রাত বারোটায় বৃদ্ধ বর ধড়ফড়িয়ে উঠলেন! ইদানিং স্মৃতিভ্রষ্ট বউটার জন্য শান্তিতে ঘুমুতে পারেন না৷ যৌবনে বউটার ওপর বড্ড রাগ হত— বাচ্চা বউটা তুলোর স্তূপের মতো নরম শরীর নিয়ে দুলে-দুলে হাঁটত৷ কাজকম্ম একদম পারত না ৷ বরের কাছে বকুনি খেয়েই দিন কাটত৷ তাই কি এখন টানটা বেশি টের পান বর ? না কি কষ্টটা— বউটা আর তাঁকে বর বলে চিনতে পারবে না বলে! সিঙ্গল বেডে চাঁদের আলো ভরে রয়েছে৷
বউয়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলেন বর, একটু হলেও কি স্মৃতি ফিরল! ফিরবে না জানেন, তবু রোজ ওই একটু ঝাঁক মেরে যাওয়া ৷ চিনতে পারছ…তুমি কি আমায় আর একটুও চিনতে পারো না? ইত্যাদি প্রশ্ন করে করে পথভোলা রোগীকে জেরবার করা৷ যদি বিব্রত হয়ে বউটা কিছুক্ষণের জন্য চাঁদ চিনতে পারে। বিয়ের পর বাগানে যত্ন করে পোঁতা সুপুরি গাছটাকে মনে করতে পারে! বর বউয়ের সঙ্গে গাছটাও বুড়ো হয়ে গেল৷
নাহ! এমন চাঁদও জাগাতে পারেনি বউকে৷ বুড়িবেটি ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েই যাচ্ছে ৷ দু’দিকে সরু দুটো বেণী ৷ এত সরু যে— পাখার হাওয়ায় বেণী কাঁপছে৷
আরও পড়ুন: পৃথ্বী বসুর গল্প ‘টোটো কোম্পানি’
কী হল? প্রেম হয়ে গেল? একা-একা চাঁদ খাবে বলে জানলার দিকে এগোচ্ছ যে বড় ! মহা স্বার্থপর তো তুমি! মোটা গলায় মোটা পুতুল বলল৷
দেখো পুতুল— রোজ-রোজ আমাকে এভাবে জ্বালাবে না তুমি ৷ আমি কী করি না করি সে বিষয়ে তোমার এই সবসময়ে নাক গলাবার অভ্যেস ছাড়৷ একবার যদি জানতাম কে তোমাকে এখানে এনেছে, কোন দেশ থেকে এনেছে, ফেরত পাঠিয়েই ছাড়তাম তোমায়৷ ঝঞ্ঝাটে পুতুল কোথাকার! নেহাত তোমার নাচ দেখে বউটা হাসে, তাই তোমায় হজম করি৷
বলতে-বলতে বর দেখলেন— সারা সময় কথা বলা ফ্যান্সি পুতুল কাঁদছে নিঃশব্দে৷
আহা! আহা! কাঁদ কেন গো ? বকেছি বলে ?
—তুমি বকলে আমার রাগ হয়না৷ আসলে চাবি ঘুরোলে তবে আমি নাচতে পারি গো ৷ নিজে তো নাচতে পারি না ৷ তাই নাচের কথা মনে করালে আমার খুব ব্যর্থ লাগে ৷ এই দেখো না— তোমার বউ যখন আমার নাচ দেখে হাসে, তখন ওর হাসিটা সত্যি হয়। কিন্তু আমার নাচটা তো মিছে বলো, আমি ঠিক বলছি কি না! বলো না। এই শয়তান বুড়ো বলো না । আমার নাচ, আমার ঘাড় ঘোরানো, চোখের ঘূর্ণি বরাবরের জন্য মিছে কি না! মুখের ওপর সত্যি বলতে মানুষের এত অসুবিধে কেন হয় গো ! খালি সান্ত্বনা, খালি সোনা পুতুল মিঠে পুতুল বলে ন্যাকামি ৷ লজ্জা করে না! রুগী মানুষটার মন ভোলাতে একটা নির্জীব মাল ঘরে এনে রেখেছ!
— পুতুল ফের মোটা গলা করে কান্না থেকে সরে ঝগড়ায় মেতেছে ৷
—আরে দূর ! আমার বউয়ের হাসির কোনও মানে আছে যে, তাই দেখে তুমি মন খারাপ করছ ! স্মৃতিহারা মানুষ কখন কী দেখে হাসে তা কি সে নিজে জানে !
— বরের এই কথায়ও শান্ত নয় পুতুল ৷
মৃদু গলায় বললে, বরভাই তোমার বউয়ের হাসিটাও নিজের। হাসির মানে না থাকাও নিজের ৷ আমার হাত-পা মাথানাড়া সব কলে নয় ব্যাটারিতে ৷ এত সুন্দর জামা যে মাথা গলিয়ে খুলে একবার কাচব তারও জো নেই! নোংরা জামাটা কত বছর ধরে পরে আছি! কী করব! হাত-পাগুলো প্লাস্টিকের৷ প্লাস্টিকের ক্ষয় নেই৷ বুঝলে?
উ উ উ— এই রে বউটা জেগে গেছে তাদের কথায়!
কুঁজো থেকে ঠাণ্ডা জল দিলেন বর৷ বোধহয় স্বপ্ন দেখছিল! জিভটা শুকিয়ে গেছে৷ আঙুলে জল নিয়ে বউয়ের ঠোঁট সিক্ত করতে লাগলেন৷ বারবার জল খেয়ে-খেয়ে ঢেকুর তুলল বউ৷
পুতুল অনেকক্ষণ কথা বলেনি৷ প্লাস্টিকের আঙুলহীন হাতটা বুড়ির ঢাউস পেটের ওপর রাখা, পেট উঠছে নামছে ৷ সুপুরিগাছের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে পুতুল৷ চাঁদের আলো তার কালোরঙে আঁকা চোখে ৷
গাছের স্মৃতি নেই৷ তবে সে মানুষের স্মৃতি তৈরি করতে পারে ৷
অজানা সাফল্যের আশায় পুতুল হাসল৷
প্লাস্টিকের মুখ ফাঁক হল ৷
আনন্দ তার৷
সেইমুহূর্তে চাঁদ প্রাণ ও প্রাণহীনে পূর্ণ স্পর্শ দিচ্ছে ৷
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র