সংবাদ মূলত কাব্য : পর্ব ১৫

মিছিল থেকে মেলা

চৌরঙ্গীর রাস্তা ধরে পথচারী ও যানবাহন যাত্রীদের হকচকিয়ে দেওয়া চমকপ্রদ জনা-কুড়ি মানুষজনের ওই মিছিল  কাদের? জরুরি অবস্থার ভেতরে কোথায় চলেছে তারা? কী উদ্দেশ্য মিছিলের?

আমি ছিলাম এই মিছিলে একজন, তাই বলছি, সবই বলছি। ওই যে ঘণ্টা, হাতুড়িতে পিটিয়ে ঢং-ঢং বাজাতে-বাজাতে চলেছে তরুণটি, তার নাম অলকেশ ভট্টাচার্য, তখনও তার ‘বরফটিলার স্টেশন’ নামে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়নি।  এই অলকেশ আর ঘনশ্যাম দাস, যিনি পরবর্তীকালে সোমক দাস নামে কবিতা ও গল্প লেখার জন্য সুপরিচিত, তারা দু’জন বেলতলা গার্লস স্কুলের পাঁচিল টপকে ঘণ্টা ও হাতুড়িটি চুরি করে নিয়ে এসেছে। তাদের ওই ঘণ্টা ও হাতুড়ির সন্ধান দিয়ে পাঁচিলের ওপাশে রাস্তায় পাহারায় ছিলেন তখনকার নামী লিটল ম্যাগাজিন ‘আত্মপ্রকাশ’-এর সম্পাদক সমরেন্দ্র দাস। ঘরাঞ্চিটি অবশ্য ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে দমকলের সদর দপ্তর থেকে ফেরত দেওয়ার কড়ারে কালীকৃষ্ণ গুহ দিয়েছিলেন, তিনি তখন দমকলের অধিকর্তা। পোক্ত কাঠের মস্ত ওই ঘরাঞ্চি বইতে লেগেছিল ভাড়া করা লোক কয়েকজন। দমকল অফিস থেকেই শুরু ওই মিছিল। রবীন্দ্রসদন অভিমুখে। রবীন্দ্রসদনের বিপরীতে এখন যেখানে মোহরকুঞ্জ, সেখানে ছিল একটি মাঠ। ১৯৭৬ সালের মার্চের সেই মাঠেই হয়েছিল প্রথমবারের বইমেলা। গিল্ড আয়োজিত সেই বইমেলার জন্যই ঘরাঞ্চি আর ঘণ্টা নিয়ে যাচ্ছিল ওই মিছিল।

আরও পড়ুন: সংবাদে সেন্সর ব‍্যবস্থা বসানো হয়েছিল জরুরি অবস্থার পয়লা দিনটি থেকেই! মৃদুল দাশগুপ্তর কলমে সংবাদ মূলত কাব্য পর্ব ১৪…

অলকেশ আর ঘনশ্যাম ওরফে সোমক— আমার দুই বন্ধুই অকালপ্রয়াত। তাদের পেছনে, মিছিলে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে হাঁটছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী আর পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। একবার সামনে গিয়ে, একবার পিছনে ঘুরপাক দিচ্ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তুষার রায়-ও মহা উৎসাহে মিছিলের এদিক-সেদিক ঘুরছিলেন। ‘আরও লিটিল ম্যাগাজিন পড়ুন’ প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে অতি উৎসাহে ছিল সন্দীপ, তখন সদ্য-গড়া লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা সন্দীপ দত্ত-ও ঘুরছিলেন মিছিলে। তাঁরাও আর কেউ নেই। গৌতমের ‘অভিমান’ পত্রিকা, সমরেন্দ্র দাসের ‘আত্মপ্রকাশ’, ধূর্জটি চন্দ-র ‘এবং’ পত্রিকায় তখন আমাদের কবিতায় হইহুল্লোড়। ছিলেন তাঁরা।  রবীন্দ্রসদনের কাছে গিয়ে দেখলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তারাপদ রায়ও এসেছেন। কবিতা সিংহও চলে এসেছেন আকাশবাণী থেকে।

পাবলিসার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড আয়োজিত ওই প্রথম কলিকাতা পুস্তকমেলা নিয়ে তাহলে কিছু কথা বলতে হয়। ঘোর জরুরি অবস্থার হাঁসফাঁসের ভেতরে ১৯৭৫ সালে পুজোর পর, কলকাতার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে বসে কয়েকজন প্রকাশক কিছু একটা করার বাসনায় গড়ে ফেলেন পাবলিসার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড। গিল্ডের সভাপতি হন সুশীল মুখোপাধ্যায়। এরপর তাঁরা কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে বইপত্রের প্রদর্শনী করেন। তখনই ভাবনা আসে কলকাতার ময়দানে একটি বইমেলা করার। ১৯৭৬ সালের গোড়ায় বইমেলা করার বিষয়টি দানা বেধে ওঠে। গিল্ডের প্রকাশকরা লেখক-কবিদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। প্রবল উৎসাহী হয়ে ওঠেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, হিমানীশ গোস্বামী, অমিতাভ দাশগুপ্ত, তারাপদ রায়রা। আমার মনে আছে, প্রথমবারের বইমেলার প্রস্তুতির সময়ে কফি হাউসে সন্ধ্যায় ঘুরে-ঘুরে গিল্ডের বাদল ধর, সুপ্রকাশ বসুরা সবার সহযোগিতা চাইতেন। যেন তাঁদের মেয়ের বিয়ে। সে-সময়ে আমাদের অল্প বয়স, আমরা মেতে গিয়েছিলাম।

রবীন্দ্র সদনের উলটোদিকে তখনকার মাঠে জমজমাটভাবে জরুরি অবস্থাকে যেন তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে ১৯৭৬-এর ৫ মার্চ শুরু হয়েছিল গিল্ড আয়োজিত প্রথম কলিকাতা পুস্তকমেলা। গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত, জ্যোতির্ময় দত্ত তখনও ছিলেন জেলে। তাতে কী, নিষিদ্ধ ‘কলকাতা’ পত্রিকার জরুরি অবস্থা বিরোধী সংখ্যাটি ইতিউতি ওই বইমেলায় গোপনে বিক্রি হয়েছিল। ঘণ্টা বাজিয়ে তৎকালীন রাজ্যপাল এএল ডায়াস উদ্বোধন করেছিলেন ওই বইমেলা। মেলায় যোগ দিয়েছিল ৩৪টি প্রকাশনা সংস্থা, বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন, ইত্যাদি। মেলা চলেছিল ১৪ মার্চ পর্যন্ত। ঘরাঞ্চিটিকে শিল্পী প্রকাশ কর্মকারের পরামর্শে চটজলদি ধবধবে সাদা রং করে দেওয়া হয়েছিল। মেলার প্রতিদিনই বিকেল গড়ালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ঘণ্টা বাজিয়ে সমাগত কবিদের একে-একে নাম ধরে ডাকতেন। ঘরাঞ্চির কয়েক ধাপ, ইচ্ছুকদের টঙে তুলে তাদের কবিতাপাঠ হত। ওই ঘরাঞ্চির পায়া ধরে থাকতেন কয়েকজন। আমাকে টঙে উঠিয়ে দিয়েছিলেন তুষারদা। আমি পড়েছিলাম, সে-সময়ে ‘কৃত্তিবাস’-এ (এখনকার জাল ‘কৃত্তিবাস’ নয়) প্রকাশিত ‘ভারতবর্ষ’ কবিতাটি। ‘ভারতবর্ষ থেকে ভারতবর্ষের দিকে পাখি উড়ে যায়।’ ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ বইতে কবিতাটি আছে। তারাপদ রায়কে কিছুতেই ঘরাঞ্চির এক ধাপ উঠতেও রাজি করানো যায়নি।  নীচে দাঁড়িয়েই তিনি পড়েছিলেন, ‘নীল দিগন্তে এখন ম্যাজিক…’

একটা কথা, এখন, বিশেষভাবেই বলব, ওই বয়সেই নজর করে দেখেছি, ওই প্রথমবারের বইমেলায় অতি উৎসাহে আমাদের সমবয়সি তরুণী মেয়েরা এসেছিলেন বাঁধনহারা স্রোতের মতো, ঝাঁকে-ঝাঁকে। কবিরা তাঁদের করতালি পেয়েছিলেন।

১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার বছর ঘুরতে একদিন তা শিথিল হল, সরকারি ঘোষণাতেই। রাজনৈতিক দলগুলির নড়াচড়া শুরু হল। ওইরকমই সময়ে ইন্দিরা-র মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসে জগজীবন রাম ‘কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি’ দল গড়লেন। চন্দ্রশেখর, রামবিলাস, অরুণ নেহরু এই তরুণ নেতৃবৃন্দ ইন্দিরার বিরুদ্ধে মুখ খুলছিলেন। ভারতীয় রাজনীতিতে ‘তরুণ তুর্কি’ কথাটির তখন খুব চল হয়েছিল। এরপর ১৯৭৭-এর গোড়া থেকেই রটল ভোট আসন্ন। শুনেছিলাম, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আশ্বস্ত করেছিলেন, অবিলম্বে নির্বাচন ডাকা হলে ইন্দিরা জিতবেন। লোকসভা নির্বাচন ডাকা হল ১৯৭৭ সালের ১৬ মার্চ। এই ভোটের আগেই জয়প্রকাশের তৎপরতায় বিরোধী নেতৃবৃন্দ ১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে তাঁদের জনতা মোর্চা, সংগঠন বা আদি কংগ্রেস, জনসংঘ, সমাজতান্ত্রিক দল, লোকদল একসঙ্গে মিলে জনতা পার্টি গড়ে তুললেন। ১৯৭৭ সালে ভারতব্যাপী মুক্ত বাতাসের ঢেউ তুলে নবগঠিত জনতা পার্টির কাছে হেরে গেল কংগ্রেস। নিজের কেন্দ্র উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলিতে রাজনারায়ণের কাছে হেরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দু’বছর আগে ১৯৭৫ সালে এই রায়বেরিলিতেই সেবারের ভোটে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পরাজয়কে চ্যালেঞ্জ করে এলাহাবাদ হাইকোর্টে রাজনারায়ণের তরফে যে পু্নর্গণনার আবেদন করা হয়েছিল, তাতে হাইকোর্ট রাজনারায়ণকে বিজয়ী ঘোষণা করে। তৎকালে জয়প্রকাশের নেতৃত্বে ইন্দিরার তানাশাহির বিরুদ্ধে যে-আন্দোলন চলছিল, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে তা তুঙ্গে ওঠে। এরপরই ইন্দিরা সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে।

১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার বছর ঘুরতে একদিন তা শিথিল হল, সরকারি ঘোষণাতেই। রাজনৈতিক দলগুলির নড়াচড়া শুরু হল। ওইরকমই সময়ে ইন্দিরা-র মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসে জগজীবন রাম ‘কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি’ দল গড়লেন।

১৯৭৭-এর নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২১ মার্চ তারিখে সারা দেশ থেকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করেন। জরুরি অবস্থায় জারি করা নিষেধাজ্ঞাগুলি তুলে নেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, আনন্দমার্গ, সিপিআই (এম-এল) প্রভৃতি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলা হয়।

১৯৭৭-এর ২৪ মার্চ দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন জনতা পার্টি নেতা মোরারজি দেশাই। তিনিই ভারতের প্রথম অকংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী। জনতা পার্টি সরকার এক দুর্নীতির মামলায় ইন্দিরা গান্ধীকে স্বল্পকাল কারাগারে রেখেছিল। মনে পড়ে, উত্তরপ্রদেশের তরুণ দু’ভাই একটি ছোট বিমান ছিনতাই করে ইন্দিরা গান্ধীর মুক্তির দাবিও করেছিল।

সেই যুগে, সারা বিশ্বেই যত্রতত্র বিমান ছিনতাই হত। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এক ফরাসি যুবক সে-দেশের একটি বিমান ছিনতাই করে  ফ্রান্স সরকারকে চাপ দিয়েছিল, এক্ষুনি বাংলাদেশে ব্যাপক ত্রাণ পাঠাতে হবে।