আমার গৌরদা

Gourkishor Ghosh

১৯৮১-র লাগুর লগ্ন। তখনও বাঙালি জীবনে শুরু হয়নি মোবাইল ফোনের সর্বত্রগামী বিদ্যুৎদ্রুত দুঃস্বপ্ন। তখনও জড় ফোনের ডাক নিজেরা ছুটে গিয়ে ধরি। কিংবা না-ধরি। ফোনের সঙ্গে দিবারাত্রির সহবাসের সর্বগ্রাসী সর্বনাশ তখনও বাঙালির জীবন, বিচ্ছিরি বিয়ের মতো, চিবিয়ে ছিবড়ে করে দেয়নি। 

মোবাইল-মুক্ত সেই বিমল বেঁচে থাকার মধ্যে আমি একাধিক বাংলা-ইংরেজি বাণিজ্যিক পত্রিকায় ও খবরের  কাগজে তেড়ে লিখছি। থরে থরে ও স্তরে স্তরে ঘরে বসে প্রাইভেট টিউশন করছি। এবং বিবাহিত হয়েও একাধিক প্রেম করছি। ফুলের বনে যার পাশে যাই, তারেই লাগে ভাল। এবং এমন সর্বভূতে আমার বিরাজমানতা সম্ভব হচ্ছে মোবাইল ফোনের বিশ্বজোড়া ফাঁদ না থাকার জন্য। যেখানে-সেখানে ফোনের গোঁতমারা নেই। নেই অস্থানে-কুস্থানে যখন তখন বার্তা-ব্যাপিকা। নেই ফেসবুকের ফষ্টিনষ্টি ফ্যাসাদ। নেই ভিডিও কলের ভুবনব্যাপী দৈব আঁখিপাত। নেই মোবাইল-ফোনাশ্রিত লোকেশন সন্ধান ও অকুস্থল লোকিত করার কোনও উপায়। নেই পে ফোনে প্রেমিকা ও পাওনাদারের এখনই টাকা পাঠানোর আবদার ও জবরদস্তি। কী অবিরল আনন্দে ছড়িয়ে, গড়িয়ে, জিরিয়ে বেঁচেছিলেম আমরা মোবাইল-আপদহীন সেই সোনালি সময়ে। সেই সুদূর স্বপ্নময় অতীতে ঘটেছিল ঘটনাটা, যা বদলে দিল আমার জীবন একটি ডাক ও সাড়ার অব্যর্থ অভিঘাতে।

আমি তখন ইংরেজি পড়াই স্কটিশ চার্চ কলেজে। বসে আছি স্টাফরুমে। পরের ক্লাস ইংরেজি অনার্সের টিউটোরিয়াল। এই ক্লাসটা নিতে সবচেয়ে ভাল লাগে, যার বোধ, চোখ, বিন্যাসের জন্য, তার লাল টিপ আজও মনের মধ্যে নিভে যায়নি। একটু পরেই দেখা হবে তার সঙ্গে। বাইরে বৃষ্টি। আসবে তো? কখনও সে মিস করে না টিউটোরিয়াল। মনের মধ্যে অনিশ্চয়তার আঁচ থাকেই, যেদিন থাকে ওই টিপজ্বলা টিউটোরিয়াল।

আরও পড়ুন : সাগরময় ঘোষ পত্রিকা সম্পাদনায় নিয়ে এসেছিলেন অন্য রং!
লিখছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়…

স্টাফরুমে ঢুকল এক স্টাফরুম সেবক। কাছে এসে বলল, স্যর, আপনার একটা ফোন এসেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোনও নাম বলেছেন?’ 

‘হ্যাঁ স্যর, বলেছেন, গৌরকিশোর ঘোষ।’ 

গৌরকিশোর ঘোষ

পিলে চমকে উঠল। গৌরদা! কেন? নট মাই কাপ অফ টি। আমাকে এই সময়ে গৌরদা কী দরকারে? ফোনবক্স স্টাফরুম থেকে বেশ কিছুটা দূরে, ভাইস প্রিন্সিপালের ঘরের পাশে। 

‘হ্যালো’, ফোন ধরলাম।

‘গৌরদা বলছি, তোর সঙ্গে এখনই আমার দেখা করা প্রয়োজন।’

‘কিন্তু গৌরদা, একটা ক্লাস নিতে হবে এখনই। ক্লাসের পরে পারব।’ 

“তোর সিদ্ধান্তটা আমাকে জানতে হবে। এক ঘণ্টার মধ্যে। খুব জরুরি। তুই চলে আয় আমহার্স্ট স্ট্রিটে, ‘আজকাল’-এর অফিসে। না হলে আমি আসছি। দেরি করিসনি।” 

‘কীসের সিদ্ধান্ত?’ না প্রশ্ন করে পারি না। 

‘টেলিফোনে এসব কথা হয় না। তুই সোজা আমার কাছে চলে আয়। সামনাসামনি কথা বলব।’ 

গৌরকিশোর ঘোষের একটি ডাক বদলে দিয়েছিল জীবন…

আমার মন থেকে সেই বিন্যাস, বোধ, দৃষ্টি, লাল টিপ, সব মুছে গেল। গৌরদার ‘তুই চলে আয়’-এর মধ্যে এমন একটা জোর ও জরুরিপনা ছিল।

গৌরদা আমার মুখোমুখি। চোখদুটো হেডলাইটের মতো জ্বলজ্বল করছে। ওই দৃষ্টির সামনে সম্মোহিত না হয়ে উপায় নেই। গৌরদা বললেন, “জানিস তো ‘আজকাল’ আর কয়েকদিনের মধ্যে প্রকাশিত হবে। বাংলায় এমন সংবাদপত্র হয়নি। তোকে আমি চাই। সহ-সম্পাদকের পদে।”

‘গৌরদা, আমি তো বলেছি, যখন যা বলবেন লেখার চেষ্টা করব। কিন্তু স্কটিশ কলেজে ষোলো বছরের চাকরি। কী করে ছাড়ব বলুন?’

গৌরদা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার দিকে। আমি ক্রমশ সম্মোহিত হচ্ছি। গৌরদা আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। গম্ভীরভাবে বললেন, ‘মন খুলে বল, আমার কাছে আসতে তোর দ্বিধাটা কোথায়?’

বললাম যত সংক্ষেপে সম্ভব: বাবা মারা গিয়েছেন খুব বেশিদিন আগে নয়। বাবা চলে যাওয়ার পর মাকে নিয়ে আমি অথৈ জলে। তারপর আমার প্রথম বিয়েটা ভেঙে গিয়েছে। আমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চলেছি। এই সময়ে…

‘আজকাল’-এর শেষ দিনে…

‘এটাই একেবারে ঠিক সময়। নতুন সংসার, নতুন কাজ। নতুন উদ্দীপনা। সারাজীবন পড়াবি নাকি? একটা ঘরের মধ্যে শুধু এক জিনিস পড়িয়ে যাবি? আমি জানি তুই পরিবর্তন চাস। শোন, তোকে কী জন্য আমার দরকার।  আমি একটা নতুন ধরনের থার্ড পেজ করব। যেটা তুই করবি। বাঙালির মনে নানা দ্বিধা, বাধা, ইনহিবিশনস আছে। থার্ড পেজ যেটা হবে, বাংলা সংবাদপত্রে সেটা নেই। তোর লেখা নতুন স্বাদ আনবে বাংলা সংবাদপত্রে।  তোকে রিপোর্টার হিসেবে চাইছি না। তোকে নানা ধরনের বিনোদনের লেখা লিখতে হবে। আর ইন্টারভিউয়ের ধরনটা একেবারে বদলে দিতে হবে। শোন, তোকে আর একটা কথা বলে রাখি। রানি এলিজাবেথের বড় ছেলে চার্লস বিয়ে করতে চলেছে ডায়ানা নামে এক সুন্দরীকে। তোকে আমি লন্ডনে পাঠাব এই বিয়ে ‘আজকাল’-এর জন্য কভার করতে। হইহই পড়ে যাবে দেখবি।’ 

‘আমাকে?’ 

‘হ্যাঁ, তোকে। কারণ তুই আমেরিকায় ছিলি। কানাডায় ছিলি। ইউরোপে ঘুরেছিস। লন্ডনে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে ছিস। চার্লস ডায়ানার বিয়ে তুই কভার করবি।’

সে এক দীর্ঘ রাত! অনেক, অনেক কথা হয়েছিল গৌরদার সঙ্গে। দু’জনে রাম পান করতে করতে গৌরদা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে জয়েন করছিস?’

আমি বলেছিলাম, ‘কাল!’ 

এবং সত্যিই ষোলো বছরের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে ‘আজকাল’-এ চলে গেলাম, যে কাগজ তখনও বেরয়নি। শুধুমাত্র গৌরদা বলেছিলেন বলে, “তোকে আমার চাই। তুই যা খুশি, তাই লিখবি। তবে সকাল ন’টার মধ্যে আপিসে চলে আসবি। কখন বাড়ি ফিরবি, জানিস না।” 

‘আজকাল’ কিছু দিনের মধ্যে বেরল। আমজাদ আলি কলকাতায়। গৌরদা আমাকে পাঠালেন স্টোরি করতে। এমন কিছু, যা আগে হয়নি। আমার মাথায় আকাশ চুরমার হল।

আমজাদ ভীষণ ব্যস্ত। এবং চিন্তিত। সেইদিন সন্ধ্যায় তাঁর অনুষ্ঠান কলকাতায়। কিন্তু তাঁর সরোদের শরীর খারাপ। চিকিৎসা হচ্ছে গড়িয়াহাটে বাজনার বিখ্যাত দোকানে। সুভদ্র আমজাদ জানালেন, তাঁর বিন্দুমাত্র সময় নেই। তিনি গাড়িতে উঠলেন গড়িয়াহাটে যাবেন বলে। 

আমজাদ আলি

বললাম, ‘যেতে পারি আপনার সঙ্গে?’ 

বললেন, ‘সেটা পারেন।’ 

আমি তখনও আশায় আশায়, দরজা খুলবে। এটাই সাংবাদিকতার মজা। কখন যে দরজা খুলবে, কেউ জানে না। আমার কানে গৌরদার কন্ঠ, আমি চাই সেই স্টোরি, যা কেউ কখনও লেখেনি।

আমজাদ নামলেন গড়িয়াহাটের দোকানে। উস্তাদজিকে দেখে সবার হৃৎপিণ্ড গলায়। উনি খবর নিলেন আরও কতক্ষণ লাগবে সরোদের সুস্থ হতে। জানতে পারলেন, আরও ঘণ্টাখানেকের ব্যাপার। হঠাৎ আমজাদের নজরে পড়ল একটি সেতার। সত্যি দেখার মতো। আর দেখলেই গায়ে হাত দিতে ইচ্ছে করে। একটা ম্যাজিক টান আছে। আমজাদ বললেন, ‘ওই সেতারটা একবার দেবেন?’

আমজাদ আলির হাতে মুহূর্তে এসে গেল সেতার। তিনি বাজাতে শুরু করলেন। এবং চোখ বুজে ডুবে গেলেন।

সেই যুগে আমার কাঁধে ঝুলত আমার আদরের এডক্স, বেলোওয়ালা সেকেলে জার্মান ক্যামেরা। সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবির শুটিংয়ে এই ক্যামেরায় ছবি তুলছি দেখে তিনি ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করে বলেছিলেন, ‘সুন্দর ক্যামেরা।’

আমজাদ সেতার বাজাচ্ছেন। আর আমি ছবি তুলছি।

‘আজকাল’ কাগজের প্রথম পাতায় অ্যাংকর করে গৌরদা ছাপলেন আমার স্টোরি: গড়িয়াহাটের মোড়ে আমজাদের সেতার। সেই স্টোরি আয়নার সামনে আয়না ধরার মতো। অন্তহীন বিম্বন। আজও চলেছে। আমার কানে গৌরদার কণ্ঠের মতো, ‘যেন একটা নতুন দৃষ্টিকোণ থাকে, একটা নতুন টেক অফ! কেউ যা ভাবেনি, তোকে ভাবতে হবে। আর পুরনো ধারণা, পুরনো মূর্তিগুলো ভাঙতে হবে। ভয় পাবি না। দ্বিধা করবি না।’ 

ভাল কথা, অধ্যাপনা ছেড়েছিলাম বলে এতটুকু শোচনা নেই। ‘একটা ঘরে একই জিনিস পড়িয়ে চলেছিস, ভাবতে পারিস?’ প্রশ্ন করেছিলেন গৌরকিশোর। 

ভাগ্যিস তিনি ঘটেছিলেন আমার জীবনে!