ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আমফান, ইয়াস এবং...


    শ্যামল চক্রবর্তী (June 12, 2021)
     

    গ্রামের নাম হরিণহুলা। মিনাখাঁ ব্লকের মধ্য মোহনপুরে মেডিক্যাল ক্যাম্প শেষ করে ফিরছি বাসন্তী হাইওয়ের দিকে। থেমে গেল ভ্যান। সামনে রাস্তার ওপর দিয়ে বইছে জোয়ার। নেমে হাঁটছি সবাই। ভূমিপুত্রদের দরিদ্র গ্রাম। তিন দিদি মিলে উঁচু জায়গায় বড় একটা ঘরে দুশো জনের ভাত-তরকারি রাঁধছেন। যৌথ রান্নাঘর। একটু দূরে ভেসে যাওয়া পুকুরে দাপাদাপি করছে বালকের দল। দুই শিশু গামছা পেতে মাছ ধরার খেলায় মেতেছে।

    ফিরে পেয়েছি শৈশব। মা বলছেন, সবাই মিলে বসে ভাগ করে খেয়ে নে। গ্রামের লোকজন বলছেন, আমাদের সঙ্গে চাট্টি ডালভাত খেয়ে যান। মাতৃভূমি এভাবেই বারবার ভিজিয়ে দিয়েছে আঁখিপল্লব, ছেলেবেলা থেকে বিশ সালের আমফানে। সুন্দরবনে ত্রাণকাজে সব যন্ত্রণা কখন যে বদলে গেছে আনন্দের উথাল জোয়ারে! গতবার আমফানে বাহান্নটা মেডিক্যাল ক্যাম্প আর একত্রিশটা যৌথ রান্নাঘর চালিয়েছে সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতাল। চাল জুগিয়েছিল সরকারি রেশন। বিন্দু-বিন্দু দানে-অনুদানে ওষুধ, ডাল, সবজি, সয়াবিন, ডিম, তেল, মশলা, কুঁচো  চিংড়ির অভাব হয়নি কোনওদিন। রাজরাজেশ্বরী নাই বা হলেন, মা আমাদের সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। শুধু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্রান্তিকালে সবাই মিলে লড়াইটা করতে জানলে আয়লা-আমফান-ইয়াস, কেউ হারাতে পারে না বাংলাকে।

    বাউনিয়া গ্রামটাকে মডেল বানিয়েছিলাম আমরা। মেয়েরা রাঁধবে কমিউনিটি কিচেনে। পুরুষরা বাজার করে দিয়ে হাত লাগাবে ভাঙা ঘর, বাঁধ, রাস্তাঘাট পুনর্নিমাণে। এবার ইয়াসেও তাই। মেডিক্যাল ক্যাম্প সেরে গ্রামের লোকের সঙ্গে গোল হয়ে বসে মিটিং। ওরা বলছেন, আমরা শুনছি। কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া নয়, সবাই মিলে গ্রাম পুনর্গঠনের স্বপ্ন। জল  নামছে দ্রুত। ডুবে যাওয়া নলকূপগুলো ভেসে উঠতেই ব্লিচিং পাউডারের দ্রবণ বানিয়ে জলের উৎসগুলোকে জীবাণুমুক্ত করে ফেলা।

    আমফানে সরকারি জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগ এত সক্রিয় ছিল না। এবার ধামাখালির ঘাটে পি.এইচ.ই.-র  চিফ ইঞ্জিনিয়ারের বিশাল লঞ্চ ঠায় দাঁড়িয়ে। আতাপুর, মণিপুর, ছোটতুষনিয়া ও অন্য অসংখ্য গ্রামে গ্রামে পৌঁছে যাচ্ছে ছোট ট্যাঙ্কে পানীয় জল। স্কুলে, স্টর্ম সেন্টারে দু’বেলা খিচুড়ি। সকালে চিঁড়ে আর আখের গুড়। একটু চেখে দেখলাম একটা রাস্তার মাঝে। এমন মিষ্টি চিঁড়ে আর দানা-দানা ঝোলাগুড় শেষ কবে খেয়েছি মনে পড়ে না।

    ন্যাজাটে ক্যাম্প চলছে গত জুনে। সেই প্রথম স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হচ্ছে গ্রামের মেয়েদের। জরুরি ছিল, কেননা মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন বজায় রাখতে না পারলে পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ বাড়বে নোংরা জলে। সেই শুরু, তারপর থেকে মেডিক্যাল ক্যাম্প হলেই আমাদের দুই মামণি, মধুমিতা-রিয়া ও অন্য মেয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা একটু নির্জনে ওদের হাতে তুলে দেয় প্যাকেট, বুঝিয়ে দেয় ব্যবহারের নিয়ম। এগারো মাস বাদে জলমগ্ন মনিপুর ক্যাম্পে শ’তিনেক রোগী দেখছি আমরা। বন্ধু শাশ্বতী ও অন্যরা দূরে একটা পাকুড় গাছের ছায়ায় মেয়েদের ন্যাপকিন দিচ্ছে, সমস্যা শুনছে ওঁদের।

    আমফানের পর ক্যাম্পগুলোতে বা যৌথ রান্নাঘরে সেভাবে পাশে ছিল না পঞ্চায়েত। এবার ইয়াসের পর প্রথমদিকে ওরা সাহায্য করেছেন। তারপরই কেমন যেন বদলে যাচ্ছে পরিবেশ। অসংখ্য গ্রামীণ যুবক সাহায্য করছেন আমাদের মতো সংস্থাগুলোকে। বাংলা সংস্কৃতির মঞ্চের সামিরুলের দলবল, যাদবপুরের কিউ.এস. ওয়াই.এন.-এর মন্মথরা, এ পি ডি আর, কলকাতা, যাদবপুর আর প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা… অনেক সংগঠন লড়ে যাচ্ছে সুন্দরবন, ঘোড়ামারা, মৌসুনি, সাগর, কাকদ্বীপের ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে।

    না, কোনও সংস্থার এসি গাড়িতে চেপে ক্যাম্প করতে যাই না আমরা! যাই ভটভটিতে নদী পেরিয়ে ভ্যানরিকশায় চেপে। আমফানে কাপড়ের মাস্ক পরতেন, মেডিকেল ক্যাম্পে দেখাতে আসা রোগীরা। এবার কোভিডে ভরসা সার্জিকাল মাস্ক। ইয়াসের ক্যাম্প বা রান্নাঘরে তাই ওই মাস্কই দেওয়া হচ্ছে। বাউনিয়া, মধ্য মোহনপুর, ন্যাজাট, বাউনিয়া… গতবার ক্যাম্প আর রান্নাঘরগুলোতে বাচ্চাদের গুঁড়ো দুধ দিতে পারিনি। এবার কিছু সহৃদয় চিকিৎসক, অধ্যাপক ও অন্য নানা পেশার মানুষের সাহায্য পেয়ে হিঙ্গলগঞ্জের রূপমারি, ধামাখালি-সন্দেশখালিতে ছোট বাচ্চাদের দিন দশেকের দুধ দেওয়া গেল। দুধের প্যাকেট হাতে শিশুদের ফোগলা দাঁতের সে কী হাসি! ভ্যানরিকশার ঝাঁকুনিতে কোমরের কলকব্জার ব্যথা সারিয়ে দিচ্ছে সুন্দরবনের সেই নয়নভুলানো হাসি।

    আমফানের পর ক্যাম্পগুলোতে বা যৌথ রান্নাঘরে সেভাবে পাশে ছিল না পঞ্চায়েত। এবার ইয়াসের পর প্রথমদিকে ওরা সাহায্য করেছেন। তারপরই কেমন যেন বদলে যাচ্ছে পরিবেশ। অসংখ্য গ্রামীণ যুবক সাহায্য করছেন আমাদের মতো সংস্থাগুলোকে। বাংলা সংস্কৃতির মঞ্চের সামিরুলের দলবল, যাদবপুরের কিউ.এস. ওয়াই.এন.-এর মন্মথরা, এ পি ডি আর, কলকাতা, যাদবপুর আর প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা… অনেক সংগঠন লড়ে যাচ্ছে সুন্দরবন, ঘোড়ামারা, মৌসুনি, সাগর, কাকদ্বীপের ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে। আর.জি. করের ডাক্তার নীলাঞ্জন আর দ্বৈপায়নের আই.এম.এ.-র মেডিক্যাল টিম কাজ করে এসেছে দুর্গম সাগরদ্বীপ থেকে।

    নওজোয়ান জুনিয়র ডাক্তাররা তাগাদা দিচ্ছে প্রায়ই। মৌসুমী, বনি, দীপাঞ্জন আমার সঙ্গে ক্যাম্প করে এল মণিপুরে। আম্ফানে তুহিন, ওবাইদুল্লা, নন্দিনী ক্যাম্প করেছে একের পর এক। এই মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলো ওদের অনেক কিছু শেখায়। গ্রামে কাজ করলে, বিশেষ করে ক্রান্তিকালে একদিনে শেখা যায়, একমাসের কাজ।

    গতবার আমফানের পর হাজারখানেক সুন্দরী, হেঁতাল, গরান ও অন্য গাছ লাগিয়েছিলাম আমরা, সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতালের বন্ধুরা। অর্ধেক বেঁচে আছে। আর একটা কোটাল সামনেই। সরকার প্রস্তুত। আমরাও। ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে সবটুকু শক্তি দিয়ে। আমরা সরকারি হাসপাতালের সব কাজ শেষ করে ত্রাণে সরকারি স্বাস্থ্যর বিকল্প নয়, পরিপূরক হিসেবে কাজ করি।

    হাজার-হাজার প্লাস্টিকের প্যাকেট, পাউচ, থার্মোকলের থালা ভাসছে ইছামতী, কালিন্দী, বিদ্যাধরীর জলে… নিকাশি-নালাগুলো পরিষ্কার করতে গিয়ে শুধু চিকচিকি আর প্লাস্টিকের কাপ… হিঙ্গলগঞ্জের বাকড়া ক্যাম্পে সন্ধ্যা সাতটাতেও রোগী দেখে যাচ্ছি ওবাইদুল্লা আর আমি… 

    সোলার আলো ধরে আছেন কনকনগর স্কুলের হেডমাস্টার পুলক… নবি এসে বলে যাচ্ছে, অনেক ওষুধ আছে, প্রেসারের ওষুধ একমাসের দিয়ে দিন… ফেরার পথে  নৌকায় উঠে আসা এক ছাত্র মাউথঅর্গান ছোঁয়াচ্ছে ঠোঁটে… পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা… গেয়ে উঠছি  আমরা… তখন এ গান, তুলে তুফান নবীন প্রাণের প্লাবন আনে দিকে দিকে… মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দিনান্তের অপার্থিব সূর্য ন’দিকে সাক্ষী রেখে স্তব্ধ হয়ে শুনছে আমাদের সুর আর গানের সেই ঐকতান।  

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook