ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সহোদরা: পর্ব ২


    সাগুফতা শারমীন তানিয়া (July 9, 2022)
     

    পর্ব ২

    প্রথমদিকে দাসী-বাঁদীরা বড়ি বেগমের মহলের দিকে যেতে পারত না, অনুমতি নেই। খুব কৌতূহল ওদের, কেমন দেখতে ওই মেহেরুন্নিসা বেগম! তিনিই নাকি মুর্শিদাবাদের নবাব বদলে দিয়েছেন, ছোটি বেগমের ছেলে সিরাজকে খুন করিয়েছেন! ডাইন ছাড়া অমন কেউ করতে পারে! খালা তো মা-ই! বড়ি মেহেরুন্নিসা তথা ঘসেটি বিবির খাস নোকরানি দিলদার, আর ছোটি আমেনা বেগমের খাস নোকরানি সলিমা। দিলদার আর সলিমাতে চুলোচুলি বেঁধে যেত। বুড়ি আক্তারি এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে থামাত ওদের। অবশ্য বাঁদীদের কোন্দল বেশিক্ষণ টিকত না, গল্পের টানে ছোটরা ভিড়ত বড়দের আসরে, বুড়িরা পিঠ-হাত-পা বানিয়ে নিত ছুকরিদের দিয়ে— গল্পের লোভে ওরা বুড়িদের খটখটে হাত বুকে-পেটে-জাঙে সইতেও রাজি। 

    বাইরে শাল-শিমুল-চালতা-শিশম গাছে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, কেয়াঝোপ থেকে কলাবাদুড়ের ডানা ঝাপটানির আওয়াজ শোনা যায়। বন্ধ প্রমোদশালার আলসেতে সারা দুপুর যেসব ঘুঘু ডাক ছেড়ে কেঁদেছে, তারা ঘুম গেছে। নওগেরা হাভেলির নীচা মহলে বাঁদীরা বেগমদের খাওয়ার সুপুরি ঘৃতকুমারির তেলে সেদ্ধ করে, বুড়িরা নিপুণ হাতে পাতলা করে কুচিয়ে আস্ত সুপুরি এমন করে তোয়ের করে যেন পরিবেশনের সময় মনে হয় আস্ত, অথচ আঙুল ঠেকালেই চূর্ণ হয়ে যাবে। 

    দিলদার বলে, ধপধপে গায়ের রং মেহেরুন্নিসা বেগমের, অত সফেদ সুবে বাংলার সূর্যের গরম সইতে পারে না তাই গালে-গলায় ছিনে পড়েছে। কে বলবে তিনিই বড়ি বেগম! এখনও বেদের বীনের মতো বুক। সাপের মতো লম্বা বেণি মাথায়। ছোটি বেগমের তুলনায় কত লম্বাচওড়া সমর্থ দেহ! 

    চমনের খোঁচা মারার স্বভাব, সে খপ করে বলে বসে, ‘সলিমা বহিন, দিলদার আপা, যাই বলো, তোমার বড়ি বেগমের শরীর যেন হরবখত জ্বলছে— বাঁদীরা পাঙ্খা টেনে-টেনে ক্লান্ত হয়ে যায়!’

    আক্তারি বলে, ‘শুয়ে-বসে থাকেন, তাইতে গা একটু তেলতেলে। দেখিস না, বাঘের মতো পুরু গাল! তা নবাবনন্দিনীরা তো আয়েসিই হন। হাতে সারাক্ষণের সঙ্গী গড়গড়া, তার পাতলা মজবুত নৈচা। কিন্তু ভাল করে তাকালেই দেখবি তোরা— চোখে তীক্ষ্ণ চাউনি, ওই চাউনিই যেন বলে দেয় সদরে যাই থাক অন্দরে বাজপাখিটির বাস!’

    ‘ও কি সত্যিকারের ডাইন আক্তারিবুয়া? চোখ দিয়ে বুকের রক্ত চুষে খায়? হামেদার খসম, ওই যে মাদার বখশ… সে হামেদাকে কসম করে বলেছে, রাতের টহলদাররা দেখেছে কাঠের পুলের ওপর দিয়ে বড়ি বেগম রাতে পিলখানায় গিয়ে পেট পুরে হাতির রক্ত খেয়ে আসে। একটা হাতি মরল পিলখানাতে!’ বলে গুলবদন। 

    ‘কাঠের পুলের ওপর দিয়ে যায় না কি সুড়ঙ্গপথে লালবাগ কেল্লায় চলে যায় বড়ি বেগম? মাদার বখশ খৈনিখোরটা ঠিক দেখেছে যে পুল দিয়ে বড়ি বেগম যায়?’

    ‘আরে বেগম হাতি খাক, ঘোড়া খাক, মুহররমের মিছিলের সব উট খাক! নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে তো খেয়েছেই, এখনকার মসনদের নবাব মীরজাফরকে খাক, আমাদের না খাক।’ 

    ‘ও কী সলিমা, অত বাজে কথা জোর গলায় বলতে আছে! মীরনের লোক ঘুরছে সবসময়। শুনতে পেলে আর রক্ষা নেই!’ খেঁকিয়ে ওঠে দিলদার। তারপর ওরা নীচু গলায় আলাপ করে; জাহাঙ্গীরনগরের নায়েবে নাজিম নওয়াজিশ মুহম্মদের বেওয়া এই বড়ি বেগম, হোসেনকুলি খাঁর মাশুকা… খালার আশেক সেই হোসেনকুলি খাঁ-কে মেরে ফেলেছিলেন নবাব সিরাজ, খালা তাই আর খালা থাকেনি, বড় জ্বালা সাপিনীর অঙ্গে। শুনতে-শুনতে সলিমা দিলদারের মাথার উকুন মেরে দেয়, বলবে না বলবে না করে বলেই ফেলে— হোসেনকুলি খাঁ-কে নাকি ছোটি বেগমও ভালবাসতেন! বলে না, ছোটি বেগম হেকিমের কাছ থেকে কালকেউটের বিষ কিনে এনে দিতে বলেছে সলিমাকে। নিশ্চয়ই বড়ি বেগমকে বিষ খাওয়াবে বলে! দিলদার অবশ্য সলিমাকে না বলে পারে না যে, বড়ি বেগম কবিরাজের কাছ থেকে সালাজিত এনে দিতে বলেছেন।

    ‘বুড়ি খসম খেল, আমেনাবুড়ির ছেলেগুলো খেল, এখনও অটুট যৌবনের দাওয়াই খুঁজছে কেন রে?’

    ‘তোদের মন কালা! গেঁটে বাতের জন্যও তো হতে পারে!’  

    শাহীন আর চমন ফিচফিচ করে হাসছিল নিজেদের ভেতর, দিলদার হাঁক পাড়ে— ‘কী নিয়ে দাঁত মেলছিস তোরা?’ 

    ‘নবাব সিরাজের বেওয়া… বুঝলি না, আমাদের লুৎফা বেগমকে মীরন বিয়ে করতে চেয়েছিল জানিস? লুৎফা বেগম নাকি বলেছে, ও সারাজীবন হাতির হাওদায় চড়েছে; আজ দিন খারাপ বলে গাধার পিঠে চড়তে হবে নাকি!’ এই হাভেলির কেউ অসম ক্ষমতাধর মীরনকে গাধার সঙ্গে তুলনা দিয়েছে সেটা ভেবে ওদের ভারি পুলক লাগে। শাহীন হাসতে-হাসতে চমনের গায়ে লুটিয়ে পড়তে-পড়তে বলে, ‘ওরে শুধু মীরন কেন, মীরনের বাপ আমাদের নতুন নবাব মীরজাফরও বিয়ে করতে চেয়েছিল লুৎফা বেগমকে। কাকে যে লুৎফা বেগম গাধা বলেছেন আল্লা মালুম!’ 

    ‘খুব তেজ লুৎফা বেগমের জানিস তোরা? পলাশিতে হেরে নবাব নাকি হেরেমের সব মেয়েমানুষকে দেওয়ান মোহনলালের হেফাজতে সোপর্দ করে দিয়েছিলেন, আগে তো জান বাঁচুক! কিন্তু লুৎফা বেগম রইলেন নবাবের সঙ্গে। নতুন নবাব মীরজাফর বড় বেইজ্জত করেছে বেগমকে, তবু ধনদৌলতের হদিশ দেননি!’ সতী লুৎফা বেগমের কাহিনি দাসী-বাঁদী-নোকরানির চোখ ছলছলে করে তোলে, কিন্তু ওই দুখ-ছলছল লোভ-চকচকে হতে সময় নেয় না। 

    ‘ধর, আমাদের কাউকে লুৎফা বেগমের মনে ধরল, আর তিনি দুনিয়া ছাড়ার আগে আমাদের কাউকে বলে গেলেন, কী করবি সেই ধনরতন দিয়ে?’ 

    ‘আরে, আর যাকে জানাক গুলবদনকে না জানাক, বদতমিজ ছোকরি সব দৌলত ওই চকের কালেজিকা সালন খেয়ে উশুল করবে!’ সলিমার কথায় সকলে হো-হো করে হেসে ফেলে।

    খালার আশেক সেই হোসেনকুলি খাঁ-কে মেরে ফেলেছিলেন নবাব সিরাজ, খালা তাই আর খালা থাকেনি, বড় জ্বালা সাপিনীর অঙ্গে। শুনতে-শুনতে সলিমা দিলদারের মাথার উকুন মেরে দেয়, বলবে না বলবে না করে বলেই ফেলে— হোসেনকুলি খাঁ-কে নাকি ছোটি বেগমও ভালবাসতেন! বলে না, ছোটি বেগম হেকিমের কাছ থেকে কালকেউটের বিষ কিনে এনে দিতে বলেছে সলিমাকে। 

    পরের হপ্তায় সলিমার কাছে ছোটি বেগমের মোতিদার নথ পাওয়া গেলে নীচা মহলে মারামারি বেঁধে যায়। সলিমাকে কিল মারতে-মারতে আক্তারি হাঁপায়— ‘বল বাঁদীর বাঁদী, ছোটি বেগমের জেওর তুই চুরি করলি কেন?’

    মার সহ্য করে অনেকক্ষণ টিকে ছিল সলিমা; মর্দান বেগের ডান হাত আশরফ বেগ এসে সলিমার চুলের মুঠি ধরে তুললে, সে সেই অপমান আর সইতে পারল না। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘ছোটি বেগম আমায় জেওর দিয়ে বলেছিলেন, জোছনা হলে পেছনের খিল খুলে আমায় একদিন বাগে চম্পাতে নিয়ে যাবি?’ কী না, আজিমাবাদের নায়েবে নাজিম জয়েন-উদ-দীন আহম্মদ হয়বত জঙ্গের বিধবা বেগম আমেনা, মরহুম নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মা আমিনা বেগম নোকরানিকে অনুনয় করেছেন একবার সন্ধ্যার ‘বাগে চম্পা’তে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর আদেশ করার বদলে তাঁর গয়না ঘুষ দিয়েছেন! এরপর আশরফ বেগের ঘুষি-লাথি খেয়ে তার মুখ ফুলে গেলে সে একেবারে মুখ বুঁজে রইল, বিষ সংগ্রহ করার জন্য আমেনা বেগম তাঁর গয়না বাঁদীর হাতে দিয়েছেন— এ-কথা ভাঙল না। একখানা দোষে মানে চুরির দোষে মার খাওয়াই ভাল। একবার শুধু কঁকিয়ে উঠে বলল, ‘যাও না, ছোটি বেগমকেই জিজ্ঞেস করো না তোমরা, উনি আমায় নিজেই এ গয়না দিয়েছেন কি না!’

    উভয় বেগমই কয়েক দফায় বিষক্রিয়াজনিত পেটের পীড়ায় ভুগলেন। মর্দান বেগ চতুর লোক, সে নিয়ম করে দিল— কোনও বাঁদীকে যদি পাতা বাটতে বা সন্দেহজনক কিছু গুলতে দেখা যায়, সব বাঁদীর একসঙ্গে নোকরি যাবে। বেগমদের মাথাব্যথায় মাথায় জোঁক লাগানো, ঘায়ে নিমপাতা গুঁড়োর পুলটিস দেওয়া—এইসব মূর্খ মেয়েলোকের হাজামতিতেও সবার নোকরি যাবে। বেগমরা কেউ গলায় ফাঁস দিলে বাঁদীদের নোকরি যাবে। পানিতে সোরা মেশাবার সময় সব বাঁদী উপস্থিত থাকবে, একই জলাধার থেকে সবার পানি পান করতে হবে, নইলে সক্কলের নোকরি যাবে। হাভেলির বাঁদী হয়ে খেয়ে-পরে বাঁচবার মেয়েমানুষের অভাব হবে না এ-তল্লাটে। মুর্শিদাবাদের নবাবপুত্র মীরন এঁদের নজরবন্দি করে রাখতে পাঠিয়েছেন, বিষ খাওয়াতে যেদিন হুকুম দেবেন সেদিন দেখা যাবে। 

    স্বভাবচপলা চমন জিজ্ঞেস করে বসে, ‘নোকরি থাকবে কোন পথে?’

    এক ধমকে গোস্তাক বাঁদীকে খামোশ করে দিয়ে মর্দান বেগ জানায়, যে-কোনও গোপন খবর তাকে দিতে পারলে নোকরি থাকবে। বেগমরা ঘুষ হিসেবে বাঁদীকে আশরফি কিংবা জেওর হাতে দিলে তক্ষুনি সেসব মর্দান বেগের জিম্মা করে দিলে নোকরি থাকবে। 

    ৬.
    মহল আলাদা, তবু কী করে একদিন মুখোমুখি হয়ে যান দুই বেগম। বড়ি বেগমের হাতে একটা ছুরি, ছোটি বেগমের আস্তিনে আফিমের গুলি। কিছুক্ষণ থমকে থাকেন দুজনেই, অকস্মাৎ হাতের ছুরিটা ছুঁড়ে মারেন বড়ি বেগম, ছোটি বেগম সরে যান। 

    সে-রাতে কপালে-গালে করাঘাত করে রক্ষীদের শুনিয়ে-শুনিয়ে অশ্রান্ত বিলাপ করে যান বড়ি বেগম মেহেরুন্নিসা, মহল কেঁপে ওঠে তাঁর চিৎকারে। এ-জীবনে আমেনা বেগমের ছেলে সিরাজ তাঁর ভালবাসার ধনদের একে-একে কোতল করেছে, ‘শওকত জঙ্গকে পুত্রজ্ঞান করেছি, আমেনার সিরাজ তাকে মেরেছে!… হোসেন কুলি খাঁ-কে আপনা ভেবেছি ভরসা করেছি, সিরাজ তাকে মেরেছে!’ 

    আমেনা বেগম চমকে ওঠেন, হোসেন কুলি খাঁ-কে খুনের ব্যবস্থা তো মেহেরুন্নিসা করেছিলেন! জবাব দিতে গিয়ে সামলে নেন নিজেকে, কিন্তু বড়ি বেগম থামেন কই? 

    ‘ছেলের জন্য ডুকরে কাঁদছ হর রোজ, তার জীবদ্দশায় তুমি তার জননী হতে পেরেছিলে? ছিলে তার স্নেহের আশ্রয়? প্রেমিকা হবার টানে ভুলে যাওনি মাতৃত্বকে? সব দিখাওয়া!’ 

    অত বড় অপবাদে ছোটি বেগম আমেনার ধৈর্যের বাঁধ টুটে যায়; তিনিও তাঁর মহল থেকে চেঁচিয়ে বলেন, ‘আরে মাশুকা হবার বাসনায় তুমিও তো ভুলে গেছিলে ঘরওয়ালি হতে! আর মা হওয়া ভুলবে কী, খোদা গর্ভে কিছু দিলে তো কোনওদিন!… মা হওয়া এখন উনি শেখাবেন!… পুরুষের সভায় চিরকাল দখল নিতে গেছ। আমি তো তবু অন্তঃপুরিকা ছিলাম!’ 

    জবাব মুখের আগায় নিয়ে তৈরি ছিলেন মেহেরুন্নিসা, ‘আমার আশেক তো শুনি তোমারও আশেক! তা তোমার সেই আশেককেও তো তোমার বদবখত পুত্র প্রকাশ্য রাজপথে কোতল করেছে!… আর অন্তঃপুরিকা তো তুমি শুনতে পাই পাটনার আফগানদেরও হয়েছিলে! আব্বা না বাঁচালে তুমি তো তাদের হাতে-হাতেই ঘুরছিলে!…’  আজ বুঝি শরমের আগল খুলে গেছে বড়ি বেগমের! 

    ‘নবাব রাখবেন হাজার মহলা শাহী হারেম, আর নবাবজাদীদের একজন প্রেমিক থাকলেও দোষ? কে করেছে এই নিয়ম? ওই আফিমখোর হেজে যাওয়া বুড়োদের জন্য সব আছে, বেগমদের কেবল মায়ের পদ আর ঘরওয়ালির পদ?’ গজগজ করেন মেহেরুন্নিসা। রক্ষীরা চমকায় না, হাভেলিতে এমন তারা বহুত দেখেছে। 

    ওবেলা চমন আবিষ্কার করে ছোট্ট একটা বাদশাহী ছুরি বিঁধে আছে জানালার কপাটে, বাঁটে কোফত্‌গার কী সুন্দর সোনার পাতের কাজ করেছে, চুনি-মরকত বসানো একটা ময়ূরকণ্ঠ। বাইরের কেউ কি চিঠি-সহ ছুরিটা ছুঁড়ে মেরেছে বেগমদের? পালাবার বন্দোবস্ত? ছুরি নিয়ে আহ্লাদিত চমন যায় মর্দান বেগকে জানাতে।

    বড়ি বেগমের হাতে একটা ছুরি, ছোটি বেগমের আস্তিনে আফিমের গুলি

    মহলের খাসবাঁদী সামান্য দীপের আলোয় দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ; ছোটি বেগম আঁধার ফুঁড়ে এগিয়ে আসেন, চক্ষু কোটরাগত, জীবন্মৃতের মতো চেহারা। ফিসফিস করে বলেন, ‘হীরামতিকে বলবি বিষ নয়, আমার ফণায় চাকাওয়ালা নাগিন চাই। জ্যান্ত!’ 

    ধূর্ত বাঁদী জিজ্ঞেস করে বসে, ‘নাগিন দিয়ে কী করবেন ছোটি বেগম?’

    বাঁদীর দুঃসাহসে আমেনা বেগমের চোখ জ্বলে উঠলেও নিভে যায় আবার; এ-হাভেলিতে চাকর-নোকরই ভরসা।  

    ‘দুধকলা দিয়ে পুষব!’

    ‘এ-দেশে গাছে-গাছে বিষের ফুল, হাতে-হাতে বিষের লাড্ডু। আপনি বেফিকর থাকুন ছোটি বেগম, বিষ আমি জোগাড় করে দেব।’ 

    ৭.
    বুড়িগঙ্গার ওপর ঝুলন্ত আকাশে মেহেদি-রঙা আলো। রমজান মাসের থমথমে সন্ধ্যা। শাহী মসজিদ থেকে ভেসে এসেছে আজান। নায়েবে নাজিম জেসারত খাঁ বড় কাটরায় স্থায়ী হয়েছেন, বড় কাটরার আশপাশে নিখরচার মুসাফিরখানাগুলো রমরম করছে। জিঞ্জিরার নওগেরা হাভেলির নীচামহলেও ইফতারির কোলাহল। বেগমদের খানাদানা পরিবেশন করে এসে খোদাবন্দ বাঁদীরা কেবল রোজা ভেঙে মুখে পানি তুলেছে, আক্তারি চলে গেছে নামাজ পড়তে। অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে বলে ছোটি তরফের দিকের ছাদে উঠেছিল শাহীন, চমন আর গুলবদন; ছাদ বলতে দোচালা কুঁড়ের আদলে গড়া চিলেকোঠার পাশ দিয়ে সংকীর্ণ জায়গা। ওই চিলেকোঠায় নাকি কার জ্যান্ত সমাধি আছে! আক্তারিবুয়া জানে তার নাম। বাঁদীদের চমকে দিল গুমরানো কান্নার শব্দ। ছোটি বেগম কাঁদছেন; পুত্রহীনার বুক খালি করা হাহাকার। শাহীনের চোখে জল এসে যায়। চমন মাথার ওড়নাটা টানতে-টানতে বলে, ‘চল বহিন ওইধারে যাই।’ বড়ি তরফের দিকে ঘন গাছের ছায়া; গুমরে কাঁদছেন বড়ি বেগম। বাঁদীরা কিছুক্ষণ ভেবেও বুঝতে পারল না, বড়ি বেগম কাঁদছেন কেন। স্বামী বহুকাল হল গত, সন্তান ধারণ করেননি, তবে? আজ দুই বছর হল ওঁরা এখানে এসেছেন, ওঁদের রূপ-যৌবন নিয়ে রটনাগুলোও হাস্যকর হয়ে এসেছে। গোমড়ামুখো, কর্তৃত্বপরায়ণ দুই বুড়ি, যাঁরা শুধুই একে অন্যের মৃত্যুকামনা করেন, এই তো বাঁদীমহলে তাঁদের স্থায়ী পরিচয়! ওঁদের নাওয়া-খাওয়ার সমস্ত তত্ত্বাবধানের পরেও বাঁদীরা তবু বেগমদের কত কম জানে! 

    একদা নবাববেগম শরফুন্নিসা সর্বক্ষণ শয্যাশায়ী, একদা নবাববেগম লুৎফুন্নিসা মূর্ছিত পড়ে থাকেন একটি কামরায়, পাগলিনীপ্রায়।

    ‘ওরে গুলবদন কালেজাখাকি, ভরা যৌবনে সোয়ামি হারালে কালেজিকা সালন আর রোচে না! হবি নবাববেগম? দ্যাখ নানীরও যা কপাল, নাতবৌয়েরও সেই কপাল!’ বাঁদীরা জাঁতায় গম পিষতে-পিষতে ওসব বলে কিংবা ইয়াখনিতে এলাচখোসার সম্বরা দিতে-দিতে গীত গায়। গুলবদনের পীরিতের লোক মাওলা বখশ মনিবের খোরাসানি মোরগাকে যুদ্ধ করতে শেখায়, ঝাঁপিয়ে পড়ে এক লহমায় বিদীর্ণ করে দেয় রামপুরী মোরগার সিনা; বাঁদীরা কখনও ভিড় করে গিয়ে দেখে আসে; লুৎফুন্নিসা বেগমের শিশুকন্যা কুদসিয়া আর মৃত ইকরাম-উদ-দৌলার পুত্র মুরাদ-উদ-দৌলা তাদের পিছু নিতে যায়, রক্ষীরা ফিরিয়ে দেয় (আহা, ওদের নানা নবাব আলিবর্দি বেঁচে থাকতে দেখেছেন হাতির লড়াই, নাতি-নাতনি মোরগার লড়াইও দেখতে পায় না!)। অবিশ্রান্ত গঙ্গাফড়িং কাঁচা পাতা খেয়ে বেড়ায়, তারা সব্বাই হাভেলির শিশুদের চেয়ে স্বাধীন। আঙিনা থেকে ভরা বরষায় বাঁদীরা দ্যাখে বিষবৈদ্যের কন্যা হীরামতি ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে, হয়তো কালনাগিনীর পিছু পিছু! মেঘ ঘনিয়ে আসা কালো আকাশের তলে আলপথগুলো দেখায় অনেকদিনের পরিত্যক্ত গোস্তের হাড়ের মতো, সাদা। ধানক্ষেতে বাতাস কাটলে আওয়াজ ওঠে— শরশর। বাঁদীরা গলা খুলে ডাকে— ‘হীরা হৈ!’ কাচারু বেলোয়ারি চুড়িতে লাক্ষা লেপে সোনালি টিনের পাত লাগিয়ে নকশা করে দেয়, মাঝে মাঝে হীরামতি নিয়ে আসে সেই চুড়ি-মালার পসরা। ওরা সদলবলে খরিদ করে। বাঁদীরা হাভেলির বাইরে গেলে রক্ষীরা যেতে-আসতে গায়ে থাবড়ে দেখে নেয় বেগমরা বাইরের কারো সঙ্গে বাঁদীদের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছে কি না; মুখরা বাঁদীরা রক্ষীদের বাপ তুলে গালমন্দ করে, নির্লজ্জ হাসেও। হাভেলির অত কলরবে ভেতর-আঙিনার ঝরোকাপথে সুপারি গাছের সারির দিকে চেয়ে চুপচাপ বসে থাকেন বড়ি আর ছোটি বেগম। নবাব আলিবর্দি খাঁ-র গরবিনী কন্যারা।

    শাহীন গরিব পুঁথিয়ালের ঘরের কন্যা, সে মুখে-মুখে ছড়া বাঁধে—

    ‘মুনশি ছেফাত উল্যা ওয়ালিদ আমার, 
    আশরাফ কুলেতে জন্ম, অতি নেক্কার। 
    শিশুকালে এন্তেকাল করিলেন পিতা, 
    এতিম হৈনু আমি ছাড়িলেন মাতা। 
    দাসীকুলে মিশিলাম হৈয়া লাচার। 
    জান বাঁচিবার দায় বিষম আকার।’ 

    শাহীন যে কপালদোষে তাদের শ্রেণিতে এসে মিশেছে, তা শুনেও বাঁদীরা আবদার করে, ‘শাহীনবুয়া বড়ি বেগম ছোটি বেগমকে নিয়ে বয়ান করো!’ সে তখন দ্বিগুণ উৎসাহে ধরে—

    ‘নানা-নাতি গলাগলি ঝিয়ে ঝিয়ে আড়ি, 
    বইনে উপায় করি বইনপুতে মারি। 
    মরদের মসনদে বসিবার আশ,
    নিকটেরে দূর করে হেন হাবিলাষ। 
    জুলমতি ওক্তে দুই বইনে ঘর ছাড়ে।  
    কুরসি যাহারে ডাকো, জহর বলি তারে।’ 

    ‘কত নবাব আসে যায়, বুড়িগঙ্গার বাঁক বদলায়, বাঁদীর তকদিরে শুধু পরের আগুনে হাত সেঁকে জীবন পার করা!’ 

    আক্তারির অতশত আহাজারি শুনতে গিয়ে অসহিষ্ণু চমন বলে বসে, ‘বাঁদীর ওপর বাদশাজাদার চোখ পড়তে নেই না কি! জারিয়া লুৎফা বেগম নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার চোখে পড়েছিল না?’ 

    অন্যরা ওর মুখ চাপা দিতে দৌড়ে আসে। গুলবদন তাড়াতাড়ি বলে, ‘বাঁদীর তকদির আর বেগমের তকদির এক হয়ে গেছে দ্যাখো না আক্তারিবুয়া! বেগমদের সেই বাদশাহী দস্তরখান তো আর নেই, সেই শাহি খানসামা নেই! মীরনের হুকুমে মহলের সবাই শুরবা আর শুখা রোটি খাচ্ছে বছর ধরে!’

    ‘বাদশা-বেগমদের কত খেয়াল! আজ বেগমদের খিদমতগারদের মাফিক বাজরার রোটি-শুরবা খাওয়াচ্ছে, কাল আচমকা বরাদ্দ করবে পুলাও, পরশু গুমঘরে নিয়ে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেবে, নয় ফাঁসি চড়াবে। সব ব্যবস্থাই তো হাভেলিতে আছে!’

    ‘বড়ি বেগমের আওয়াজ কমে আসছে খেয়াল করেছিস?’ 

    ‘ছোটি বেগমও রা করে না।’ 

    ‘বিপদে পড়লে দুই বহিন এক শুঁটির দুই দানার মতো এক হয়ে থাকবে দেখিস!’ 

    ‘বকোয়াস! তক্কে-তক্কে আছে, কে কাকে খুন করবে। শীতঘুমে থাকা সাপ কি আর সাপ নয়?’ 

    ৮.
    একদিন রাতে বড়ি বেগমের মহলে পা টিপে-টিপে প্রবেশ করেন ছোটি বেগম। সেদিন সন্ধ্যায় ইচ্ছা করেই আফিম সেবন করেননি তিনি, ঝিমোবার ভান করে পড়ে ছিলেন। পাঙ্খা টানতে-টানতে ক্রীতদাসী ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘুমিয়ে গেলেও তার হাত সচল। দুয়ারের কাছে আড়াআড়ি শুয়ে আছে খাসবাঁদী দিলদার। তাকে হেলায় ডিঙিয়ে মহলে ঢোকেন তিনি। আসবাবহীন ঘর, মেঝে গালিচাহীন। নোনাধরা দেওয়ালে কত আশ্চর্য ছবি এঁকে গেছে সময়, বাতাস আর আর্দ্রতা। শয্যায় রেশমের সুজনি পাতা— তাতে ঘুমিয়ে আছেন বড়ি বেগম। শয্যার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে গল্প শোনানোর কথক। জাফরিকাটা জানালার বাইরে বুড়িগঙ্গার ওপর চাঁদ উঠেছে কাঁসার পরাতের শামিল। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে বড়ি বেগমের শরীর— যার অপরিসীম ঘৃণার কারণে মরতে হয়েছে আমেনার আদরের পুত্র সিরাজকে। কোম্পানির ইংরেজ সাবিত জং-এর (কর্নেল ক্লাইভ) বিপরীতে পলাশির অন্যায় যুদ্ধে সিরাজ হেরেছিল এদের ষড়যন্ত্রের কারণে। মোহম্মদী বেগ যখন সিরাজকে হত্যা করতে এসেছিল, শেষ মুহূর্তে নাকি সুবে বাংলার কোনও নামহীন কোণে ভাতা ভোগ করে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল তাঁর পুত্র, বাংলার নবাব! সেই মিনতির কথা ভাবলে আজও ছোটি বেগমের বুক ভেঙে যায়। বিছানার কাঠে ছারপোকা লুকিয়ে আছে নিশ্চিত, কেমন বাজে গন্ধ লাগে ছোটি বেগমের নাকে। 

    তরবারির অর্ধেক দৈর্ঘ্যের আফগান ছু্রিখানা বের করেন ছোটি বেগম; হাত-পায়ের কোন শিরা কাটলে মানুষ রক্ত ঝরতে-ঝরতে মরে যাবে তা তিনি জানেন। অথবা আস্ত ছুরিটাই বুকে বিঁধিয়ে দিলে কলিজা-গুর্দা সব ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু ছুরি ওঁর হাতে কাঁপে। আজও তো বেঁচে আছেন তিনি, বড়ি বেগমকে খুন করলে মীরন কি তাঁকে আর আস্ত রাখবে? বাকি জীবন গুজরানের কী নিদারুণ সাধ মানুষের! এই অসম্ভব মনোবাঞ্ছা কোথায় থাকে, যখন তিনি কেঁদে জার-জার হয়ে নিজের মৃত্যুকামনা করেন? তাকিয়াটা বড়ি বেগমের মুখে ঠেসে ওই ঘুম দীর্ঘ করে দেওয়া যায় না? 

    ছুরি কিংবা তাকিয়া দুই-ই প্রতিহত করতে পারবেন বড়ি বেগম, যদি তিনি জেগে ওঠেন। ঝঞ্ঝর বাজতে থাকে ছোটি বেগমের মাথায়। 

    পীরসাহেব শিখিয়ে দিয়েছেন আল্লাতালার সেই নাম ফুঁকে বদদোয়া করতে, যে-দোয়ার ভারে কাগজ হয়ে যায় গুলির মতো লক্ষ্যভেদী, সহীহ স্থান ছাড়া এ আমল করা নিষেধ। এর চেয়ে সহীহ জায়গা আর কী হবে খোদার দুনিয়াতে? চোখের বিনিময়ে চোখ, রক্তের বিনিময়ে রক্ত। সরু বাঁশে ঢুকিয়ে বিষের তির সই করে ফুঁকবার মতো করে বড়ি বেগমের দিকে খোদার পাক নাম ছোঁড়েন ছোটি বেগম, সন্তানহারা সংক্ষুব্ধা মায়ের অব্যর্থ অভিশাপ। ঝুঁকে পড়েই যাচ্ছিলেন, সামলে নেন নিজেকে।

    আন্ধার মহলের এ-দেওয়াল সে-দেওয়াল অভিশাপে মেখে দিয়ে চলে যান আমেনা বেগম, লোকালয়ের সীমানা থেকে যেমন ফিরে যায় চোট-খাওয়া বাঘিনী। সহসা তাঁর মনে পড়ে যায়, তাঁর পুত্র ইকরাম-উদ-দৌলাকে দত্তক নিয়েছিলেন এই নিঃসন্তান মিঞা-বিবি, বিবির মনে যাই থাক, মিঞা নওয়াজিশ মোহাম্মদ খাঁ প্রেমাস্পদর মতো ভালবাসতেন আমেনা বেগমের সেই ছেলেকে। ইকরাম-উদ-দৌলা মরবার পরে বড়ি বেগমই কোলে তুলে নিয়েছিলেন ইকরাম-উদ-দৌলার এতিম পুত্র মুরাদ-উদ-দৌলাকে, নাম রেখেছিলেন ফজল কুলি খাঁ। হায় রক্তের সম্পর্ক, বড় বিচিত্র তার খেলা। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook