হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল : পর্ব ৪৪

Representative Image

স্মৃতির কয়লা

কয়লার উনুন জিনিসটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমার। মনে আছে তার শরীরে লেগে থাকা স্মৃতির টুকরোদেরও। এমন একটা বয়স তখন, যা দেখি, তা-ই জায়গা করে নেয় মনের মধ্যে। এখনই বরং স্মৃতি বেশ দুর্বল, গতকাল বা পরশু দেখা ঘটনাও আবছা হয়ে আসে। হয়তো কয়লার উনুনের ধোঁয়াই তাকে আবছা করে দেয়, সেই ছোটবেলার উঠোন থেকে উঠে এসে। নইলে তো আর কোনও কারণ দেখি না।

আমরা যখন লেক গার্ডেন্স থেকে উঠে গড়িয়ার ভাড়া বাড়িতে চলে এলাম, তখন আমার বেশ ভালরকম ছোটবেলা চলছে। একটাও ফুলপ্যান্ট নেই ট্রাঙ্কে, মারাদোনাকে তখনও কেউ চেনে না। গ্যাস ওভেন জিনিসটা কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে বটে, কিন্তু চাক্ষুষ করেনি কেউ। ফ্রিজ বা টেলিফোন যাদের বাড়িতে আছে, তারা বেজায় বড়লোক। শ্রেণিশত্রুও হতে পারে এমনকী।

হারিয়ে যাওয়া ভাঙা বাড়ির লাইব্রেরি, জমে আছে স্মৃতিতেই…
শ্রীজাত কলমে ‘হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল’ পর্ব ৪৩…

টেলিভিশন আসছে বাজারে, দু-তিন পাড়ায় একটা বাড়িতে হয়তো সে-জিনিস এসেছে বড়জোর। এইরকম এক প্রাগৈতিহাসিক মধ্যবিত্ত পৃথিবীতে উনুন ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী। এক-দেড়হাত একখানা বস্তু, কিন্তু হেঁশেলের মালিকানা তারই দখলে। উপরে কয়লা দেবার জায়গা, আর নীচে একটা ছোট্ট মতো গুহামুখ, হাতপাখার হাওয়া যার গায়ে লেগে আগুনকে চাড় দিয়ে তোলে বারবার।

সত্যি বলতে কী, বর্ণনা দিয়ে উনুন বোঝাতে হবে, এমন দিন কখনও আসবে বলে ভাবিনি। আমাদের যে বাড়িখানা, ভাড়া বাড়িই, কিন্তু তাকে আমাদেরই করে নিয়েছিলাম আমরা, তার মূল ঘরদোর আর রান্নাঘরের মধ্যে ছিল এক ছোট্ট উঠোন, যার একমাত্র সঙ্গী একটি টিপকল। এ-জিনিসও এখন শহরে দেখি না কোথাও। সেই উঠোন পেরিয়ে ঢুকতে হত রান্নাঘরে। সেখানে টিনের ছাদ, বৃষ্টিতে রান্না হবার সময়ে ফোড়ন আর ফোঁটার শব্দ মিলেমিশে ঝালা তোলে। রান্না বসানোর আগে, উনুন তৈয়ার করা ছিল এক মস্ত ব্যাপার। তার জন্য যথেষ্ট জুত আর তরিবত লাগত, খানিকটা টিকে তামাক দিয়ে হুঁকো তৈয়ার করবার মতোই। আগুন একটু যত্ন চায়, জ্বলে ওঠবার আগে।

এখানে বলি, সকাল আর সন্ধে, দু’দফা রান্না হত আমাদের বাড়ি। সকলের বাড়িতেই হত তেমন, কেননা ফ্রিজ ব্যাপারটা ছিল না বিশেষ। তাছাড়া এবেলার খাবার ঠান্ডা যন্ত্রে পুরে রেখে ওবেলা বার করে এনে আবার খাওয়া যায়, বা এমনকী একই খাবার আজ খেয়ে আবার পরদিন গরম করে খাওয়া যায়, এসব ধারণা ভারী ত্যাজ্য ছিল তখন। খাবার হবে টাটকা, গরম। যখন খাওয়া, তারই আগে আগে রান্না হবে। এই ছিল ভাবনা বা নিয়ম।

এখন উনুন তো আর এমনি-এমনি জ্বলবে না, তার জন্য জ্বালানি চাই। অর্থাৎ, কয়লা চাই। এখানে একটি বিষয়ে কথা বলা দরকার, কয়লার পোশাকি নাম ছিল ভারী অদ্ভুত। ‘গুল’। আমরা বাংলায় গুল বলতে সাধারণত বানিয়ে বলা কথাকেই বুঝি, কিন্তু কয়লার যেসব ছোট-ছোট গোলাকৃতি টুকরো দিয়ে উনুন সাজানো হত, তাকেও কে জানে কেন গুল বলেই ডাকা হত। এই গুল পাওয়া যেতে পারত দু’ভাবে। এক, হাট বা বাজার থেকে কিলো দরে কিনে আনা। কিন্তু তাতে পড়তায় একটু বেশিই পড়ত। তাই অনেকে গোটা কয়লা কিনে বাড়িতেই গুল বানিয়ে নিতেন। এটা আমাদের বাড়িতেও ঘটত। আর এই পর্যায়টা দেখতে আমার দারুণ লাগত।

একজন বিক্রেতা ছিলেন, যিনি বাড়ি-বাড়ি কয়লা বিক্রি করতে আসতেন। তোবড়ানো এক দাঁড়িপাল্লায় মেপেজুকে বস্তা করে নামিয়ে রেখে যেতেন আমাদেরও উঠোনে। সেই গোটা কয়লাকে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে গুঁড়ো-গুঁড়ো করে নেওয়া হত মস্ত একখানা পাত্রে। তারপর তাতে পরিমাণমতো জল মিশিয়ে ঘন থকথকে একটা মিশেল করে হাত ডুবিয়ে অনেকক্ষণ মাখা হত। সেই মিশেল যখন ফেটানো বেসনের মতো মিহি আর মসৃণ হয়ে আসত, তখন উঠোনের গায়ে সার-সার খবর কাগজ পেতে, সেই মিশেলের ছোট-ছোট গোল্লা পাকিয়ে শুকোতে দেওয়া হত। ঠিক যেভাবে বড়ি শুকোতে দেওয়া হয়, সেইভাবে। এ-জিনিস আমার কাছে শিল্পের চেয়ে কিছু কম ছিল না। কয়েকটা টাকা বাঁচানোর জন্য এই যে সহজ আর সৎ পরিশ্রম, এও কি শিল্পের চেয়ে কম কিছু? মনে হয় না।

আমাকে এ-ধরনের কাজে নেওয়া হত না, বয়স কম বলেই। কিন্তু একটা অধিকার আমি আদায় করেছিলাম, তা হল শুকিয়ে যাবার পর গুল তুলে একের পর এক চুবড়িতে সাজিয়ে রাখা। এর মধ্যেও এক অদ্ভুত আনন্দ ছিল। একটা জিনিস, যা সকালে ছিল কয়লার চাঙাড়, দুপুরে হয়ে গেল এক গামলা কালো পায়েস, সন্ধের মুখে তারাই দিব্যি কৃষ্ণকায় ডিম্বাকৃতি জ্বালানি বিশেষ। এই গোটা প্রক্রিয়াটা বারেবারে আমাকে অবাক করে দিত। আজও ভাবলে একইরকম অবাক লাগে বৈকি।

এই গুল একের-পর-এক কয়লার মুখে সাজিয়ে, নীচ থেকে আগুন দিয়ে হাতপাখার হাওয়ায় তার আঁচ যখন তোলা হত, তখন ভারী আর ছাই রঙের এক চোখজ্বালানিয়া ধোঁয়া আমাদের উঠোন পার করে চলে যেত দূর-দূরান্তে। কখনও সকালে, কখনও সন্ধের মুখে। তার সঙ্গে মিশে যেত দূর কোনও কারখানার সাইরেনের আওয়াজ বা পাশের বাড়ির শাঁখ। এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে উনুনের মোটা ধোঁয়া উঠে আকাশ কালো করে জানান দিত, সবার বাড়ি রান্না চড়েছে। আমরা সেই চোখ জ্বালা নিয়েই স্কুলের দিকে রওনা হতাম, বা খেলার মাঠ থেকে ফিরে পড়তে বসতাম। এত অঙ্গাঙ্গী ভাবে জুড়ে থাকা একটা কিছু যে আস্তে-আস্তে প্রত্নতাত্ত্বিক আলোচনার শোভা হয়ে উঠবে, তা আর জানতাম কই। ইদানীং চোখ জ্বালা করলে বুঝি, পুরনো কোনও ধোঁয়া আজও চোখের ভাতর আটকে আছে, পালিয়ে যেতে পারেনি।

ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র