ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ‘মা কী হইলেন’


    হিয়া মুখোপাধ্যায় (December 26, 2024)
     

    ‘মা কে খিলাফ এক শব্দ ভি নেহি!’

     -রিয়েলিটি শো-এর বিচারক হুংকার দিয়ে উঠলেন। বাকি বিচারকরা হতভম্ব। অ্যাঙ্করও চুপ। স্টেজে বোম্বাচাক খেয়ে যাওয়া প্রতিযোগী। দ্বিতীয় এক বিচারক বোধহয় হালকা প্রতিবাদ করতে চাইছিলেন, কিন্তু প্রথম জন আবারও চিৎকার করে বলে উঠলেন- ‘মা কে আগে কুছ নেহি!’ এরপর আর সত্যিই তর্ক-বিতর্কের অবকাশ থাকে না। আবেগে থরথর বিচারক বলেন আর কথা নয়, এবার তিনি গান গাইবেন। কোথা থেকে উড়ে একটা স্প্যানিশ গিটারও চলে আসে। আর প্রতিযোগী, অ্যাঙ্কর, সহ-বিচারক- সব্বাই মিলে তখন ‘মা মেরি মা’ বলে হাশিখুশি মাতৃবন্দনার গান গাইতে থাকে কোরাসে। শট ফেড আউট করে যায়।

    ‘এলএসডি টু’ সিনেমার পরিচালক দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় হাড়ে হাড়ে বুঝিয়েছিলেন, ‘মা’ শব্দটি আখেরে একটি ডাইনামাইট। যুক্তি-পালটা যুক্তির পরতে তৈরি করা তর্কের সিঁড়িতে একবার ওই শব্দটি ছুড়ে মারতে পারলেই কিস্তিমাত। কারণ ‘মা’- শুধু শব্দ নয়, একখান দুর্ধর্ষ আবেগ। আর সে আবেগ প্রশ্নাতীত। কারণ প্রশ্নকর্তার কি মা নেই? মা না থাকলে তিনি এ-ধরাধামে অবতীর্ণ হতেন কীভাবে? আর কীভাবেই বা এই সর্বগ্রাসী মাতৃ-আরাধনাকে জিজ্ঞাসাচিহ্নের মুখে দাঁড় করাতেন? কাজেই যাবতীয় সংলাপে ইতি টানার মোক্ষম অস্ত্র- মা!

    ‘এলএসডি টু’’ ছবির দৃশ্য

    কিন্তু মুশকিলটা হল, সর্ব-আরাধ্য এই মাতৃরূপটির সঙ্গে জলজ্যান্ত মায়েদের খুব একটা সম্পর্ক নেই। এমনকী, কখনও কখনও এই আলোচনা থেকে সত্যিকারের মায়েরা পুরোপুরি উধাও! যা পড়ে থাকে, তা এক অসম্ভব ধারণামাত্র। দেশমাতৃকা। মাদার টেরেসা। জনমদুখিনী মা। ইয়ামি মামি। সুপার মম। মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়। মাতৃরূপিনী দেবী। এই ধারণার সবটুকুতে খাপে খাপে ফিট করে যাওয়া রক্তমাংসের কোনও হোমো সেপিয়েন্সের পক্ষে অসম্ভব। অবশ্য মা-কে বেদিতে বসিয়ে পুজো করার একটা সুবিধে এই যে, পাথরের প্রতিমা তো আর পালটা কথা বলে না!

    কথা বললে সমূহ বিপদ। যেমন রাধিকা আপ্তে। সদ্য মা হওয়া রাধিকা আপ্তে দোষের মধ্যে বলে ফেলেছিলেন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার অভিজ্ঞতা তার কাছে সুখকর ছিল না মোটেই। জানিয়েছেন, বিনা পরিকল্পনায় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ায় একজন গর্ভবতী নারীর শরীরে দীর্ঘ ন-মাস ধরে যা যা পরিবর্তন আসে, তার জন্য মানসিকভাবে তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। শরীরে হরমোনের ভারসাম্য ঘেঁটে যাওয়ার ফলে যা যা বিচিত্র উৎপাত শুরু হতে পারে- ওজন বেড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে মনমেজাজ যখন তখন খারাপ হওয়া, অনিদ্রা অথবা শরীরের নানা অংশ হঠাৎই ফুলে যাওয়া- এসবে যথেষ্ট ভুগেছেন তিনি। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একদিন দেখেছেন তিনি নিজেই নিজেকে চিনতে পারছেন না। রাধিকা বলেন- ‘বিরক্ত লাগছিল। তাই এই নিয়ে আমার কোনও আনন্দ ছিল না।’

    রাধিকার এহেন বয়ানের পর ট্রোলিং-এর বন্যায় তার কমেন্ট বক্স ভেসে গেছে। এমনকী, নিজের প্রেগনেন্সি ফোটোশুটে যখন সংবাদপত্রের ভাষায় ‘সাহসী’ নেট ড্রেস আর ব্রা লেস ম্যাক্সি পরে রাধিকা ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন- ঘোরতর অন্তঃসত্ত্বা একটা শরীরের উচ্চকিত চিৎকারের মতো সেই ছবিগুলিতেও হয়তো নেটিজেনদের ততটা আপত্তি নয়, যত না ‘প্রেগনেন্সি’ আর ‘বিরক্তিকর’ এই শব্দদুটোকে এক লব্জে উচ্চারণ করার মতো দুঃসাহসে। এক বিক্ষুব্ধ নেটিজেন তো বলেই বসলেন, অন্তঃসত্ত্বা হলে এসব তো হয়েই থাকে! এ নিয়ে এমন প্যানপ্যানানি তো কেউ করে না!

    অথচ ভেবে দেখলে; একটা গর্ভবতী নারীশরীরে যা যা ঝড়ঝাপট উঠতে পারে, রাধিকা তার সাক্ষাৎকারে সেসবের সিংহভাগ নিয়েই আলোচনা করেননি! মেয়েদের অন্তঃসত্ত্বা শরীরের অস্বস্তি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অ্যানা ক্যারেনিনার বিখ্যাত প্রথম বাক্যটি মনে না করার কোনও কারণ নেই; প্রতিটি অসুখী ‘শরীর’ যেখানে নিজের মতো করে অসুখী। মর্নিং সিকনেস থেকে থেকে শুরু করে শ্রোণীচক্রের অসহ্য যন্ত্রণা, চুল পড়ে যাওয়া অথবা রাতের পর রাত নির্ঘুম থাকা-তালিকা দীর্ঘ। এমনকী, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরও একটা বড় অংশের মেয়েরা প্রসবোত্তর অবসাদে ভুগতে থাকে। ‘বিরক্তি’ না জাগার কোনও কারণ নেই। কিন্তু সে-কথা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করে রাধিকা এক বিষম লক্ষণরেখা পার করে ফেলেছেন!

    কারণ সবার ওপরে ইমেজ সত্য। আর বহু-বহু যুগ ধরে জনমানসে যত্ন করে নির্মিত মাতৃ ইমেজ আমাদের শিখিয়েছে- নারীর এক এবং একমাত্র পূর্ণতা মাতৃত্বে। আর সে মাতৃত্ব সর্বংসহা। নিঃস্বার্থ। সন্তানের মুখ চেয়ে, পরিবারের মুখ চেয়ে ক্রমাগত আত্মাহুতি দিয়ে চলাই তার চরিত্র। মায়েদের কষ্ট হতে নেই। বিরক্তি তো নৈব নৈব চ! সত্যিকারের মায়েদের ‘বিরক্তি’ জাগলে ‘মা’ স্টিরিওটাইপটির গায়ে আঁচ পড়বে! আর আসল মায়েদের থেকে কল্পনার আদর্শ মায়েদের নিয়েই যাবতীয় উৎকণ্ঠা। অথচ একথাও হাড়ে হাড়ে সত্যি, একটি মানবশিশুর জন্মের জন্য মায়েরা একা দায়ী নয়। কোনও এক আশ্চর্য নিয়মে বাবারা বরাবরই এসব সামাজিক প্রত্যাশার সমীকরণের বাইরে…!

    সেই কোন যুগে সিমন দ্য বোভ্যেয়া তার ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইতে লিখেছিলেন; কেউ নারী হিসেবে জন্মায় না বরং সমাজ তাকে নারী হিসেবে গড়ে তোলে। আর্থসামাজিক বাস্তব দিয়ে তিলে তিলে তৈরি করা সেই সেই ‘নারী’ নামক ধারণাটির চূড়ান্ত রূপ ওই ‘মা’। বোভ্যেয়া-র মতে মাতৃত্বকে আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব, ঐশ্বরিক আশীর্বাদের মতো পুজোর বেদিতে বসানো আখেরে নারীকে সাংসারিক যাঁতাকলে বেঁধে রাখার পুরুষতান্ত্রিক প্রয়াস ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি লিখেছিলেন, ‘নেহাত একটা মেয়েকে একথা বলা যায় না যে সারাজীবন ধরে স্যসপ্যান ধোওয়া তার ঐশ্বরিক কর্তব্য, সেজন্যই বাচ্চা প্রতিপালন করাকে দেবদত্ত আশীর্বাদ বলতে হয়।’ নারীবাদী লেখিকা শিলা হেতি তার ‘মাদারহুড’ বইয়ে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে লেখেন, ‘প্রতিটি নারীকে সন্তানের জন্ম দিতে হবে কারণ তাকে ব্যস্ত রাখতে হবে। যে নারী নিজের সন্তানকে নিয়ে ব্যস্ত নয় তাকে দেখলে কেমন অস্বস্তি জাগে। ব্যস্ত না থেকে সে করবেটা কী? ঠিক কী ধরনের ঝামেলা পাকাবে?’

    এসব অবশ্য বিষম অলুক্ষুণে কথা। তবু, ‘নারীবাদ’ শব্দটা শুনেই যারা শিউরে ওঠেন, তাদের অন্তত একবার কোরা বা রেডিটের মতো অ্যানোনিমাস প্ল্যাটফর্মগুলো ঘুরে আসা উচিত। স্ত্রী-কে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার জন্য তাকে অন্তঃসত্ত্বা করা অথবা অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী-কে চাকরি ছাড়ার জন্য বাধ্য করার উপায় জানতে যে পরিমাণ পুরুষ পরামর্শ চেয়ে এসব সাইটে পোস্ট করেন; সংখ্যাটা দেখলে সিমন দ্য ব্যোভেয়া-র স্যসপ্যান তত্ত্বকে আর ততটাও ‘বাড়াবাড়ি’ মনে হয় না।

    সেই কোন যুগে সিমন দ্য বোভ্যেয়া তার ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইতে লিখেছিলেন; কেউ নারী হিসেবে জন্মায় না বরং সমাজ তাকে নারী হিসেবে গড়ে তোলে। আর্থসামাজিক বাস্তব দিয়ে তিলে তিলে তৈরি করা সেই সেই ‘নারী’ নামক ধারণাটির চূড়ান্ত রূপ ওই ‘মা’।

    কাজেই বিষয়টা কখনওই মা ও সন্তানের স্বাচ্ছন্দ্য নয়। বিষয়টা বরাবরই নারীশরীরের দখলদারির। জন্ম ইস্তক, দেশ- কাল-জাতি-শ্রেণি নির্বিশেষে প্রতিটি মেয়েকে সেই দখলদারির বিরূদ্ধে লড়ে যেতে হয়। তাকে প্রাথমিকভাবে লড়তে হয় পছন্দের যৌনসঙ্গীকে ‘হ্যাঁ’ এবং অনভিপ্রেত দৃষ্টিদের ‘না’ বলার জন্য। এরপর তাকে লড়তে হয় ‘মাতৃত্ব’-কে স্বেচ্ছায় স্বীকার অথবা অস্বীকার করার জন্য। তাকে লড়তে হয় গর্ভপাতের অধিকারটুকুর জন্যও।

    আর যে নারী মাতৃত্বকে একটি স্বাভাবিক ঘটনার মতো গ্রহণ করল, তাকে লড়তে হয় জোর করে আরোপিত দেবীত্বর বিরূদ্ধে, নিজের মানবী সত্তাটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আর রাধিকাদের লড়তে হয়, তাদের ‘বিরক্তি’-টুকু প্রকাশের জন্য।

    রাধিকা অবশ্য ট্রোলিংকে পাত্তা দিতে নারাজ। তিনি জানিয়েছেন, প্রসবের পর সন্তানের সঙ্গে এই সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতায় তিনি খুশি। ভাল থাকুন তিনি। ভাল থাকুক সেই মা, যার ব্যথা লাগে। দেবী না, স্রেফ আর পাঁচটা মানবীর মতোই যার শরীরে কেটে গেলে রক্ত ঝরে। সন্তান আর পরিবার ছাড়াও যার ধুকপুকে একটা জ্যান্ত অস্তিত্ব আছে। ভাল থাকুক সেই মেয়েও যে মা না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে যেন বোঝে, আজীবন সন্তানহীন থাকলেও তার নারীত্বে বিন্দুমাত্র আঁচ পড়বে না। কারণ ‘মা’ শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই সাবেক সংলাপে ইতি নামার চেয়েও জ্যান্ত মানবীদের ভাল থাকা বেশি জরুরি। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook