আব্বাস কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্র বিষয়ে কথা বলতে গেলে, প্রথমেই যে দু’টি প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে এসে পড়ে, তা হল স্বল্পবাদ বা মিনিমালিজম এবং বাস্তববাদ বা রিয়ালিজম। ছবি দেখতে বসে, আমরা অনেক সময়ে ভুলে যাই, যে বাস্তববাদ আসলে ন্যাচারালিজম থেকে কিছুটা আলাদা, অর্থাৎ বাস্তববাদ কেবলমাত্র বাস্তবের প্রতিলিপি নয়। সেরকমটা ন্যাচারালিজমে কিছুটা হতে পারে। কিন্তু বাস্তববাদ আসলে বাস্তব থেকে আহরণ করা বিভিন্ন উপাদানের সৃজনশীল পুনর্গঠন, যেখানে শিল্পের অভিজ্ঞতা ও দৈনন্দিন বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা মিল থাকে।
কিয়ারোস্তামির ছবি দেখতে গিয়ে, এইরকমটা মনে হয় যে একটা বাস্তবের প্রতিলিপি যেন তাঁর ছবির ইমেজে উঠে আসছে। অন্যদিকে চলচ্চিত্র, অন্যান্য দৃশ্যকলা ও সাহিত্যে বাস্তববাদী শৈলীর বিপরীতে যাকে ভাবা হয়, তা হল ফরমালিজম বা আঙ্গিকবাদ। সাধারণভাবে আঙ্গিকবাদী শিল্প অনেক বেশি করে বাস্তবের ইমেজগুলোকে আমূল পুনর্গঠন করে, বা তাদের নির্যাসটুকু থেকে, বিশেষ আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যর জন্ম দেয়। চলচ্চিত্রে যেমন আইজেনস্টাইন ও জিগা ভের্তভের ছবিকে ফরমালিস্ট বা আঙ্গিকবাদী কাজ বলা যায়। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে, সব ধরনের শিল্পের ক্ষেত্রেই, বাস্তবকে শিল্পী পুনর্গঠন করেন। কে কীভাবে এই পুনর্গঠন করছেন তার ওপর নির্ভর করে শিল্পীর বা বাস্তববাদের বিশেষ শসিকিয়া
কিয়ারোস্তামির ছবিতে, এই পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ‘রিদম অফ এ ফিল্ম ইজ রিচড বাই এলিমিনেশন।’ অর্থাৎ কিয়ারোস্তামির ছবিকে যতই মিনিমালিস্টিক সম্পাদনা মনে হোক না কেন, সেখানেও ইমেজের মধ্যে কী থাকবে এবং কী থাকবে না, কোন ইমেজ ছবিতে থাকবে কোন ইমেজ বাদ দিতে হবে শেষ পর্যন্ত, তার একটা তুল্যমূল্য বিচার হয়। আবার কিয়ারোস্তামি একথাও বলছেন, ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্স ঈশ্বরের সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি। এখানে আমাদের বুঝতে হবে কিয়ারোস্তামির অবস্থান। ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্স যেমন চারপাশের অনেক বেশি স্থানকে ইমেজের অন্তর্গত করতে পারে। তেমনি অনেকটা দূর পর্যন্ত ক্যামেরার দৃষ্টি প্রসারিত থাকে ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স ব্যবহারে। অর্থাৎ কিয়ারোস্তামির ছবিতে ক্যামেরায় তোলা বাস্তবের ছবি যেমন পুনর্গঠন হয়, সম্পাদনা কক্ষে তেমনই এটাও বলতে হবে, তাঁর প্রিয় ইমেজগুলি হল সেইসব শট যেগুলি ওয়াইড এঙ্গল লেন্সে তোলা।

তাঁর ছবিতে, সময়ের ব্যবহারের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলবো সেখানেও একটা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলে। শেষ পর্যন্ত কিয়ারোস্তামি এমন এক ধরনের রিদম বা ছন্দ তৈরি করেন যার চলন একটু ধীরগতির, যার মধ্যে একটা ধ্যানস্থ ভাব থাকে। কিয়ারোস্তামির সঙ্গে আরেকটি কথোপকথনের একটি দৃশ্যে আমরা দেখি, একটা মাটির পথ ধরে কিয়ারোস্তামি হেঁটে চলেছেন তাঁর সঙ্গীর সঙ্গে। উলটো দিক থেকে একজন আসছেন, যাঁকে দেখে পরিচালক সম্ভাষণ করছেন, ‘গুড মর্নিং’। অথচ সময়টা ছিল বিকেল, সন্ধ্যার কাছাকাছি। ঘড়ি না দেখলে চারপাশের আলো ও প্রকৃতি দেখে চেনা সম্ভব নয়, সেটা ভোর নাকি সন্ধ্যা। তাঁর ছবিতেও এরকম আমরা অনেকক্ষেত্রে দেখি। যে-সময়টা আসলে আখ্যানে সন্ধ্যা বলে দেখা যাচ্ছে, তা হয়তো ক্যামেরায় তোলা হয়েছে ভোরবেলা। আসলে ঘড়ির সময়টা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিয়ারোস্তামি বোঝাতে চাইছেন, এখানে আসল কথা হল আলো। সন্ধ্যা আর ভোরের আলোর মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। অর্থাৎ পুনর্গঠিত চলচ্চিত্র-বাস্তবে ভোরকে সন্ধ্যা বা সন্ধ্যাকে ভোর বললে, দর্শকের চোখে আলোর কোনও হেরফের হয় না। আবার তিনি একইসঙ্গে বলেন যে, চলচ্চিত্রে যা তিনি সবচেয়ে অপছন্দ করেন, তা হল ছবিতে একটা দ্রুত নিটোল গল্প বলে চলা। কারণ তা দর্শকের আবেগকে ম্যানিপুলেট করে। তিনি বলেন, এ-ধরনের ছবি আসলে দর্শকের সঙ্গে প্রতারণা। কারণ প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে এ ছবি আর দর্শকের মনে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
তিনি বলেন, ‘এ গুড ফিল্ম ইজ ওয়ান দ্যাট হ্যাজ লাস্টিং পাওয়ার। ইউ স্টার্ট টু রিকনস্ট্রাক্ট ইট রাইট আফটার ইউ লিভ দা থিয়েটার।’ তিনি দ্বর্থ্যহীন ভাষায় বলছেন, তাঁর পছন্দ হল ধীরগতির ছবি, যেখানে আখ্যান এতটাই ঢিলেঢালা, যে তাকে ছাপিয়ে প্রকৃতি পরিবেশ মানুষ প্রধান হয়ে ওঠে। অর্থাৎ চলচ্চিত্র-সময়ের কথা বললে, তার ছবি যে ধীর স্থিত সময়কে দেখায় সেটাই তার অন্বিষ্ট। তিনি বলেন, টানটান আখ্যান আসলে দর্শককে পণবন্দী করে রাখে। তাঁর ছবিতে আমরা যে প্রায়শই দেখি আখ্যানের শেষে একটি বহুমুখী সমাপ্তি সম্ভবনা আর আখ্যানের মধ্যে বহুমুখী অভিজ্ঞতার সমাহার— তা আসলে, দর্শকের প্রতি তাঁর একপ্রকার শ্রদ্ধার নিদর্শন। দর্শকের সঙ্গে ছবির উদ্দিষ্ট সম্পর্ক কী হবে, তা অনেকটাই পরিচালকের সততার প্রশ্ন। যা কিয়ারোস্তামি তাঁর সারা জীবনের কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অক্ষরে-অক্ষরে পালন করে এসেছেন। বোধহয় সেখানেই তাঁর প্রিয় চলচ্চিত্রকার কারা হবেন তা নির্ধারিত হয়েছে।
তিনি বলছেন, তিনি খুব বেশি অন্য চলচ্চিত্রকারদের ছবির দ্বারা প্রভাবিত হননি। কিন্তু ওজু ও বাস্টার কিটন যে তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছে তা তিনি অনুভব করেছেন। ওজু কেন তাঁর অন্যতম প্রিয় চলচ্চিত্রকার তা বুঝতে পারা তুলনায় অনেক সহজে। ওজুর ছবির গভীর জীবনবোধ, ধীরগতির ছন্দ এবং অনন্যতা যে কিয়ারোস্তামির পছন্দ হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কেন বাস্টার কিটন? এর উত্তর আমার কাছেও খুব একটা পরিষ্কার নয়। তবে সম্ভবত বাস্টার কিটনের ছবিতে যেভাবে অরডিনারি ও এক্সট্রা-অর্ডিনারির অপূর্ব সম্মিলন হয় তা কিয়ারোস্তামিকে আকর্ষণ করেছিল। বাস্টার কিটনের ছবিতে এই কল্পনা আর বাস্তব, সাধারণ এবং অসাধারণের একটা আশ্চর্য সমন্বয় ঘটে।

এইখানে কিয়ারোস্তামিকে একটু গভীরভাবে বুঝতে হবে। তিনি বাস্তববাদী চলচ্চিত্রকার। কিন্তু এক জায়গায় বলছেন, ‘ড্রিম ইজ লাইক আ উইন্ডো।’ একটু অদ্ভুত লাগতে পারে, কারণ সাধারণত উইন্ড মেটোনিমিটা ব্যবহার হয় জানলার বাইরের বাস্তবকে বোঝাতে। কিন্তু কিয়ারোস্তামির ভাবনাটা একটু অন্য। তিনি বলছেন, কল্পনা বাস্তবের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বলছেন, আমরা স্বপ্ন দেখি, যখন আমাদের মধ্যে কোনও হতাশা কাজ করে, কাজ করে অসহায়তা। আর মজা হল, দুনিয়ার কোনও স্বৈরাচারী শাসকই কারও স্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে পারে না। সে চাইলে, কাউকে অবরুদ্ধ করতে পারে, কিন্তু তার কল্পনাশক্তিকে কারারুদ্ধ করার ক্ষমতা তার নেই।
কিয়ারোস্তামির ছবিতে, বিষয়ী নির্মাণ এই প্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রায়শই আমরা দেখি এমন এক বিষয়ীর অভিজ্ঞতা, জার্নির কথা তিনি বলছেন— যার মধ্যে কল্পনা আর বাস্তব কবিতার মতো করে, একে অন্যের সঙ্গে সংলাপ চালাচ্ছে। ‘হোয়ার ইজ দা ফ্রেন্ডস হাউস’ ছবির ছোট ছেলেটির কথা ধরা যাক, যে তার বন্ধুর খাতা তাকে ফেরত দেওয়ার জন্য, অচেনা গ্রামের দিকে একাকী যাত্রা করে। তাঁর ‘মুসাফির’ ছবির কিশোর, যে কিনা তার স্বপ্নের ফুটবল ম্যাচ দেখবে বলে, গ্রাম থেকে পালাচ্ছে তেহেরানে। তেমনই আমরা ‘ক্লোজ আপ’-এর সাবজিয়ানের কথা ভাবতে পারি। আমরা আদালত কক্ষে তার কথা শুনে বুঝি, তার মধ্যে এক অতি সাধারণ, অসহায়, নিম্নবিত্ত মানুষ বাস করে কিন্তু সে যুক্তিহীন নয়। আবার এই সবজিয়ান, নিজেকে মাখমালবাফ বলে পরিচয় দিয়ে আশ্চর্য সব কথোপকথন চালায়, একমাস এক মাখমালবাফ-ভক্ত পরিবারের সঙ্গে। সাবজিয়ানের ছাপোষা জীবন এবং তার কল্পনায় নিজেকে মাখমালবাফ মনে করা— আশ্চর্য কাব্যিকভাবে মিশে যায় কিয়ারোস্তামির ছবিতে। আরও অনেকগুলি ছবি থেকে, এইরকম উদাহরণ খুঁজে বার করা যায়। অর্থাৎ তিনি এমন একজন বাস্তববাদী, যিনি মনে করেন— জীবনের অভিজ্ঞতাই চলচ্চিত্র নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূলধন। আবার একই সঙ্গে তিনি কল্পনা প্রবণতাকে নাকচ করেন না। সত্যি কথা বলতে কি, ইরানের চলচ্চিত্রকারকে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে হয় সেখানে, এমনকী একটা সরল সুস্থ স্বাভাবিক বাস্তবের ভাবনাও কল্পনা থেকেই টেনে এনে হাজির করতে হয়। এই উদাহরণ ইরানের কবিতায়, বিশেষত ইরানের আধুনিক কবিতায় বিরল নয়।
দর্শকের সঙ্গে ছবির উদ্দিষ্ট সম্পর্ক কী হবে, তা অনেকটাই পরিচালকের সততার প্রশ্ন। যা কিয়ারোস্তামি তাঁর সারা জীবনের কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অক্ষরে-অক্ষরে পালন করে এসেছেন। বোধহয় সেখানেই তাঁর প্রিয় চলচ্চিত্রকার কারা হবেন তা নির্ধারিত হয়েছে।
শুধু এইটুকুই নয়, তাঁর ছবিতে বিষয়ী নির্মাণ নিয়ে যে কথা শুরু হয়েছিল, সেটা আরেকটু ব্যাখ্যা করি। ঐ ‘ক্লোজ আপ’ ছবিতেই একটি অসাধারণ দৃশ্য আছে। ছবিটা প্রথম থেকে দেখলে বোঝা যায়, গাড়ির চালক এবং তরুণ পুলিশকর্মী দু’টি, যারা কিনা গ্রামাঞ্চল থেকে এসেছে তেহরানে চাকরি করতে, তাদের মুখ ক্যামেরা দেখায় অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে। কিয়ারোস্তামি বলছেন, এটা তাঁর খুব প্রিয় একটা দিক। এমন সমস্ত মানুষের মুখ তাঁর ছবির পর্দায় আমরা দেখি, যাদের প্রতি বোঝা যায় একটা বিশেষ আকর্ষণ বোধ করছে তাঁর ক্যামেরা। অথচ তারা সবক্ষেত্রে বিশেষ কেউ নয়। সাবজিয়ানকে গ্রেফতার করতে যখন বিরক্তিকর সাংবাদিকটি, পুলিশকর্মীদের নিয়ে একটি বাড়ির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, তখন আমরা দেখি, ক্যামেরা বাইরে অপেক্ষা করে। কিয়ারোস্তামি একটা নীতিবোধ দ্বারা চালিত হন, যা হল ক্যামেরা কারও প্রাইভেসির মধ্যে নাক গলাবে না, কোনও হিউমিলিয়েশনের মধ্যে সে অংশগ্রহণ করবে না। সে অবশ্য অন্য কথা, সে বিষয়ে আজ আলোচনা করতে চাই না। যাইহোক, ক্যামেরা বাইরে যতক্ষণ অপেক্ষা করে, ততক্ষণ গাড়ির চালক, যিনি ধীরে-ধীরে গাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ান, তার প্রতি একটা বিশেষ আগ্রহ বোধ করে। ক্যামেরা মানুষটিকে নিবিষ্ট মনে দেখে। এই দেখা শেষ হয় ওই চালকটির পায়ের হালকা আঘাতে, যখন একটি ফাঁকা কীটনাশকের গোলাকার কৌটো ঢালু রাস্তা দিয়ে গড়াতে-গড়াতে অনেকটা দূর পর্যন্ত চলে যায়। যদি একটু ভাবা যায়, তাহলে বোঝা যাবে যে এই শটটা নিতে গিয়ে হয়তো তাঁকে বেশ কয়েকটা টেক করতে হয়েছে। আর সর্বোপরি এই অকিঞ্চিতকর একটি কৌটো গড়িয়ে চলেছে, সেই শটটা শেষ পর্যন্ত রাখবেন এই সিদ্ধান্ত সম্পাদনা কক্ষেই হয়তো নিতে হয়েছে। সেখানে এই বস্তুটি গড়িয়ে চলার শব্দ, তাঁকে আলাদা করে যোগ করতে হয়েছে।


স্বাভাবিকভাবেই চলচ্চিত্রের পর্দায় যেটা নিখুঁতভাবে বাস্তবসম্মত দেখাচ্ছে, তাকে বেশ কিছু পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিশ্চয়ই যেতে হয়েছে। কিন্তু এখানে মূল কথা সেটা নয়। এই যে গাড়ির চালক তিনি এই আখ্যানের মধ্যে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নন। সত্যি কথা বলতে, কি তিনি চরিত্রই নন এই আখ্যানের নাটকীয়তার। তবু ক্যামেরা তাকে নিবিষ্ট মনে দেখে, তার বেশ কয়েক মিনিটের অলস সময় কাটানোর মুহূর্তগুলোকে— মন দিয়ে লক্ষ্য করে।
আসলে এখানেই তফাতটা হয়ে যায়। অন্যেরা যেখানে আখ্যানের মধ্যে, সক্রিয় চরিত্রগুলির মুখ খুঁজে বেড়ান, কিয়ারোস্তামি সেখানে ব্যতিক্রম; তিনি এমন একটি মানুষের মুখ খুঁজে নিচ্ছেন, যিনি আখ্যানে গুরুত্বপূর্ণ নন। কিন্তু ক্যামেরার সামনে একটা আশ্চর্য জীবনবোধের স্বাক্ষর রাখেন।
এভাবেই আমরা ভাবতে পারি, ‘টেস্ট অফ চেরি’ ছবির কথা, যেখানে মিস্টার বাদী তার গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়ছেন এমন একজনকে জোগাড় করতে যিনি বাদীর আত্মহত্যার পর, তার গোরে মোটা অর্থলাভের বিনিময়ে মাটি দেবে। আমরা দেখি, বাদীর গাড়ির জানালায় একে-একে অনেক মুখ, কেউ শ্রমিক, কেউ নেহাতই পথচারী, কেউ সাধারণ সৈনিক, কেউ র্যাগপিকার। হ্যাঁ এটা ঠিক যে প্রতিটি দৃশ্যই এখানে বিশেষভাবে শুটিং করা হয়েছে। এমনকী কথোপকথন অংশগুলিতেও বাদী এবং অন্যান্য মানুষগুলি, আলাদা আলাদাভাবে অনেক ক্ষেত্রেই ক্যামেরার সামনে এসে তাদের সংলাপ বলেছেন। কিন্তু যেটা আকর্ষণীয়, তা হল— এই অজস্র মানুষের মুখ পর্দায় ভেসে ওঠা, যারা সেই অর্থে হয়তো ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নয়, নয়তো বটেই, কিন্তু প্রতিটি মুখ ক্যামেরার সামনে উদ্ভাসিত হয়, একটা মানবিক আকর্ষণ নিয়ে। এই মানুষের মুখের সারি, সে যত ধীরগতিতে বা যত বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে তাঁর ছবিতে আসুক না কেন, তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। এটা আরও ভালভাবে বোঝা যায়, তার ‘শিরিন’ ছবিতে। সেখানে দর্শকাশনে বসা ইরানের চলচ্চিত্রে, অংশগ্রহণকারী ইতিহাস ও বর্তমানের অভিনেত্রীদের মুখগুলি পর্দায় ভেসে ওঠে। প্রতিটি মুখ ইরানের চলচ্চিত্রের যন্ত্রণা, আবেগ ও মায়াময়তার একটি করে ছোট্ট কিন্তু আপার মূল্যবান অভিব্যক্তি। এরকমটা আমরা, ‘অ্যান্ড লাইভ গো’জ অন’ ছবিতেও দেখি, দীর্ঘ গাড়ি যাত্রায় পরিচালক কত মানুষের দেখা পাচ্ছেন তাদের মুখ, ছোট-ছোট সংলাপের অংশ— আমরা বুঝি, কিয়ারোস্তামি কি অসীম যত্ন সহকারে ক্যামেরাবন্দি করছেন।


এইসব মুখগুলি, তাঁর বিষয়ী নির্মাণের বৈচিত্র্য আমাদের বোঝায়, বোধ এবং জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে কতটা মূল্যবান। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি থাকবেন না, কিন্তু আপনার ছবিগুলি অমর হয়ে থাকবে, আপনার অভিমত কী। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ছবিগুলো না থাকলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু আমি থাকতে চাই। একমাত্র তিনিই পারেন অমরত্বকে তুচ্ছ করে জাগতিক অস্ত্বিত্বের জয়গান করতে। তিনি আব্বাস কিয়ারোস্তামি।