গান, আড্ডা, স্মৃতি
শান্তিনিকেতনের আড্ডা বললেই স্মরণে আসে, কালোর দোকানের আড্ডা। বিশ্বপ্রসিদ্ধ সেই আড্ডার কথা, কম-বেশি সকলেই জানেন। কিন্তু ছোট হলেও, প্রতিটা ভবনেরই নিজস্ব একটা আড্ডার মহল ছিল। সংগীত ভবনও তার ব্যতিক্রম নয়।
ধরা যাক, কোনও নাচের বা গানের অনুষ্ঠান হবে, তার আগে, সংগীত ভবনের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত হয়ে আড্ডা জমত। মাস্টারমশাইরা ছিলেন সেই আড্ডায়, যাঁরা একসময়ে ছাত্র ছিলেন, তাঁদের অন্যতম রণধীর রায়, অলোক চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
এত বিচিত্র সেই আড্ডার বিষয়, আলাদা করে বিষয় বলা খুব মুশকিল। আমি ছয়ের দশকে শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছি, সে-সময়ে, সংগীত ভবনের পিছনদিকে— একটা চারকোনা বেদি ছিল, একটা গাছ ছিল তার মাঝে— সেখানে একটা চায়ের আড্ডা জমত। সেই আড্ডাতে রামদা বলে, আমাদের একজন চা দিতেন। এঁরা সকলেই ছিলেন অফিস বেয়ারার। কিন্তু সেটা ছাড়াও অন্য নানা কাজে তাঁরা পারদর্শী ছিলেন। যেমন বাঙ্কিদা বলে একজন ছিলেন, তিনি তবলা বাজাতে পারতেন, তাঁর তো তবলা শিল্পী হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু তিনি পারদর্শী ছিলেন তাতে।

আরও পড়ুন : বাউল আখড়া থেকে ট্রেনের কামরা, নানা আড্ডাই সম্বল ছিল দোহারের গানের!
সুদীপ্ত চক্রবর্তীর কলমে ‘মশগুল’ পর্ব ১১…
ওই ন’টা কুড়ি থেকে, সাড়ে ন’টা-ন’টা চল্লিশ অবধি আড্ডাটা চলত। বিচিত্র সেই আড্ডার বিষয়! এ-ওর পিছনে লাগা, গান-নাচ নিয়ে নানা কথা, এমন কত কী! অশেষদা, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সেই আড্ডার কর্ণধার ওরফে মধ্যমণি। মোহরদি, মঞ্জুদি, বাচ্চুদি, মাধবদা— এমন অনেকে ছিলেন এই আড্ডার অঙ্গ! তবে সংগীত ভবনের আড্ডার, প্রাণ ছিল ‘গান’। প্রায় সমস্ত আড্ডার গল্প, প্রসঙ্গই গানে এসে মিলত। আড্ডার মাঝেই গান গেয়ে উঠত অনেকে। বিভিন্ন শিল্পীদের গায়কী নিয়ে আড্ডা, বিশ্লেষণ হত। সে-আড্ডায়, আমার অন্যতম সঙ্গী ছিল, রণধীর রায়। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল সে, বেস্ট ফ্রেন্ড।
শান্তিদেব ঘোষ রেওয়াজ করতেন প্রতিদিন সকালে, সেই নিয়ে একটা আড্ডা জমত। শান্তিদার হারমোনিয়ামটাও ছিল বিশেষ। খুব মন দিয়ে, আগ্রহ ভরে শুনতাম সেই রেওয়াজ। ওই গায়কী আমরা নকল করার চেষ্টা করতাম। এমন একদিন শান্তিদাকে নকল করে গাইছি, উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে, দাঁড়িয়ে পড়লেন শুনে, ‘এই, তুমি তো দারুণ গাইছ, তুমি কী করে গাইলে, এ তো আমার নকল হচ্ছে একেবারে’— শান্তিদা রাগ করেননি, খুশি হয়ে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন।

এমনই ছিল শান্তিনিকেতন, সংগীত ভবনের আবহাওয়া, তার আকাশ-বাতাসে গান, সেই গানের অছিলাতেই হোক কিংবা নিছক আড্ডার সূত্রে… গানই ছিল সূত্রধর। এখন প্রকারান্তরে, শান্তিনিকেতনের আকাশ-বাতাসে গান নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। আগে ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকদের মধ্যে কত নিবিড় সম্পর্ক ছিল, প্রত্যেক শিক্ষক প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে নামে চিনতেন। পরস্পর-পরস্পরের প্রতি আচরণে কোনও সংকোচ ছিল না। ধরা যাক, কোনও মাস্টারমশাই লাঞ্চে যাচ্ছেন, কেউ একটা প্রশ্ন করলেন সেই মুহূর্তে, তিনি কিন্তু এড়িয়ে যেতেন না, কথার উত্তর দিয়ে যেতেন। কথার উত্তর দেওয়া তখন একটা দারুণ ব্যাপার ছিল। ছাত্রছাত্রীরাও প্রশ্ন করার একটা সাহস পেত। শিক্ষকদের শুধু মাস্টারমশাই বলেই মনে হত না, মনে হত, ওঁরা আমাদের অবিভাবক। পরিবারের থেকে কম কিছু নয়। এখন সেই পরিস্থিতি অনেক বদলেছে।
উত্তরায়ণে গিয়ে গান করা ছিল আমাদের নেশা। উত্তরায়ণের বাঁ-দিকে যে উঠোনটা আছে, ওখানে আমাদের রেওয়াজ করার অনুমতি ছিল, কোনও-কোনওদিন আমরা, চাঁদনি রাতে, সংগীত ভবনের ছেলেরা— ওখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজ করতাম। রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী ওখানে থাকতেন তখন, উনি মাঝে-মাঝে হুইলচেয়ারে করে এসে আমাদের রেওয়াজ শুনতেন। অনেকক্ষণ পরে, রেওয়াজ শেষে যখন আমরা উঠব, উনি এসে বলতেন, ‘তোমরা শুধু মুখে যেও না। মিষ্টি আছে, খেয়ে যেও।’

এখানে এক সাধুবাবা ছিলেন, তাঁর বয়স আন্দাজ করা যেত না, তিনিও বলতেন না। বিনয় ভবনের ওখানে তাঁর আস্তানা ছিল। মোহরদি যেতেন সেখানে, আমিও যাওয়া শুরু করলাম, সাধুবাবা আমার কাছে, নানকের ভজন শুনতে চাইলেন, নানকের ভজন-সহ আরও নানা কিছু তাঁকে শোনালাম। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয়ে গেল। সেখানেও নানারকম মজা হত।
মোহরদির বাড়িতেও আড্ডা হত, গোরাদা আসতেন নিয়মিত আরও অনেকে আসতেন সংগীত ভবনের। সে এক ধার্মিক আড্ডা ছিল বলা যেতে পারে।
কিঙ্করদাকে নিয়েও অনেক স্মৃতি, একবার কিঙ্করদা ঠিক করলেন, কলাভবনের একটা জায়গায় গাছ পুঁতবেন। সব জোগাড় করা হল, কিঙ্করদা বললেন, ‘মোহনকে ডাকো, মোহন একটা গুরুনানকের ভজন গাইবে এখানে, তারপর গাছ পোঁতা হবে, তা না-হলে কিন্তু পোঁতা যাবে না।’
আমি তখন হস্টেলে ছিলাম না, ছিলাম ক্যান্টিনে। চীনা ভবনের পাশে বিশ্বভারতীর একটা ক্যান্টিন ছিল, সেখানে ছিলাম। ওখানে কলাভবনের দু’জন ছেলে এসে আমায় ডেকে নিয়ে গেল। গেলাম, কিঙ্করদা বললেন, একটা নানকের ভজন গেয়ে দাও। তারপর গাছ পোঁতা হল।
শান্তিনিকেতন আঁকড়ে ধরে, ছেড়ে যেতে দেয় না। স্মৃতিরও ডালি তাই জমে যায় এখানে।