ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শুভারম্ভ: পর্ব ৩


    শুভা মুদ্গল (Shubha Mudgal) (April 10, 2021)
     
    চিল্লা: পর্ব ১


    হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছাত্রেরা বহু বছর ধরে কঠিন এবং দীর্ঘ সাধনা করে থাকেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গুরুর (বা গুরুজনদের) উপদেশে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাইরের পৃথিবীর থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখেন, যাতে সেই সময়টুকু একমনে রেওয়াজ করা যায়। এর নাম ‘চিল্লা’। এই চিল্লার লক্ষ্য হল, আত্মবিশ্লেষণ করা ও নিজের সাধনাকে উচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়া। 

    ‘একটা চিল্লা করতে চাই’, একই সঙ্গে যেন একটা প্রস্তাব দিলেন এবং ঘোষণা করলেন নির্মলা মালব্য। পরিশ্রমে ঘেমে ওঠা তাঁর মুখে উত্তেজনার একটা ঝিলিক খেলে গেল, যেন আচমকাই মাথায় একটা অসাধারণ বুদ্ধি এসেছে! ঘরে বাকি যে তিনজন তাঁর সঙ্গে আসন্ন কত্থক অনুষ্ঠানের রিহার্সাল করছিল, তাদের কোনও হেলদোল দেখা গেল না। কিন্তু নির্মলার কোনও সন্দেহ ছিল না, যে-সাফল্য তাঁর কপালে নাচছে, সেই পথে চিল্লার আইডিয়াটা তাঁকে অনেক দূর এগিয়ে দিতে পারে। সঙ্গীদের বিশেষ গা করতে না দেখে তিনি আবার গলা তুলে বললেন, ‘কথাটা কানে গেল, হ্যাঁ? আমি চিল্লা করব।’ তিন শিল্পীর থেকে সামান্য একটু উত্তেজনার আভাসটুকুও না পেয়ে নির্মলা মনে মনে ভাবলেন, ‘মুখ্যুর দল! ওদের আর কী? যে-ই টাকা দেয় তার সঙ্গেই বাজনা বাজায়, আর কেউ ‘ফরেন ট্রিপ’-এর লোভ দেখালে তার কেনা হয়ে যায়। আমি যা করতে চাইছি, শিল্পের প্রতি আমার যে অনুরাগ, এসবের মর্ম ওরা জীবনে বুঝবে? আরে বাবা, হাজার হোক, চিল্লা একটা আধ্যাত্মিক জিনিস, সাধনার অঙ্গ! চিল্লা মানে প্রতিজ্ঞা করা, আর সেই প্রতিজ্ঞা পালন করার মতো মনের জোরটা রাখতে পারা। কিন্তু এদের তো একটাই প্রতিজ্ঞা, যেখান থেকে হোক পয়সা কামানো! যাকগে, আমি মন ঠিক করে ফেলেছি, নিজের পথে এগিয়ে যাব। এই বছর থেকে আর বাৎসরিক অনুষ্ঠানও করব না, তার বদলে করব চিল্লা। আর সে-চিল্লা এমন করব যে, একটা গিনেস বিশ্বরেকর্ড হয়ে যাবে, আর তারপর প্রত্যেক বছর আগের বারের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়ব। হাহা, কী মজা!’   

    ঘরের বাকিরা এতক্ষণ নির্বিকার ছিল, তবে চুপ করে ছিল না। তিনজনেই বাজনদার; নাচিয়েদের সাথে তবলা, পাখোয়াজ, আর গানে সঙ্গত করেই তাদের রোজগার। এদের পাণ্ডা হচ্ছে ওই পান-চিবুনো ও ছোপ-লাগা পাঁড় বেনারস-বাসী গঙ্গাপ্রসাদ মিশ্র। যতক্ষণ নির্মলা নামক গর্বিতা শিল্পীটির মনের ভেতর এইসব উথালপাথাল চলছিল, সে তার ধূসর তেলচিটে চুলগুলো নাচিয়ে,  শিল্পীর মার্কামারা দেখনদারির ঢঙে আঙুলগুলোর হালকা তালে তবলায় তুলছিল ‘রেলা’। পাশেই বসেছিল তরুণ পাখোয়াজ-বাদক পৃথ্বীকুমার মিশ্র, এও বেনারসের লোক। প্রবীণের বাজনার তারিফ করতে মাঝে মাঝেই ‘ওয়া চাচা’ বলে চেঁচিয়ে উঠছিল। তৃতীয়জনের নাম পিনাকী লেঙ্কা, সবাই তাকে পিঙ্কু বলেই ডাকে। বেনারসের দুই দেশোয়ালি ভাইয়ের পাল্লাদারির মধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে বসে পিঙ্কু মোবাইল ফোন ঘাঁটছিল, ফেসবুক আর হোয়্যাটস্যাপের মধ্যেই ডুবে ছিল।

    সে সময়ে কত্থক নাচের জগতে তবলচি গঙ্গাপ্রসাদের খুব কদর। দিল্লির সব কত্থক-নাচিয়ে অনুষ্ঠান ঠিক হলেই তাকে ভাড়া করতে ছুটত। কেউ কেউ তো খাতায়-কলমে অনুষ্ঠানের কথা পাকা হওয়ার আগেই, অ্যাডভান্সে বায়না দিয়ে রাখত, অনুষ্ঠান শেষমেশ না হলে ক্যানসেলেশনের জন্যে তাকে কত টাকা দিতে হবে— সেসব তোয়াক্কা করত না। অন্য জায়গা থেকে যেসব কত্থক শিল্পীরা আসত, তারাও জানত, রাজধানীতে আসর জমাতে গেলে গঙ্গাপ্রসাদকেই চাই। ওকে পেয়ে, তারা নির্দ্বিধায় নিজেদের বাঁধা তবলচিদের নামিয়ে দিত অর্কেস্ট্রার কোনও নীচের সারির কাজে। বা দায়িত্ব দিত তবলার সঙ্গে সঙ্গে বোল বলার। আর গঙ্গাপ্রসাদ চোখ-ধাঁধানো ব্রোকেডের কুর্তা গায়ে, ‘এডি আউর কিস্টল’ (আমেরিকান ডায়মন্ড আর ক্রিস্টাল) লেখা একটা বিশাল মেডেল ঝুলিয়ে, বিরাজ করত অর্কেস্ট্রার শীর্ষে। যেসব নাচিয়ের রেওয়াজের অভাব ছিল, বা জটিল তালে যারা নাজেহাল হয়ে যেত, কিংবা যারা গুচ্ছের খুঁটিনাটি মনে রাখতে ঘেমেনেয়ে সারা হত, তাদের কাছে গঙ্গাপ্রসাদ বা গঙ্গা ভাইয়ার দাম ছিল আরও বেশি। গঙ্গাভাইয়ার সব মুখস্থ ছিল, সব, যতরকমের টুকরা, পারান, তিহাই, চক্রদার— সমস্ত ছিল তার বিশাল পাঞ্জাওয়ালা আংটিভর্তি হাতের পাঁচ! রিহার্সালে সঙ্গত করতে শুরু করেই, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এদের সমস্ত দোষত্রুটি গঙ্গাপ্রসাদের চোখে পড়ে যেত। আর সে জানত, যত নিখুঁতভাবে এই দোষগুলো সে আড়াল করে দিতে পারবে, তত এই নাচিয়েরা ভরসা করে তাকেই বারবার ভাড়া করে আনবে। যখনই কোনও নাচিয়ে নার্ভাস হয়ে পড়ত, এই বুঝি কিছু ভুল করে ফেলল আর বিচক্ষণ দর্শকেরা তা বুঝে ফেলল, তখনই গঙ্গাপ্রসাদ নীচের ঠোঁটটা ওপরের দিকে বেঁকিয়ে (যাতে পানের রস না গড়িয়ে পড়ে যায়) বলত, ‘কেন মাইডাম (ম্যাডাম), কেন? হাম হ্যায় না!’ কঠিন জায়গাগুলোয় বাঁচিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি স্বরূপ ওই মার্কামারা ‘হাম হ্যায় না’-র জোরে শুধু নার্ভাস নাচিয়েরা আশ্বস্ত হত তা-ই নয়, তারা যখন স্টেজে ঢুকে প্রত্যেক সহশিল্পীকে প্রথাগতভাবে প্রণাম জানাচ্ছে, তখন সবচেয়ে ভক্তিবোঝাই প্রণামটা গঙ্গাপ্রসাদকেই ঠোকা হত। শোনা যায়, একবার সে বুক ফুলিয়ে কাদের যেন বলেছিল, ওই ‘ফিলিমওয়ালা করণ জোহরওয়া’ তার এই ‘হাম হ্যায় না’ শুনেই নিজের সিনেমার নাম ‘ম্যায় হুঁ না’ রেখেছিল। অবশ্য পরে যখন পৃথ্বী চটপট তাকে মনে করিয়ে দেয়, ‘চাচা, ম্যায় হুঁ না জোহারওয়া থোড়ি বানিয়েছিল, উ তো ফরাখাঁ (মানে ফারাহ খান) বানাই হ্যায়’, তখন গঙ্গাপ্রসাদ এই দাবিটি মুলতুবি রাখে।

    বিগত ১৫ বছরে নিজের যে ক’টি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন নির্মলা মালব্য, প্রতিটায় গঙ্গা ভাইয়াকেই নিয়েছেন। হ্যাঁ, ঠিকই পড়লেন; একেবারে গোড়া থেকেই প্রত্যেক বছর নিজের অনুষ্ঠানের আয়োজন নির্মলা নিজের হাতেই করেছেন। কোনওদিন কেউ তাঁকে নাচতে ডাকেনি, যদিও আয়োজক-প্রযোজকদের সুনজরে পড়তে কম কাঠখড় পোড়াননি নির্মলা। নাচার জন্যেই যে তাঁর জন্ম হয়েছে, এ বিষয়ে তাঁর নিজের কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু নাচের প্রতি এত নিষ্ঠা, এতটা খাঁটি ভালবাসা সত্ত্বেও নির্মলা কোনওদিনই নিজের ভুলত্রুটিগুলোকে নিজে চিনতে শেখেননি। এমনিতে মানুষটা ভারি চমৎকার, সবারই বড় পছন্দের, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের অনেকেরই ভালবাসার ও শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু তাঁকে নাচতে দেখলেই দর্শকদের মধ্যে হাসির হররা ছুটে যেত, কিংবা অনেকের সেই উদ্ভট নাচ দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যেত। নির্মলার কিন্তু অটুট বিশ্বাস ছিল, তিনি আসলে একজন অসামান্যা শিল্পী, শিল্পের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। তিনি উঠতে পারেননি স্রেফ চরিত্রহীনার মতো যার-তার সাথে শুয়ে বেড়াননি বলে, বা নিজের মার্কেটিং করতে পারেননি বলে। শেষমেশ অন্যদের ডাকের আশায় বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে, তিনি স্বাবলম্বী হলেন! প্রত্যেক বছর নিজের অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া নিতে শুরু করলেন সিরি ফোর্ট প্রেক্ষাগৃহ— রাজধানীর সবচেয়ে বিরাট হলঘর, যেখানে দু’হাজার লোক বসতে পারে! সচরাচর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বা নৃত্যশিল্পীরা অত বড় প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া নেন না, কারণ হল না-ভরার ঝুঁকি আছে। তবে এ সব ভয়-ভাবনায় পিছিয়ে যাওয়ার লোক নির্মলা নন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি প্রত্যেক বার নিশ্চিত করতেন, তাঁর অনুষ্ঠানে শুধু ভাল ভিড় হবে না, সেই ভিড়ে থাকবেন রাজধানীর যত ভিআইপি, তারকা, হোমরা-চোমরা আমির-ওমরা। হ্যাঁ, পনেরো বছরে একবারও তিনি হল পুরো ভরাতে পারেননি বটে, কিন্তু তাতে কী? কেউকেটা আর ঠিকঠাক সব লোক তো আসেন, অন্তত কয়েক মিনিটের জন্যে, তারপরেই কীসব যেন জরুরি কাজের কথা মনে পড়ায় তড়িঘড়ি চলে যান। 

    এই চটপট কেটে পড়ার আগে অবশ্য নির্মলার বিশেষ অনুরোধে একটি কাজ এই গণ্যমান্য অতিথিদের করে যেতে হত। যেই কোনও ভিআইপি অতিথি আসতেন, তক্ষুনি সঞ্চালক ঘোষণা করে নির্মলার অনুষ্ঠান কিছুক্ষণের জন্যে থামিয়ে দিত। তারপরে অতিথিদের সসম্মানে স্টেজে তুলে অনুরোধ করা হত, ভারতীয় সংস্কৃতি এবং নাচের জগতে নির্মলা মালব্যের অবদান নিয়ে সামান্য ‘দু-চার কথা’ যদি বলেন। সেখানে মোতায়েন তিনটি ভিডিও ক্যামেরা সমস্তটা রেকর্ড করে নিত, নির্মলাজি, নির্মলা দিদি বা নির্মলা ভাবীকে নিয়ে তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা! ভাষণ শেষ হতে না হতে, উইংস থেকে স্টেজে ঢুকত নির্মলার সেক্রেটারি বীণা, আর তার পিছন-পিছন শাড়ি-পরিহিতা এক তরুণী, তার হাতে রুপোর ট্রে-তে সাজানো টাটকা ফুলের দুটি তোড়া। প্রথমে নির্মলা একটি ফুলের তোড়া তুলে দিতেন ভিআইপি অতিথির হাতে, তাঁর এতটা মূল্যবান সময় নষ্ট করে অধমের অনুষ্ঠানে পায়ের ধুলো দেওয়ার জন্য। পালটা একটি তোড়া চালান হত অতিথির থেকে নির্মলার হাতে। ক্যামেরায় এই আদান-প্রদানের স্থিরছবি ও ভিডিও ঠিকঠাক তুলে রাখা হচ্ছে কি না, সে তদারকি শেষ করে, বীণা নিজে অতিথিদের নিয়ে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসত। বীণা হল-এ ফেরার আগেই নির্মলা আবার শুরু করে দিতেন স্টেজে সাংঘাতিক পা দাপানো আর বেসামাল হাত ছোড়া— যাকে ঠিক কত্থক নাচ বলা শক্ত। সব ঠিকঠাক চলছে, নিশ্চিন্ত হয়ে, বীণা আবার টাইপ করা তালিকায় নামগুলোর উপর চোখ বোলাতে শুরু করত। কেন না, খেয়াল রাখতে হবে, এর পরে কে আসবেন এবং কে কখন কেটে পড়ার চেষ্টা করবেন।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook