ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ৪৯


    বিমল মিত্র (February 4, 2022)
     

    পর্ব ৪৮

    সেদিন যে মর্মান্তিক কান্ড হয়েছিল, তা আজও ভাবলে শিউরে উঠি। তা সেই রাত্রেই রতনকে ঘুম ভাঙিয়ে ওঠানো হল। রতন আসতেই গুরু বললে— রামজীকো গাড়ি লিকালনে বোলো—
    সেই রাত দুটোর সময় গ্যারেজ থেকে গাড়ি বেরোল। আলো জ্বলল বারান্দায়। পাশের বারান্দায় কুকুরটা একবার হাই তুলে কান খাড়া করে রইল। সে এ-বাড়ির নাড়ি-নক্ষত্র চেনে। একদিন গুরুই তাকে কোলে করে এনে এ-বাড়িতে তুলেছে। আজ আর তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। কিন্তু সে সব শোনে, সব দেখে।

    নিস্তব্ধ রাত্রে হঠাৎ গীতা চেঁচিয়ে বললে, চুপ করো!
    গুরুও তখন রেগে চেঁচিয়ে বললে— কেন, চুপ করব কেন?
    গীতা বললে— ও-ঘরে বিমলদা রয়েছেন, বউদি রয়েছে—
    গুরু বললে— থাক্ না, ওদের আমি ভয় করি নাকি?
    আগের রাত্রে ঘুমের জন্য কাতর হয়ে গুরু হুইস্কির বোতলে চুমুক দিয়েছে প্রাণপণ শক্তিতে। সেই মূল্যবান ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে গীতা। রাগ তো হবারই কথা।
    ততক্ষণে গাড়িও তৈরি। রাম সিংও গাড়ির স্টিয়ারিং-এ বসে গেছে।
    গুরু হুঙ্কার দিয়ে উঠল— রামজী, লে যাও ইসকো—

    সে কি তেজ তখন গুরুর আর কত গায়ের জোর! গুরু জোর করে ঠেলে গীতাকে গাড়িতে তুলে দিলে। গীতার বাঁ হাতের কব্জি দিয়ে তখন ঝর-ঝর করে রক্ত পড়ছে। গীতা একবার বলতে গেলে— কেন তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ? আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি?
    গুরু বাধা দিয়ে বললে— রোজ-রোজ তুমি আমাকে এমন করে জ্বালাবে? আমি তোমার জন্য কি ঘুমাতেও পারব না? তুমি যাও, তুমি চলে যাও, তুমি আর কখনও এসো না এ-বাড়িতে— এ-বাড়িটাই তো তোমার খারাপ লাগে। এ-বাড়িটাই তো তোমায় অশান্তি এনে দিয়েছে, কতবার তো বলেছ এ-বাড়িতে আসার পর তোমার কপাল ভেঙেছে—
    গীতাও তেমনি মেয়ে। বলে উঠল— এ-বাড়িটা কপাল ভাঙেনি, কপাল ভেঙেছো তুমি। তুমি আর ওয়াহিদা রেহমান—

    ওয়াহিদার নাম শুনতেই গুরু যেন আরো নির্মম হয়ে উঠল।
    বললে— রামজী, চলা যাও—
    গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গড়-গড় করে গড়িয়ে চলল রাস্তার দিকে। লালা সদর গেটের পাল্লা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ি গিয়ে রাস্তায় পড়ল। তারপর লাল দুটো আলোর বিন্দু জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    এ-সব ঘটনা ঘটেছে রাত্রে। অথচ আমরা কিছুই জানতে পারিনি। কিন্তু গুরু যখন সকালবেলা আমার ঘরে এসে হাজির হল, তখন তার মুখে-চেহারায় গত রাত্রে বিপর্যয়ের চিহ্নটুকু পর্যন্ত নেই। সেই হাসি মুখ, সেই নির্বিকার দৃষ্টি। আমরা অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে।
    আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে— গীতাদির কি হয়েছিল?
    গুরু শুধু বললে— শরীরটা খারাপ হয়েছিল তাই মার কাছে চলে গেছে—
    তার খানিকপরেই আবার গাড়ি এল। আমার স্ত্রী চলে গেল গীতার কাছে। আমি আর গুরু তখন বসে-বসে গল্প নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম।

    গুরু বাধা দিয়ে বললে— রোজ-রোজ তুমি আমাকে এমন করে জ্বালাবে? আমি তোমার জন্য কি ঘুমাতেও পারব না? তুমি যাও, তুমি চলে যাও, তুমি আর কখনও এসো না এ-বাড়িতে— এ-বাড়িটাই তো তোমার খারাপ লাগে। এ-বাড়িটাই তো তোমায় অশান্তি এনে দিয়েছে, কতবার তো বলেছ এ-বাড়িতে আসার পর তোমার কপাল ভেঙেছে

    গীতাও তেমনি মেয়ে। বলে উঠল— এ-বাড়িটা কপাল ভাঙেনি, কপাল ভেঙেছো তুমি। তুমি আর ওয়াহিদা রেহমান



    এতদিন পরে মাদ্রাজের এই টুরিস্ট হাউসে বসে গুরু হয়তো সে-সব কথা ভুলে গেছে। কিন্তু আমি ভুলতে পারিনি। গুরু যখন নিজে রান্না করবার জন্যে স্টোভ, কেরোসিন তেল, কুকার কিনে নিয়ে এল, তখন না হেসে থাকতে পারলাম না।
    গুরু বললে—চলুন, বাজার করে নিয়ে আসি—
    আমি গুরুর কান্ড দেখে হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারলাম না। গুরু কি সত্যিই বাজার করবে? আলু-বেগুন-পটল-কুমড়ো-মাছ কিনবে?

    তা সত্যিই গুরু বাজারে চললে। আমিও সঙ্গে চললাম। কোথায় বাজার তাও জানি না আমি, গুরুও জানে না, তবুও চললাম। ড্রাইভার আমাদের নিয়ে চলল। গাড়ি চলতে লাগল ঝড়ের গতিতে। প্রায় তিরিশ মাইল কি কত মাইল জানি না— পেরিয়ে পৌঁছলাম চিংলিপেট-এর বাজারে।

    আমার নিজের একটা স্বভাব বাজার ঘোরা। আমি কিছু কিনি আর না-কিনি, মাঝে-মাঝে বাজারে ঘুরে বেড়াই। নানা জাতের লোক, বড়লোক-গরিবলোক-মধ্যবিত্ত সবাইকেই কম বেশি বাজারে যেতে হয়। শ্মশানের পর এমন সমবাদী চিত্র আর কোথায় পাব? আর তাছাড়া বাজার এমনই একটা জায়গা, যেখানে গেলে কোনও দেশের আসল চিত্রটা পাওয়া যায়।

    দেখলাম অন্য সব দেশের বাজারের মতো চিংলিপেট-এর বাইরেও গরিব লোকের সংখ্যা বেশি। জিনিসপত্রের দাম মোটামুটি আমাদের দেশের মতোই। ইতর-বিশেষ কিছু নেই। গুরু পটল কিনলে, পেঁয়াজ কিনলে, টম্যাটো কিনলে, পালংশাক কিনলে, তারপর মাছের বাজার। বললাম— মাছ কিনবেন না?

    দেখলাম মাছের দিকে গুরুর বিশেষ ঝোঁক নেই। তবু আমার অনুরোধে কিছু মাছও কিনলে। কিন্তু আসলে যেটা কিনতে ভুল হয় না সেটা হল ধনেপাতা। ধনেপাতা গুরুর খুব প্রিয় জিনিস। প্রায় প্রত্যেক তরকারিতে গুরু ধনেপাতা দিত। আর তার সঙ্গে কিনলে তেল, নুন, লঙ্কা আর মুসুর ডাল।

    পাকা রাঁধুনি গুরু দত্ত। অনেকবার তার নিজের হাতের রান্না খেয়েছি, সত্যি বলতে কি অমন সুস্বাদু ভালো রান্না বড় কম খেয়েছি জীবনে। অনেক সময় আবার বই পড়ে পড়ে রান্না করত। খেতে যেমন ভালবাসতো গুরু, তেমনি রান্না করতেও ভালবাসতো। তারপর বাজার তো হল, এরপর রান্না। গাড়ি যখন আবার মহাবলীপুরম্-এর টুরিস্ট হাউসে এসে হাজির হল তখন মিস্টার চন্দ্রগেশম সমস্ত কিছু দেখে অবাক।

    গুরু খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলে। তারপর দুপুরবেলা আমিও আমার লেখা নিয়ে মেতে রইলুম। ঠিক বিকেলবেলা আবার গুরু আমার ঘরে এলে।
    বললে— চলুন বিমলবাবু, রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে—

    বিকেলবেলা মানেই যার নাম সন্ধে অর্থাৎ শুরু করতে করতেও সেই দেরি হয়ে গেল। প্রেসার-কুকারের ছাপানো বইখানা নিয়ে পড়তে লাগলাম। কেমন করে ব্যবহার করতে হবে, তার সব খুঁটিনাটি বিবরণ আছে তাতে।

    গুরুর ঘরে স্টোভ জ্বালানো হল। তারপর বই দেখে-দেখে প্রেসার কুকার চড়ানো হল। টুরিস্ট হাউসের রান্নাঘর থেকে তরকারি কাটবার ছুরি এনে তরকারি কাটা হল। পালংশাকের ঘন্ট আর ডাল। আর রুটি। রুটিটা তৈরি করে দেবে ওদের রান্নাঘর থেকে।
    গুরু হুইস্কির বোতল খুলল। গ্লাসে ঢালতে লাগল হুইস্কি। আর আমি বই পড়ে-পড়ে বলতে লাগলাম। কিনতি কতক্ষণ পরে জানি না, গুরু বললে— ডাল হয়ে গেছে—এবার তরকারি চড়াব—

    কিন্তু কুকার খুলে দেখা গেল ডাল গলেনি, তখনও শক্ত রয়েছে।
    পালংশাকের ঘন্টটাও ঠিক হল না। গলে একেবারে জল হয়ে গেল। ওদিকে দেখলাম গুরুরও তখন অস্বাভাবিক অবস্থা। হয়তো হুইস্কি বেশি খেয়ে ফেলেছে। তখন প্রায় শুয়ে পড়বার অবস্থা। আমি বললাম— কি হল, খাবেন না?

    গুরুর মুখ দিয়ে তখন আর কথা বেরোচ্ছে না। মিস্টার চন্দ্রগেশম হঠাৎ এসে হাজির। বললে— এ কি হল, রান্না হল না?
    বললাম— না, সব নষ্ট হয়ে গেল—

    চন্দ্রগেশম বললে— আপনারা কেন কষ্ট করে রাঁধতে গেলেন? আমাদের বললেই তো আমরা সব রান্না করে দিতুম। আমরা কি শুধু চপ-কাটলেট রান্না করতে পারি। বললে আমরা তো দিশি রান্নাও করে দিতে পারি। রুটি দিতে পারি, পালংশাকের ঘন্ট দিতে পারি। আবার মুসুর ডালও তৈরি করতে পারি—

    সত্যিই মিস্টার চন্দ্রগেশম খুব দুঃখ করতে লাগল, আমাদের অবস্থা দেখে। কিন্তু চন্দ্রগেশম তো জানত না যে গুরু দত্ত সাধারণ লোক নয়। গুরু দত্ত যদি সাধারণ মানুষ হত তো সব সমস্যা মিটেই যেত!

    যা হোক সে-রাত কোনও রকমে কাটল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে গুরু আবার অন্য মানুষ। আমার ঘরে এসে বললে—শুনুন, ও প্রেসার-কুকার আপনি কলকাতায় নিয়ে যান ওতে আমি রাঁধতে পারব না। আজকে আমি এঁদের রান্নাঘরে গিয়ে এদের উনুনেই রান্না করব—

    গুরুর খেয়ালিপনা দেখে আমি আরো অবাক হয়ে গেলাম।
    বললাম— দরকার কি রান্না করে? বেশ তো আছি, বেশ তো খাচ্ছি—
    গুরু বললে— না, এদের রান্না পছন্দ হবে না। আমি রান্না করে খাবো—

    সেদিন সত্যিই গুরু দত্ত নিজের হাতে সব রান্না করলে। ডাল, চচ্চড়ি, আরো অনেক কিছু।

    আসলে ওই রান্নাটা ছিল উপলক্ষ। গুরু সব সময়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখে সমস্ত কিছু ভুলে থাকতে চাইত। ভুলতে চাইত সংসারকে, ভুলতে চাইত গীতাকে, ভুলতে চাইত ছেলে-মেয়ে সকলকে। সকলকে ভুলেই সে ভোলানাথ হবার আশায় কখনও রান্না করত, কখনও বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে আড্ডা দিত, কখনও বা হুইস্কির বোতলে আকন্ঠ ডুব দিত!

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook