ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ভবদীয়: পর্ব ২


    সাগুফতা শারমীন তানিয়া (November 27, 2021)
     

    পর্ব ১

    গির্জার ভেতরদিককার দেওয়ালে সাঁটা আয়তাকার একটা বাক্স, তাতে সাজানো খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হবার সহযোগী পুস্তিকা। প্রধান ফটকের কাঠে খোদাই করা বাইবেলের দৃশ্য— যিশু অন্ধকে চোখ দিচ্ছেন, কুষ্ঠরোগীকে ত্রাণ করছেন। ধানজোড় প্রায়োরি স্কুলের হাবা ছেলেপুলেরা এই কাঠের কাজ করে দিয়েছে। ‘হাবা’ ডাকছে শুনলে মাদার বিরক্ত হবেন, বলতে হয় বুদ্ধিমত্তায় পিছিয়ে পড়া শিশু। মোজেস দ্যাখে আর ভাবে। যিনি মানুষকে এত ভালবাসেন, তিনি অন্ধত্ব দেবেনই বা কেন, কুষ্ঠর মতো ভয়ানক অসুখ দেবেন কেন, কেন শিলপাটার মতো কুঁদে দেবেন বাপের মুখটা? জিজ্ঞেস করলেই থাবড়া খাবে বলে সে জিজ্ঞেস করে না বাপকে। মাদারের কাছে গিয়ে পড়ে প্রশ্নটা নিয়ে, মাদার সুপিরিয়র মৃদু-মৃদু হাসেন আর বলেন— ‘কেমন মোজেস, ইস্কুলে পরীক্ষা হবে না? কে ফেল কল্লো আর কে পাশ কল্লো সেটা হেডমাস্টার দেখবেন না? তা ইস্কুলে পরীক্ষা হবার মতো করে ঈশ্বরও আমাদের পরীক্ষা নেন।’ মোজেস তক্ষুনি জিজ্ঞেস করে, তবে কি তার বাপ ফেল করেছে চিরতরে, গুটিবসন্তের এই দাগগুলি যেহেতু কোনওদিন আর যাবে না! মাদার স্নেহের সাথে তাড়ন করেন তাকে, বলেন, ‘ঈশ্বরের পরীক্ষা আর সেই পরীক্ষার রেজাল্ট বোঝা এত সহজ নয়। বহুদিন সাধনা করতে হয়।’

    চাপকলটার জলে ভূগর্ভের বিষ ধরা পড়েছিল বলে আর কেউ সেটায় চাপ দেয় না। কিন্তু কখনও-কখনও নিস্তব্ধ দিনে রেবতী কান পেতে চাপকলের সেই জল আসবার শব্দ শুনতে পায়, যুবতীর কলহাস্যের মতো শব্দ, পৌরসভার কলের জলের ফোঁসফাঁস নয়। কলতলায় সুনীল সরেন সমারোহ করে কড়ুয়া তেল ডলত গায়ে, আচ্ছামতো সাবান ঘষে কত ফেনা তুলত, তারপর ঝপাঝপ গোসল। সেকালের মাদার একদিন সুনীল সরেনকে ডেকে বললেন, এইরকম প্রকাশ্য দিবালোকে উদোম হয়ে গোসল করা চলবে না, এ যে সন্ন্যাসিনীদের মঠ। সুনীলও নড়া ধরে ঘরে নিয়ে গেল রেবতীকে, বাপ-ছেলে তখন থেকে আড়াল হয়েই স্নান করত। মোজেসকেও এই গল্প বলতে হয়েছে রেবতীর, উজ্জ্বল প্রশস্ত রোদে অজস্র জল ঢেলে স্নানের আনন্দ কেন মোজেস নিতে পারবে না সেটা বোঝাতে গিয়ে বলতে হয়েছে। মোজেস অবশ্য দিবালোক প্রকাশ্য হবে না তো কী হবে এইসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল বলে চড়চাপড় খেয়েছে।

    পশ্চিম আকাশে অগাধ আবির মাখামাখি তখনও, বড় গাছগুলির মগডালে রাঙা রোদের লুকোচুরি, ঝোপগুলোয় অন্ধকার নেমে এসেছে। পুবদিকের বাগানে লম্বা-লম্বা বেগুনি ছায়া পড়েছে। বাগান যেখান থেকে বন্য হতে শুরু করেছে, সেখানে কিছু কুলগাছে খুব পাখি ডাকছে। রসুইন্যা-জিয়ল-মাদার গাছে জড়াজড়ি জায়গাটা। জংলি মাখনসিমের ফুল ফুটেছে নীল-নীল। ছ’টার সাপারের পর মাদার এসে বসেন এই ঘেরা বারান্দায়। তাঁর চারদিকে অনাবিল পৃথিবী সদাপ্রভুর করুণার রঙে নেয়ে উঠছে এমন একটা অনুভূতি হয়, যদিও দেওয়ালের বাইরের বাকি পৃথিবী আবিলতায় ক্লিষ্ট হয়ে ওঠেনি এমন ভাবনাটা তিনি করেন না, করতে পারেন না। বরং এইটুকু দ্বীপদেশের মতো গির্জা আর আশ্রমের প্রাঙ্গণের নির্মলতা ধরে রাখতে তাঁকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়, হয়েছে, বিরামহীন, প্রত্যহ। বাগানের কাকলির দিকে কান পেতে তাঁর মনে পড়ে গেল এক জাতের পাখি আসত, যুদ্ধের আগে। খাটো কাস্তের মতো পাখা, ছুঁচলো লেজ, ধুলোমাটির সাথে মিশে যাবে এমন রং। বদমাস ছেলেরা গির্জার দেওয়ালে চড়ে এয়ারগান দিয়ে শিকার করত সেই পাখি। বিহারি আসলাম মাঝে মাঝে মাদারদেরকে ভাড়া গাড়ি চালিয়ে ‘জাগরণী’ ধর্মপল্লিতে দিয়ে আসত, সে বলত— ওই পাখির নাম কুহর। কী সুন্দর ডাক! কোথায় বিলুপ্ত হয়ে গেল সেই পাখি, আর আসে না। সন্ধ্যা ফুরাবার আগেই শুরু হয় ওয়াজ, আগে হত শীতকালে এবং মমিনপুরা জামে মসজিদে, এখন হয় মোটামুটি সারা বছর, অলিগলি সর্বত্র, পথ-ঘাট বন্ধ করে দিয়ে। মাদার ‘দোজাহানের কামিয়াবি হাসিল করুন’ মানে বোঝেন, আসলামের ছেলেই শিখিয়ে দিয়েছে এ-কথার অর্থ, অবশ্য কথা যে খুব বোঝা যায় তা নয়, চিৎকার বোঝা যায়। কিন্তু বিরতিহীন আরাধনার এই মঠে ধৈর্যই তো শেষ কথা, মুহূর্তকে এক-একটি টনটনে মুক্তোদানার মতো অনুভব করাই তাঁদের শিক্ষা, অস্থিরতার ভিতরে শুভকে জেনে স্থির থাকাই তাঁদের ব্রত। অতএব শান্ত থাকা ছাড়া তাঁর আর কী বা করার আছে! সাধু দামিয়ানের মঠের ভিতর চল্লিশ বছর টানা আরাধনা করে যাওয়া সাধ্বী ক্লারার মতো শান্ত, স্থির। আজ ওয়াজ শুরু হয়নি বলেই যেন পাখিদের আত্মহারা ওয়াজ শোনা যাচ্ছে। 

    বিকেল চারটা থেকে সোয়া পাঁচটা অব্দি সিস্টারদের কাজের সময় বরাদ্দ করা, এই— রাতের রান্নার কুটনো কোটা, ঘরদোর পরিপাটি করা, থালাবাসন ধোয়া থেকে জানালার কাঁচ মোছা এসব নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সময় সেটা। সিস্টাররা বয়সের অজুহাতে ওঁকে কুটনো কুটতে দেয় না, তবু কাজ কেড়ে নিয়ে মাদার আনাজপাতি কাটছিলেন। হাত চললেই জীবন চলে। কাটতে-কাটতে ভাবছিলেন— এক সময় গির্জার ছাদে উঠলে দেখা যেত শুধু অড়হরের মাঠ, বাতাসের বিসর্পিল দাগ ধানক্ষেতের উপর, সেখানে বিস্তর বাবুইপাখি নেমেছে। দূরে গ্লাস ফ্যাক্টরি আর অ্যালুমিনিয়াম কারখানা, যেন পাশাপাশি দুই ভাই দাঁড়িয়ে। সে কবেকার কথা! এখন শুধু বাড়িঘর দেখা যায়, সেইসব বাড়ির ছাদে বড় বেশি অ্যান্টেনা, বড় বেশি উৎসুক মানুষ, আর তাদের হাতে বড় বেশি দূরবিন। তারা বড় বেশি গল্প শোনে মঠের, সবাই জানতে চায় মনাস্টারি সিস্টাররা সত্যি সারারাত কাঁদে কি না, সারারাত জেগে জেগে নিজেরাই নিজেদের কবর খোঁড়ে কি না, সিস্টাররা চুলে তেল মাখে কি না, অন্তর্বাস পরে কি না, কাপড় বদলানোর সময় তাদেরকে অন্যান্য মেয়েদের মতোই লাগে কি না, তারা লুকিয়ে চটিবই পড়ে কি না, তারা মদ্যপান করে ঢুলতে-ঢুলতে কোথায় ফেরত যায়… যাজকদের সাথে শুতে আসে কি না, এমনি হাজার উপযাচক প্রশ্ন। এইসব প্রশ্নের স্বকপোলকল্পিত উত্তরও আছে মানুষের বুকে-বুকে। ‘এমনকী প্রায়োরি স্কুলের অভিভাবকদেরও এত কৌতূহল, সিস্টাররা বিরক্ত হন কিন্তু গায়ে মাখেন না’, বলেন পূর্ব কেরলের মেয়ে সিস্টার সিসিলিয়া। মাদার বলেন, ‘প্রশ্ন না শুনলে তুমি কেমন করে বুঝবে মানুষ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? মানুষ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা না বুঝলে কী করে তুমি তাঁর কাছে যাবে? যিশু যে মানুষের কাছে যেতে বলে গেছেন!’ 

    অশীতিপর মাদার চেয়ে-চেয়ে দেখেছিলেন পাথরের ভাঙা বুক, যেন খপ করে এসে
    পড়েছে দুর্বৃত্তের হাত

    শ্বাস ফেলে সিস্টার সিসিলিয়া বলেন, ‘এত বছর ধরে এই প্রান্তরে এ-পাথরের গির্জা দাঁড়িয়ে আছে, আলোর দরজা অবারিত খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ তবু মানুষের মনগড়া গল্প কমল না!’ 

    মাদার শান্তসুরে বলেন, ‘এ আমাদেরই হয়তো খামতি। তারা আমাদের কাছে আসবে না, আমরাই তাদের কাছে যাব। সেটা হয়তো এখনও সম্পন্ন করতে পারিনি।’

    সিস্টার সিসিলিয়া চটপট কোটা-বাছার কাজ সেরে শীতের গরম কাপড় বুনতে বসেছিলেন। মগ্ন বলিষ্ঠ চিবুকে দু-একটি বয়সের কোঁকড়া দাড়ি, আবলুস কাঠের মতো কালো শরীর, কপাল ঘিরে ছোট করে ছাঁটা ঢেউখেলানো সাদাকালো চুলের রাশি, আলগোছে পিঠের হাড় উলের কাঁটায় চুলকে নিয়ে সিস্টার চ্যাপেলের মাতা মেরির মূর্তি ভাঙা নিয়ে কথা তোলেন। এবারের গ্রীষ্মে সুদূর রাজধানীতে জাস্টিসিয়ার মূর্তি নিয়ে তৌহিদবাদী জনতার শোরগোল তুঙ্গে উঠবার পর থেকে ওঁরা খুব বিচলিত। চ্যাপেলের এই ছোট্ট মাতৃমূর্তিটি সন্ন্যাসিনীদের খুব প্রিয়, ক’দিন আগে কারা যেন দেওয়াল টপকে এসে ভেঙে দিয়ে গেছে মেরির ঘাড় আর স্তন। সকালে অশীতিপর মাদার চেয়ে-চেয়ে দেখেছিলেন পাথরের ভাঙা বুক, যেন খপ করে এসে পড়েছে দুর্বৃত্তের হাত, যেন সেটা মেরির মূর্তি নয়, সতেরো বছরের নবীনা সন্ন্যাসিনী। থাবাগুলো যেন একই রকম। ভাবতে-ভাবতে বেঁকে গেছিল মাদারের মুখ। সিস্টার সিসিলিয়ার পাশে বসে এইসব অশান্তির কথা শুনতে-শুনতেই একঝলক নিজের যৌবনের কথা মনে পড়ে গেল মাদারের। 

    সতেরো বছর বয়সে এই জীবন আস্বাদ করতে তিন মাসের জন্য এসেছিলেন তিনি, ইসলামপুর রোডের সেই মঠে, মঠের বাইরের ঢাকা তখন রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সোচ্চার। তারপর আরও তিনমাস। তারপর পস্টুল্যান্ট হলেন। ‘বিরহদহন লাগে’, সেই ঝাপটা লাগত কি তাঁদের নবীন গায়ে, চেরা গলায় সিস্টাররা উচ্চগ্রামে গাইতেন— ‘তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’ কিন্তু কেমন ছিল তাঁর ধারণাগুলো, মঠে প্রবেশের আগে? সন্ন্যাস নেওয়ার আগে এই জীবনটার কল্পিত রংগুলি? প্রথমদিকে, যখন ইসলামপুরের সেই দোকানে বিশাল কড়াইয়ে ফুরফুরে দাড়িওয়ালা এক লোক জিলাপি ভাজত, আর বলত, ‘আমি ভি হালায় বাংলা চাই!’ গরম জিলাপির প্রলোভন সম্বরণ করে মঠে ঢুকে যেত সতেরো বছরের মেয়েটি? কিংবা প্রিস্টদের কমিউনিয়নের পরে ব্রেকফাস্ট পরিবেশন করতে গিয়ে একবার কী কাণ্ড! পরে প্রিস্ট হাসপাতালে গিয়ে নিজের থুতনি সেলাই করে আনলেন, ডাক্তারকে বললেন গির্জার সিঁড়িতে পিছলে পড়ে গেছেন তিনি, আর কখনও সেই প্রিস্ট মেয়েটিকে আনুগত্যের শপথ মনে করিয়ে দিতে আসেননি। প্রতিবার এক বছরের শপথ নিতে গিয়ে নিজেকে কী জিজ্ঞেস করত সেই মেয়েটি? ভূতের ভয়ে কনভেন্টের ঘরে আধমরা হয়ে থাকত সে, সেটা কি ভুলবার! 

    তবু স্পষ্ট মনে করতে পারেন পঁয়ষট্টি বছর আগের সেই রাত্রির কথা, যেদিন প্রভুর আহ্বান হৃদয়ে শুনতে পেলেন। বাতাসে প্রথম শীতের চোরা আভাসের মতো, সন্তর্পণে আলাদা, খুব অন্যরকম। একটা ফুলে ভরা ইন্ডিয়ান ল্যাবার্নামের তলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি, সেদিনকার বেলা, অসহ্য উল্লাসে ফেটে পড়া হলদে ফুলের অনন্ত ঝরনা যেন, তার তলায় দাঁড়িয়ে আলোয়-পাপড়িতে-অহেতুক আনন্দে-যন্ত্রণায় কেন চোখে জল এসে গেছিল ওঁর? কেন সমস্ত অন্তর গেয়ে উঠেছিল প্রভুর জয়গান? প্রিয় পুরুষের ডাকে যত শিহরন মিশে থাকে, ততখানিই নিশ্চয়ই শিউরে উঠেছিলেন কিশোরী কন্যা, কে জানে! এক তালপত্র-রোববারের চাঁদনি রাতে নীল-নীল জলপাই পাতারা দ্যুতি ছড়াতে-ছড়াতে সাধ্বী ক্লারাকে হাত বাড়িয়ে ডেকেছিল— এসো! যেমন করে সন্ত বার্নাদেত উঁকি দিয়ে দেখেছিলেন গুহার শীতলতায় জ্যোতি ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তোর জপমালা হাতে মাতা মেরি। একটা খাটো তৃপ্তির শ্বাস নিলেন ঈশ্বরের আরেক দীনদাসী এই মাদার, তাজা ঘাসে চরে ফিরতে-ফিরতে গাভী যেমন নেয়। সেই সুখস্মৃতি মনে করে যত জায়গায় মাদার গেছেন, এই হলদে ঝরনার মতো ইন্ডিয়ান ল্যাবার্নামের সারি পুঁতেছেন সেই ভুঁইয়ে।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook