‘বহুরূপী’তে যোগ দেওয়ার অনেক আগে থেকেই ওঁকে চিনতাম। অত বড় মানুষ তাপস সেন— থিয়েটার জগতে ওঁর আলোয় নির্মিত প্রযোজনাগুলির কথা মানুষের মুখে-মুখে ফিরত। আমি ‘বহুরূপী’তে যোগ দিই আটের দশকের মাঝামাঝি। আমাদের যে প্রযোজনাগুলি হত, তার নির্দেশনা দিতেন, কুমার রায়, শম্ভু মিত্র প্রমুখরা। ওঁরা সকলেই বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। তাপস সেনের আগের কথা, কীভাবে উনি কীভাবে থিয়েটার জগতে এলেন, নির্মাণ করলেন নানা ঐতিহাসিক প্রযোজনা— এগুলির ইতিহাস নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেছেন, ভবিষ্যতেও বলবেন। আমি সে-পথে না গিয়ে, অন্য দু’একটা দিকে আলোকপাত করার চেষ্টা করি।
আমাদের একটি প্রযোজনা হত, নাম— ‘পিরিতি পরমনিধি’ পরিচালনায় কুমার রায়, অভিনয় করতেন, গার্গী রায়চৌধুরী, রজত গাঙ্গুলি প্রমুখরা। নাটকটি নিধুবাবুর জীবনালেখ্য কেন্দ্রিক। গার্গী রায়চৌধুরী শ্রীমতির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আলো করেছিলেন তাপসদা।
কুমারদা, তাপসদার মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা হত। এমনই একদিন রিহার্সাল শেষে আমার মনে হল, কোনও একটা জায়গায় ডায়লগ, কম্পোজিশনে কিছু খামতি থেকে যাচ্ছে, আমি তাপসদাকে ডেকে আমার যা-যা মনে হচ্ছিল শেয়ার করলাম। উনি মনোযোগ দিয়ে শুনেই কুমারদাকে ডাকলেন, ‘কুমার, দেবেশ কী বলছে, তুই তো আমাকে এগুলো বলিসনি’— ওঁকে আমার ভাবনাগুলো বললেন এবং সেই অনুযায়ী পরিমার্জন করা হল। উদাহরণটা এই কারণেই দেওয়া, তখন তো আমি একেবারেই নতুন ‘বহুরূপীতে’, কিন্তু বয়সে ও অভিজ্ঞতায় ছোট একজনের কথা যেভাবে বয়োজ্যেষ্ঠরা শুনলেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর।

মাঝে-মাঝে আমরা দূর থেকে দেখতাম, উনি চোখ বন্ধ করে আছেন, বয়স্ক মানুষ, আমরা ভাবতাম ঘুমিয়ে পড়েছেন। তারপর হঠাৎ দেখতাম, টেকনিকাল লোক যিনি আছেন, তাঁকে সংশোধন করে দিচ্ছেন। আমরা অবাক হয়ে যেতাম! আপাতদৃষ্টিতে মানুষটা ঘুমিয়ে আছেন বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু তাও সব দেখছে পাচ্ছেন! এ বোধহয় অন্তর্দৃষ্টি ছাড়া সম্ভব হয় না। তাপসদা সম্পূর্ণ মঞ্চ ও তাতে আলোর পরিকল্পনা ছবির মতো দেখতে পেতেন। এক কথায়— চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারতেন, আলো কেমন হতে পারে। ওঁর অভিজ্ঞতা, মনন, বোধ এই পর্যায়ে নিয়ে গেছিল ওঁকে।
আমি তো ‘বহুরূপী’তে অনেক পরে যুক্ত হয়েছি, আগে খেলাধুলো করতাম, থিয়েটার অত দেখাও হত না। তখন ওঁর করা বিখ্যাত আলোকসজ্জাগুলোর অনেকই দেখা হয়নি। কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছিল সেসব লোকমুখে; মঞ্চে রেলগাড়ি, আগুন, জাহাজ— এসবই শোনা কথা, আমার এগুলো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। পরবর্তীকালে আমি যা দেখেছি এবং শিখেছি, থিয়েটার কর্মী হিসেবে আজীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে।