদিন। মেহের সব দেখতে পেল, শুনতে পেল। তারপর হাসতে হাসতে নেমে গেল ছাদ থেকে।

বাইরে গোলমাল বেড়েই চলেছে, মেহের আলি তালাওয়ের বরফ ঠান্ডা জলে চান করে ভেজা গায়েই তার তালি মারা আলখাল্লা চাপিয়ে এসে বসল চকে। কনকনে উত্তুরে হাওয়ায় গেটের বাইরের চিৎকার, তার নাম তুলে গালাগালি সহজেই ভেসে আসে কানে। যত টুরিস্ট দুর্গ দেখতে আসে, কেউ খেয়াল করে না চকের এক কোণে সাতপুরনো বস্তাটা। ওই হল সম্রাট মেহের আলির কুড়িয়ে বাড়িয়ে তৈরি খাজানা। ওতে হাত ঢুকিয়ে সে বার করে আনে একখানা আধখোলা পটেটো চিপসের প্যাকেট। ঝরনার উলটোদিকে বাবু হয়ে বসে মনের সুখে চিবোতে থাকে। সেখান থেকে সোজা দেখা যায় বাগান থেকে ওপরে আসার সিঁড়িটা, বাগানের ওপারে মেন গেটটাও। সেখানকার কাণ্ডকারখানা দেখে সে খুক খুক করে হাসে, কাকে যেন বলে ‘দ্যাখো দ্যাখো, ভীতুগুলার কাণ্ড দ্যাখো। ক’টা ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পার করে ঢুকতে পারচিস না? এত সময় লাগে? আসলে সালা সব মিথ্যে, সব মিথ্যে। তাই লাঠিসোটা, বোমা, গুলি নিয়েও কেবল মুখেন মারিতং জগৎ। সাহস হচ্চে না। একখান খাঁটি লোকের সামনে পড়ে গেলে কী হবে ভেবে ভয় পাচ্চে, লোক দেখিয়ে হল্লা করচে। আয় না শালা, আয়। আমাদের চুলের মুঠি ধরে বের করে দে দেখি? নয় গলাটাই কেটে ফেল। তবে তো দুর্গটা পাবি। নইলে কাঁচকলা।’

তাকে অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। হুড়মুড়িয়ে বাগানের ফুল মাড়িয়ে ঢুকে পড়ল কাতারে কাতারে লোক। তারা ছড়িয়ে পড়ল এদিক ওদিক। যেখানে যা আছে সব ভেঙেচুরে ফেলতে হবে তো। সকালের প্রথম রোদে তখন শুকিয়ে এসেছে ভেজা চুল দাড়ি আর আলখাল্লা, চিপসে পেট ভরেছে, নোনতা স্বাদে মনটাও। জনাপঞ্চাশেক লোক অস্ত্রশস্ত্র হাতে ধেয়ে এল মেহের আলির দিকে।

‘অ্যাই শুয়োরের বাচ্চা, বেরো শালা। বেরিয়ে যা। চুপচাপ বেরিয়ে যা, তা’লে জানে মারব না।’

যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে মেহের জিজ্ঞেস করল ‘কোতায় যাব?’

‘সে তুই বুঝে নে গে। এখানে তোর আর থাকা হবে না। এটা মন্দির, এখানে বেজাতের লোক থাকতে দেয়া হবে না।’

মেহের আলি হেসে কুটিপাটি হয়ে বলল, ‘তুই কোন জাত? আমি কোন জাত? বেজাত কী রে?’

‘বেজাত না তো কী? ইয়ার্কি হচ্ছে? মেহের আলি তো। আলি আবার আমাদের জাতের হয় নাকি?’

সে আরও জোরে হেসে বলল, ‘সে লোকে বলে। আমি বলেচি আমার নাম মেহের আলি?’

‘তা’লে কী নাম তোর?’

সকলে অত কথা পছন্দ করে না। তাদের একজন বলল, ‘সালা ডর সে ইয়ে সব বোল রহা হ্যায়। নঙ্গা করা ইসকো। দুধ কা দুধ পানি কা পানি হো জায়গা।’

শুনে উন্মাদ হা হা করে হেসে নিজেই খুলে ফেলল তার সবেধন নীলমণি আলখাল্লা। দেখে তো সবাই অবাক। ‘অরে ইয়ে তো সচ মে অপনা আদমি হ্যায়!’

‘ছেড়ে দে, চলে আয়। পাগল বুড়ো, ও আমাদের আর কী করবে?’ একজন ভারিক্কি চেহারার লোক বলল। ওরা আরও ওপরে উঠতে যাবে, এক লাফে উঠে পথ আটকে উলঙ্গ মেহের নেচে উঠল, গেয়ে উঠল

সুন্নত দিলে হয় মুসলমান

নারীর তবে কী হয় বিধান?

বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ

বামনি চিনি কী প্রকারে?

কাণ্ড দেখে হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল ধর্মযোদ্ধারা, সিটিও বাজিয়ে দিল কেউ কেউ। পাগলের নাচগান আর থামেই না। তার সঙ্গে যোদ্ধারাও খানিক নেচে নিলে। মনের সুখে দু-চার খিস্তি দিয়ে নিলে একে-অপরকে। দেড় হাজার বছর ধরে যারা মন্দিরটা দখল করে আছে, তাদেরও। তারপর নাচনকোঁদনের পরিশ্রমে শীতের সকালেও ঘাম বেরিয়ে গেলে কয়েকজনের খেয়াল হল— ফুর্তি করতে আসা হয়নি।

‘অ্যাই বুড়ো, সরে যা। ওপরে যাব।’

‘আর তো উপরে যাওয়া তোদের হবে না’, হঠাৎ কেমন ভারি গলায় মরা মাছের মতো চোখে বলল মেহের আলি।

‘কে আটকাবে বে? তুই? চল ফোট’, বলে মেহেরকে ধাক্কা দিতে যেতেই লোকটার হাত মুচড়ে ছোরাটা এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দিল সে। ষণ্ডা লোকটা ব্যথায় কেঁদে ফেলল, বাকিরা ভ্যাবাচ্যাকা। তবে সে ভাব কেটে যেত কয়েক সেকেন্ডেই, যদি না মেহের চোখ লাল করে গলা তুলে ডাকতে শুরু করত ‘আসুন আমার মা, আমার বহেন। সবাই বেরিয়ে আসুন।’

কে আসবে? ভাবতে না ভাবতেই বাদুড়ে বাদুড়ে ছেয়ে গেল চকটা। মুহূর্তের মধ্যে ঠোঁট দিয়ে সব বীরের টুঁটি টিপে ধরল তারা। যারা পিছনদিকে ছিল তারা আতঙ্কে পিছু ফিরে দৌড়তে শুরু করল বাগানের দিকে। কিন্তু দৌড়ে পালাবে কোথায়? ততক্ষণে সেখানে শত শত লোকের হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। দুর্গের যে যেখানে ছিল, সবাই ছুটে পালাতে চাইছে মেন গেটের দিকে— সকলকেই ধাওয়া করছে বাদুড়ের পাল। যার টুঁটিতে ঠোঁট লাগাচ্ছে, রক্তশূন্য লাশ হয়ে পড়ে যেতে তার সময় লাগছে না। আত্মহারা হয়ে তাদের হাত থেকে বাঁচতে দৌড়চ্ছে সবাই। উলটে পড়ছে, পায়ের তলায় পিষে যাচ্ছে। আর স্লোগান নয়, চারদিকে শুধু আর্তনাদ। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য কেউ কেউ লাফ দিল তালাওয়ে। বুকজলের বেশি থাকে না শীতে। ডুবে থেকে বাঁচতে চাইল, সেখানেও নিস্তার নেই। শ্বাস নিতে জল থেকে মাথা তুললেই ধেয়ে আসছে বাদুড়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দুর্গের বাইরে জমা ভিড় উধাও। আর কেউ যা পারছে হাতে নিয়ে ঢুকতে চাইছে না, প্রাণ হাতে করে কোনওমতে রক্তে ভাসতে ভাসতে বেরিয়ে আসতে পেরেছে কয়েকজন। গেটের বাইরে এসেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে একে একে।

হাসপাতালে ঘনশ্যামবাবুর যখন জ্ঞান ফিরল, বুঝলেন গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছে না। সে হোকগে, চোখের সামনে গিন্নি আর দুই ছেলেকে দেখে প্রাণটা বেঁচে গেছে বুঝে কপালে হাত ঠেকিয়ে পরম মঙ্গলময় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন তিনি। তাঁর দেখাদেখি গিন্নি আর ছেলেরাও তাই করল। যাওয়ার মধ্যে ভোকাল কর্ডটাই গেছে— ডাক্তারের মুখে একথা জানতে পেরে ঘনশ্যামবাবুর স্ত্রী যে খুব অখুশি হয়েছেন তা নয়। তাঁর বরাবরই আশঙ্কা ছিল, সারাদিন ধরে বাজখাঁই গলায় চারদিকে আকথা-কুকথা বলে বেড়ানোর পাপে ঠাকুর একদিন কোনও একটা কঠোর শাস্তি দেবেন। পাপ করবে আর শাস্তি পাবে না?

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির অধীন তদন্ত কমিশন সাতসকালে নিয়মকানুন ভেঙে অত লোককে দুর্গে ঢুকতে দেওয়ার জন্য সিকিউরিটি এজেন্সির চুক্তি বাতিল করার নির্দেশ দিল। পদপিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া লোকেদের মোটা ক্ষতিপূরণ দিল সরকার। কিন্তু ভোকাল কর্ড নষ্ট হয়ে যাওয়া লোকেদের কি ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত? এ নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনেকক্ষণ আলোচনা হল, কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত হল না। কারণ অফিসারদের আশঙ্কা, এদের ক্ষতিপূরণ দিলে ভবিষ্যতে বড় বড় দুর্ঘটনায় যাদের হাত-পা খোয়া যায়নি, তারাও নানা ছুতোয় ক্ষতিপূরণ দাবি করবে। কী হবে তখন? এই লোকগুলোর কথাই যা বন্ধ হয়ে গেছে, খেটে খাওয়ার ক্ষমতা তো চলে যায়নি।

মেহের আলিকে শাস্তি দেওয়ার কথাও উঠেছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল সব ভিডিওতে পরিষ্কার দেখা গেছে, তার ডাকেই বছরের পর বছর শান্তিতে অন্ধকারে ঝুলে থাকা বাদুড়গুলো বেরিয়ে এসে এই ভয়ংকর কাণ্ড করেছে। কিন্তু শাস্তি দিতে গেলে লোকটাকে তো পেতে হবে। সেদিন সকালের পরে আর তাকে কেউ দেখেনি। পুলিশ পলাতক বলে রিপোর্ট দিয়েছে। প্রবাসে বসে রজত এসব খবর দেখেশুনে অবশ্য বুঝেছে, মেহের আলি কোত্থাও যায়নি। একদিন সকালের দিকে গিয়ে ওই বিরাট অন্ধকারের দোরগোড়ায় দাঁড়ালেই দেখা যাবে তাকে। হয়তো চেনা যাবে না, কারণ সে ঝুলে আছে অন্য বাদুড়দের সঙ্গে।

ধারণাটা যে নেহাত ভুল নয়, তা রজত বুঝতে পারল মায়ের ফোনে। ‘জানিস, ওই চত্বরের লোকেরা বলে গভীর রাতে নাকি ছাদে মেহের আলি এখনও ঘুরে বেড়ায়।’

রজত এমনটাই আশা করেছিল। আবার দুর্গ আক্রমণ হলে মেহের আলিই বাঁচাবে। অবশ্য অত সাহস আর হবে কি কারও?

ঋণ:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ক্ষিতিমোহন সেন
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
লালন ফকির

অলংকরণ: সায়ন চক্রবর্তী