নবারুণের স্টপওয়াচ

Nabarun Bhattachariya

নবারুণ ভট্টাচার্য বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে এসেছেন উলটোদিক দিয়ে। অর্থাৎ মূল রাস্তা মেনে নয়। ১৯৮২ সালে প্রথমবার প্রকাশিত হয় ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’। লাইনটি আজকের দিনে প্রবাদপ্রতিম হয়ে দাঁড়ালেও, নবারুণের প্রথম বই আটের দশকের বাংলা কবিতার পাঠক্রমে খুব বড় হয়ে দেখা দেয়নি। এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। ২০০৭-এ ‘পুলিশ করে মানুষ শিকার’-এর ১৭টি কবিতা এই বইয়ের সঙ্গে জোট বাঁধে। পরের দুটো সংস্করণ ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে। অর্থাৎ গত কুড়ি বছরে ‘এই মৃত্যু উপত্যকা…’ ছাপতে হয়েছে চার বার। আর আগের কুড়ি বছরে একবারও না। যদিও বাংলা কবিতা বইয়ের সংস্করণ দেখে কিছু বোঝা যাবে, এমন কথা পাগলেও স্বীকার করবে না।

এর পরে আর তিনটি কবিতা-বই লিখেছিলেন এই কবি। ‘মুখে মেঘের রুমাল বাঁধা’, ‘রাতের সার্কাস’ আর ‘বুলেটপ্রুফ কবিতা’। এছাড়া ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ আর ‘জোড়াতালি’ বইদুটোয় নানা সময়ের কিছু লেখা এককাট্টা করা হয়েছে। এই সবই ঘটেছে ১৯৯৩ সালে ‘হারবার্ট’ উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পরে। নবারুণের জনপ্রিয়তায় এক বিস্ফোরণই ঘটে যায় ‘কাঙাল মালসাট’ হাজির হলে। নতুন সহ্রসাব্দের নতুন পাঠক ঠিক তখনই খুঁজতে শুরু করেন নবারুণের কবিতা, যে-কবিতা ঠিক পুরন্দর ভাটের মতন নয়। ফলে যাঁরা কিনলেন, তাঁরা হতাশা গিলে বইয়ের তাকে সাজালেন কি না, সে-কথা কেউ জানে না। তবে পড়লেন যাঁরা নতুন করে, তাঁরা প্রায় সবই একবিংশ শতকের প্রথম দুটো দশকের পাঠক। অথচ নবারুণ কবিতা লেখা শুরু করেন সেই ষাটের দশকের শেষ দিকে! আর সে-কবিতা ঠিক বুলেটপ্রুফ বলতে যা বোঝায়, তেমন ছিল না।

আরও পড়ুন: সভ্যতা ও সময়ের উল্টোদিকে হাঁটাই ধর্ম, শিখিয়েছিলেন ডন কিহোতে! লিখছেন সুমন মুখোপাধ্যায়

কী কারণে জানি না, বাংলা কবিতার পাঠক উপন্যাস বা গদ্য-লেখকদের কবিতা তেমন পড়তে চায় না। খুব ঠেকায় না পড়লে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর হয়ে হালে প্রকাশিত সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়ে কাউকে বসতে দেখিনি। কথাটা কমবেশি সমরেশ বসু, বনফুল বা অন্যদের পক্ষেও খাটে। কিন্তু কবিদের উপন্যাস পড়াটা বেদস্তুর নয়। বিদেশে এইরকম কোনও পাঠক-ভেদ নেই। গুন্টার গ্রাস বা এনসেনৎসবার্গার ঔপন্যাসিক-কবি না কবি-ঔপন্যসিক— এ-নিয়ে খুব একটা মাথা কেউ ঘামাবে না। নানা কিসিমের সাহিত্যের সংরূপ নিয়ে কাজ করেছেন এমন বহু সাহিত্যিককে না খুঁজলেও, হাতের কাছেই পাওয়া যাবে। বাংলায় এই গদ্য-পদ্যের পথবদল মূলত পাঁচের দশকের পরবর্তী ঘটনা।

পাঁচের দশকের শেষ দিকে দেখা দিতে থাকে নতুন এক কবিতা-বোধ, যা মূলত পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক এবং পুরনো বাংলা কবিতা-ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। এই সময়ের প্রধান কবিদের প্রথম দু’তিনটে বই আর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁদের ভাবনাচিন্তা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাবে। আমাদের স্বাধীনতার অপরার্ধের মূল ঔপন্যাসিক বা কথাসাহিত্যিকরা কবিতা লিখেছেন তাঁরই সমসময়ের কিংবা কবিতা-বই পড়া কবিতা-ধারণা নিয়ে। নতুন কোনও রাস্তা তাঁদের হাতে খোলেনি। বাংলা কবিতায় এইখানেই নবারুণের একেবারে খাঁটি জায়গা। সমসময়ের পাঠকদের কবিতা পড়ায় তিনি আশ্রয় খোঁজেননি। তাঁর বইগুলোর ডানা আছে। বলা ভাল, তাঁর কবিতার লাইনগুলো পরিযায়ী পাখি বা শ্রমিকদের মতন তিন দশক-চার দশক লম্বা হাঁটতে কাহিল বোধ করেনি। এর একটা ভেতরকার গল্প আছে।

আট-দশকে এবং সাত-দশকে আধুনিক বাংলা কবিতার যে-চেহারা আমাদের কাছে ধরা পড়ে, নবারুণ কবিতা লিখতে চাইছিলেন তার বাইরে থেকে। আটের দশকের একেবারে শুরুতেই বেরিয়েছিল ‘এসো সুসংবাদ এসো’। কাছাকাছি সময়ে চোখ রাখলে দেখব ‘আলেয়া হ্রদ’, ‘প্রত্নজীব’, ‘আমাদের লাজুক কবিতা’ অথবা ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ নিয়ে হাজির হয়েছিল সেদিনের তরুণ কবিরা। আর উত্তীর্ণ পঞ্চাশ-এ ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ পেরিয়ে তখন শোনা যাচ্ছে ‘প্রহর জোড়া ত্রিতাল’। ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’র গা ঘেঁষেই পড়া যাচ্ছে ‘বন্ধুরা মাতি তরজায়’। ‘স্মৃতির শহরে’ কেউ পাশ থেকে বলছেন ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’। ‘উন্মাদের পাঠক্রমে’ দমবন্ধ মানুষটিকে সঙ্গ দিতে পাশাপাশি ঝলমলে ‘দেবতার সঙ্গে’ একই বইয়ের ঝোলায় ঢুকে পড়েছে। এই তালিকা অর্থহীন। ‘লোচনদাস কারিগর’, ‘আবার পুরী সিরিজ’-এর মতো সম্পূর্ণ বেকায়দায় বাংলা কবিতা শুধু নয়, এখানে নেই সত্তরোর্ধ্ব যুবক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই সময়ের দরজা-জানলা খোলা কবিতার কথাও। কিন্তু মোটের ওপর এই বাংলা কবিতার কার্যালয়ের দিকে তাকালে নবারুণকে এই নন্দন-চত্বরে খুঁজে পাওয়া শক্ত।

১৯৬৯ সালের ডায়েরি-তে যেসব কবিতা নবারুণ লিখেছেন সে-সন কোনও কবিতা-বইতেই জায়গা পায়নি। দুটো যেমন-তেমন উদাহরণ নেওয়া যাক:

১. ‘কফি হাউসে বসে যাদের বিয়ের ঠিক হয়েছিলো
                                তাদের বিয়ে ভেঙে গেছে
                চোখ ঠিকরে গেছে বাজারের জৌলুষে
                এক ফুঁতে কবিতা অতি বোকা বোকা
                        কিই বা হবে ওদের দিয়ে।’

২. ‘আজন্মকাল স্মৃতির দু’পায় হত্যে দিলাম
        মন টলে না, মুখ খোলে না জাত হারামি
       রাস্তা ভুলে ঠিক বাড়িটার সামনে এলাম
আহ্লাদেতে ওলটপালট এমনি আমি।’

প্রথমটা গদ্যে লেখা কাঁচা কবিতা। দ্বিতীয়টি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ষাট দশক জোড়া কীর্তিকলাপ মাথায় রাখলে, তাঁরই অনুবর্তী। নবারুণের কবিতা নিয়ে ভাবতে চাইলে এই কবিতাগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। এদের ভেতর দিয়ে চললে বোঝা যাবে, কোন-কোন স্টেশন-বাজার তিনি ছেড়ে এসেছেন। পথ হিসেবে ষাট-সত্তর-আশির বাংলা কবিতার মূল রাস্তায় না গেলেও, নবারুণের কবিতা সম্পূর্ণ আকাশ থেকেও পড়েনি। ওঁর পথ বাংলা কবিতার একটি হারিয়ে যাওয়া জাতীয় সড়ক। সে হল ঘোষিত বামপন্থী রাজনৈতিক পরিত্যক্ত কবিতার ধারা।

বাংলা কবিতায় পাঁচের দশকেও দুটো প্রধান বিতর্কের আন্দাজ পাওয়া যায় কবিতা আর রাজনীতির সহাবস্থান নিয়ে। যার শুরু হয়েছিল চারের দশকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতন কবিতা-বিষয়ক অবস্থান নিয়ে। কেউ মনে করে নিতে পারেন, বুদ্ধদেব বসুর দু’টি ফতোয়া—১. ‘সুভাষকে ঠিক করতে হবে সে কর্মী হবে না কবি হবে এবং ফ্যান দাও ফ্যান দাও করে কাঁদলেই তা কবিতা হয় না।’ ২. ‘কবিতা, কবি আর রাজনীতি কীভাবে বাংলা কবিতার আধুনিকতায় মীমাংসা খুঁজে পেল সে গল্প বারান্তরে তোলা যাবে।’ আপাতত এইটুকু মনে করা যাক, ষাট-সত্তর-আশির দশকে বাংলা কবিতায় রাজনৈতিক কর্মী,  অ্যাকটিভিস্টদের অবস্থাননির্ভর কবিতা, কবিতার পাঠকদের বালিশের তলা থেকে হারিয়ে গেল। প্রশ্ন হল, এই দিকনির্দেশ নবারুণ আঁকড়ে রইলেন কীভাবে!

কবিতার মুক্তি, কবিতার স্বাধীনতা আর দায়বদ্ধ কবিতার টানা-পোড়েনের ভেতর বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের কবিতা হাস্যকররকমের বোঝা হয়ে উঠেছিল আটের দশকে। বামপন্থী-অতিবামপন্থী কবিতায় আটের দশকের বাংলা কবিতার পাঠক আস্থা রাখেননি। বিপ্লবের কবিতা নয়, তাঁদের মূল খোঁজটাই ছিল কবিতার বিপ্লবে। যা ঘটছিল ‘খণ্ডবৈচিত্র্যের দিন’, ‘বালি ও তরমুজ’ অথবা ‘রাস্তায় আবার’-এর কবিতায়। এই সময়ের কবিদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল এমন কবিতা, যার ভেতর অবিরত খেলা করবে রাজনৈতিক ইশারা কিন্তু কবিকে কেউ বলবেন না ইনি রাজনৈতিক কর্মী। তাই ‘কৃত্তিবাস’-সম্পাদক অনায়াসে একদিন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীর কবিতা ছেপে দিতে পারবেন আর কবিতায় লিখবেন ‘কবির মৃত্যু’ অথবা ইন্দিরার শুকনো ঠোঁটের কথা।

‘স্মৃতির শহরে’ কেউ পাশ থেকে বলছেন ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’। ‘উন্মাদের পাঠক্রমে’ দমবন্ধ মানুষটিকে সঙ্গ দিতে পাশাপাশি ঝলমলে ‘দেবতার সঙ্গে’ একই বইয়ের ঝোলায় ঢুকে পড়েছে।

নবারুণ ওঁর লেখায়-কথায় বার বার ঘোষণা করে বলে গেছেন তিনি অতিবামপন্থী রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী এক অ্যাকটিভিস্ট। তাঁর লেখার মূল জোরের জায়গাই এই বিশ্বাসের জোর। মিথ্যে বিশ্বাস নয়, খাঁটি বিশ্বাস। যে-বিশ্বাস একদা সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল ‘স্ট্যালিন’। এই বিশ্বাসের জোরেও কবিতা অনেক দূর উড়ে যেতে পারে। সেটাই প্রমাণ হল নবারুণের নতুন ধরনের রাজনৈতিক কবিতাচর্চায়। আজকের তরুণ কবি নতুন প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন করে সেই লেখা থেকে তাঁর অবস্থান খুঁজে নেবেন সেটাই স্বাভাবিক।

এই লেখার শেষে ছোট্ট এক টুকরো গদ্য আর তিনটে কবিতা বেছে নিচ্ছি এই বিশ্বাস থেকে, কবিতা নিয়ে যে-কোনও কথাই শেষ পর্যন্ত একটা খোলা দরজার সামনে এনে দেবে আমাদের, যার ওপারে অক্ষর-সমুদ্র কেবলই বালিতে আছড়ে পড়ছে। শব্দ-মেঘ সরে গেলে সেখানেই পাঠক আর কবির দেখা হবে একদিন।

গদ্য: ১
কবিতা: ১
কবিতা: ২
কবিতা: