নোনতা হাওয়ার গান

Representative Image

সমুদ্রের সঙ্গে কতবার যে কতভাবে পরিচয় হয় মানুষের, তার কোনও হিসেব নেই। আর প্রতিবারই, সমুদ্রস্নান মানুষকে একটু হলেও অন্যরকম করে দেয়, এই আমার বিশ্বাস। যে-মানুষ স্নানে নামে, জল থেকে সে আর ওঠে না। উঠে আসে অন্য মানুষ, নতুন স্নানের পর। গানও অনেকটাই এরকম। অন্তত আমার জীবনে তো বটেই। কতবার যে কত নতুন গান এসে আমার চলার পথ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ফিরে গিয়েছে, তা আজ আর হাতে গুনে বলতে পারি না। তেমনই একখানা নতুন গানের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল সমুদ্রের পাশে। 

আমরা তখন কলেজে পড়ি। ছোটখাটো একটা দলও আছে আমাদের, আড্ডার। তার মধ্যে যে সকলেই আমার মতো ভূগোল পড়ে, তা নয়। কেউ ইংরেজি, কেউ অর্থনীতি, কেউ বা ডাক্তারি। কিন্তু মিলিজুলি সরকার একখানা বানানো হয়েছে এবং তা বেশ ভালই চলছে। সেইরকমই এক এলোমেলো আড্ডায় একদিন হঠাৎ প্রস্তাব উঠল, সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাওয়া যাক। শুনতে মন্দ নয় ব্যাপারটা। কিন্তু যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া, এসবের তো বিস্তর খরচ! সে জোগাবে কোন চিন্তামণি? ঠিক হল, আমরা খুব কমসমের মধ্যেই গোটা ব্যাপারটা সারব। এক বন্ধুর আত্মীয়ের একটা বাড়ি আছে কলকাতা থেকে কিছু দূরে, ফ্রেজারগঞ্জে। সে-বাড়ির অবস্থা যে খুব ভাল এমন নয়, কিন্তু কয়েকখানা লাগোয়া ঘর আছে, আর সেখান থেকে হেঁটে দশ মিনিট গেলেই সমুদ্দুর। এর চেয়ে ভাল ব্যাপার আর কী-ই বা হতে পারে! অতএব, আমরা বাস ধরে, ফেরি চড়ে, টোটো চেপে পৌঁছে গেলাম ফ্রেজারগঞ্জ। ঝাউবনে ঘেরা, সমুদ্রের নোনা বাতাসে ভেজা জায়গাটাকে প্রথম দেখায় মন্দ লাগল না আমাদের। 

আরও পড়ুন : ‘সমুদ্রের বাচালতা’-কে পর্যটন আর পরিক্রমায় চেনায় উৎপলকুমার বসুর ‘পুরী সিরিজ’! লিখছেন অভীক মজুমদার…

খুব সাধারণ একটা বাড়ি, বেশ পুরনো। শীতাতপের প্রশ্নই নেই, কয়েকখানা সিলিং-পাখা ক্লান্ত হয়ে ঘোরার চেষ্টা করে চলেছে। আমাদের সে-ই অনেক। আছে একটা পোড়ো ছাদ, সারাদিন সমুদ্রের ধারে অগোছালো ঘুরপাকের পর যেখানে এসে আমরা মন শুকিয়ে নিই। দুটো দিন বেশ কাটল। হইহই, পানভোজন, দেদার আড্ডা আর রাত জাগা। সেইসঙ্গে যখন ইচ্ছে নোনা জলের উথালপাথালে গা ভাসানো। তৃতীয় দিন বিকেল থেকে একটু একটু মনকেমন শুরু হল। পরের দিনই ফিরে যাওয়া। আবার সেই কলেজ, সেই টিউশন, সেই বাঁধন! দিব্যি ছিলাম তিনটে দিন। শেষ দিন সন্ধের দিকে, যখন রোদ বেশ তরল হয়ে মিশে গিয়েছে সমুদ্রের জলে, দেখলাম আমাদের দলেরই একটি মেয়ে সকলের থেকে দূরে, বালির ওপর চুপচাপ বসে আছে। তারও নিশ্চিত মনকেমন, মনে হল আমার। 

এখানে বলি, এই আড়াই দিনে আমরা সক্কলে একে-অপরকে প্রচুর গান শুনিয়েছি। সকলেই কম বেশি গাইতে পারে। আর যেটুকু যার খামতি, তা নিয়ে কোনও লজ্জা নেই বন্ধুদের মধ্যে। তাই সোলো, ডুয়েট থেকে কোরাস, সবই হয়েছে। এই মেয়েটিকেও বেশ কিছু গান গাইতে শুনেছি। তাকে একা বসে থাকতে দেখে পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী রে, মনখারাপ করছে?’ সে কোনও উত্তর না-দিয়ে উঠে পড়ে হাঁটতে লাগল ঢেউয়ের ধার ঘেঁষে। আমিও চললাম পাশে পাশে। একসময়ে আবার বললাম, ‘একটা গান শোনাবি? কে জানে এখানে আবার কবে আসা হবে, দল বেঁধে আদৌ আসা হবে কি না!’ এ-কথা শুনেও সে চুপচাপ হাঁটল কিছুক্ষণ। বোধহয় মনের মধ্যে গানটাকে চারিয়ে নিতেই। 

তারপর হঠাৎই তার গলায় একটা অশ্রুতপূর্ব সুর আর কথা ফুটে উঠতে শুনলাম। ‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে/ নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ/ আমি শুনেছি সেদিন তুমি নোনাবালি তীর ধরে/ বহু দূর বহু দূর হেঁটে এসেছ/ আমি কখনও যাইনি জলে, কখনও ভাসিনি নীলে/ কখনও রাখিনি চোখ ডানামেলা গাঙচিলে/ আবার যেদিন তুমি সমুদ্রস্নানে যাবে/ আমাকেও সাথে নিও, নেবে তো আমায়/ বলো, নেবে তো আমায়…’।

এরকম একখানা গান যে আছে, বোকাসোকা আমি সে-খবর তখনও পাইনি। ফলে, সমুদ্রের ধারে, ওই ছেড়ে আসার মনখারাপের মধ্যে এই গানের কথা আর সুর আমার মনখারাপকে বহু গুণ বাড়িয়েই দিল। 

সুরের মধ্যে একটা পুনরাবৃত্তি আছে, যেমন মনখারাপের বাতাসে থাকে। সে বারে বারে একই পথে ফিরে এসে হানা দেয়, এ-গানের সুরও তাই। আর যখন বলা হচ্ছে, ‘আমাকেও সাথে নিও, নেবে তো আমায়…’, এইটুকুর মধ্যে আকুতি, অনুরোধ, আশঙ্কা আর অনির্দেশ একসঙ্গে ফুটে উঠছে, এমনই আশ্চর্য আর অব্যর্থ শব্দ-সুরের প্রয়োগ!

কলকাতায় ফিরে এসে আমার প্রথম কাজ হয় মৌসুমী ভৌমিকের এই গানটি জোগাড় করা। হাতখরচার পয়সা থেকে ক্যাসেটখানা কিনি এবং কেবল এই গানটা বারংবার শুনতে থাকি। সত্যি বলতে কী, এই সংকলনের বাকি গানগুলোর কাছে আমি অনেকদিন পরে পৌঁছেছি। কেননা, এই গানটিকে অতিক্রম করে উঠতে পারিনি। যে-গানের মধ্যে সমুদ্র ভেসে আছে, তাকে কি পেরিয়ে যাওয়া যায় কখনও?

সুরের মধ্যে একটা পুনরাবৃত্তি আছে, যেমন মনখারাপের বাতাসে থাকে। সে বারে বারে একই পথে ফিরে এসে হানা দেয়, এ-গানের সুরও তাই। আর যখন বলা হচ্ছে, ‘আমাকেও সাথে নিও, নেবে তো আমায়…’, এইটুকুর মধ্যে আকুতি, অনুরোধ, আশঙ্কা আর অনির্দেশ একসঙ্গে ফুটে উঠছে, এমনই আশ্চর্য আর অব্যর্থ শব্দ-সুরের প্রয়োগ!

এ-গানের মধ্যে প্রেম, বিরহ, অপেক্ষা, রাজনীতি, সমাজবোধ, দর্শন, সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। কীভাবে মৌসুমী লিখতে পারলেন, ‘আমি শুনেছি সেদিন নাকি/ তুমি তুমি তুমি মিলে/ তোমরা সদলবলে সভা করেছিলে’! এই একটি লাইনের কাছে যতবারই ফিরি, বিস্ময় ঘিরে ধরে আমাকে। বাংলা গান আর কবিতায় এই ‘তুমি’-র যাতায়াত তো অগণন। কিন্তু সেই ‘তুমি’ সবসময়ই কোনও একজন। তাকে পরপর তিনবার বসিয়ে যে ‘সদলবলে’ করে দেওয়া যায়, ‘একাকী’-কে যে ‘জনতা’ করে তোলা যায় কেবল একটি শব্দের বহু ব্যবহারে, তা এর আগে অকল্পনীয় ছিল। যেন-বা অনায়াসেই মৌসুমী তা করেছেন। ব্যক্তিকে এক লহমায় করে তুলেছেন সমষ্টি। সংসারকে করে তুলেছেন পৃথিবী। 

আর এই সবের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে এক অদ্ভুত মনকেমন করা গিটার ও বাঁশির আবহ, যা এই গানকে নিয়ে গিয়েছে অন্য মাত্রায়।

আজ বুঝতে পারি, আমাদের যৌবন থেকে যে-কয়েকটি গান আমাদের বার্ধক্য পর্যন্ত সঙ্গী হবে, তার মধ্যে এ-গান অন্যতম। সেই সমুদ্রের তীর, সেই তিনদিনের ছুটি, সেই এলোমেলো বন্ধুদল আজ আর নেই, ফিরবেও না কোনওদিন। কেবল গাঙচিলের ভিজে ডানায় মরা রোদ্দুর আর নোনতা বাতাস বয়ে বয়ে ফিরে আসবে এই গান, যার কাছে আমার আজীবনের ঋণ।