‘সামোসা’ সমস্যা

অশোকদার চায়ের দোকানে চা-বিস্কুট, টোস্ট-অমলেটই পাওয়া যায়, কিন্তু আমাদের রবিবারের সকালের আড্ডায় প্রতি সপ্তাহে সামনের শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে ‘শিঙ্গাড়া’ আর ‘জালেবি’ আসে। পাড়ার ছেলেদের আড্ডা বলে অশোকদা এই আবদারটা মেনে নিয়েছে, কারণ এই কয়েক ঘণ্টায় দোকানের বিক্রি নেহাত মন্দ হয় না। একটা রোস্টার করা আছে, এক-এক সপ্তাহে এক-এক আড্ডাধারী স্পনসর করে সেই শিঙ্গাড়া-জালেবি।

কালকে সকালে চায়ের দোকানে গিয়ে দেখি, সব আড্ডাধারী হাজির, কিন্তু শিঙ্গাড়া জিলিপির নাম-গন্ধ নেই। মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সব শেষ করে দিয়েছিস?’

উত্তরে জানলাম যে, শিঙ্গাড়া-জিলিপি আনা হয়নি, কারণ সরকার ঘোষণা করেছে ‘সামোসা’ আর ‘জালেবি’ আর লাড্ডু নাকি স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। স্বাস্থ্যসচেতন লিটন রোজ ভোরে একঘণ্টা হাঁটে আর অফিস থেকে একঘণ্টা জিম করে, তাই জেনেশুনে ও ক্ষতিকারক জিনিস খাবে না, কাউকে খেতেও দেবে না। মনে পড়ল, আজকে লিটনের পালা ছিল খাওয়ানোর।

আরও পড়ুন: ডায়েটে অতিষ্ট জনগণের জন্য রয়েছে রসনার একটি গোটা দিন? লিখছেন রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়…

লিটনকে একটু চুলকে দিতে গর্জে উঠল— ‘আমি তোদের চিকেন স্ট্যু খাওয়াতে দশ গুণ টাকা খরচ করব, কিন্তু নো সামোসা-জিলিপি! জেনেশুনে বিষ খেতে পারব না!’

লিটনের সেন্টিমেন্টে আর না ঘা দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চায়ে-পে-চর্চা শুরু হল।  

এতক্ষণ দেবু আপন মনে খবরের কাগজ পড়ছিল। এবার কাগজ থেকে মুখ তুলে বললো, ‘এই খবর নিয়ে যে সারা দেশে এত হইচই পড়ে গিয়েছে, এটাই কি হওয়ার ছিল না?’

সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতে দেবু বলল, ‘আরে বাবা, হিন্দুরাষ্ট্র নামক বাড়িটা বানানোর জন্য যখন ভিতপুজো নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন যদি সেই বাড়ি তৈরির মিস্তিরিরা যদি সামোসা আর জালেবি নামক দুই বিধর্মী খাবার খেতে খেতে আলোচনায় যোগ দেয়, সেটা কি মেনে নেওয়া যায়? দুটো খাবারই তো আদপে এই দেশের নয়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে!’

প্রায় ছিটকে পড়ছিলাম ওর কথা শুনে। সামোসা আর জালেবি বিদেশি খাবার? কিন্তু দেবু তো ভুল বকার পাবলিক নয়! বিস্তর পড়াশোনা খাবারের বিষয়ে! সবাই ওকে একটু বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলতে অনুরোধ করায় ও জানাল, প্রায় ন’শো বছর আগে এই দেশে আসা ইরানি ব্যবসায়ীদের হাত ধরে সামোসা এই দেশে প্রবেশ করে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী এই ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াত, সারাদিন পথ চলে সন্ধেবেলায় কোনও সরাইখানায় রাত কাটানোর জন্য থামত। আর সেখানে পরের দিনের পথে চলার সময় খাবার জন্য মাংসের পুর দিয়ে কড়া করে শিঙাড়া ভেজে সাবধানে মুড়িয়ে ঘোড়ার পিঠে ঝুলিয়ে রাখত রাতের বেলাতেই। পরের দিন পথ চলতে চলতে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনটা হয়ে যেত এই খাবার দিয়ে। তখনও এই খাবারের নাম ‘সামোসা’-ই ছিল। দিল্লির সুলতানদের রাজকবি আমির খুসরু ১৩০০ সালের আশেপাশে লিখেছেন, মাংস, ঘি আর পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি সামোসা রাজকুমারদের আর তাদের পার্ষদদের ভীষণ প্রিয় খাবার ছিল।

‘ইরানের জুলাবিয়া আর আমাদের জালেবি একই জিনিস। ওদেশে জুলাবিয়া বিশেষ পালা-পার্বণে তৈরি হয়, আর রমজানের সময় গরিবদের বিলোনো হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লেখা আল্‌ বাগদাদির রান্নার বইয়ে জালেবি বানানোর কায়দা-কৌশল বর্ণনা করা আছে। শুধু মধ্য এশিয়া নয়, গোটা এশিয়া মহাদেশই জালেবির রসে ভেজা।… ’

চতুর্দশ শতাব্দীর পর্যটক ইবন বতুতা তাঁর লেখায় মহম্মদ বিন তুঘলকের দরবারের এক ভোজের বর্ণনা করেছেন, যেখানে ‘সামুশাক’ বা ‘সাম্বুসাক’-এর কথা আছে, যা তৈরি হত মাংসের কিমা, পেস্তা, কাঠবাদাম, আর মশলা দিয়ে তৈরি পুর বানিয়ে পাতলা ময়দার মোড়কের মধ্যে পুরে ঘি দিয়ে ভেজে। এটা পরিবেশন করা হত ঠিক পুলাও পরিবেশনের আগে। মুঘল আমলে লেখা আইন-ই-আকবরিতে ‘কুতাব’ বলে এক পদের রান্নার ফন্দিফিকির লেখা আছে— সেখানে বলা হয়েছে ‘হিন্দুস্তানের লোকে একে সাম্‌বুসা বলে!’

সবাই সমস্বরে বলে উঠল, ‘আর জালেবি?’

দেবু মুচকি হেসে বলতে থাকল, ‘ইরানের জুলাবিয়া আর আমাদের জালেবি একই জিনিস। ওদেশে জুলাবিয়া বিশেষ পালা-পার্বণে তৈরি হয়, আর রমজানের সময় গরিবদের বিলোনো হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লেখা আল্‌ বাগদাদির রান্নার বইয়ে জালেবি বানানোর কায়দা-কৌশল বর্ণনা করা আছে। শুধু মধ্য এশিয়া নয়, গোটা এশিয়া মহাদেশই জালেবির রসে ভেজা। আফগানিস্থানে জালেবি এতটাই প্রিয় যে, শীতের দিনে আফগানিরা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মাছ আর জালেবি খেয়ে গ্রীষ্মকালের কথা ভাবে। মধ্য এশিয়া অঞ্চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুলাবিয়ার বিস্তার আর গ্রহণযোগ্যতা দেখে এটা মেনে নেওয়া হয়েছে, এদেশে সামোসার মতোই জালেবিও এসেছে মধ্য এশিয়া থেকে।’

ছোটন কখন এসে চুপ করে কথা শুনছিল, কেউ খেয়াল করেনি। তার সঙ্গে আবার দেবুর সাপে-নেউলে সম্পর্ক, কারণ দু’জনেই পড়ুয়া আর অশোকদার দোকানে প্রতি রোববার দু’জনের কম্পিটিশন হয়, কে আমাদের মতো পাব্‌লিকদের বেশি করে জ্ঞানের পুকুরে চুবোবে। ছোটন এবার খ্যাঁক করে উঠলো, ‘বললেই হল? আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে রান্নার ওপরে একটা পুঁথি লেখা হয়েছিল সংস্কৃতে, পয়ার ছন্দে— নাম গুন্যগুণবোধিনী। সেখানে জিলিপি বানানোর জন্য কী লাগে আর কীভাবে বানাতে হয়, সব লেখা রয়েছে। গুন্যগুণবোধিনীতে লেখা কলাকৌশল আজকের জিলিপি বানানোর কলাকৌশলের সঙ্গে প্রায় পুরোটাই মিলে যায়। এমনকী, তারও দেড়শো বছর আগে সালে জৈন সাধু জিনাসুরের লেখা পুঁথিতে জিলিপির উল্লেখ রয়েছে। এই পুঁথির কথা রঘুনাথের লেখা প্রামাণ্য ভোজন-কুতুহলেও উল্লেখ করা আছে!’

আশার কিছুটা আলো দেখে এবার সবাই এবার সোৎসাহে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আর শিঙ্গাড়া?’

“আরে বাবা, সামোসায় নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে— শিঙ্গাড়া আর সামোসা তো এক নয়! বাংলাদেশে দেখিসনি, সামোসা মাংসের পুর দেওয়া আর শিঙ্গাড়া নিরামিষ? ১৭৬৬ সালে নাকি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর রাজসভার রাজ-হালুইকর উড়িষ্যার গুণীনাথ হালুইকরের ষষ্ঠ পুত্র গিরীধারী হালুইকরের বউ ধরিত্রী দেবীর আবিস্কার শিঙ্গাড়া— লুচির লেচিতে তরকারি পুরে সেই লেচি ঘি’তে ভেজে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে খাইয়েছিল। সামোসায় নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে, শিঙ্গাড়া নিয়ে তো কিছু বলেনি!’

উত্তরবঙ্গে বেশ কয়েক বছর কাটানো উৎপল বলে উঠল, ‘কোচবিহারের রাসমেলা উঠে যাবে ভ্যাটাগুড়ির জিলিপি সেখানে পাওয়া না গেলে, শিলিগুড়ির বিধান মার্কেটের দোকানদাররা না খেয়ে খেয়ে আলসারে ভুগে মারা যাবে সারাদিন ধরে শিঙ্গাড়া আর জিলিপি না পেলে। রাজ্যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসবে!’

সবাই হইহই করে উঠল আর লিটনকে ধাক্কা দিয়ে পাঠাল শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। 

সবাই যখন হইহই করে শিঙ্গাড়া-জিলিপি সাঁটাচ্ছে, লিটন তখনও চিন্তিত। ‘এই যে লাড্ডুর ওপরেও নিষেধাজ্ঞা এনেছে, মঙ্গলবার হনুমানজিকে কী নিবেদন করব? ওঁকে তো লাড্ডুই দিতে হয়!’

পাশ থেকে রিপন বলে উঠল, ‘চাপ নিস না, শিঙ্গাড়া খা। গনেশজি, হনুমানজিকে অভুক্ত রাখার সাহস আছে কারও?বিশেষ করে যারা গদিতে বসে পেছন সেঁকছে আর ফরমান জারি করছে? গণেশ উল্টোলে তো সব গেল, আমদানি আর ক্যাদ্দানি দুটোই যাবে! আর লাড্ডু নিয়ে এমনিতেই চাপ নেই, কারণ সে-সবসময়েই বেনিফিট-অফ-ডাউট পেয়ে যায়। শুনিসনি, দিল্লি কা লাড্ডু, যো খায়া ওহ পস্তায়া, যো নহি খায়া ওহ ভি পস্তায়া! আসলে এইসব হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলে ইমেজ তৈরির ফিকির। ইজরায়েল ইরানে বোমা মেরেছে, ইজরায়েল ভারতের বন্ধু দেশ! অস্ত্র থেকে রাত-চশমা— সবই ভারতকে সাপ্লাই করছে। অন্য দেশেরা যখন সাপোর্ট করল ইজরায়েলকে, ভারত সরকার বন্ধু-দেশের শত্রুর প্রিয় খাবারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল দেখাতে যে, সে ইজরায়েলের কত বড় বন্ধু।’

অশোকদা এমনিতেই কম কথার মানুষ। এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। আর থাকতে না পেরে বলল, ‘রিপনকে আর শিঙ্গাড়া দিস না। ওকে আমি লেবু-জল করে দিচ্ছি। কালকের রাতের খোঁয়াড়ি এখনও যায়নি ওর!’