অবাক গাছের প্রশ্নের ডালে, উত্তরসুন্দরী ফুল ফুটেছে। আমি মেঘ বললেই, তুমি যদি বজ্রপাত আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামো, তাহলে কী করে বোঝাই যে, ছাউনিটা বেশ ভালই আছে। কিন্তু আমি অর্ধেক ভিজে। জল নিজেও যতটা জলের গায়ে, জলের ঢেউ ভেঙে কাছে ডাকে, জলে জল তলিয়ে যাওয়ার সময়ে, কাউকে বলে যায় না।
কথা নেই, বার্তা নেই, বেরিয়ে পড়ল, উধাও। বাউলদের গলায় ভাঙা চাঁদের আলো আন্দলিত, যেদিকে দু’চোখ যায়। বোকা বারান্দায় ঝুঁকে থাকা ফেলে রেখে, ছিঁড়ে-ছিঁড়ে যায় ঝড়ের চাদর। গলিতে ঢোকার মুখে, ঘুমের পরমান্ন, চুপ করে একা, কলার তুলে হাওয়াখেকো একা একটা এলাকা, রাতের আলোয় খুঁজছে সবাই রাতের অন্ধকার, মনের অন্ধকারে তুলোয় মোড়ানো আলোর দৈত্য, কেবল দৈত্য বেরতে থাকে দলে-দলে। তোমার ইচ্ছের ছায়া পড়ে আছে মাটিতে। পায়রা ডানা ঝাপটানোর মতো পলক ফেলে-ফেলে হাত ধরে রাস্তা পেরনোর আঙুলে এখন একজন
শৈশব ছুটে এসে, যদি এই ছাই মাখা উন্মাদের গায়ে জ্বর জড়িয়ে ধরে?
তখন তোমাকে, আমার মতো অচেনা কেউ বুঝিয়ে বলবে, এই যে পৃথিবী থেকে পৃথিবীর জল অনন্ত ও আদিম, এই যে আমার বন্ধুপ্রিয় আলোমধুভ্রমর গান তোমার সামনে তখন আমি থাকি, তুমি দেখতে পাও। তুমি যখন দেখতে পাও না, তখনও আমি থাকি।
আরও পড়ুন: গান যার ভেতরে আছে, সে একবার প্রশ্রয় পেলে, নদীর মতো অবারিত, তাকে আটকায়, সাধ্য কার? লিখছেন রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়
জন্মের পর সময় শুরু হল, আর মৃত্যুর পর কি সময় শেষ হয়ে গেল? নিজের জন্মের প্রতি এত গর্ব করো, আর নিজের মৃত্যুকে তুমি নিজে না যত্ন করলে, সে কোনওদিনই কাছে আসবে না। ১০০ বছর বয়সের বেশি একটা মানুষ যদি এক বোতল বিয়ার খেতে চায় হঠাৎ? আমি জানি আপনি একটা ভয়ের মধ্যে বিপদে পড়ে আছেন। একটু সঠিক পদ্ধতিতে ভালবাসা পেলে, ঠিক অর্কিডের বায়না করবেন।
কোন বঁটিতে সবজি কাটলে পছন্দসই মাপের সবজি কাটাও হবে? আবার বুড়ো আঙুলও কাটবে না, এটা আমি জানি না অনেক সময় হয়, ফোনে গল্প করতে-করতে চা-টা ঠান্ডা হলে, হেলান দিয়ে চা-টা বুকের কাছে এনে, একটা শান্ত চুমুকের পর— চাবুকের মতো যে কোনও কথায় হঠাৎ একটা চমকের আঘাত লাগে। কিছুক্ষণ থ হয়ে বসে থাকার পর, আবার হাসি-গল্পে, মানুষ, মানুষ ওড়ায়। বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ, খিদের যুদ্ধ নামে যুদ্ধের খিদেপেট, অশ্লীল, ধুলো ইতিহাস।
রোজ পৃথিবীর ম্যাপে নতুন-নতুন ধ্বংসস্তুপ। মিসাইলের দিকে কোন কবিতা ছুড়ে মারলে পৃথিবীর সব অস্ত্র বিকল হয়ে পড়বে, আমায় জানিও। পড়ে গেলে উঠে পড়ে আবার খালি পায়ে বাইকের কিক সামলাতে যে শিখিয়েছে, সে আমায় চুপিচুপি বলেছিল, পিয়ানোর তালে অক্ষর বাঁধলে বুকের ভেতর হিম হয়ে যায় সময়। চুপ ছাড়া আর কোন গানে বলো চুম্বন ছাড়া, কোন প্রাণে তার, কোন অভিমানে জ্যান্ত মানুষ গলে জল হয়ে যায়। খোঁজ পেলে খবর দিও।
সে তো এমনিই তাকিয়ে রয়েছে, পালকের রোদ্দুর ঝরে পড়া দেখছে হয়তো? হতেই তো পারে, না হলে তুমি আগে থেকে বুঝে গেলে কী করে, যে এখানেই আমি লুকিয়ে ছিলাম? ভালবাসে, না ছাই! ওরকম মনে রাখার জন্য অনেক কথা বলে, ওসব আমি জানি। কিন্তু আমি জানতাম না, এই দিশেহারা পৃথিবীতে কে প্রথম গান বানিয়েছে। দোতলার কোণার ঘরভর্তি লোক, একটা কবেকার পুরোনো আলমারি, তার ওপর পানের কৌটো খুলতেই দেখি, একটা-একটা করে হাসির আওয়াজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটা, একটা করে নোয়া পলার পদক্ষেপ মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।
ফেরিওয়ালা, ধুনুরি, শিলনোড়া, চাবিওয়ালা, পাতিলেবু— তারা কি কেবল অবাক করা, ধার দেওয়া ছুরির আগুন ছিটানো দুপুর? না কি টাকা ঘুরছে, কিন্তু লোকটা এগচ্ছেও না, পিছচ্ছেও না। কেবল ধার দিয়ে যাচ্ছে ছুরি-বঁটি। কী বলতে পারে একটা ক্যামবিজ বল তোমার বড় হয়ে ওঠা কাচের জানালাটাকে, অন্য একটা ছোটবেলা এসে মেরে ভেঙে ফেলবে না। এরা যতটা আলপনা দেওয়া, উলুধ্বনি জমিয়ে রাখে, পুজোর রিলিজ এই শহরের এক আওয়াজে পিছিয়ে যায়। কান্নার অধিক আর্তনাদ আর হরিবোল মিলিয়ে গিয়েছে মিছিলে। তখনও কামরিয়া লপালুপ করেনি, কাঁটা লাগা শুনে খেলা শেষ।
কোন সুদুরে গানের স্কুলের গলা, আসছে ভেসে, বৃষ্টি নেমে। বখাটে হাতিবাগান বাজারের রংবাজ ভিড় বিক্রি করছে। তানপুরার গানগুলো একটু ঘষে দেবেন কাকু? বড্ড কেমন বয়াং বয়াং করছে।
তার মধ্যে আবার পাসপোর্ট সাইজের ফটোতে নিজেকে দেখেই আমি বুঝে গিয়েছি, হয় মাধুকরী না হলে দরবেশি, কোনও একটা পথ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। মাঝে-মধ্যেই, তখন পাড়ায়-পাড়ায় ব্যান্ড। গিটারের ঝ্যাও কোত্থেকে আসে, কেউ জানি না।
আপনি দেখুন, আমি এই পাশের দোকান থেকে আসছি। বাজারে ঢুকলে, ‘এদিকে, এদিকে টাটকা, এদিকে এদিকে।’ গ্রানাইট পাথর হড়কাতে-হড়কাতে হাঁটবেন, আঁশটে গন্ধে, নাক সিঁটকাবেন। তার মাঝে মাতাল মুখ গুঁজে নর্দমায় কাঁদছে। ওর ওঠার ক্ষমতা নেই। হঠাৎ বলল, বিশুর ছেলে বাটারফ্লাই মাংসের কিমা, সে কী সুন্দর চপার চালানো, কাঠের গুঁড়ির ওপর কিছু রক্ত ছিটোয়। এত মিহি, যে মিহিদানা ফেল। মিহিদানার সব মানে, বর্ধমান নয়। মিহিদানা চ্যাটার্জি মাস কম ফাইনাল, কটা চোখ, বেনজিন নিয়ে কথা উঠল বলেই বেঞ্জালডিহাইড এল। ক্যান্টিনে তো কাচের গ্লাস জড়ো করার আওয়াজে নরম হচ্ছে এরিকসন। আমি নোকিয়া-তে স্নেক খেলতে-খেলতে, কী-প্যাডের পেট ফুলিয়ে দিয়েছি। ওদের ফোনে গান বাজে। আমার নাকি মেমরি কার্ড না কী একটা লাগে, ওটা নেই। না কি তারিখ মনে থাকে না, হ্রস্ব ই না দীর্ঘ ঈ— মনেও পড়ে না। সার্কাসের মুস্কান থেকে আলোর ঝলক উড়ন্ত সব মানুষ। চন্দনকাঠ যদি দামি হয়, তাহলে তাকে ঘষে-ঘষে খইয়ে ফেলার মানে কী? সেদিন দেখি বেশ রাত্তিরে, চাঁপাতলা ঘাটের কাছে, একজন তার মোবাইল ক্যামেরাতে ছবি তুলতে গিয়ে আলোর অভাবে বলছে, বড় আলোর সামনের গাছের ডালটা কেটে দে। তাহলে ভাল সেলফি আসবে। না না, প্রসঙ্গটা তোমার-আমার মাঝে এরা কী করছে, সেটা না। পার্টনারের সাপোর্ট পেলে, গোলাম-টেক্কা ছাড়াও, রি ডবল দেওয়া যায়।
পাথরে পাথর ঢুকে সেবার আগুন আবিষ্কার, তারপর শুরু নাচ। জলসা হলে, আমরা যারা কলেজে পড়ি, তাদের জন্য একক তবলিয়া অপেক্ষারত। পাঁচিল টপকানোর ব্যবস্থা চলছে। বাঁয়া টেস্টিং চলছে। ঈশ্বর দেখে, লোকজন যেমন ছোটলোকের মতো আনন্দে মেতে ওঠেন, ঈশ্বরও কিছু লোকজন দেখে ততটাই ছোটলোক হয়ে যায়। ঈশ্বরের আসল কাজ, ছোটলোকের উত্তেজনাকে উসকে দেওয়া। আমরাই পাঁঠা, একদম রেজালা হয়ে বেরিয়ে এলাম। বাজনা শুনে, অনেকেই বাজনা ছেড়ে দেবে ঠিক করে ফেলেছে। ফেরার জন্য ভিড় বাসে উঠেই, ইনস্ট্রাকশন আসে, দাদা পিছনদিকে এগিয়ে যান। তার হাতে আড়াই টাকার টিকিট, ৫০ পয়সা নিয়ে বাওয়াল করছে। আমরা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি ভোরবেলা। চোখদুটোতে ঘুম নেই, ঘামে লাল আমাদের দেখে, আমাদের পাশের বাড়ির লোকেরা চিনতে পারছে না। বলছে, এ কী অবস্থা! মুখ থুবড়ে বালিশের ওপর পড়লাম। স্বপ্নে তেহাই মেলানো টুকরা বাজে, আমি চমকে চমকে উঠি, মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের পর একজন মিউজিসিয়ান, তার কোনও একটা রেজিউমে তৈরি করে ফেলেছে, কিন্তু কোন অফিসের কোন দপ্তরে জমা হবে, সেই বাঁকা পিন আটকানো পাতা দুটো?
তার মধ্যে আবার পাসপোর্ট সাইজের ফটোতে নিজেকে দেখেই আমি বুঝে গিয়েছি, হয় মাধুকরী না হলে দরবেশি, কোনও একটা পথ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। মাঝে-মধ্যেই, তখন পাড়ায়-পাড়ায় ব্যান্ড। গিটারের ঝ্যাও কোত্থেকে আসে, কেউ জানি না। কিন্তু, আমি শুধু এটুকু বুঝতে পারিনি আমার গানগুলো কবে ওয়ামার গান হয়ে গেল?
খ্যামটা, গাজন, কবিগান, গম্ভীরা— ওরা কোথায় গেল, কে জানে? সাইমন অ্যান্ড গার্ফাংকল, না হয় আমাদের মৌন মুখরতা দিয়ে গেল, কিন্তু আরবি তখন মেহেবুবার ‘হুঁ’ দিয়ে বুক চিতিয়ে ঘুরছে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের পুরনো বাড়ির ঠিকানা আপনারা জানলে আমাকে বলবেন, আর আপনি গান গাইলেই বিপ্লব হচ্ছে, এই ভ্রান্ত ধারণাটা আপনার মধ্যে যে কে প্রতিষ্ঠা করল, আমার জানতে ইচ্ছে হয়। যুগের সঙ্গে কাল মেলাতে না পারলেও, ভাষা, গান, বই, মলাট, মানুষ— সব বদলাতে থাকে। বদলাবেই। আপনাদের মাইকেল জ্যাকসনের বিলিজিনের প্রতি লোভ দেখে হতাশ লাগে। ইনফ্লুয়েন্সের চাকর ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। আমরা হারালাম ভারতীয় সুমনকে, হারালাম ভারতীয় অঞ্জনকে, হারালাম ভারতীয় নচিকেতাকে, ভারতীয় শিলাজিৎ, অনিন্দ্য, চন্দ্রিল, রূপমদের। কেন জানেন? গানকে খাঁচার বাইরে কিছু মানুষ বেরতে না দেওয়ার শিক্ষা দিলেন। গানকে আটকে রাখার শিক্ষা দিলেন। গান মানুষের অন্তরে আলো জ্বেলে দেবে, কয়েকজন কী করে এত সহজে সহ্য করবেন। নিজের অসভ্য বাঙালিটাকে না প্রকাশ করলে চলছিল না।
আমি সা বাজলে, কোমল ধা গাইতাম। আমার সরোদ শিক্ষার এক গুরু, কালীঘাটের কাছে থাকেন। সেদিন রবিবার সকাল, আমি আধদামড়া, মাসেল মেমরি চেঞ্জ হয়ে যাওয়া একটা লোক। নিজের হোমওয়ার্ক ভুল করেছি বলে আমাকে আমার শিক্ষক বলেছিলেন এসব গান লিখে, ক’টাকা রোজগার করতে পারবি? ছেড়ে দিয়ে যা বলছি তাই কর। ওই শেষ দিন, আমি ওঁর বাড়ি গিয়েছিলাম।
কোথা থেকে গান আসে আর কোথায় যে আমার গান আমায় একলা ফেলে রেখে চলে যাবে, আপনি-আমি শুধুই মিউজিক ডে পালন করে বুঝতে পারব না। যেদিন হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত পকেটে সাত টাকার খুচরো নাচবে, সেই দিন কেউ কেউ, হয়তো আমার মতো ভিখিরিরা গান বানাবে।