আশ্চর্য মিছিল
চলল জরুরি অবস্থার দিনগুলি। জরুরি অবস্থার সূচনাতেই জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাই প্রমুখ নেতাদের ধরপাকড় হলেও, বাংলায় তেমন হেলদোল হল না। এ-রাজ্যে তখন ছিল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কংগ্রেস সরকার। ১৯৭২-’৭৩ সাল থেকেই জেলখানাগুলি ছিল তরুণ রাজনৈতিক বন্দিতে পরিপূর্ণ। সংবাদপত্রগুলিতে তখন বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটলেও খবর দেওয়া নিষেধ ছিল। ধরপাকড় বা পুলিশি তৎপরতার কোনও খবর দেওয়া হত না। কেবল সরকারের উন্নয়ন ও কর্মকৃতিত্বের খবর দেওয়া হত সংবাদপত্রগুলিতে। আকাশবাণী-ও কেবল এমনই খবর সারা দেশকে মুহুর্মুহু প্রচার করত। সিপিআই দলটি তখন ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থাকে সমর্থন জানিয়েছিল। মনে পড়ে, আকাশবাণী-তে শুনেছিলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ে কবিতাপাঠ:
ভেঙো নাকো, শুধু ভাঙা নয়।
মন দাও আজ…
দেশ জুড়ে আরও ভালো এক ছবি
টাঙানোয়।
এইরকম। স্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি, মৃদু ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। তবু এইরকম।
সংবাদে সেন্সর ব্যবস্থা বসানো হয়েছিল জরুরি অবস্থার পয়লা দিনটি থেকেই। এই সেন্সর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রগুলি চমকপ্রদ প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়েছিল। বাংলা, ইংরেজি-সহ সকল ভাষার সংবাদপত্রগুলি যে-সকল সংবাদ সেন্সর করে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেই খবরটির বরাদ্দ স্থানটি শূন্য অর্থাৎ সাদা রেখে দিত। কখনও কখনও দেখা যেত, সংবাদপত্রটির প্রথম পাতাতেই ৪/৫টি জায়গা ফাঁকা। কলকাতা, সারা দেশেই সংবাদপত্রগুলি নিয়েছিল এই প্রতিবাদী ব্যবস্থা। ভারতীয় সাংবাদিকতা ওই সময় আন্তর্জাতিক খ্যাতিও পেয়েছিল। খবর সেন্সর করার জন্য সংবাদপত্রগুলিতে সন্ধেবেলা চলে আসতেন সরকারি লোকজন, অনেক সময় শাসক দলের নেতা কর্মীরা। আটের দশকের গোড়ায় আমি যখন ‘যুগান্তর’-এ যোগ দিই, অগ্রজ সাংবাদিকদের কাছে শুনেছি, রাজ্যের তৎকালীন তরুণ তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ‘যুগান্তর’ ও ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র খবরে সেন্সরের নজরদারির জন্য বাবলু নামে এক কংগ্রেস কর্মীকে যুগান্তর-অমৃতবাজার পত্রিকার বাগবাজার অফিসে পাঠিয়েছিলেন। ওই বাবলু সন্ধের সময় রোজ আসতেন। সাংবাদিকদের লেখা খবর দেখে দেখে বাবলু বলে দিতেন, এই খবরটা যাবে না, এইটা বাদ, ওইটা দিতে পারেন, এটা দিন। এই সব।
বাবলুর পদবি আমি ভুলে গিয়েছি।
শুনলে এখন হয়তো অনেকে হাসবেন, লিটল ম্যাগাজিনও সেন্সর হত। জেলায় জেলায় তথ্য-সংস্কৃতি অফিসে, সরকারি দপ্তরে গোছা গোছা লেখাপত্রের ওপর অনুমোদনের রাবার স্ট্যাম্প ছাপ নিতে হত। আবার সেন্সরের নিষেধাজ্ঞায় কবিতার ওপর কালো কালির জ্যাবড়া ছাপ পড়ে গিয়েছে, জরুরি অবস্থার গোড়ার দিকে তা-ও দেখেছি। কোন্নগরের ‘মানচিত্র’ পত্রিকায় শঙ্খ ঘোষের কবিতায় ওই কালো কালির বিকট ছাপ পড়েছিল, মনে পড়ছে।
হল কী, সুনীলদা, সুনীল মিত্রের ‘বিভিন্ন কোরাস’ পত্রিকাটি বের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৭৪ সালের শেষদিকটায়। ছেপে বেরতে বেরতে পরের বছর এপ্রিলও কেটে গেল, মে-র মাঝামাঝি যখন প্রকাশিত হল, ঝপ করে জারি হয়ে গেল জরুরি অবস্থা। সেই সংখ্যা ‘বিভিন্ন কোরাস’-টিতে জ্বলজ্বল করতে লাগল শঙ্খ ঘোষের কবিতা:
আকাশ ভরে আছে কালো ভস্মে
দেবতাদের অভিমান ওই রকম…
সুনীলদার বিভিন্ন কোরাসের ওই সংখ্যায় সেবার আমার যে কবিতাটি ছিল, সেটিতেও নিশ্চয় সেন্সর-বাবলুর কালো ছাপটি পড়ে যেত:
ভাবো সেদিনের উৎসব!
বরানগরের গঙ্গার জল থেকে
আবার এসেছে উঠে
তিনশো তরুণ
তা জরুরি অবস্থা জারির প্রথম দিকটাতেও ‘বিনা সেন্সর’-এর এই ‘বিভিন্ন কোরাস’ পত্রিকাটি দিব্যি বিলিবন্টন চলল, কফি হাউসেও, এমনকী, বিক্রির জন্য পাতিরামের স্টলেও বিক্রি হল। আমাকে বেশ দাপটের সঙ্গে সুনীলদা বললেন, ‘কোনও সেন্সর বিভিন্ন কোরাসকে ছুঁতে পারবে না। ঘোষ সব দেখে নিয়েছে।’ এই ঘোষদা তখন চাকরিসূত্রে শ্রীরামপুরে এসে হয়ে গিয়েছিলেন সুনীল মিত্রর পানীয়সূত্রে বান্ধব। শ্রীরামপুরে প্রশাসনিক কোনও উচ্চপদে তৎকালে আসীন হয়েছিলেন ওই ঘোষ। সেন্সর বোধ করি তাঁর দেখভালের ভেতর ছিল। একগাল হেসে সুনীল মিত্র আমাকে বললেন, ‘ঘোষ আমাকে বলে দিয়েছে, বিভিন্ন কোরাসের সেন্সর দরকার নেই।’
এরপর মাসকয়েক ধরেই ইতিউতি শুনেছি, আমাদের অঞ্চলের লিটিল ম্যাগাজিনের বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই ওই ঘোষদার ছাড়পত্র পেয়েছে। রাস্তায় জিপ থামিয়ে ঘোষদা মাঝে-মধ্যে আমার সঙ্গে কথা বলতেন। কুশল শুধোতেন। মানুষটিকে মনে পড়ল।
শুনলে এখন হয়তো অনেকে হাসবেন, লিটল ম্যাগাজিনও সেন্সর হত। জেলায় জেলায় তথ্য-সংস্কৃতি অফিসে, সরকারি দপ্তরে গোছা গোছা লেখাপত্রের ওপর অনুমোদনের রাবার স্ট্যাম্প ছাপ নিতে হত। আবার সেন্সরের নিষেধাজ্ঞায় কবিতার ওপর কালো কালির জ্যাবড়া ছাপ পড়ে গিয়েছে, জরুরি অবস্থার গোড়ার দিকে তা-ও দেখেছি। কোন্নগরের ‘মানচিত্র’ পত্রিকায় শঙ্খ ঘোষের কবিতায় ওই কালো কালির বিকট ছাপ পড়েছিল, মনে পড়ছে।
বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার আগে, ১৯৭৪ সালে কলেজে আমাদের স্নাতক শ্রেণির পরীক্ষা হয়ে গেছে তখন, উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরির মাঠে এক বিকেলে স্থানীয় কোনও পত্রিকা বা সংগঠন কবি-সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। আমাকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আয়োজকরা। ওই কবি সম্মেলনে এসেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত— তৎকালে এই কবিরা ছিলেন অতি উজ্জ্বল। ওই কবিসভায় আমি দু’টি কবিতার পরে মঞ্চের নিচে নামতেই তারা আমাকে ডেকে খুবই খাতির করেন। এরপর শক্তি বলেন, ‘সুনীল, কৃত্তিবাসের জন্য ওর কবিতা নিয়ে নাও।’


ওই প্রথম ওই নক্ষত্রসকলের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ পরিচয় হয়। কৃত্তিবাসে ওই ১৯৭৪-এর শেষে বা ১৯৭৫-এর গোড়ায় আমার একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। ওই সময়ই কলকাতার বিশ্বজ্ঞান প্রকাশনীর প্রকাশক দেবকুমার বসু আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়ে তাঁদের দপ্তরে ডাকেন। আমি সেখানে গেলে তিনি জানান। ন্যাশনাল রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড তরুণ কবি হিসেবে আমাকে দেওয়া হবে, তরুণ লেখক হিসেব পুরস্কার পাবেন বলরাম বসাক। গোর্কি সদনে ওই অনুষ্ঠানে আমাদের হাতে ওই পুরস্কার তুলে দিতে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্ল। পুরস্কার দেওয়ার আগে ওই অনুষ্ঠানে কবিতাপাঠের সময় যখন বিনয় মজুমদার কবিতা পড়তে ওঠেন, তাঁকে আমি প্রথম দেখি। তিনি তাঁর ‘ভুট্টা সিরিজ’-এর একটি কবিতা পড়তে শুরু করামাত্র আপত্তি ওঠে। চিৎকার-চেঁচামেচিতে বিনয় মজুমদারকে মঞ্চ থেকে উদ্যোক্তারা সরিয়ে দেন। পুরস্কার দেওয়ার পর যখন আমাকে বলতে দেওয়া হয়, আমি কবি বিনয় মজুমদারের এই অসম্মানের নিন্দা করি। কী কী বলেছিলাম, তা আর মনে নেই।

ফিরে আসি জরুরি অবস্থায়। জরুরি অবস্থা যখন এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে সমাজদেহে জাগছিল মুক্তিব্যাকুল উসখুস। বিশেষত ছটফট করছিল সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পজগতের মানুষজন। নাটকের দলগুলি নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছিল। দিকদিগন্তে যাচ্ছিল যাত্রার শিল্পীদের বাস। কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে শানু লাহিড়ী এঁকে যাচ্ছিলেন আশা-আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর মানুষজনের সমবেত মুখ। সাপ আর পদ্মফুল আঁকতে আঁকতে শিল্পী অসিত পাল মনোহর দাস তরাগের একটি গম্বুজে স্থাপন করলেন এক মুক্ত গ্যালারি। সেখানে চিত্র প্রদর্শনীরও থাকত আয়োজন। উঁকিঝুঁকি দিতে এসে পুলিশ ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল।
ওই রকমই একদিন, জরুরি অবস্থা ততদিনে ‘শিথিল’ ঘোষিতও হয়েছে, দুপুর গড়িয়ে সবে বিকেল তখন, চৌরঙ্গীর রাস্তায় দেখা গেল এক আজব মিছিল। ঢং ঢং ! একটি ঘণ্টা হাতুড়িতে পিটতে পিটতে এক যুবক চলেছে, তার পিছনেই দু-চারজন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটি পোক্ত কাঠের ঘরাঞ্চি। এদের পিছু পিছু জনা কুড়ি মানুষের রবীন্দ্রসদন অভিমুখে চলেছে ওই অভিনব মিছিল।
শিথিল জরুরি অবস্থার ওই মিছিলে তাজ্জব হয়ে গেল পথচারীবৃন্দ, যানবাহনের যাত্রী সকল।