নীলা-নীলাব্জ: পর্ব ১৮

Representative Image

পোশাক, সমাজ, বৈষম্য

নীলা একটা সুইমিং কস্টিউমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ গেয়ে ওঠে— আমার শহরে সাঁতার শিখতে চেয়ে…

নীলা: না, আমি রাজধানী থেকে আসিনি।

নীলাব্জ: সাঁতার কাটবে?

নীলা: এই যাও তো এখান থেকে! আবার জ্বালাতে এলে?

নীলাব্জ: আরে কী যে বলো, আমি সাহায্য করতে পারি তোমাকে… কোনটা নেবে বলো? ওই সবুজটা দারুণ মানাবে তোমাকে…

নীলা: আমি কি টু-পিস পরে পুরীর সমুদ্রে নামব? তুমি কি উন্মাদ?

নীলাব্জ: পুরী কেন? ইউরোপ যাও! ফ্রান্স কিংবা ইতালি! মেডিটেরেনিয়ানের অদ্ভুত নীল জলে স্নান করে উঠে এসে, সৈকতে বসে স্ট্র দিয়ে চুকচুক করে আনারসের সরবত খাবে।

নীলা: টাকা নেই এসব করার। তুমি কি ট্যুরিজম খুলেছ না কি?

এইসব আলোচনার মধ্যেই একজন তরুণী বেশ খোলামেলা পোশাকে প্রবেশ করে দোকানটিতে। দু’জনেই কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর দোকানটাকে পেছনে রেখে হাঁটতে শুরু করে।

নীলা: এর আর সুইম-ওয়্যার কেনার কী দরকার…পরেই তো ঘুরছে।

আরও পড়ুন: সরকার কি নিজের প্রোপাগান্ডা সিস্টেম বানিয়ে দেবে সমাজমাধ্যমকে? লিখছেন অনুপম রায়…

নীলাব্জ: না, আসলে সুইম-ওয়্যার সুতির হয়না। এমন কাপড়ের হয় যাতে জল…

নীলা: থাক! আর ওকালতি করতে হবে না মেয়েটার হয়ে! তোমার নিশ্চয়ই দারুণ লেগেছে, না?

নীলাব্জ: লাজুক হাসে— এই নীরস জীবনে যদি একট টুকরো কবিতা টুকি দিয়ে যায়, মন্দ কী?

নীলা মুখ ঝামটা দেয়— ঢং! অন্য মেয়েরা ছোট জামা পরলে তোমাদের, মানে ছেলেদের দারুণ লাগে কিন্তু বউ বা প্রেমিকা পরলেই ব্যাস! ঘোরতর আপত্তি!

নীলাব্জ: যাস্‌শালা! আমার তো বউ বা প্রেমিকা কিছুই নেই!

নীলা: তাতে কী? তুমি তো ওই শরীর দেখানো পোশাকের পক্ষে, তাই না?

নীলাব্জ:  আহ! মানুষের যা ইচ্ছে তাই পরতে দাও না, তোমার কী? তুমিও তো সুইমিং কস্টিউম কিনতে গিয়েছিলে…

নীলা: না, আমি একটা শর্টস কিনতে গেছিলাম। পুরীতে এসব পরা যায় না।

নীলাব্জ: বুঝেছি, তার মানে তুমিও পরতে চাও কিন্তু লোকলজ্জায় পরতে পারছ না, তাই তোমার রাগ।

নীলা: কাঁচকলা বুঝেছ! আমি সুইমিং কস্টিউম পরে কলকাতার রাস্তায় মোটেও ঘুরে বেড়াতে চাই না। ওটা সমুদ্রের ধারেই মানায়। কিন্তু সব সমুদ্র না। যেখানে মানুষ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, সেখানে ওসব পরা যায় না। এই দেশে অসম্ভব।

নীলাব্জ: আহ্‌, মানুষ কি তাকাবে না? যাতে সুন্দর দেখায় তাই জন্যই তো পরেছ, তাকালে দোষ?

নীলা: তাকালে দোষ না… কীভাবে তাকাচ্ছে সেটা ম্যাটার করে। এমন তাকাল যে, আমার ভয় করল বা আমার অস্বস্তি হল, সেটা আমি সহ্য করব কেন?

নীলাব্জ: তাহলে যার অস্বস্তি হচ্ছে না, তাকে পরতে দাও। তোমাকে পরতে তো কেউ বাধ্য করে নি রে বাবা!

নীলা: না, না এটা একটা সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌনতা প্রদর্শন। আগেকার দিনে তো এরকম ছিল না।

নীলাব্জ: আগেকার দিনে তো মানুষ কিছুই পরত না… গাছের পাতা-ফাতা দিয়ে ঢাকত…

নীলা একটু অবাক হয়— উফ! অত আগেকার কথা বলছি না।

নীলাব্জ: তাহলে কত আগেকার কথা বলছ? তোমার রেফারেন্সটা কী?

নীলা: তুমি সেয়ানা, ন্যাকা সাজছ। ভাল-ই বুঝেছ আমি কী বলতে চাইছি। কী পাচ্ছে শরীর দেখিয়ে মেয়েগুলো?

নীলাব্জ: মনোযোগ পাচ্ছে। তোমার জ্বলছে?

নীলা: মুখের দিকে তাকানো যায় না, শরীর একটু ফাঁক করে মনোযোগ দেখাচ্ছ? এটা বেশ্যাবৃত্তি নয়? কোনও পুরুষকে তো এটা করতে হচ্ছে না?

নীলাব্জ: এটা পুরুষদের কারেন্সি নয়। তবে যৌনতা পুরুষরাও বিক্রি করে।

নীলা: শোনো, এগুলো সব পুরুষদের তৈরি করা চক্রান্ত। বিদেশের সিনেমা বা গানের অনুষ্ঠানগুলো দেখবে। পুরুষগুলো সব কোট-টাই পরে ঘুরছে আর মেয়েগুলোকে দিয়েছে সব খোলামেলা পোশাক। কেন? নিজেরাও তাহলে ল্যাঙ্গোট পরে ঘোর!

নীলাব্জ: ইশ! কী বিশ্রী লাগবে!

নীলা: চুপ করো! গায়িকাগুলোকে দেখবে বিদেশের। পারলে ন্যাংটো করে স্টেজে তুলে দেয়। প্রথম দুটো ক্যাসেট জামা কাপড় পরেই করে, তারপর মার্কেট ধরে রাখতে বা উন্নতি করতে জামা কাপড় খুলতে হয়। না খুললে পিছিয়ে পড়বে, কারণ সবাই খুলছে, এই তো লজিক? কই? আমাদের লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়-কে তো খুলতে হয়নি…

নীলাব্জ: ইশ! বলো না এভাবে! আমি ভাবতেই পারছি না!

নীলা: তাহলে?

নীলাব্জ: শিল্পের ক্ষেত্রে এখানে গান শুধু গান নয় আর। তার সঙ্গে মিশে আছে আর্টিস্টের স্টাইল স্টেটমেন্ট।

নীলা: মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা যৌনতা, তাই তো?

নীলাব্জ: কেউ যদি তার যৌনতাকে বেচে তাহলে প্রবলেমটা কী?

নীলা: প্রবলেম নয়? মাতৃস্নেহ, পিতৃ বিয়োগের দুঃখ, সব তাহলে বিক্রি শুরু করে দাও!

নীলাব্জ: ঘেঁটে ফেলছ ব্যাপারটা। আচ্ছা ধরো একটা আইটেম গান। একজন স্বল্পবসনা নারী ঘুরে-ঘুরে নাচছে, তার যৌনতা বিক্রি করছে আর পুরুষরা তা চেটে পুটে খাচ্ছে আর সেই যৌনতার দাসত্ব করছে। এটা পাওয়ার না? তুমি নারীর যৌনতার এই ক্ষমতা দেখতে চাইছ না?

নীলা: না, আমি এই ঢপের ক্ষমতা চাই না। আমি চাই ওই সুট পরা পুরুষটার ক্ষমতা, যে এটা প্রযোজনা করছে। যার টাকায় সেট বানানো হয়েছে, যার টাকায় ওই মেয়েটা নাচছে, পাবলিক হাততালি দিচ্ছে, গান সুপারহিট করিয়ে নিজের ব্যাঙ্কে মুনাফার টাকা তুলছে। তারপর সেই টাকা লগ্নি করে আবার নতুন একটা অর্ধনগ্ন মেয়েকে নাচিয়ে টাকা রোজগার করছে। এটাকে বলে ক্ষমতা।

নীলাব্জ কিছুক্ষণ চুপ থাকে— দেখো নীলা, এই সাজ পোশাক কিন্তু সবই মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সব মেয়েদের যে জোর করে পরানো হচ্ছে, তা কিন্তু নয়…

নীলা: না, না কনস্ট্রাক্টটাই এমন করে ফেলেছে, বোকাগুলো ভাবছে না, পরলে বুঝি বা পিছিয়ে পরবে… কম্পিটিশনে থাকতে পরছে! 

নীলাব্জ: না, না এটার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। যেমন ধরো বডি পজিটিভিটি, নিজেকে এক্সপ্রেস করা…

নীলা: তোমার ভাষায় বলতে গেলে, এগুলো সব বা*র কথা! আর কিছু পারে না নিজেকে এক্সপ্রেস করার জন্য? জামা খুলে খুলে নিজেকে এক্সপ্রেস করতে হবে? একজন ব্যক্তির যদি অর্থ ছাড়া আর কিছুই না থাকে নিজেকে এক্সপ্রেস করার, সে তো অবশ্যই গরীব। আর কীসের ঘোড়ার ডিমের বডি পজিটিভিটি? সব বাজে কথা, নিজের বলদামিকে ন্যায্যতা পাইয়ে দেওয়ার জন্য, বড়-বড় শব্দ আবিষ্কার করেছে।

নীলাব্জ: ভাল দেখতে লাগলে, সাজলে তুমি কনফিডেন্স পাও না?

নীলা: অবশ্যই পাই! কিন্তু বক্ষ বিভাজিকা দেখিয়ে আমার কোনওরকম কনফিডেন্স বৃদ্ধি হয় না…

নীলাব্জ: বক্ষ বিভাজিকা যদি কেউ দেখাতে চায়, দেখাক না… সে দেখিয়ে হয়তো কনফিডেন্স পাচ্ছে!

নীলা: মৈনাক ভৌমিকের সিনেমার একটা সংলাপ ছিল, সেই একই তো জিনিস, তাও কী খোঁজো ওখানে?

নীলাব্জ হেসে ফেলে— একই উত্তর… ওই… যদি নতুন কিছু একটা খুঁজে পাওয়া যায়!

নীলা: সেই! শালীনতা বলে কিছুই থাকল না…

নীলাব্জ: সংসদ থেকে কোনও বিল পাশ হয়নি কোনটা শালীন আর কোনটা অশালীন বলে দেওয়ার জন্য। এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। সবার মাপকাঠি আলাদা। তুমি কি চাও সবাই কালো বোরখা পরে ঘুরুক?

নীলা: যাহ্‌! আমি কখন তা বলতে গেলাম? আমি একদম বোরখার বিরুদ্ধে!

নীলাব্জ: তুমি যেটা করছ, সেটাকে বলা যেতে পারে ‘নীলা বোরখা’…

নীলা: এটা আবার কী জিনিস?

নীলাব্জ: এটা হল, তোমার সেট করে দেওয়া একটা স্ট্যান্ডার্ড। বোরখা যদি ১০০% ঢাকা হয়, তোমার ‘নীলা বোরখা’ হল ৭০% ঢাকা। তোমার পাশের বাড়ির সুনীলার মনে হতেই পারে তোমার নিয়মটা ভুল, সে চায় ৬০% ঢাকা। তার তো কোনো অপরাধ নেই এতে। তুমি ওর সমালোচনা করার কে হে? সবার আলাদা-আলাদা স্ট্যান্ডার্ড, সবাইকে সবার মতো থাকতে দাও।

নীলা: কিন্তু তাহলে তাকালে বলতে পারবে না কিছু। তুমি দেখাবে, কিন্তু দেখলে বলবে কেন দেখছে, তা কী করে হয়? কিছুটা বড়লোকের শো অফ করার মতো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তোমার কোটি টাকার গাড়ি তুমি গ্যারেজে পার্ক না করে বাড়ির বাইরে রাখলে, যাতে লোকে দেখতে পায়। দেখে বুঝতে পারে, তোমার কত টাকা।

নীলাব্জ: হ্যাঁ, আমিও তো তখন তাই বললাম, তাকালে তাকাবে। দামি গাড়ি দেখে বুঝুক তোমার কত টাকা, কিন্তু দেখতে গিয়ে লুকিং গ্লাস খুলে নিয়ে যাওয়াটা কিন্তু অপরাধ।

নীলা: কিন্তু এই লোক দেখানো রুচিটাই তো ভালগার একটা রুচি। বড়লোকের বড়লোকি, রূপবতীর শরীর— এই দেখতে কি আমরা এসেছি পৃথিবীতে?

নীলাব্জ: এখানে একটা পয়েন্ট, শরীর দেখাতে গেলে, রূপবতী হওয়ার প্রয়োজন নেই… এখানেই আসে বডি পজিটিভিটির ব্যাপারটা…

নীলা: ওই এক ঢপের কথা… যাও গিয়ে তাহলে বিপুলাদের বেলি ড্যান্স দেখো! কিন্তু তা না, দেখবে সেই নোরা ফাতেহি-রই! আর মুখে যত বড়-বড় কথা।

নীলাব্জ: এই রে, এবার তো বডি শেমিং করছ! তুমি শরীর ব্যাপারটা ঠিক বোঝো না…

নীলা: এবার কী? শরীর বোঝাতে আসবে আমাকে?

নীলাব্জ: না মানে, আমি তা বলতে চাইনি …

নীলা: ফা* অফ নীলাব্জ!