ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • সিনেমার বর্মিবাক্স ও অরুন্ধতী দেবী

    দেবারতি গুপ্ত (January 23, 2025)
     

    কিছু কিছু রাজকুমারী রূপকথার তোয়াক্কা করে না। নিজেরাই নিজেদের জিয়নকাঠি খুঁজে নেয়। আমার চোখে অরুন্ধতী দেবী তেমনই এক চরিত্র, যিনি অভিনেত্রী হিসেবে বাংলা ছবিতে নজির তৈরি করেছেন তো বটেই, কিন্তু শুধুই নায়িকা হয়ে সোনার খাটে পা ছড়িয়ে বসে থাকেননি। পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে উড়েও বেরিয়েছেন। যে উড়ানের গল্প বাংলা সিনেমার ইতিহাসে তেমন আমল পায়নি। অথচ, নারীর লেন্স দিয়ে পরিচালকের ক্যামেরা ধরতে তিনিই প্রথম শেখালেন। ভারতীয় ও বাংলা ছবির মূল ধারা নিয়ে আমার বোঝাপড়া অনুযায়ী সেই লেন্সই কিন্তু পরবর্তীকালের সাই পরাঞ্জপে, অপর্ণা সেনদের কাছে হাতবদল হয়েছে। মহিলা পরিচালক তার আগে বেশ কয়েকজন এসেছেন। ভারতীয় সিনেমায় প্রথম মহিলা পরিচালক ফাতমা বেগম; সিনেমার ইতিহাসের পাঠক মাত্রেই এই খবর রাখেন। ১৯২৭ সালে ফাতমা পরিচালনা করেন নির্বাক ছবি ‘বুলবুল-এ-পরিস্তান’। বাংলায় ’৫৪ সালে মঞ্জু দে পরিচালনা করেন, ‘স্বর্গ হতে বিদায়’। তিনিই বাংলা ছবির প্রথম মহিলা পরিচালক। কিন্তু শ্রীমতী দে-র পরিচালিত ছবিগুলি যেমন, ‘অভিশপ্ত চম্বল’ বা ‘শজারুর কাঁটা’ সম্পর্কে খোঁজ নিলে বোঝা যায়, নিজস্ব প্রেক্ষিত তৈরির ভাবনা হয়তো তার মাথায় কাজ করেনি। সেরকম দৃষ্টিকোণ হয়তো ফাতমা বেগমেরও ছিল না। তাই বলাই যায় যে, অরুন্ধতী দেবীই সেই প্রথম মহিলা পরিচালক যিনি নিজের লিঙ্গ-অবস্থান বিষয়ে সচেতন হয়ে পরিচালনায় হাত দিয়েছিলেন। অরুন্ধতীর প্রত্যেকটি ছবি, তাদের প্রায় সবক’টি উপাদান নিয়ে একান্তভাবে একটি মেয়ের চোখ দিয়ে দেখা এবং তার দৃষ্টিপথ অনুসারে দেখতে আমন্ত্রণ করা। 

    আরও পড়ুন : অরুন্ধতী দেবীর অভিনয় ও পরিচালনায় নিহিত ছিল আভিজাত্য!
    লিখছেন সুপ্রিয় রায়…

    দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অরুন্ধতী দেবী-র প্রথম ছবি ‘ছুটি’ বাদ দিলে আর কোনও ছবিই সেভাবে সংরক্ষিত হয়নি। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ আর ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’ দেখার আবছা অভিজ্ঞতা মনে আছে মাত্র। সেই স্মৃতি ওই ছবির প্রিন্টের থেকেও অস্পষ্ট। আমাদের নয়ের দশকের কৈশোরের থেকেও দুষ্প্রাপ্য। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ কিংবা ‘দীপার প্রেম’ আবার করে দেখে যে-অনুভূতি স্মৃতিতে উঁকি দেয়, তা আগে না আঁচ পাওয়া একরকমের আলো। যে আলো তাতায় না, পোড়ায় না, বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আমেজ তৈরি করে চলে যায়। অরুন্ধতীর সবক’টি ছবিতেই শৈশব আর কৈশোরের আনাগোনা। প্রেম একটুও জড়োসড়ো নয়। আড়ম্বরহীন এবং আশ্চর্য রকমের অনায়াস। আর সংগীতের প্রয়োগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডিয়েজেটিক সাউন্ডের মতো। 

    অরুন্ধতী যখন পরিচালনা শুরু করেছেন, তখন ফরাসি নিউ ওয়েভ তুঙ্গে। প্যারিসে অ্যাগনেস ভের্দা আর প্রাগে ভেরা চিতিলোভা তাদের প্রথম দিকের মাইলফলক ছবি বানিয়ে ফেলেছেন। সেইসব ছবি অরুন্ধতী দেখেছিলেন কি না, জানা যায় না, তবে আন্তর্জাতিক ছবির জগৎ সম্পর্কে জানকারি থাকার সূত্রে ‘ক্লিও ফ্রম ৫ টু ৭’ আর ‘ডেইসিস’ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন, আশা করাই যায়। এভাবে ছয়ের দশকের ইউরোপকে টেনে আনার প্রয়োজন পড়ল, কারণ ইতিহাস-বিস্মৃত জাতিকে চোখে আঙুল দিয়ে কনটেক্সট না দেখালে অরুন্ধতীর তাৎপর্য প্রমাণ করা যাবে না। অরুন্ধতী সেই সময়ের ফসল যখন ইউরোপে মেয়েরা যে-কোনও ক্ষেত্রেই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। তার সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে, নারীর উত্তোরণের জন্যে তখনকার ভারতের জমি মোটেই যথেষ্ট উর্বর ছিল না। অরুন্ধতী সেই অনুর্বর জমির প্রথম দিকের ফসল। এই প্রসঙ্গে আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখা আশু কর্তব্য বলে মনে করি। ইন্টারনেটে ভারতীয় মহিলা পরিচালক লিখে খোঁজ করলে ওই ১৯২৭-এর ফাতমা বেগমের পর একেবারে লাফ দিয়ে আটের দশকের সাই আর অপর্ণার নাম লেখা পাবেন। মঞ্জু দে, প্রতিমা দাশগুপ্ত বা শোভনা সমর্থ (এরা প্রত্যেকেই একটি–দুটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন) তো কোন ছাড়, ৫টা ছবির পরিচালক অরুন্ধতীর নাম কোথাও পাওয়া যায় না। 

    এই ভয়ানক বিস্মরণ কেন? না কি শুধু ভুলে যাওয়া নয়, আরও অন্য কিছু? সিনেমার ক্ষেত্রে যে-সব মেয়েরা ক্যামেরার সামনে কাজ করতেন তাদের ছাড়া একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অন্য মহিলা কলাকুশলীদের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। মহিলা সুরকারদের কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। লতা, আশা, সন্ধ্যা নিয়ে আমরা সংগত কারণেই মাতামাতি করি, অথচ ঊষা খান্না বা অসীমা ভট্টাচার্যদের মতো সুরস্রষ্টা সরস্বতীরা আমাদের তালিকা এবং স্মৃতি থেকে বেমালুম উধাও। ঠিক তেমনই মহিলা পরিচালকের অদৃশ্যকরণ চূড়ান্ত দক্ষতার সঙ্গে করা হয়েছে। অর্থাৎ, যতক্ষণ মেয়েরা পরিচালিত হয়ে নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শন করছে ততক্ষণ তাদের মাথায় তুলে রাখাই যায় কিন্তু নিজেরা যখন সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন যেহেতু তারা পুরুষের জন্য একান্তভাবে রক্ষিত ক্ষেত্রে পা দিয়ে ফেলছে, অতএব তালিকা-বহির্ভূত হয়ে যাচ্ছে। এবার কে বা কারা এমনটা করছে? করছি আমরাই। আমরা বৃহত্তর ভারতীয় সমাজ থেকে শুরু করে তথাকথিত হাতে গোনা উদার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত প্রত্যেকেই এই ডিমেনশিয়া রোগে ভুগে থাকি। কিন্তু যখন এই মহিলা পরিচালকদের দক্ষতা পুরুষের সমান বা তাদের চেয়ে অনেকটা আলাদা হয়ে উঠছে সেই সাই পরাঞ্জপে, অপর্ণা সেনদের ক্ষেত্রে আমরা আর এরকম অন্যায় করতে পারছি না। 

    ১৯৭৬ সালে আমেরিকান সেন্টারে আমন্ত্রিত হয়ে অরুন্ধতী দেবী একটি খুব মনোজ্ঞ বক্তৃতা রেখেছিলেন। তাতে উনি এক জায়গায় বলছেন ওনার ন্যারেটিভে এমন অনেক উপাদান উনি ব্যবহার করেছেন, যা বহুদিন আগের শৈশবের স্মৃতি থেকে তুলে আনা। এরপরেই উনি একটি মারাত্মক কথা উল্লেখ করেছেন। পুরুষ হলে এইভাবে কবেকার স্মৃতি আগলে রাখতে পারতেন না। এটা মহিলা বলেই সম্ভব হয়েছে। অরুন্ধতী কঠোর নারীবাদী ছিলেন না। তবু ওঁর এই কথাটিকে একান্ত নারীবাদী উচ্চারণ বলেই আমি মনে করি। সাহিত্য, ছবি আঁকা বা সিনেমার আখ্যান রচনার মতো কাজে স্মৃতি বড়োই মূল্যবান পুঁজি। নারীর সেই অভিনব সাংস্কৃতিক পুঁজি পুরুষের চেয়ে বেশি পরিমাণে আছে– এই বোধ জারিয়ে দিয়ে নিজের উত্তরসূরি নারী পরিচালকদের রাস্তা দেখিয়েছেন অরুন্ধতী। এই বক্তৃতার শেষে অরুন্ধতী আক্ষেপ করছেন যে, সিনেমায় তখনও পর্যন্ত কেন আরও মহিলা পরিচালক উঠে আসছে না। কেন মেয়েরা শুধু ক্যামেরার সামনে থাকার গ্ল্যামারেই মজে আছে, কেন তারা ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানোর দায়িত্ব নিতে তখনো নারাজ। এই আক্ষেপের মধ্যে এক প্রচ্ছন্ন ডাক রয়েছে, যেখানে উনি ওঁর ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী অনুচ্চকিতভাবে মহিলা সিনেমাকর্মীদের ক্ষমতায়নের ইচ্ছে প্রকাশ করছেন। 

    অরুন্ধতী যখন পরিচালনা শুরু করেছেন, তখন ফরাসি নিউ ওয়েভ তুঙ্গে। প্যারিসে অ্যাগনেস ভের্দা আর প্রাগে ভেরা চিতিলোভা তাদের প্রথম দিকের মাইলফলক ছবি বানিয়ে ফেলেছেন। সেইসব ছবি অরুন্ধতী দেখেছিলেন কি না, জানা যায় না, তবে আন্তর্জাতিক ছবির জগৎ সম্পর্কে জানকারি থাকার সূত্রে ‘ক্লিও ফ্রম ৫ টু ৭’ আর ‘ডেইসিস’ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন, আশা করাই যায়।

    এসব কথা তখন কাদের প্রভাবিত করেছিল, আজ তা জানা সম্ভব নয় হয়তো। অবাক লাগে, শতবর্ষ হওয়ার আগে দু-একটা নিয়মরক্ষার উল্লেখ বাদ দিলে, পরিচালক অরুন্ধতী বিষয়ে আলোচনার কোনও পরিসর তৈরি করা যায়নি। আমরা সহজেই তাকে বাতিল করে দিয়েছি। বিস্মৃত হয়েছি। 

    তথ্য সংগ্রহ সায়নদেব চৌধুরী ও অরুন্ধতী দেবী পারিবারিক আর্কাইভ (তপতী গুহঠাকুরতা, অনিন্দ্য সিনহা, কাকলি মুখোপাধ্যায় এবং মৃনালিনী বাসুদেভন
    দ্বারা সংরক্ষিত)

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook