আত্মপ্রত্যয়ী, বিবেকী বন্ধু

এ বছর সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মশতবর্ষপূর্তি পালিত হচ্ছে সাড়ম্বরে, কত জায়গায়। সদ্যপ্রয়াতা আমার অনেক দিনের বন্ধু স্বপ্না দেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তথা বন্ধুত্বের উপর কোথাও যেন সুকান্তের স্মৃতি-ছায়া ছড়িয়ে ছিল। সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক পত্রে— প্রথমে ‘জনযুদ্ধ’, পরে ‘স্বাধীনতা’য় ছোটদের পাতা ‘কিশোর সভা’র সম্পাদনা করতেন; পাশাপাশি ‘কিশোর বাহিনী’ নামে কমিউনিস্ট পার্টির একটি কিশোর-সংগঠনের পরিচালকও ছিলেন। সুকান্তের মৃত্যুর পর দেশভাগ, পার্টির উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার ঝড়ঝাপটা-দুর্যোগ কাটিয়ে পার্টি যখন আবার সম্পূর্ণ সক্রিয়, তখন ‘কিশোর সভা’ ও ‘কিশোর বাহিনী’র পুনরুজ্জীবনে একটা জটিলতা এসেছে।

আগে লেখালিখির ক্ষেত্র ও সংগঠনের যে-স্পষ্ট বিভাজন ছিল, তাতে ব্যত্যয় ঘটিয়ে পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ‘কিশোর সভা’র পাঠক-পাঠিকাদের নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ‘কিশোর সভা’র স্থানীয় সংগঠন তৈরি করে সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের চল হবে। ‘কিশোর সভা’ ও ‘কিশোর বাহিনী’র মধ্যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হয়ে যায় সঙ্গে-সঙ্গে।

আরও পড়ুন: অবিচল থেকে সাংবাদিকতা করার স্বপ্ন ছিল স্বপ্না দেব-এর! লিখছেন যুধাজিৎ সেনগুপ্ত…

আমি তখন— সময়টা যতদূর মনে পড়ে, ১৯৫৭-’৫৮ হবে— ‘কিশোর সভা’র তৎকালীন বিভাগীয় সম্পাদক অমরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সহকারী রূপে তাঁর সঙ্গে গিয়ে বেথুয়াডহরি, নৈহাটি, আতপুর, জগদ্দল, দমদমে ‘কিশোর সভা’র শাখা উদ্‌বোধন করে বেড়াচ্ছি। এই বিভিন্ন শাখার গুণী কিশোর-কিশোরী শিল্পীদের নিয়ে বছরে একবার শেয়ালদার ক্লেম ব্রাউন ইন্সটিটিউট হলে আমরা একটা বার্ষিক অনুষ্ঠানও নিয়মিত করে থাকি।

‘প্রতিক্ষণ’ বইচাঘরে যুধাজিৎ সেনগুপ্ত, স্বপ্না দেব ও শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়

তারই মধ্যে একবার মনে আছে, সুকান্তের ‘অভিযান’ নাটকে আমিও অভিনয়ে নেমে পড়েছি— আমিও তো কিশোরই তখনও, সতেরো-আঠেরো বছর বয়সে কলেজ পড়ুয়া— রাজার ভূমিকায়— জীবনে আমার সেই শেষ মঞ্চাভিনয়! সেই সন্ধ্যার শেষ সেই অনুষ্ঠানের শেষে আমারই বয়সিনি এক কিশোরী সোজা মঞ্চে উঠে এসে আমাকে বললেন, স্পষ্ট ধারালো উচ্চারণে, ‘আমাদের কিশোর বাহিনীর প্রোডাকশন আপনাদের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছিল। তবে আপনার অভিনয় আমাদের রাজার চেয়ে ভাল।’

সরাসরি বিচারশীল, নিঃসংশয়ী উচ্চারণের সেই স্পর্ধাই স্বপ্না পরবর্তী জীবনে ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকার চারিত্র্য নির্ধারণে রক্ষা করে গিয়েছিল। একটা গণতন্ত্রচেতন সমাজে ‘প্রতিক্ষণ’-এর সেই প্রয়োজনীয় ভূমিকার অভাব লক্ষ করে ভাবি, একটা দেশ বা সমাজ যখন স্বার্থান্ধ আত্মাবমাননা-আত্মসমর্পণের গড্ডলিকা-প্রবাহে ক্রমশই পঙ্কে নিমজ্জিত হতে থাকে, তখন যেমন সেই ‘প্রতিক্ষণ’-এর জন্য নিষ্ফল বিলাপ করি, আর আত্মপ্রত্যয়ী বিবেকী বন্ধু স্বপ্নাকে শেষ নমস্কার জানাই।

ছবি ঋণ:প্রতিক্ষণ