অ্যানাটমি রহস্য
ডাক্তারিতে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হওয়ার সময় থেকেই অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের পুরনো বাড়িটা আমাদের কাছে ছিল এক গভীর আকর্ষণের জায়গা। উঁকিঝুঁকি মেরে চোখে পড়ত বিশাল হল, যার একধার দিয়ে মার্বেলের সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। দিনের বেলাতেও আধো-অন্ধকার, যেন নিষিদ্ধ কিছুর মতো টানত আমাদের।
তারপর একদিন প্রবেশাধিকার মিলল। দোতলা ও তিনতলার মাঝখানটা ফাঁকা। দোতলার একপাশে ডিপার্টমেন্টের ঘরগুলো, তার ওপরে তিনতলার টঙে ডিসেকশন হল। দেয়াল ঘেঁষে সারি-সারি টেবলে শোয়ানো ডেডবডি। চারদিকে ফরম্যালিনের তীব্র গন্ধে নাক ঝাঁঝিয়ে যাচ্ছে। এক-একটা বডি নিয়ে আমরা তিন-চার জন স্টুডেন্ট। আমাদের প্রথম পার্ট ছিল ‘inferior extremity’— অর্থাৎ, উরু থেকে পা। একটা রোগা, কালো শরীর।
একবার কাটাছেঁড়া শুরু হলে আর অন্যদিকে মন থাকে না। তখন চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে মাসল, আর্টারি, নার্ভের রহস্য। হইহই করে কেটে গেল প্রথম কয়েকটা দিন। সত্যি বলতে কী, সবকিছুই এখন আর আগের মতো রহস্যময় লাগছে না।
আরও পড়ুন : পুরুষের নিয়ন্ত্রণেই থাকে মেয়েদের শরীর ও চিকিৎসা!
তিস্তা সান্যালের ‘মেডিসিনারি’ পর্ব ১৩…
এর মধ্যে একদিন রাতে হস্টেলে খাওয়াদাওয়ার পর আড্ডা চলছে, হঠাৎ এক বন্ধু প্রস্তাবটা দিল। ‘এই এখন, এই রাতে যেতে পারবি ডিসেকশন হলে?’
আমার এক রুমমেট তো সরাসরি ‘না’ বলে দিল। বাকিরাও একটু ইতস্তত করছে। আমাদের জনা তিন-চার বন্ধুর ততক্ষণে রোখ চেপে গিয়েছে। কী আর হবে? আর আমরা সবাই গ্রামের ছেলে। ছোটবেলা থেকে রাতে অন্ধকার মাঠে-ঘাটে চলা অভ্যেস। যদিও তার সঙ্গে এটার তুলনা হয় না।
যাই হোক, মন শক্ত করে বেরিয়ে পড়া গেল। হস্টেলের পরে ডানদিকে ফুটবল মাঠের সীমানার পরে যেন ভূতুড়ে আলোয় দাঁড়িয়ে আছে অ্যানাটমি বিল্ডিংটা। সামনের দরজা হাট করে খোলা। রাতবিরেতে যে-কোনও সময় বেওয়ারিশ বডি চলে আসতে পারে। নিচের তলার ডানদিকে একধারে ডেডবডি রাখার জায়গা। বড় বড় বক্সের মধ্যে রাখা। ফর্মালিনের তীব্র গন্ধ ছাড়িয়ে একটা বিশ্রী বোঁটকা গন্ধে ভরা চারপাশটা। আমরা উল্টোদিকের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়। ডিপার্টমেন্টের তালাবন্ধ ঘরগুলো পেরিয়ে এবার ওপরে ডিসেকশন হল। কম পাওয়ারের আলোতে দেখা যাচ্ছে সবকিছুই। একপ্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত হেঁটে চললাম আমরা। একটার পর একটা মেয়ে পুরুষের লাশ। বুড়ো থেকে কমবয়সি; বেশিরভাগ মুখগুলোই অবিকৃত। আধো অন্ধকারে কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল। একটু গা ছমছম করছিল না বললে মিথ্যে বলা হবে। সেটা ঢাকা দিতেই বেশি জোরে জোরে কথা বলছিলাম আমরা।
খানিকটা সময় কাটিয়ে সোজা হস্টেল। না, সে রাতে স্বপ্নটপ্ন দেখিনি কিছু,যদিও অনেকক্ষণ ঘুম আসছিল না।

তারপর ক্রমশ আরও অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম অ্যানাটমি হলের সঙ্গে। সন্ধ্যায়, এমনকী, রাতেও কখনও গিয়েছি দাদাদের কাছে ডিসেকশন শিখতে। তখন শুধু কৌতূহল, নতুন শেখার উত্তেজনা। রহস্য,রোমাঞ্চ কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে। গ্রে’স অ্যানাটমি বইটা দেখলেই বুক ধড়ফড় করত। একটাই চিন্তা এই ভবসমুদ্র পার হব কী করে? কোর্সের যেন শেষ নেই! বস্তুত অনেকদিন পরেও মনে হয়েছিল, জীবনে অন্য পরীক্ষা আর একবার দিতে পারি, কিন্তু অ্যানাটমি? নৈব নৈব চ!
এরপর বহু বছর কেটে গিয়েছে। ডাক্তারি পাশ করে কলেজ ছেড়েছি। চাকরির সূত্রে নানা জায়গায়। এর মধ্যে মেয়ে বড় হয়েছে। ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছে। ওদের ফার্স্ট এমবিবিএস পরীক্ষার সিট পড়ল আরজি করে। ভাবলাম, বহুদিন পরে পুরনো কলেজ ঘুরেই আসি।
হস্টেলের পরে ডানদিকে ফুটবল মাঠের সীমানার পরে যেন ভূতুড়ে আলোয় দাঁড়িয়ে আছে অ্যানাটমি বিল্ডিংটা। সামনের দরজা হাট করে খোলা। রাতবিরেতে যে-কোনও সময় বেওয়ারিশ বডি চলে আসতে পারে। নিচের তলার ডানদিকে একধারে ডেডবডি রাখার জায়গা। বড় বড় বক্সের মধ্যে রাখা। ফর্মালিনের তীব্র গন্ধ ছাড়িয়ে একটা বিশ্রী বোঁটকা গন্ধে ভরা চারপাশটা। আমরা উল্টোদিকের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়। ডিপার্টমেন্টের তালাবন্ধ ঘরগুলো পেরিয়ে এবার ওপরে ডিসেকশন হল।…
পরীক্ষা শুরু হয়েছে, গার্জেনরা সব এদিক-ওদিক ছড়িয়েছিটিয়ে। হঠাৎ কী মনে হল, এগিয়ে চললাম অ্যানাটমি বিল্ডিংয়ের দিকে। দুপুরে সেদিন কেউ নেই চারপাশে। একতলার হলে ঢুকে দেখি হলের শেষ প্রান্তে একটা যেন সাদা কাপড়ে ঢাকা কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে দেখি, পাশাপাশি শোয়ানো দুটো ট্রলিতে দুটি ডেডবডি। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। ছেলেটির বয়স বড়জোর পঁচিশ, মেয়েটির কুড়ি-বাইশ। এক্কেবারে তাজা ডেডবডি, সদ্য এনে রেখে গিয়েছে। ছেলেটির পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, মেয়েটির একটা টকটকে লাল শাড়ি। যেন বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে সোজা এসেছে এখানে। মেয়েটির চোখ পুরো বন্ধ নয়, আধেক খোলা। মুখদুটো এত জীবন্ত লাগছিল, ঠিক যেন ঘুমিয়ে আছে ওরা।
ধারে-কাছে কেউ নেই, একটু সময় ওদের দিকে তাকিয়ে মনে কত কথা ভেসে উঠল। দেখে প্রথমেই মনে হয়, দু’জনে একসঙ্গে আত্মহত্যার কেস। কোন অভিমানে কে জানে শেষ হয়ে গেল তাজা দু’টি প্রাণ। কী পরম নিশ্চিন্তে পাশাপাশি শুয়ে এখন দু’জনে! মৃত্যু তো অনেক দেখলাম, এই বয়সে এসব দেখে মনে কোনও বিশেষ অনুভূতি হয় না, তবু কেমন যেন একটা শিরশিরে ভাব সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল!
মেয়ের পরীক্ষা শেষ হল। বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়িতে কাউকে আর এই ঘটনাটার কথা বলিনি। রাতে শুয়ে আছি, আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল টকটকে লাল শাড়ি পরা মেয়েটার চেহারাটা। আধেক খোলা চোখদুটোয় যেন কোন স্বপ্ন লেগে আছে! কিছুতেই ঘুম আসছে না, ওই মুখদুটো যেন চোখের সামনে থেকে সরছে না। এতদিন এত মৃত শরীর দেখেছি, কত নবীন প্রাণ শেষ হয়ে গিয়েছে চোখের সামনে… কই, এমনটা তো মনে হয়নি।
তবে কি ওই অ্যানাটমি হলের নির্জন পরিবেশের রহস্য, না কি, আমার মনের দুর্বলতা! জানি না!