ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • জাকারিয়ার জার্নাল

    অর্পণ ঘোষ (March 23, 2025)
     

    ‘চিৎপুরের বড় রাস্তা মেঘ কল্লে কাদা হয়’— এই একটি বাক্যেই হুতোম উনিশ শতকীয় কলকাতা শহরের ব্যস্ততম অঞ্চলের পরিচয় দিয়েছিলেন। চিৎপুর (বর্তমান রবীন্দ্র সরণী) ব্যস্ততম অঞ্চল ছিল মূলত ব্যবসায়িক কারণেই।

    কলকাতা, গোবিন্দপুর, সুতানুটি— তিন অঞ্চল মিশে তখন ভবিষ্যতের মহানগর গড়ে উঠছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে,  চিৎপুরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ব্যবসায়ীদের বসতি। খুব স্বাভাবিকভাবে, মাড়োয়ারি, ইসলাম ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ী মানুষদের কমিউনিটিও চিৎপুরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল।

    লক্ষ্যণীয়, কলকাতার এই অঞ্চলে ইসলামীয় সম্প্রদায়ের মানুষরা কিন্তু বাঙালি মুসলমান নন, ‘কূটচি মেমন্’ সম্প্রদায়ভুক্ত ‘মাইগ্রেটেড মুসলমান’। মাড়োয়ারিদের ক্ষেত্রেও, নাম থেকেই স্পষ্ট, তাঁরা যোধপুর-সংলগ্ন অঞ্চল থেকে এসেছিলেন।

    আরও পড়ুন : ফরীদা খানুম, জন্মস্থান কলকাতা! লিখছেন মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায়…

    কাবাব-এর স্বাদ যেমন ম্যারিনেশন-এর ওপর নির্ভর করে, তেমনই, বর্তমান জাকারিয়া স্ট্রিট অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ইতিহাস এবং এর হয়ে ওঠার কাহিনি খুঁজতে গেলেও চিৎপুর-এর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাই এত ইতিহাস-ভূগোলের অবতারণা।

    জাকারিয়া স্ট্রিটের মূল ফটক

    এখন হঠাৎ করে একদল মানুষ এসে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলেই নিজেদের কমিউনিটি কেন গড়ে তুলবেন? এঁরা এলেনই বা কোত্থেকে?

    তথ্য বলছে, উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে, এই অঞ্চলে গুজরাতের কচ্ছর রণ থেকে সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত ‘কূটচি মেমন্’ মুসলমানরা আসতে শুরু করেন। মূলত রেশম, গন্ধদ্রব্য, চিনি— এসবই ছিল ব্যবসার বস্তু। এছাড়াও এঁরা ছিলেন, প্রচুর জাহাজের মালিক। ফলত, জলপথেই চলত বাণিজ্য।

    ‘কূটচি’ মূলত ইন্দো-আর্য ভাষা বংশের অন্তর্গত ভাষা, গুজরাতের কচ্ছ উপকূলের মানুষরা এই ভাষা ব্যবহার করতেন বলেই এমন নামকরণ। মেমন্-দের আদি বসতি, কাঠিওয়ার (সৌরাষ্ট্র) অঞ্চল। এঁদের ভাষা ‘মেমনি’। ম্যাপ-এর অবস্থান অনুযায়ী দু’টিই উপকূল সংলগ্ন অঞ্চল, তাই এঁদের পেশা যে বাণিজ্যকেন্দ্রিক হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই থেকেই তাঁরা ‘কূটচি মেমন্’।

    রমজানে সেজে ওঠে জাকারিয়া স্ট্রিট

    শব্দগুলি অনেকের কাছে হঠাৎ অপরিচিত লাগতে পারে, তাই একটু বিভূতিভূষণকে স্মরণ করা যাক; ‘চাঁদের পাহাড়’-এ শঙ্কর সলসবেরি শহরে এসে, যে ভারতীয় দোকান দেখে আহ্লাদিত হয়েছিল, যে দোকানি তাকে দু’টাকা সাহায্য করেছিল— তার পরিচয় বিভূতিভূষণ দিচ্ছেন, ‘দোকানদার মেমন্ মুসলমান, সাবান ও গন্ধ দ্রব্যের পাইকারি বিক্রেতা’—এই হল সেই ‘মেমন্’ সম্প্রদায়! 

    আসলে, ভারতীয় মেমন্ সম্প্রদায়ের একটা অংশ উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুর দিকে পাকাপাকিভাবে চলে যান দক্ষিণ পূর্ব-আফ্রিকায়, আর-একদল চলে আসেন কলকাতা অঞ্চলে। দু’টি অঞ্চলেই ব্রিটিশ উপনিবেশকে মাইগ্রেশন-এর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।  

    কোনও অঞ্চলে, কোনও বিশেষ কমিউনিটির মাইগ্রেশন হলে, সেখানে প্রথমেই তাঁরা দুটো জিনিস গড়ে তোলেন। প্রথমত, বাজার, দ্বিতীয়ত, উপাসনা স্থল। 

    বৃহত্তর চিৎপুর-সংলগ্ন অঞ্চলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাজারের সঙ্গে-সঙ্গে গড়ে উঠেছিল উপাসনাস্থলও। শুধু মসজিদ-ই যে গড়ে উঠেছিল তা নয়, যেহেতু মাড়োয়ারি গোষ্ঠীরও একটি কমিউনিটি এই অঞ্চলে ছিল, বেশ কিছু মন্দিরও তৈরি হয়েছিল সমান্তরালভাবে। উনিশ শতক থেকে আজকের জাকারিয়া— মসজিদের পাশাপাশি রয়েছে মন্দিরও।

    অধুনা জাকারিয়া স্ট্রিট ও লোয়ার চিৎপুর রোড-এর সংযোগস্থলে আমরা যে ‘নাখোদা’ মসজিদ দেখি, এটির নির্মাণ শেষ হয় ১৯২৬-এ। কিন্তু, ১৮৫৭-র আগে এই জায়গায় ছিল দু’টি আলাদা-আলাদা মসজিদ। হাজি জাকারিয়া এই দু’টি মসজিদ-এর মাঝে জমি কিনে, বর্তমান মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা নেন। জাকারিয়া ছিলেন প্রচুর সম্পত্তির মালিক। একই সঙ্গে সুন্নি সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় এক ব্যক্তিত্ব। থাকতেন নাখোদার উল্টোদিকেই, আর্মেনিটোলা অঞ্চলে। মূলত, আমদানি-রপ্তানির ব্যবসাই ছিল ‘কূটচি মেমন্’ সম্প্রদায়ভুক্ত জাকারিয়াদের অর্থোপার্জনের মূল উৎস, এই অঞ্চলের আরও বাড়ির মালিক ছিলেন তিনি, অঞ্চলের মাদ্রাসাও তাঁর অর্থেই নির্মিত।

    কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘নাখোদা’-র নির্মাণকাজ যদি ১৯২৬-এ শেষ হয়, সেক্ষেত্রে নাখোদা হওয়ার আগে এই অঞ্চলে যে দু’টি মসজিদের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে— সে দু’টির পরিচয় কী?

    বিশ শতকের প্রথমার্ধেও অনেকটা সময় জুড়ে এই মসজিদ ‘নাখোদা’ নামে পরিচিত ছিল না। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতিকথা ‘ঘরোয়া’-য় বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন-এর প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ-এর রাখি পরানোর গল্প বলতে গিয়ে,  ‘চিৎপুরের বড় মসজিদ’ বলে একটি মসজিদ-এর উল্লেখ করছেন, যেখানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ইমাম-এর হাতে রাখি পরিয়েছিলেন। তাহলে কি আজকের ‘নাখোদা’-র পূর্ব রূপই ছিল সেই মসজিদ? যেখানে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন, যাকে অবন ঠাকুর ‘চিৎপুরের বড় মসজিদ’ বলছেন? এই প্রশ্ন থেকেই যায়। যেখানে বড় মসজিদ-এর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, খুব স্বাভাবিকভাবে ছোট মসজিদও থাকবে, রবীন্দ্রনাথের শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল জগন্নাথ ঘাট থেকে, সেখান থেকে চিৎপুর রোড ধরে সোজা আসলে বড় মসজিদ অর্থে প্রথমে এই মসজিদটিকেই চিহ্নিত করা যেতে পারে। ম্যাপ অন্তত সেই কথাই বলে।

    পি. টি. নাইয়ার তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ ক্যালকাটা স্ট্রিটস’ বইতে দেখাচ্ছেন, হাজি জাকারিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায়, ১৮৫৭-তে কুরবান আহমেদ বর্তমান নাখোদার ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপন করছেন, কিন্তু ‘নাখোদা’ নামটি পরিচিতি পায় বিশ শতকে, ১৯২৬-এর পর থেকেই। এই নামেই বর্তমান রাস্তার নাম; (নাখোদা কিন্তু কোনও একজন ব্যক্তির নাম নয়) প্রসঙ্গত, ‘নাখোদা’ ফার্সি শব্দ, যার অর্থ– ‘নাবিক’। যেহেতু কূটচি মেমন্ সম্প্রদায়, জাকারিয়াদের মূল আয়ের উৎসই ছিল বাণিজ্য, এবং সেই সময় দাঁড়িয়ে জাকারিয়ারা একাধিক জাহাজের মালিক ছিলেন, একই সঙ্গে হাজি জাকারিয়াই ছিলেন সুন্নি সম্প্রদায়ের স্থানীয় নেতা, তাই ‘নাবিক’ ব্যঞ্জনার্থেই যে মসজিদের নাম ‘নাখোদা’ হবে, এ আর আশ্চর্যের কী! উনিশ শতকের শেষার্ধে হাজি জাকারিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর উত্তর প্রজন্ম নুর মহম্মদ জাকারিয়া ও অন্যান্যরা মসজিদ নির্মাণ সহ অন্য পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব নেন। একই সঙ্গে চলত এঁদের সমাজসেবামূলক কাজ। নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, কলকাতার সামাজিক ইতিহাসে ‘জাকারিয়া’ একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম।

    ব্রিটিশ উপনিবেশের হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের বিভেদরেখায় বর্তমানের চিৎপুর-সংলগ্ন জাকারিয়া অঞ্চল ছিল ব্ল্যাক টাউনের অন্তর্গত। ফলত, অপরিকল্পিতভাবেই গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলের বাড়িগুলি। মাড়োয়ারি, মুসলমানদের সহাবস্থান থাকলেও নানা সময় তাঁদের মধ্যে সম্পত্তি কেনা-বেচা হয়েছে, কখনও মুসলমানরা বেচে দিয়েছেন মাড়োয়ারিদের কাছে, কখনও মাড়োয়ারিরা মুসলমানদের। ১৯১০ সালে দাঙ্গা হওয়ার পর এই অঞ্চলের অধিকাংশ মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীই তাঁদের সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে, বড়বাজার-সহ অন্য নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন। তাঁদের স্মৃতিস্বরূপ বাড়িগুলি জাকারিয়া অঞ্চলে আজও জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু অন্য মালিকানায়; তবে, মাড়োয়ারিরা অল্প হলেও এই অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। এই অঞ্চলের একটি বিল্ডিং বর্তমানে ‘ভারত রিলিফ সোসাইটি’, যার মালিকানা ছিল বিড়লাদের, (তাঁরাও তো রাজস্থানের মাড়োয়ারি সম্প্রদায়)। বিশ শতকে এখানে কংগ্রেস-এর নেতাদের আনাগোনা লেগে থাকত, পরে বিড়লাদের থেকে এর মালিকানা ‘ভারত রিলিফ সোসাইটি’-র নামে স্থানান্তরিত হয়। 

    এই অঞ্চলে যে একসময় দুই সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ছিল, অনেক কঠিন সময় পেরিয়ে আজও সেই সাক্ষ্য বহন করছে, অঞ্চলেরই দু’টি পুরনো মন্দির। একটি উনিশ শতকে নির্মিত কলকাতার অন্যতম পুরনো শিব মন্দির, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে জাকারিয়া প্রবেশের দীর্ঘ তোরণ পেরিয়ে ডান হাতেই এটির বর্তমান অবস্থান, নাম– ‘জবরেশ্বর শিব মন্দির’, বয়স প্রায় ২২২ বছর। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠার সময় যদিও এই নাম ছিল না। বর্তমানে মন্দিরের দক্ষিণ দেওয়ালে বাংলা হরফে সংস্কৃত ভাষায় খোদিত প্রতিষ্ঠালিপি থেকে যা জানা যায়, তার মর্মার্থ— বৈশাখ মাসের ১৯-তম দিনে, গঙ্গার নিকট শ্যাম কবিরাজ কর্তৃক ১৮০৪ খ্রি: এই মন্দির স্থাপিত হয়। 

    জবরেশ্বর শিব মন্দির

    নানা সময়ে, ‘১৯১০-এর দাঙ্গা’, ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর মতো সাম্প্রদায়িক অস্থির পরিস্থিতিতে এই মন্দির ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে নানা বদলের মধ্য দিয়ে গিয়ে আজকের বর্তমান চেহারায় দাঁড়িয়েছে। জবরেশ্বর নামটি পরবর্তী সময়ের সংযোজন। এর উল্টোদিকেই শীল পরিবারের বাড়ি ও মন্দির— যার ফলকে লেখা রাধাকান্ত জীউ ঠাকুর বাটি, সন ১৩৪৬। জানা যায়, জবরেশ্বর মন্দির নানা সময় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর এই শীল পরিবার থেকে শুরু করে বর্ধমানের রাজা-সহ অনেকেই মন্দির পুনর্নির্মাণে প্রভূত সাহায্য করছেন। তবে এই মন্দিরেই প্রতিষ্ঠালিপির ওপরে আরও একটি ফলকে লেখা, ‘৬ কার্ত্তিক ১৩৩২— ‘স্বর্গীয় ছোটে লাল কানেডিয়ার ধর্মপত্নী জানকী বাই দ্বারা এই মন্দির পুনঃস্থাপিত হইল’।

    লক্ষ্যণীয়, এই বছরেই কিন্তু নাখোদা নির্মাণ সম্পূর্ণ হচ্ছে। প্রায় একই বছরে মাত্র কয়েকশো মিটার দূরস্থিত মন্দির-মসজিদের পুনর্নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া, কাকতালীয় হলেও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তো বটেই।

    রমজান মাস চলছে, হুতোমের আজব শহর কলকাতা থেকে ২০২৫ সালের মহানগরীতে আজও চিৎপুর শহরের ব্যস্ততম অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। জাকারিয়া স্ট্রিট আলোয় সেজে ওঠে এ-সময়, সারা বছর এখানে বেশ কিছু বিখ্যাত খাবারের দোকান থাকলেও বছরের এই নির্দিষ্ট সময়, শহর, রাজ্য, দেশের নানা অঞ্চল থেকে মানুষ এসে হরেক কিসিমের খাবার, মনোহারি দ্রব্যর পশরা সাজিয়ে বসেন। অনেক মানুষ আবার নিজের পেশাও সাময়িকভাবে বদলে নিয়ে জাকারিয়া অঞ্চলে ব্যবসা শুরু করেন। রমজান মাস শেষ হলেই ফিরে যান নিজের পুরনো পেশায়। যেমন মহম্মদ আলাউদ্দিন-এর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁর মূল পেশা ট্যাক্সি চালানো, তিনি ট্যাংরা অঞ্চলের বাসিন্দা। রমজান মাসটুকুই সেমাইয়ের পশরা সাজিয়ে বসবেন, মাস শেষ হলেই আবার ফিরে যাবেন নিজের পুরনো পেশায়। এমনই অনেকে বছরের এই সময় নিজেদের পেশা বদলে নিয়ে রাস্তা জুড়ে খেজুর, ফল, কাবাব, হালিম থেকে হালুয়া হয়ে ফিরনি, মহব্বৎ কী শরবৎ, বান–পাঁউরুটির পসরা সাজিয়ে বসেন। এঁদের মধ্যে এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা উত্তরপ্রদেশের লখনউ থেকে এসেছেন, কেউ এসেছেন, বিহার থেকে।

    একটি কথা না বললেই নয়, জাকারিয়া স্ট্রিট তো শুধু সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-র বড় তোরণটি থেকে পশ্চিমমুখী লম্বা রাস্তাটুকু, যা একদম লোয়ার চিৎপুর রোড পর্যন্ত বিস্তৃত। এই রাস্তার বিখ্যাত স্থায়ী দোকান, ‘টাসকিন’, ‘দিল্লি সিক্স’, ‘বম্বে হোটেল’, ‘সুফিয়া’ ইত্যাদি কিন্তু, জাকারিয়ার পাশেও কলুটোলার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে রয়েছে; বলাই দত্ত লেন, ফিয়ার্স লেন, যেখানে আছে বিখ্যাত কিছু দোকানপাট, যেমন ‘দিল শাহ লাজিজ কাবাব’, ‘আল বাইক’, শতবর্ষ পেরনো ‘অ্যাডামস কাবাব’ হয়ে ‘হাজি আলাউদ্দিন’-এর মিষ্টির দোকান। 

    এঁদের অধিকাংশর পূর্বপুরুষই উত্তরপ্রদেশ অঞ্চল থেকে এসেছিলেন, সময়টা ১৯৪৭। কোনও প্রামাণ্য তথ্য না বলা গেলেও দেশভাগ, উত্তর বলয়ে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতাকেই এই মাইগ্রেশন-এর কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, ৭ নম্বর বলাই দত্ত লেন-এ আল বাইক বিরিয়ানির দোকানের নিচেই অনাড়ম্বরভাবে বসেন, শাহ্‌দত খান তাঁর কাবাবের পশরা সাজিয়ে, জাকারিয়া-সংলগ্ন অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ সুতা কাবাব সম্ভবত ইনিই বিক্রি করেন। ’৪৭-এ তাঁর বাবা তবকউল্লাহ খান এই অঞ্চলে চলে আসেন, তখন থেকেই তাঁদের ব্যবসা। জাকারিয়ার সীমানা ছাড়িয়েও এই অঞ্চলে এমন মাইগ্রেশনের উদাহরণ অজস্র।

    পবিত্র রমজান মাস শেষ হতে চলল, আর মাত্র ক’টা দিনই জাকারিয়ার সুসজ্জিত দোকানগুলোর পশরা থাকবে, তারপর যে যার পেশায় ফিরে যাবেন, অনেকে ফিরে যাবেন নিজ-নিজ রাজ্যে। সন্ধেবেলায় নানা ধর্মের মানুষ এসে মিলিত হন এখানে, কত মানুষ একসঙ্গে বসে ইফতার সারেন… খাদ্যরসিকরা মজা করে বলেন, ‘ধর্ম যার-যার ইফতার সবার!’ একটু বৃহত্তর পরিসরে দেখলে রমজান মাস মুক্তির মাস, যে মুক্তি আসলে শ্রমে মুক্তি, সংযমে মুক্তি, যে মুক্তির জন্য সমাজ গড়ে ওঠে, সমাজ বদলায়। শেষে অবশিষ্ট থাকে জাকারিয়া অঞ্চলের মতো একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, যা ধারণ করে অনেক মানুষের জীবিকা, জীবন।

    আদপে ধর্মও তো বৃহত্তর অর্থে জীবনকে ধারণ করাই! তা সে যে ধর্মই হোক না কেন।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook