ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • তোর তরে তমাল-তলায়


    সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় (March 7, 2021)
     

    ছোটবেলা থেকেই ভারি ইচ্ছে ছিল লাগামছাড়া বেপরোয়া হব। এমন বেপরোয়া যে ঢি-ঢি পড়বে পাড়ায়, ত্রস্ত থাকবে কলেজ, বাড়িতে নালিশ আসবে বিস্তর, রাগে টকটকে হবে মায়ের মুখ, নিন্দে শুনে কান গরম হবে বাবার। এ সব পূর্ণ করতে গেলে খানিক লীলাময়ী আর ছলনাময়ী হওয়াও দরকার, এ-ও দিব্য জানতাম। আসলে আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল— আমি হয়ে উঠব রূপে চাঁদ, আর গুণে কলঙ্ক। 

    কিন্তু সে চাওয়া, চাওয়াই থেকে গেল। না তেমন করে হতে পারলাম বেপরোয়া, না সাহসী, না আয়ত্ত করতে পারলাম কলঙ্ক। আমি নেহাত বাবার সুশ্রী, বাধ্য কন্যে হয়ে রয়ে গেলাম। তাই বলে কি পোষা ইচ্ছেগুলো চলে যায়? কখনওই না। সে থাকে মনে, গোপনে।

    বালগোপালের পর্ব শেষে, জন্মাষ্টমীর লুচি-তালের বড়ার শৈশব পেরিয়ে যখন আসল কৃষ্ণের সঙ্গে মোলাকাত হল, তখন ভাবলাম, এই তো পাওয়া গিয়েছে, ঠিক যেন আমার মতো। বেপরোয়া, নির্লজ্জ, চার্মিং, লীলাময়, ছলনার রাজা, এমনকী রুথলেস। (বলে রাখা ভাল কৃষ্ণের অনৈতিক কার্যকলাপকে মোটেও সাপোর্ট করি না। মেয়েদের বস্ত্র চুরি করাই হোক কিংবা কৌশলে মিথ্যাচার)।

    তবু চেনাশোনা হওয়ার পর ভাবলাম, ধুর! বোকা মেয়ে! তুই আর কৃষ্ণ? চাইতে তুই অনেক পারিস, কিন্তু সেগুলো সব সত্যি চাওয়া তো? কেবল একটা বানানো, গ্ল্যামারাস, অন্যরকম হয়ে ওঠার  চাওয়া থেকে এই ইমেজ তৈরির চেষ্টা নয় তো? কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। এমনটা হতেও পারে।  

    কিন্তু কৃষ্ণ? সে তো বানানো নয়। তার রাধার সঙ্গে বেপরোয়া প্রেম আবার রাধার মন ভেঙেচুরে দেওয়া— একই সঙ্গে। এমন করা যায়? ষোড়শ গোপিনীর সঙ্গে লীলা, আবার ফের রাধার কাছেই ফিরে যাওয়া। রাধার প্রেম পাওয়ার জন্য আকুল আকুতি, মোহনবাঁশি বাজিয়ে মানভঞ্জন। আবার রাধার বাড়ির আঙিনা দিয়েই চন্দ্রাবলীর বাড়ি যাওয়া। চন্দ্রাবলীর সঙ্গে রাত্রিযাপন। এত নিষ্ঠুর একটা মানুষ হতে পারে? তৎক্ষণাৎ তো তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘোষণা করা উচিত। অথচ রাধা কেন, কোনও গোপিনীই পারছে? পারছে না। আবার ওদিকে কৃষ্ণ, তার এমন এমন সব কুকীর্তি লুকোনোর, ঢাকা-চাপা দেওয়ার কোনও চেষ্টাও করছে না। সে খোলা বই। সে খারাপ ছেলে। তবু তার প্রতি এত আকর্ষণ কীসের? রূপের না লীলার? না কি অমন কঠোর ঔদাসীন্যের? যেন ছুঁয়েও ছুঁতে পারলে না, যেন কাছে পেলেও নিজের করতে পারলে না, সে তোমার কাছেই আছে, অথচ বুঝতে পারছ তার মনের তল পাওয়ার চেষ্টা বৃথা। এক কথায়, তাকে কোনও ভাবেই আয়ত্তে আনা যাচ্ছে না, অধিকার করা যাচ্ছে না। সে তোমার প্রতি মনোযোগী কিন্তু তোমার সম্পর্কে উদাসীন। আর তাই তার এত আকর্ষণ। ওই যে বোঝা যাচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে সে অধরা, আর তা-ই যত না পাওয়া, তত আকুতি।

    কিন্তু কৃষ্ণ শুধুই কি তাই? সে কি কেবল লীলা, ছলনা, বেপরোয়া আর কলঙ্ক-পূর্ণ? তা হলে মহাভারতের কৃষ্ণ কে? মহাভারতের কৃষ্ণের সঙ্গে আমার আলাপ কিছুটা বড় হয়ে। এই আলাপের পর কৃষ্ণের মোহময় আকর্ষণ কিছুটা ফিকে হয়ে গিয়েছে আমার কাছে। তখন তাকে বোঝা আমার কাছে একটা নিত্যি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং সেই বুঝতে চাওয়ার চেষ্টা এখনও চলছে। মহাভারতের কৃষ্ণ-চরিত্র বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমার নেই। সেসব আলোচনা-সমালোচনা করবেন দার্শনিক-পণ্ডিতরা। আমি কেবল তাঁকে বুঝতে চাইব। আমার মতো করে। 

    এই প্রথম কৃষ্ণকে আমি ‘আপনি’ সম্বোধন করলাম। এবং তিনি আমার থেকে একটু দূরত্বে দাঁড়ালেন। সে আর আমার সে-ই বেপরোয়া, লীলাময়, উদাসীন কৃষ্ণ থাকল না। তাঁর অন্য এক সত্তা আমার কাছে ক্রমাগত উন্মোচিত হতে থাকল এবং আমি বুঝলাম চরিত্রটি হয়তো বা জটিল। তিনি কি দেবতা? তিনি কি মানব? 

    আমি তাঁকে ‘মানুষ’ ভাবতে বেশি ভালবাসি। কারণ, তাঁর মধ্যে অ-ন্যায় খুঁজে পাই, দোষ খুঁজে পাই। যা মনুষ্য-চরিত্রের অভিজ্ঞান। আমার মনে হয় তাতে চরিত্রের ভারসাম্য থাকে। কেবল ভালত্ব দিয়ে চরিত্র গড়লে সে চরিত্রের দৃঢ়তা কমে যায়। কারণ পৃথিবীতে সব কিছুর মোকাবিলা ভালত্ব দিয়ে করা যায় না। হয়তো কোনও ক্ষেত্রে ন্যায্যতাও দিয়েও যায় না। রূঢ়, কঠিন, নির্মম (নির্মম মানে কিন্তু মিসোজিনিস্ট নয়) হতে হয়। তবে এ-ও ঠিক, যে-নির্মমতাকে বৃহত্তর স্বার্থে কল্যাণকর বলে কৃষ্ণ প্রতিষ্ঠা করতে চান, তা মেনে নেওয়া যায় না। কুরুক্ষেত্রে যখন ঘটোৎকচ কর্ণের একাঘ্নী-তে বধ হলেন, তখন কৃষ্ণ আনন্দনৃত্য করছিলেন। কেন? কারণ, যে-অস্ত্র কর্ণ অর্জুনের জন্য মজুত করে রেখেছিলেন, তা ঘটোৎকচ বধে খরচ হয়ে গেল। ফলে অর্জুন বিপন্মুক্ত হয়ে গেলেন। পাণ্ডবদের জয় সুনিশ্চিত হল। কৃষ্ণ নাকি এই যুদ্ধের পরিণতির কথা ভাবছিলেন। ভাবছিলেন ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা। আর ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়। এমনকী প্রিয়তম পুত্রকেও। কিন্তু ঘটোৎকচ তো ভীমের সন্তান। পাণ্ডবদের সন্তান। তাঁর মৃত্যুতে কৃষ্ণের মতো বন্ধুর কি এই আনন্দপ্রকাশ মেনে নেওয়া যায়? সন্তানহারার কষ্ট সর্বাপেক্ষা বেশি। তবু তিনি বুঝলেন না? অথচ এই কৃষ্ণই তো কুরুক্ষেত্রের ‘ধর্মযুদ্ধ’, বা বলা ভাল ‘ন্যায়যুদ্ধের’ কারিগর। তিনি যেন প্রতিটি মানুষকে দিয়ে তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট কাজ করিয়ে নেন। যদি ইচ্ছেমতো মানুষের কর্ম স্থির করতে পারেন, তবে তো তিনি দেবতার সমান। এমন প্রযোজক-কর্তা দেবতা ছাড়া কে-ই বা হতে পারেন? আর যদি দেবতা একেবারে না-ই ভাবতে চাই, তা হলে ভাবতে হয় তিনি অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, ক্ষুরধার বুদ্ধিধর এক মহানায়ক। যিনি সুদক্ষ দাবা খেলোয়াড়ের মতো বহু আগে বুঝতে পারতেন ১৮ চাল বা ২৫ চাল পরে কী হবে, কী হতে পারে। সেখানেই তাঁর কৃতিত্ব। 

    কিন্তু ফের দ্বন্দ্বে পড়তে হয়— তিনি ন্যায়যুদ্ধের কারিগর হয়েও নীতি ভঙ্গ করেছেন। তিনি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে অর্ধসত্য বলিয়েছেন, যা মিথ্যা বলার চেয়েও জঘন্য অপরাধ। ধর্মরাজ ধর্মচ্যুত হয়েছেন। কী জন্য? স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এ স্বার্থসিদ্ধি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে কবে ন্যায় প্রতিষ্ঠার কাজে লাগবে, তা ভেবে কি আর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ সব সময় চলে?  চলে না বোধহয়। তিনি ক্রোধের বশবর্তী হয়ে পিতামহ ভীষ্মের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন। এ-ও তাঁর অবস্থান-বিরোধী। কারণ কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধরবেন না। তা হলে? সেখানেই তো ভুল-ত্রুটি ধরা পড়তে থাকে। ক্রোধে মত্ত হবে সাধারণ মানুষ, কৃষ্ণ থাকবেন অবিচল। সেটা হল কই? প্রশ্ন ওঠে, এমন সব ভুলচুক তো মানুষকে মানায়, কৃষ্ণকে কি মানায়? না, মানায় না বলেই কৃষ্ণ আমার এত প্রিয়। কোনও দেবতার তো এত শেড দেখিনি। কারও মধ্যে এত আলো-ছায়ার ঘনঘটা দেখিনি। এই মনে হয় হিরো, এই মনে হয় ভিলেন। এই মনে হয় এঁর ক্যারিশমায় চোখ ধাঁধিয়ে গেল, এই মনে হয় তাঁর কাজে ভুরু কুঁচকে গেল। ধর্মযুদ্ধ লড়তে এসে বেশ কিছু অন্যায় পরামর্শ দেওয়া লোককে শ্রদ্ধা করা যায় না, আবার তিনি যখন নিজের কাজের পিছনে যুক্তিগুলো দেখান, দুম করে ফেলে তো দেওয়া যায়ই না, বরং মনে হয় তিনি অনেক বেশি তলিয়ে বুঝেছেন, আমরা ওপর-ওপর দেখছি। এই তিনি দেবতা, এই তিনি মানুষ। এত আনপ্রেডিক্টেব্‌ল বলেই আমার প্রিয়।

    এই কৃষ্ণই আবার দ্রৌপদীর সখা। যে সখা দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করেন। একজন পুরুষ কেবল বন্ধু হয়েই থাকেন। ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ সিনেমার বস্তাপচা ডায়লগ দেন না। দ্রৌপদীর মতো অমন বুদ্ধিমতী, দৃপ্ত, ঋজু মহিলার সান্নিধ্য সমৃদ্ধই করেছে কৃষ্ণকে। এমন একটা নো-ম্যানস ল্যান্ড ছিল দু’জনের মাঝে, যা কৃষ্ণ বা কৃষ্ণা কখনওই পার করেননি। আর সেইখানেই আকর্ষণ। এমন সংযমই তো একজন পুরুষকে করে তোলে ভরসার পাত্র। 

    আবার এমন চতুর, বুদ্ধিমান, পরিস্থিতি-নিয়ন্ত্রক, দূরদৃষ্টি-সম্পন্ন, লীলাময়, বেপরোয়া চরিত্রটি নিতান্ত অসহায়, যখন যদুবংশ ধ্বংস হচ্ছে। তিনি এই ধ্বংসের দর্শক মাত্র। যখন প্রাণাধিক প্রিয় ভাই বলরাম, তাঁর মৃত্যু আসছে জেনেও সতর্ক হচ্ছেন না, প্রায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে নিচ্ছেন, তখন সর্বশক্তিমান কৃষ্ণ কিচ্ছুটি করতে পারছেন না। আর তাঁর নিজের মৃত্যু? অমন অসহায়, একলা মৃত্যু এমন এক উজ্জ্বল চরিত্রের কি প্রাপ্য? মহাকাব্যের এমন এক জন প্রযোজক-কর্তার মৃত্যু হচ্ছে, তাঁর মৃত্যুর সময় তো দৈববাণী হবে, কেঁপে উঠবে ধরণী, ধর্ম-অধর্মের গণ্ডি গুলিয়ে যাবে— তা নয়কো, একজন সামান্য ব্যাধের তির বিঁধে গেল লাল টুকটুকে পায়ে। তাতেই আক্রান্ত হয়ে দেহত্যাগ করলেন এমন একজন যুগপুরুষ!

    এবং এখানেই তাঁর আকর্ষণ। তিনি বেপরোয়া অথচ বিপন্ন, তিনি লীলাময় কিন্তু নৈয়ায়িক, তিনি উথালপাথাল সময়ে স্থিতধী আবার মিত্রের স্বার্থে অল্পেই বিচলিত, তিনি উদাসীন কিন্তু রাধার প্রতি প্রেমে চির-ছটফটে, তিনি মহাভারতের সূত্রধর হয়েও প্রধান পুরুষ নন। তাঁর প্রসন্ন হাসির সঙ্গে যে কৌতুক মাখা হাসিটি আমার মতো মেয়েকে বিহ্বল করে রাখে, সেই কৃষ্ণ বড় প্রিয় আমার। যে কৃষ্ণ আকুল হয়ে বিপন্ন হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বাধ্য হয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে কৃষ্ণ আমার বড় প্রিয়। যে কৃষ্ণ ‘পৌরুষে’ কিয়ৎ-কম, সে আমার বড় প্রিয়। যে কৃষ্ণ, কৃষ্ণার সখা সে আমার বড় প্রিয়। আর যে কৃষ্ণ তমাল-তলায় দাঁড়িয়ে থাকে, তার সঙ্গে এক দিন ব্যাগে দুটো জিনস আর টপ নিয়ে পালাবই আমি।   

    ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook