বাবার প্রসাদ…

'Hashish Smokers' by Gaetano Previati, created in 1887.

‘বাবার চরণে সেবা লাগে!’ Happy Father’s Day-র শুভ মহরতে এই পরিষেবা, পিতৃপুরুষগণের পদসেবা কতখানি করছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, তবে এ-বিষয়ে সকলেই প্রায় কমবেশি একমত যে, সেবা যেহেতু ‘দেহের নিমিত্ত’, তাই পদের বদলে পেটের সেবাই উত্তম।

শাস্ত্রেও সম্মতি আছে, এবিষয়ে— ‘প্রণামে, পিতৃপুরুষদের পেটটি না ভরে, পিণ্ডোদক না পেলে নরকে পচে মরে…’ ইত্যাদি-ইত্যাদি। যদিও ভারতে, ব্রাহ্মণ্যবাদ, দাদাগিরি এবং পডকাস্ট-পালা-পরব হাত ধরাধরি করে চলে; কিন্তু, ‘বাবা’বাদ এখনও যথেষ্ট ক্রিয়াশীল অক্ষশক্তি।

আরও পড়ুন: রিলসে মগ্ন যাত্রীরা, মানুষ কি সহযাত্রীর দিকে মুখ তুলে চাইবেন না আর? লিখছেন রোদ্দুর মিত্র

আশারাম থেকে রামরহিম, বাবাদের মধ্যেকার— ফ্রাঙ্কো-হিটলার-মুসোলিনিজাতীয় সমস্যা হামেশাই বহমান। এ-জাতীয় সমস্যা থেকে ‘মুক্তিকরফলায়তে’ বিজাতীয় কোনও কারণবারি নন। এই গৃহযুদ্ধের একমাত্র তকদির হয়ে আসেন ‘বাবার প্রসাদ’। নিন্দার্থে গাঁজা।

‘ওঁ কালীয়কান্ত, চৌষট্টি মোহান্ত, অষ্ট কবিরাজ, দ্বাদশ গোপাল/ যে বলে গাঁজা খায়না, তার ঘরপোড়া কপাল’— হুতোম থেকে আলাল, উনিশ শতকের রেফারেন্স বইতেই মুড়ে রাখলে, এই সুভাষিত খাস একবিংশ শতাব্দীর এক রাঙাজামা, লালচোখো সাধুর। প্রেমভক্তির পাড়ে, রতনকাটারির ধারে গঞ্জিকার শুরুয়াত, রক্তনয়ানে— মালকোষ দশায় তার মধ্যগগন, আর শেষতক টানলে, পিতার আশীর্বাদে বলীয়ান ভক্ত কোন ভবনদীর কিনারে গিয়ে ঠেকবেন, তা বলা শিবের অসাধ্যি।

‘অথর্ববেদ’ থেকে ‘মুঘলনামা’, বাবার প্রসাদ নিয়ে আপত্তি— কোনও রাজাগজা না করলেও, এমন বাবার’পরে খাঁড়ার ঘা প্রথম নামিয়েছিলেন, ঔপনিবেশিক শাসকরা। জেসাস মালুম, কে তাঁদের সালিশ করেছিল (বা নালিশ করেছিল)-গাঁজা খেয়ে, এ-সভ্য দেশের বুকে, একগাদা হিদেন এসে ঝামেলা পাকায়।

এবার মতিয়ের রচিত সুসমাচারেও যখন গেঁজেলদের মতি ফিরল না, কর্তারা তখন খুললেন লুনাটিক অ্যাসাইলাম। চন্দ্রচূড়ের সন্তানগণ, মহানন্দে সদলবলে চন্দ্রাহত হয়ে, সেখানে বিরাজমান হইলেন, বিধায় গারদ গুলজার করে রাখলেন। বাবা, তোমার দরবারে সব পাগলের মেলা – বাবার গুডউইল যে বহুদিনের।  

যদিও কলকাতায় তখন পক্ষীদের রমরমা। গেঁজেলরা কথাও বলতেন কিচিরমিচির যোগে, তেমন-তেমন জটায়ু, শূন্যমার্গে বিচরণ করতেন বলেও শোনা যায়। তখন কলকাতার বিখ্যাত গাঁজার ঠেক ছিল তিনটি— বাগবাজার, বটতলা আর বউবাজার (সৌজন্যে: শিবনাথ শাস্ত্রী)।

গেঁজেলরা কথাও বলতেন কিচিরমিচির যোগে, তেমন-তেমন জটায়ু, শূন্যমার্গে বিচরণ করতেন বলেও শোনা যায়। তখন কলকাতার বিখ্যাত গাঁজার ঠেক ছিল তিনটি— বাগবাজার, বটতলা আর বউবাজার ।

একবার মহারাজ (বাবা সম্প্রদায়ের নন, বাবু সম্প্রদায়ের) গোপীমোহন দেব এই পক্ষীকুলের তামাশা দেখতে চান। অনেক সাধ্যসাধনার পর, পাখির দল খাঁচা করে (যোগরুঢ়ার্থে পালকি চড়ে) রাজসমীপে গমন করেন। গাঁজা ভাল অ্যাপেটাইজার, অতএব পাখিরা, পেটটি পুরে খেয়েদেয়ে, পড়ে রইলেন চবুতরায়। তাঁদের দ্বারা আলাদিনের উড়ন-খাটোলায় চড়া আর হল না।

একথা নির্জলা সত্যি, মিলারেপা-র নাম বঙ্গদেশে প্রচলিত না থাকলেও, গেঁজেল সমাজে তাঁর বিদ্যের কদর ছিল। আর জাহাজের মধ্যে যেমন, শ্রীযুক্ত টাইটানিক, তেমনি পাখিদের মধ্যে ছিলেন পটলভাঙার রূপচাঁদ পক্ষী এবং বাগবাজারের নিতাই ঘুঘু। যদিও টাইটানিক ছিলেন, বাগবাজারের পাখিটিই। কথিত আছে, বাবার প্রসাদে— কুতুবমিনার হতে পেরেছিলেন প্রথমজনই, হতভাগ্য নিতাই, বাবার দাক্ষিণ্যে শহিদমিনার হয়ে যান। নিধুবাবু নিজে, এই রুপচাঁদ পক্ষীরাজের প্রসাদগুণমুগ্ধ ছিলেন, যদিও সে প্রসাদ ভক্তিগীতির, লুপ্তস্মৃতির নয়।

কালক্রমে গাঁজা ভোল বদলেছে। অহোরাত্র ‘ব্যোম-ব্যোম’ ধ্বনির বদলে, বব মার্লের গানের কলি এখন ফ্যাশন। বাবা যেহেতু, পয়লা থেকেই সিদ্ধিতে ফার্স্ট ডিভিশন ছিলেন, এবার ফুলব্রাইট বৃত্তিতে বিকশিত হয়ে গেলেন লিঙ্কনের দেশে।  বিটবংশের বিটলেমি বা ডিলানের গিটার— কোন মাধ্যমে বাবার প্রসাদ খাস মার্কিন মুলুকে আত্মপ্রকাশ করল, তাই নিয়ে নানা মুনির নানা মত।

হিপি কালচারের ট্রেন্ড সেন্টার, মায় আভাঁগার্দ হয়ে দাঁড়াল, গাঁজা— শান্তি, বিপ্লব, উচ্ছল জীবন এবং বিমূর্তশিল্পের প্রতীক হয়ে উঠল উইড। এমন গরিমাময় কাউন্টার কালচারের ঠেলায়, ছিলিম হয়ে উঠল জয়েন্ট, পাড়ায়-পাড়ায় কেনা হল গিটার, কলেজ মাত্রেই গড়া হল মুক্তাঞ্চল। ক্যান্টিনে, ঝোপেঝাড়ে, পথে ঘাটে, বাথরুমে— এখনও কিছু পাঁচতারা মলে, চোখে পড়ে টুকরো-টাকরা বস্তার, অবুঝমার কিংবা লংমার্চের নিভে যাওয়া ফিল্টারের বিদ্রোহ। এদিকে দাদাঠাকুর স্রেফ লিখেই খালাস- ‘মজা করে খাওরে গাঁজা, সদা মন আনন্দে রবে।’

তা, যুগধর্মের পন্থা হলো চরৈবেতি। সেখানেও বাবার অগ্রগতি পিছিয়ে নেই। তাঁর মার্চেন্ডাইজ, বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন নামে উপলব্ধ আজ। কেবল এদেশেই মেলে মাইসোর ম্যাঙ্গো (টিপুর দয়া), ইদ্দুকি গোল্ড (ডবল মনসুনের কৃপা), ম্যাজিক মাশরুম (ব্যাঙের অনুগ্রহ), মনিপুরি (কিকের রাজা), গৌড়ভাঙা (শশাঙ্কের প্রজা?), মানালি ক্রিম (ব্রহ্মা জানেন, এটা কার গোপন কম্ম!)— সক্কলে মিলে হারমোনি ইন ডাইভারসিটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সর্বধর্মে, সর্বস্থানে, সর্বলোকে তূরীয়ানন্দে লীন হতে যেকোনও নামের একটির স্মরণ করুন, বিপদ এবং বিপথ— এই দুই বান্দা সর্বদা আপনার শরণ্যা হইয়া, সঙ্গে-সঙ্গে পথ চলিবে। সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যজ্যতি পণ্ডিত- টালমাটাল অবস্থায় যদি পুলিশনাথের দর্শন পান, সঙ্গে সঙ্গে এক পায় জুতো গলিয়ে দৌড়োন, অপর পাটির ব্যবস্থার জন্য সারমেয়রা বর্তমান। অবশ্য যদি নিজেকে সাধু-মহারাজ প্রতিপন্ন করতে পারেন, তাহলে আলাদা কথা – ‘রাজা সর্বত্র পূজ্যতে’।

বাবার নিবেদনে গাঁজার এক দোসর আছে, বলা যায় বড় তরফের শরিক, নাম তার ভাঙ। হোলির দিনে মন রাঙানো থেকে শিবরাত্তিরে আসর মাতানো— সবকিছুতেই তিনি অমিতশক্তি, একমেবাদ্বিতীয়ম। গাঁজা কুচোনোর প্রেমতক্তি বা রতনকাটারির বাহার নয়, সোজা খলে ফেলে মেড়ে নাও, তারপর আর কি- ‘বিষকুম্ভং পয়োমুখম’। রসিকজন রাগ করবেন না, দোলযাত্রায় হাত-পা দুমড়ে নর্দমা-নদীতীরে পুণ্যস্নান কিংবা ‘ভোজনং ভাণ্ড-ভাণ্ড, শয়নং ফুটপাথ-মন্দিরে’— এইসকল বীরোচিত কার্যের তাগিদ জোগাতে ভাঙ অব্যর্থ। আর বারাণসীর ঘাটে অঘোরীর পাল্লায় পড়ে  সুজুকি নামধারী জাপানিকে ভুঁয়ে গড়াগড়ি খেতে দেখেছে এই অধম নিজেই। কাজেই, ‘সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি, ভাঙ খেয়েছে জাপানি’— এই বচন সম্বল করে উৎসাহী পাঠকগণ ভূমার আস্বাদ নিতে ভাঙ খেতেই পারেন।

তবে ঘণ্টাখানেক পর, হৃদকমল-মঞ্চে যদি করালবদনী শ্যামার বদলে হিরোশিমা-নাগাসাকি’র তাণ্ডবনেত্য শুরু হয়, তার জন্য এই নরকুলের চারকোল কোনওভাবেই দায়ি নয়। বরং স্মরণে রাখবেন শ্রীশ্রীকন্ডাক্টর উবাচ – ‘মালের দায়িত্ব আরোহীর’।

সংক্ষেপে কথাটা এই যে, গিরীশ মহাপাত্র মহাশয়— গাঁজার কলকে নিয়ে ঘোরেন ঠিকই, কিন্তু তিনি বাবা-ইয়াগা। তিনি গাঁজা সেজে দেন, সেটা তাঁর ভেক; সুযোগ পেলেই মটকে দেন ইংরেজের ‘Neck’. ‘পথের দাবি’র আসল দাবিদার কোনজনা, সেই নিয়ে পাতার পর পাতা আলোচনা করা যেতে পারে, তবে মধ্যরাত্রে ফুটপাথের দখল নিয়ে জলচর এবং খেচরদের মধ্যে রাগবিস্তার এবং বাগবিতন্ডার শেষ নাই।

মালবকৌশিকের রক্তচক্ষু বনাম তরলকৌশিকের দোলনচাঁপার মাঝখানটিতে থাকেন কিছু সব্যসাচী। তাঁরা ‘ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি’ বাক্যবন্ধ সম্বল করে বাড়ির রকে, স্ট্যাচুর পদে এবং জেলখানার গর্তে— পরমার্থের খোঁজে অকাতরে নিদ্রা যেতে পারেন।

কিছুদিন আগেই, এমন এক ‘আমি রবীন্দ্রনাথ’কে এইটবি থেকে তুলে ই- ওয়ান বাসে বসিয়ে দেওয়ার সময়ে, এক অনন্যসাধারণ রচনা শুনতে পাই তাঁর মুখে। ‘চেয়ে দেখি ঠোকাঠুকি বরগা কড়িতে, কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে’- পিতৃপ্রসাদে নোবেল না থাকলেও, নেশা যে ভাগ্যে আছেন; ভাগ্যবান মাত্রেই এ সম্যক বুঝবেন। অতএব, কিমধিকমিতি।