ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ৫০


    বিমল মিত্র (February 11, 2022)
     

    পর্ব ৪৯

    বেশ ছিলাম কিন্তু আমরা। অন্তত আমার তাই মনে হত। টুরিস্ট হাউসটা এমনই জায়গায় তৈরি, যেখানে থাকলে পৃথিবীর জ্বালা-যন্ত্রণার কথা আর মনে থাকে না। তা ছাড়া যখন গুরু স্টুডিওতে চলে যেত তখন আমি আমার কলম নিয়ে হিজিবিজি চালাতাম। আমার যা কাজ। মাঝে-মাঝে কোথা থেকে কোন্ আজব দেশ থেকে দলে দলে টুরিস্টরা আসত। মেয়ে-পুরুষ-বুড়ো-বুড়ির দল। ফরসা-ফরসা চেহারা। হয় হল্যান্ড, নয় ফ্রান্স, নয় ইটালী। তারা এসেই কাপড়-জামা ছেড়ে সুইমিং-কস্টুম পরে সমুদ্রে ঝাঁপাই জুড়তো। তারপর জল থেকে উঠে এসে কাপড়-জামা পরে হ্যাম্পার বক্স খুলে লাঞ্চ খেয়ে নিত। আর তারপর কখন এক-সময়ে মটরের ধোঁয়া উড়িয়ে হুশ্ করে চলে যেত। হাজার-হাজার টাকা খরচ করে ইন্ডিয়া দেখতে এসেছে। সেই সঙ্গে মহাবলীপুরম্টাও দেখে যেত!

    কিন্তু গুরুর কথা আলাদা।

    সে সারাদিন ‘বাহিনী’ স্টুডিওতে শুটিং করে চলে আসত শটিং করে চলে আসত আমার কাছে। সন্ধেবেলাটাই আমার বড় একলা-একলা লাগত। ঘরের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি দূরের দিকে চেয়ে দেখলাম কোনও গাড়ির হেড-লাইটের আলো দেখা যায় কি না। মাঝে-মাঝে বাস-সার্ভিসের হেড-লাইট দেখে ভাবতাম গুরুর গাড়ির হেড-লাইট। তারপর ভুল ভাঙতো। তারপর এক সময়ে গুরু সত্যিই আসত। সারাদিনের পরিশ্রমের পর ক্লান্ত-শ্রান্ত গুরু। তার ক্লান্তি শ্রান্তি দূর করবার জন্যে সংসারে কেউ নেই কোথাও। গীতা তখন লন্ডনে গান গাইতে গেছে। ছেলে তরুণ হাসপাতালে। তার হয়েছে নেফ্রাইটিস। ছোট এক বছর বয়েসের নীনা আছে বোম্বাই-এর পালি হিল-এ। সব ছন্নছাড়া। গুরু এসেছে মাদ্রাজে টাকা রোজগার করতে।

    স্টুডিও থেকে ফিরে এলেই গুরুর মুখের দিকে চেয়ে দেখতাম। সেদিনও দেখছিলাম চেয়ে চেয়ে। বললাম— আজ এত দেরি যে আপনার?

    গুরু বললে— আড্ডা দিচ্ছিলুম, পরশুদিন একটা পার্টি দিচ্ছি—

    পার্টি! বেশ নিরিবিলিতে ছিলুম। আবার পার্টির হাঙ্গামা!

    গুরু বললে— ফিরোজ খান্কে চেনেন?
    বললাম— খুব চিনি, স্টুডিওতে আলাপ হয়েছিল। চমৎকার দেখতে—

    গুরু বললে— তার দুজন জার্মান গার্ল ফ্রেন্ড আসবে, আর ক্যামেরাম্যান মিস্টার বার্টলে আর সি রামচন্দ্র, মিউজিক ডাইরেক্টার—

    যা বুঝলাম, তাতে মনে হল দশ-বারোজনের পার্টি। আর পার্টি মানেই হৈ-হল্লা। আগেও তো দেখেছি, যখনই বোম্বাই, মাদ্রাজে বা লোনাভালাতে পার্টি হয়েছে ওদের, তাতে মদের বন্যা বয়ে গিয়েছে। কথাটা শুনে তাই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বললাম— হঠাৎ পার্টি দিতে গেলেন কেন?

    গুরু বললে— সবাই মিলে একটু ফুর্তি করা যাবে। আর তাছাড়া ফিরোজের দুজন মেয়ে বন্ধু এসেছে, তাদেরও একটু খাতির করা দরকার—

    কি আর করা যাবে! যে অশান্তি চাইবে তাকে আমি শান্তি দেব কি করে? তখুনি ডাকা হল চন্দ্রগেশমকে। বারো-তেরো জনকে খাওয়াবার মেনু তৈরি করে দেবে সে। দরকার হলে বাইরে থেকে কুক বা হেলপিং হ্যান্ড জোগাড় করবে। আসলে ওস্যানিক হোটেলের ম্যানেজমেন্টে এই টুরিস্ট-হাউসটা চলত। গুরু সেই পার্টির আয়োজনেই লেগে গেল। অন্য সব জিনিস ব্যবস্থা করবে হোটেল। আর হুইস্কির যা দরকার তা শহর থেকেই আনা হবে। মাদ্রাজ পুরো ড্রাই স্টেট। এক ফোঁটা মদ বিনা অনুমতিতে খাওয়ার নিয়ম নেই। সেইখানেই গাদা-গাদা বোতলের আমদানি। এ এক বিচিত্র ব্যাপার। এ-ব্যাপার বোম্বাইতেও দেখেছি। মদ্রাজেও দেখলাম। কলকাতাতে তো ওসব বালাই নেই।

    আমার কিন্তু ভয় করতে লাগল। ভয় করতে লাগল এই ভেবে যে আর একটা দিন, আর একটা রাত আবার গোলমালে কাটবে। আবার গুরুর শরীর খারাপ হয়ে যাবে। নিজেকে ভোলাবার সাধনায় সে পৃথিবীকেও ভুলে যাবে। তখন আবার পেটে ব্যথা হবে, তখন সারা রাত জেগে ছটফট করবে।

    কিন্তু তা ভাবলে কি হবে! গুরুকে বাধা দেবে, এমন মানুষকে দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গুরু একবার যে-মতলব করবে, তা থেকে কেউ তাকে নড়াতে পারবে না।

    ঠিক সন্ধেবেলা তিনগাড়ি লোক এসে হাজির। ভেনাস পিকচার্সের মিস্টার বার্টলে ও তার গার্ল ফ্রেন্ড। মিউজিক ডাইরেক্টর সি রামচন্দ্র। একজন অভিজাত নেপালী ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রী। আর তারপর ফিরোজ খান। ভারি আমুদে ছেলে ফিরোজ। যেমন সুন্দর চেহারা, তেমনি ব্যবহার। তার সঙ্গে দুজন জার্মান বান্ধবী। আর সঙ্গে একজন তামিল পুরুষ বন্ধু।



    যথাদিনে পার্টি দেওয়া হল। সেদিন সকাল থেকেই তোড়জোড় চলতে লাগল। চন্দ্রগেশম একলা পারবে না বলে সকাল বেলাই মাদ্রাজ-সিটি থেকে আর একজন অ্যাসিসটেন্ট নিয়ে এল। দুজনে মিলে তদারক করবে। আর এল কিছু বয়। একতলায় রান্নাঘর আর দোতলার বারান্দায় খাওয়া।

    লম্বা টেবিল পাতা হল। ফর্সা চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল পুরোটা। আর গুনে গুনে বারোটা চেয়ার পড়ল চারদিকে। নিখুঁত বন্দোবস্ত। গুরু সেদিনও শুটিং করতে গিয়েছিল। সকাল-সকাল ফিরে এল এক বাক্স বোতল নিয়ে। সব হুইস্কির বোতল। আমরা বিকেল থেকেই তৈরি।

    ঠিক সন্ধেবেলা তিনগাড়ি লোক এসে হাজির। ভেনাস পিকচার্সের মিস্টার বার্টলে ও তার গার্ল ফ্রেন্ড। মিউজিক ডাইরেক্টর সি রামচন্দ্র। একজন অভিজাত নেপালী ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রী। আর তারপর ফিরোজ খান। ভারি আমুদে ছেলে ফিরোজ। যেমন সুন্দর চেহারা, তেমনি ব্যবহার। তার সঙ্গে দুজন জার্মান বান্ধবী। আর সঙ্গে একজন তামিল পুরুষ বন্ধু।
    শুরু হয়ে গেল হৈ-হৈ। প্রথমে মহাবলীপুরম্-এর বীচ-এ গিয়ে বেড়ানো। তারপর হাসি-ঠাট্টা-গল্প-গুজব। সিগারেট। দেখলাম সিগারেট এমন জিনিস যা সাম্যবাদের সহায়ক। এর মুখ থেকে ওর মুখে আগুন ধরানো। মেয়ে আর পুরুষ যে আলাদা, এ বোধ আর রইল না। তারপর শুরু—

    ডিনারে যা আছে তা তো আছেই। সঙ্গে-সঙ্গে হুইস্কির বোতল খোলা হয়ে গেল। গেলাসে-গেলাসে ঢালা-ঢালি চলতে লাগল। সে-সব বিষয়ে যাতে কোনো ত্রুটি না থাকে, তা তদারক করার জন্য লোকের অভাব ছিল না। গেলাস খালি হওয়ার যেটুকু দেরি।
    খানিকক্ষণ পরে ডিনার শেষ হল। তখন চেয়ার ছেড়ে উঠে খোলা ছাদে গিয়ে বসা হল। আকাশে অসংখ্য তারা। আর সামনের মাটিতে আদিগন্ত সমুদ্র। আরা আমাদের চারপাশে অসংখ্য সাইপ্রাস গাছের সোঁ-সোঁ শব্দ।

    কে একজন সেই ফাঁকে বারান্দার একমাত্র আলোটা নিভিয়ে দিলে। আর সঙ্গে সঙ্গে নিবিড় নীলিমায় অলংকৃত হয়ে উঠল বাইরের আর মনের আকাশ। মনে হল আমরা যে আর মহাবলীপুরম্-এ নেই। আমরা সুদূর কোন্ দ্বীপের ভেতরে চলে গিয়েছি। সেখানে শুধু হাসি, শুধু গল্প আর শুধু আনন্দ। তখন সামনে পেছনে পাশে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। শুধু কথা শুনছি। শুধু সিগারেটের আগুনে বিন্দুগুলো দেখতে পাচ্ছি। আর পুরুষ-নারী সব একাকার হয়ে গেছে। কখনও দুটো আগুনের বিন্দু পাশাপাশি দেখে বুঝতে পারছি দুটো মানুষ মুখোমুখি হয়েছে। আবার তার সঙ্গে সেই ছাদের অন্ধকারেই শুরু হয়ে গেল নাচ। জোড়ায়-জোড়ায় নাচ। কখনও জোড় ভাঙছে আবার কখনও জোড়া লাগছে। কিন্তু চেহারা দেখতে পাচ্ছি না।

    জার্মান মেয়েটি তার ট্রাঞ্জিস্টার সেটটা চালিয়ে দিয়েছে। সেই বাতাসে ভাসা মিউজিকের সঙ্গে শরীর মূর্তিগুলোর কোরাস নাচ চলতে লাগল উলঙ্গ আকাশের নিচে।

    আমি গুরুকে চিনে বার করবার চেষ্টা করলাম সেই অন্ধকারের মধ্যে। কিন্তু কাউকেই চিনতে পারলাম না। পাশের দিকে চেয়ে দেখলাম। তাকে চিনতে পারলাম না। তবে আভাসে বুঝলাম তিনি সি রামচন্দ্র। তিনিও আমার মতো নিঃসঙ্গ।

    হঠাৎ একজন প্রস্তাব করলে— সমুদ্রে গিয়ে স্নান করতে হবে—

    গুরুর গলা পেলাম এতক্ষণে। সে সঙ্গে-সঙ্গে রাজি। আমি কাছে গিয়ে বললাম—এত রাত্রে সমুদ্রে যাবেন না আপনি। রাত বারোটা বেজেছে। আপনার অসুখ করবে—

    গুরু বললে— না, কিছছু হবে না। আপনিও চলুন—

    আমি গেলাম না। সি রামচন্দ্রও গেলেন না। আমরা দুজনেই শুধু বেরসিকের মতো বসে রইলাম। আর অন্য সবাই যে যে পোশাক পরে ছিল, তাই পরেই হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল সমুদ্রে।

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook