অসুখ : পর্ব ১

রোমিলার যে আর কিছুই ভাল লাগছে না সেটা দেবু বেশ অনেক দিন ধরেই বুঝতে পারছে। এই নিয়ে সাত নম্বর ডাক্তার। কোনও রকমে ওরা ডাক্তারের ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি। বাড়ি ফেরার পথে রোমিলার চোখে জল। দেবু বুঝতে পারে না কী করা উচিত। কিছু বলে না। রোমিলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। ঝরঝর করে জল পড়তে থাকে ওর গাল বেয়ে। নীরবতায় কাটে অনেকটা সময়।

রোমিলাই প্রথম মুখ খোলে, ‘তোমার ফোন আসছে। সাইলেন্ট করে রেখেছ এখনও?’

দেবু ফোনটা কেটে দেয়।

রোমিলা : কী হল? ধরলে না?’

দেবু : ‘ধুস! কী হবে? ’

রোমিলা : ‘কেন এরকম হল দেবু? ’

দেবু : ‘জানি না, মায়ের মৃত্যুতে কাঁদিনি বলে হয়তো।’

রোমিলা দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে।

বাড়ি ফিরে এসে রোমিলা বিছানাতে শুয়ে পড়ে। চোখ বোজা, কপালে হাত ভাঁজ করা।

দেবু : ‘ভাবতে পারছি না তুমি বাইরের কাপড়ে, হাত-পা না ধুয়ে বিছানায় এভাবে…’

রোমিলা উঠে বসে : ‘কী হবে?’

দেবু : ‘কিছুই তো আর হওয়ার নেই তাও অভ্যাস বলে তো…’

রোমিলা : ‘কী হবে আমার অভ্যাস দিয়ে?’

দেবু আর কথা বাড়ায় না, ‘কফি খাবে?’

রোমিলা : ‘কী হবে?’

দেবু এসে রোমিলার পাশে বসে। হাত দিয়ে কপালের চুলগুলো সরিয়ে দেয়, ‘এরকম করলে চলবে?’

রোমিলা : ‘চলার তো কিছুই নেই, তাই না…’ দেবু-কে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদে।

এক মাস আগে দেবুর জ্বর হয়। রক্ত পরীক্ষায় দেবুর শরীরে এক মারাত্মক রোগ ধরা পড়ে। ডাক্তার দেবু-কে জানিয়ে দেয়, খুব বেশি হলে আর দু-মাস। এই কিছুদিন আগেও ওরা সিকিম থেকে ঘুরে এল, একদম সুস্থ। হঠাৎ কী হয়ে গেল? ডাক্তার বললেন, এ-অসুখ ভীষণ রেয়ার। কোনও কারণ নেই, চিকিৎসাও নেই। রোগের উপসর্গ বলতে মূলত ক্লান্তি। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয় না সাধারণত। তারপর একদিন পেইনলেস ডেথ। পৃথিবীতে রিসার্চ চলছে এই নিয়ে বহুদিন কিন্তু এখনও কোথাও কোনও ওষুধ নেই। জানার পর থেকে ওরা চারিদিকে একশো রকম ওপিনিয়ন নিয়ে ক্লান্ত। দেবু বার বার ভেবেছে, পৃথিবীর এত মানুষ ছেড়ে আমারই কেন? কোনও উত্তর পায়নি।

তার ঠিক কিছুদিন পরে রোমিলার-ও জ্বর। আবার রক্ত পরীক্ষা। আবার সেই রেজাল্ট। রোমিলার শরীরেও সেই এক-ই রোগ। দেবু প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ডাক্তারের কলার চেপে ধরে, ‘তবে যে বললেন ছোঁয়াচে নয়?’

ডাক্তার : ‘আমি তো এখনও বলছি ছোঁয়াচে নয়।’

দেবু : ‘তাহলে?’

ডাক্তার : ‘সম্পূর্ণ কাকতালীয়! যদিও আপনাদের ব্লাড রিপোর্ট আমরা আমেরিকার একটি ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়ে দিয়েছি। একটা পেপার-ও হয়তো…’

দেবু কলার ছেড়ে দেয় : ‘পেপার নিয়ে আমাদের কী হবে?’

পরামর্শ করে জানা যায়, রোমিলার আরও অ্যাডভান্সড স্টেজ।

দেবু : ‘কিছু তো একটা উপায় থাকে, তাই না?’

ডাক্তার : ‘মির‍্যাকল তো হতেই পারে। আপনাদের আমি একজন কাউন্সেলারের নম্বর…’

দেবু : ‘না ,না কাউন্সেলার না। কোনও ওষুধ, কোনও অপারেশান?’

ডাক্তার মাথা তুলতে পারেন না। একটা কাগজে বেঙ্গালুরুর এক ডাক্তারের নম্বর লিখে যোগাযোগ করতে বলেন।

গত এক মাসে, নিজেদের সেভিংস নিঃস্ব করে, গোটা দেশ, বিদেশের সব রকম চেষ্টা দুজনে করে ফেলেছে। দুজনেই বিজ্ঞানের ছাত্র, কোনো রকম মাদুলি-ফাদুলির মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করেনি। আজ গেছিল একজনের কাছে যদি কোনওভাবে এই ক্ষয়টাকে স্লো করা যায়, তার উপায় জানতে। সবাই হাত তুলে দিয়েছে। সবার এক কথা— প্রে ফর আ মির‍্যাকল ।

দেবু : ‘আচ্ছা কফি খেতে হবে না। মাল খাই?’

রোমিলা অবাক হয়ে তাকায় দেবুর দিকে।

দেবু : ‘দেখো, তোমার ফ্যাটি লিভার নিয়ে তো ভেবে লাভ নেই তাই না?’

রোমিলা : ‘দেবু, উই আর ডাইং!’

দেবু : লাইক এভরিবডি এলস। শুধু আমরা একটু আগে যাচ্ছি!’

রোমিলা আবার ধপাস করে বিছানাতে শুয়ে পড়ে।

এক গ্লাস হুইস্কি আর একটা জিন নিয়ে ওরা এসি চালিয়ে বেডরুমে আরাম করে বসে। দেবু অনলাইনে একটা দোকান থেকে দারুণ সব কাবাব অর্ডার দিয়ে দেয়।

দেবু : ‘চিয়ার্স!’

রোমিলা কথা বলে না।

দেবু : ‘ঠিক তিন মাস আগে এই ঘরে, তোমার মামার সঙ্গে কী ঝামেলা, তোমার এই জিন খাওয়া নিয়ে। প্রেগন্যান্সি, ফার্টিলিটি, বাপরে বাপ! কী ভাগ্যিস কনসিভ করোনি। নাহলে অনাথাশ্রমে…’

রোমিলা : ‘শাট আপ দেবু!’

দেবু : ‘দেখো রোমিলা। বি স্ট্রং। আমি একটা পজিটিভ দিক পেয়েছি গোটা ব্যাপারটাতে।’

রোমিলা : ‘কীসের পসিটিভ দেবু? আমরা কী পাপ করেছি?’

দেবু : ‘পাপ-পুণ্য কোত্থেকে আসছে?’

রোমিলা : ‘তাহলে এত মানুষ ছেড়ে আমাদেরই কেন…’

দেবু : ‘দেখো জীবন ভীষণ অ্যাবসার্ড। পুরো ব্যাপারটাই চান্স। তুমিও তো বোঝো সবই। জীবনের একটাই সত্য— মৃত্যু। জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?’

রোমিলা : ‘তাতে কী?’

দেবু : ‘তাতে এই যে আমাদের একটা অ্যাডভান্টেজ আছে। সবার নেই।’

রোমিলা : ‘মৃত্যুর কী অ্যাডাভান্টেজ থাকতে পারে?’

দেবু : ‘এটাই যে আমরা আমাদের এক্সপায়েরি ডেট-টা জেনে গেছি। বাকিরা কেউ জানে না, সবাই ঘষে চলেছে। আমারটা আঠাশে মে, তোমার?’

রোমিলা : ‘পয়লা জুন। কিন্তু তাতে কী?’

দেবু : ‘তাতে আমরা এখন মুক্ত। আমরা যা খুশি করতে পারি, যা ইচ্ছে! যা কোনোদিন করতে পারিনি!’

রোমিলা : ‘দেবু, আমার ভালো লাগছে না। আমাদের একটা চেষ্টা তো করতে হবে তাই না?’

দেবু : ‘আর কী বাকি আছে চেষ্টার? প্রধানমন্ত্রী-কে গিয়ে বলবে? ঠাকুর-দেবতা ছাড়া আর কিছু বাকি আছে কী?’

রোমিলা : ‘দেবু, আমাদের সব শেষ হয়ে যাচ্ছে! আমাদের স্বপ্ন…’

দেবু : ‘গেল তো গেল। এখন আমরা এই সিচুয়েশানে দাঁড়িয়ে। আমার এই লাইফের আর নয় দিন পড়ে আছে। একটা কিছু স্পেশাল তো করি?’

রোমিলা : ‘কী করতে চাও তুমি?’

দেবু হাসে। গ্লাসটা নামিয়ে রেখে ল্যাপটপ বের করে। এসি-টাকে ২৪-এ দিয়ে আরাম করে বসে বিছানায়। একটা এক্সএলএস শিট খোলে মেশিনে। রোমিলা ঝুঁকে পড়ে দেখে।

রোমিলা : ‘কী সব উল্টোপাল্টা লিখে রেখেছ?’

দেবু : ‘তোমার ইচ্ছের লিস্ট-টা বলো, লিখে রাখি।’

সারারাত জেগে দেবু আর রোমিলা লিস্ট তৈরি করে। রোমিলাকে কনভিন্স করতেই বেশির ভাগ সময়টা যায় অবশ্য।

এই পৃথিবীতেই যদি আর না থাকে তাহলে চুরির মাল নিয়ে কী হবে? গোটা চুরির পদ্ধতিতেও কোনো মজা হচ্ছে না। তার উপর টেনশান, রিস্ক, কোনো দরকার নেই। ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে ওরা আবার মদ্যপান করে। বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে খায়। সেক্স করে। ঘুমিয়ে পড়ে।

দেবু : ‘পরজন্মে বিশ্বাস করো না আশা করি।’

রোমিলা : ‘সার্ত তো বলেই গেছেন, হেল ইস আদার পিপল।’

দেবু : ‘আর স্বর্গে যেতে হলে শিশু বয়সে আত্মহত্যা করে নেওয়া বেটার ছিল। যত বয়স গেছে কিছু না কিছু পাপ তো করেইছি। তাই যখন তোমার ইচ্ছের কথা বলছ সেখানে পাপ-পুণ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন এত? ইউ আর ফ্রি!’

রোমিলা : ‘চাকরিটা ছাড়ব…’

দেবু : ‘যে ক’টা সিক লিভ আছে ফুরিয়ে নাও তারপর আর যেতেই হবে না, কাউকে বলতেও হবে না। আমিও তাই করছি।’

রোমিলা : ‘আমি একবার যাব। আমার প্রোজেক্ট ম্যানেজারটাকে ঠাসিয়ে একটা চড় মেরে তারপর আসব।’

দেবু : ‘চড় মারলে ও তোমাকে ছেড়ে দেবে না, ও ব্যাটাও তোমাকে মারবে। তোমাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে তুমি সেখান থেকে সুস্থ শরীরে বেরিয়ে আস্তে পারো।’

রোমিলা : ‘কী বলতে চাইছ?’

দেবু : ‘খুন তো কয়েকটা করতেই হবে। তবে আমাদের যা রিসোর্স, আমরা পৃথিবী বদলে দেওয়ার মতো কিছু করে যেতে পারব না। দেশ নেতাদের সরাতে পারব কী? আফগানিস্তানে তালিবান উড়িয়ে দিতে পারব? রাশিয়া, আমেরিকা, চায়না, উত্তর কোরিয়া এদের শায়েস্তা করতে পারব? পারব না। সময় নেই আর ক্ষমতাও নেই। কিছু লোকাল ছোট খাটো… না, না এখন এইসব মার্ডার-ফার্ডার ভেবে লাভ নেই, লাস্ট দিনের জন্য থাক।’

রোমিলা : ‘তোমার পাঁচ নম্বর পয়েন্টটাতে কী লেখা?’

দেবু হাসে : ‘ঠিক ওটাতেই চোখ গেছে না তোমার?’

রোমিলা : ‘তুমি অর্জি করতে চাও?’

দেবু : ‘আহ! সে কে চায় না, তুমি উত্তেজিত হচ্ছে কেন?’

রোমিলা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দেবু ল্যাপটপ রেখে রোমিলাকে ধরতে যায়।

রোমিলা : ‘আমার দিকে এসো না। এটা কী শুরু করেছ?’

দেবু : ‘আরে বাবা, চাইলেই কি পারব না কি? এই শহরে কোথায় অর্জি হচ্ছে?’

রোমিলা : ‘সুযোগটা বড় কথা নয়, ইচ্ছেটাই আসল। তোমার যে…’

দেবু : ‘আরে বাবা, ইচ্ছে দিয়ে কী হয়? আমার তো ছোট থেকে কেট উইন্সলেটের সঙ্গে সেক্স করতে ইচ্ছে, করেছি কি? আমার তো বেঁচে থাকার-ও ইচ্ছে, পাচ্ছি কি?’

রোমিলা : ‘এটা আর ওটা এক নয়। উল্টোপাল্টা কথা বলে গুলিয়ে দিও না।’

দেবু : দেখো, শান্ত হও। আমাদের লাইফে সত্যিই আর হাতে গোনা কয়েকটা দিন। এই ক’টা মুহূর্ত আমরা নিজেদের মধ্যে একটা…

জড়িয়ে ধরতে চাওয়া দেবুর দুটো হাত রোমিলা ছাড়িয়ে নেয়। তারপর রোমিলা অন্য ঘরে চলে গিয়ে, দরজা বন্ধ করে দেয়। দেবু বাইরে থেকে অনেক ঠকঠক করেও সে-রাতে দরজা খোলাতে পারেনি।

পরদিন সকালে রোমিলা দেরি করে ওঠে। উঠে সোজা দেবুর ঘরে আসে। দেবু খুব মন দিয়ে চকলেট খাচ্ছিল, রোমিলাকে লক্ষ করতে একটু সময় লাগে। একটু ভয়ে ভয়েই তাকায়।

রোমিলা : ‘আমি ভেবে দেখেছি, তোমার চিন্তা ভুল কিছু মনে হয়নি আমার।’

দেবু : ‘বাঁচালে!’

রোমিলা : ‘ইচ্ছের উপর কারও লাগাম নেই, তোমার ইচ্ছে করতেই পারে।’

দেবু : ‘তার চাইতেও বড় ব্যাপার হল, আমাদের সিভিল ওয়ারের সময় নেই। আর আট দিন মাত্র আমার। তুমি আমার আসল পার্টনার ইন ক্রাইম। লেট আস মেক ইট গ্র্যান্ড!’

দুজনে আবার বিশাল ভাবতে বসে। কী করা যেতে পারে?

দেবু : ‘আট দিনে লোন দেবে কোনও ব্যাঙ্ক?’

রোমিলা : ‘ব্যাঙ্ক দেবে না, NBFC-গুলো দেবে। লোন নিয়ে কী করবে?’

দেবু : ‘তুমি আমি ৪০ লাখ করে তুলি তারপর জাস্ট দিয়ে দেব, পাবলিককে বিলিয়ে দেব। আমার দিদির ছেলেকে দিয়ে দেব। দেওয়ার জায়গা কম হবে না। কিন্তু…’

রোমিলা : ‘এই ক’দিনের জন্য আবার এইসব লোনের ঝামেলাতে ঢুকবে? এখানে সই করো, এই ডকুমেন্ট দাও…’

দেবু : ‘সেটাই ভাবছি…আপাতত বাদ দাও ওই আইডিয়াটা। আর কী করা যেতে পারে?’

সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে সন্ধে নামার সময় আসে। আইডিয়াও অনেক আসে কিন্তু ইমপ্লিমেন্ট করার ঝামেলার জন্য বাতিল হতে থাকে। বোম মেরে উড়িয়ে দেওয়ার বহু ইচ্ছে বাতিল হয় কারণ কী করে হবে? কাকে বলবে? সাউথ সিটি-তে তো কিনতে পাওয়া যাবে না। কিনতে পেলেও মারবে কীভাবে? এত পরিশ্রম করার মানে দেখে না দুজনেই। চুরি করার প্ল্যানগুলোও কাজে আসে না। চুরি না হয় করল কিন্তু তারপর কী? এই পৃথিবীতেই যদি আর না থাকে তাহলে চুরির মাল নিয়ে কী হবে? গোটা চুরির পদ্ধতিতেও কোনো মজা হচ্ছে না। তার উপর টেনশন, রিস্ক, কোনো দরকার নেই। ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে ওরা আবার মদ্যপান করে। বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে খায়। সেক্স করে। ঘুমিয়ে পড়ে।

(চলবে )

ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র