ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছবিদা— ছবি বিশ্বাস: পর্ব ৩


    তরুণ মজুমদার (March 12, 2021)
     

    পর্ব ২

    বিশ্বাসদের বেশি বিশ্বাস করিস না

    গল্পের পর গল্প, শেষ নেই যেন। তখন ‘কাঁচের স্বর্গ’ ছবিটা তৈরি করছি আমরা। প্রচুর শিল্পীর সমাবেশ সেখানে। পাহাড়ী স্যান্যাল, বিকাশ রায়, মঞ্জু দে, ছায়া দেবী, অনিল চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে উৎপল দত্ত, তরুণ রায়, তরুণকুমার, সবিতাব্রত দত্ত পর্যন্ত। এ ছবিতে কোর্টরুমের একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য আছে একেবারে শেষের দিকে। সেখানে এক বিবেকবান বিচারককে রায় দিতে হবে— কোনটা বড়? আইনের বইয়ে যা লেখা আছে সেইটা, না কি মানবিকতার মাপকাঠিতে বিচারকের অন্তর যা বলছে, সেইটা?

    গল্পের পটভূমি হল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার কলকাতা। নায়ক মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, কিন্তু নানা কারণে তার এতই সঙ্গিন অবস্থা যে পড়াশোনা চালানোই দায়। আপন বলতে তার কেউ নেই, একমাত্র এক বন্ধু ছাড়া। সেই বন্ধুটির সাহায্যেই কোনও রকমে টিকে আছে সে। ছাত্র হিসেবে প্রতিভাবান। একটাই মাত্র স্বপ্ন তার জীবনে: একদিন সে সত্যিকারের বড় সার্জন হবে, দেশের মানুষের কাজে লাগবে। কিন্তু স্বপ্ন তার সার্থক হয় না। টাকার অভাবে ফাইনাল পরীক্ষার ফিজ জমা দিতে পারে না। ফলে স্বপ্নভঙ্গ আর প্রচণ্ড হতাশা।

    এই সময়ে কাগজের একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে তার। মিলিটারিতে কিছু লোক নেবে। যেখানে যুদ্ধ চলছে, সেই ফ্রন্টে গিয়ে মিলিটারি হাসপাতালে যোগ দিতে হবে— আর্দালি হিসেবে। সাত-পাঁচ ভেবে ছেলেটি দরখাস্ত পাঠায় আর চাকরিটা জুটেও যায়।

    ফ্রন্টে পৌঁছে সে দেখে, ভয়ানক কাণ্ড। শত্রুপক্ষের বোমাবর্ষণ হচ্ছে আশেপাশে। ট্রাক বোঝাই করে রাশি রাশি আহতকে এনে ফেলা হচ্ছে মিলিটারি ফিল্ড হসপিটালে। সার্জন মোটে একজন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাজ করেও তিনি নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না।

    নায়ক ছেলেটি, যে কিনা একজন আর্দালি মাত্র, চোখের সামনে এসব দ্যাখে আর তার হাত নিশপিশ করে। তারও তো সার্জন হবারই কথা ছিল। ফাইনাল ইয়ার অবধি তো সে পড়েছে কলেজে। এই সময় যদি সে একটু কাজে লাগতে পারত।

    কিন্তু তা তো হবার নয়, সে যে শুধুমাত্র এক আর্দালি।

    একদিন রাতে বোমা এসে পড়ল এই হাসপাতালটাতেও। এর একটা অংশ তো উড়ে গেলই, কিন্তু তার থেকেও মর্মান্তিক হল, যে সার্জন আহতদের চিকিৎসা করছিলেন, তাঁর মৃত্যু।

    রক্তাক্ত, মুমূর্ষু আহতদের দেখবার এখন আর কেউ নেই। এদিকে ট্রাক-বোঝাই হয়ে তারা আসছে তো আসছেই। বিনা চিকিৎসায় তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে নিশ্চিত মৃত্যু।

    হঠাৎ ছেলেটি একটা সিদ্ধান্ত নেয়। হাতে তুলে নেয় সার্জনের ছুরি, স্ক্যালপেল। একা হাতে বহু লোকের প্রাণ বাঁচায়। আহতদের চোখে সে এখন এক দেবদূত-বিশেষ।

    কিন্তু ঘটনার এইখানেই শেষ নয়।

    যুদ্ধ শেষ হয় একদিন। ছেলেটি এখন আবার বেকার। কলকাতায় ফিরে হন্যের মতো খোঁজে একটা চাকরি। যে কোনও চাকরি।

    এমন সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। সারাদিনের চাকরি খোঁজার পালা শেষ করে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত ছেলেটি যখন পার্ক স্ট্রিট ধরে ফিরে আসছে, হঠাৎ একটা দামি গাড়ি এসে দাঁড়ায় তার পাশে। মালিক নেমে এসে বলেন,

    — ‘হ্যালো ডক্টর, আছেন কেমন? চিনতে পারছেন আমাকে?’

    ডাক্তার! তাকে ‘ডাক্তার’ বলে ডাকছেন! কে ইনি?

    — ‘মনে নেই? ফ্রন্টের হসপিটালে আপনিই তো আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। বম্বিংয়ে ইনজিওর্ড হয়ে আমি তো যেতেই বসেছিলাম।’

    কৃতজ্ঞ ভদ্রলোক প্রায় জোর করে ছেলেটিকে টেনে নিয়ে যান পাশের রেস্তোরাঁয়। কথাপ্রসঙ্গে বেরিয়ে পড়ে, ভদ্রলোক এখন এক নিরিবিলি পাহাড়ি শহরের মিউনিসিপ্যালটির চেয়ারম্যান। ওঁদের একটা হাসপাতাল আছে— যেখানে অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনের পদটি হঠাৎ খালি হয়ে গেছে।

    উপকারের প্রতিদান হিসেবে তিনি প্রায় জোর করেই ছেলেটিকে টেনে নিয়ে যান তাঁর শহরে। অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন। এ কথা না জেনেই যে, যাকে উনি ডাক্তার বলে ভুল করছেন আদতে সে ডাক্তারই নয়— ডাক্তারি পাশ করার কোনও সার্টিফিকেটই তার নেই।

    ‘ইম্পস্টার’ (Imposter) হওয়া সত্ত্বেও ছেলেটি কিন্তু দারুণ কাজ করতে থাকে। ধীরে ধীরে সব প্রতিকূলতা জয় করে সে যখন খ্যাতির শিখরে, এমন সময়ে সে ধরা পড়ে যায়। বেরিয়ে পড়ে তার আসল পরিচয়।

    মিথ্যে পরিচয় দিয়ে ‘ডাক্তার’ সাজবার অপরাধে বিচার শুরু হয়। একদিকে ‘মিথ্যে পরিচয়’টা যেমন সত্যি, অন্যদিকে বহু লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছে সে— এটাও সমান সত্যি।

    আইন এখানে কী অবস্থান নেবে? জজসাহেবই বা কী রায় দেবেন?

    জটিল প্রশ্ন। জজসাহেবকেই এর উত্তর দিতে হবে।

    আমরা গিয়ে ধরলাম ছবিদাকে। মোটে তিনদিনের কাজ। তার মধ্যে দু’দিন সাক্ষীদের জেরাপর্ব, উকিলদের ছায়াযুদ্ধ, মাঝে মাঝে গোলমাল থামাবার জন্যে কাঠের হাতুড়ি ঠুকে জজসাহেবের ‘অর্ডার’ ‘অর্ডার’ বলে ওঠা ছাড়া কিছু করণীয় নেই৷ কিন্তু তৃতীয় দিনে তাঁকে দিতে হবে সেই ভার্ডিক্ট— সুদীর্ঘ একটা রায়, যার ওপর শুধুমাত্র ছেলেটির ভবিষ্যৎই নির্ভর করছে না, নির্ভর করছে আইন এখানে কোন পক্ষ নেবে— বইতে ছাপানো কতগুলো শুকনো অক্ষরের না মানবিকতার— এই প্রশ্নও।

    হোক মোটে তিনদিনের কাজ, কিন্তু ছবিদা ছাড়া এই রোলে আর কাউকে কল্পনা করা যাচ্ছে না।

    শুনে ছবিদা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন, ‘বটে?’

    আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ। বটে।’

    এমন করে জবাব দেওয়ার অধিকার ছবিদাই আমাদের দিয়েছেন। কারণ, যতই গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে থাকুন, পর পর তিনটে ছবিতে ওঁকে নিয়ে কাজ করে বুঝেছি— ওটা মুখোশই। আসলে ভেতরে ভেতরে উনি আমাদের অসম্ভব স্নেহ করেন, এটাও ধরে ফেলেছি। কিন্তু সেই ভালবাসার কথাটা যেন আমরা টের না পাই, তার জন্যে ভ্রু দুটো ইচ্ছে করেই আরও বেশি কুঁচকে রাখেন, গলার আওয়াজ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর করেন। আসলে এ-ও এক ধরনের খেলা, যা খেলে উনি ভেতরে ভেতরে মজা পান।

    আগের কথার রেশ ধরে উনি বললেন, ‘কিন্তু কী কারণে বটে?’

    — ‘কারণ আপনি ছাড়া এই চরিত্র ফোটাবার আর কেউ নেই।’

    — ‘কী করে বুঝলি?’

    — ‘কারণ আপনার নাম ছবি বিশ্বাস।’

    — ‘তেল দিচ্ছিস? কিন্তু এ-ও বলি। বিশ্বাসদের বেশি বিশ্বাস করিস না। ডুববি।’

    — ‘ডুবি ডুবব। এখন আপনি ‘হ্যাঁ’ বলবেন কি না বলুন।’

    — ‘তাহলে ডোব। মাই অ্যানসার ইজ—’ একটু থেমে একটু সাসপেন্স তৈরি করে বললেন, ‘ইয়েস!’

    আনন্দে লাফাতে লাফাতে আমরা ফিরে এলাম।

    এর পরে সেই বিখ্যাত কোর্টরুম সিন।

    সেটটাও পড়েছে সেইরকম। পেল্লায়। আর্ট ডিরেক্টরদের ভাষায় যাকে বলে ‘ফোর-ওয়াল সেট’।

    ‘ফোর-ওয়াল সেট’ কথাটা একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। যে সেট-এর চারদিকই দেওয়াল দিয়ে ঘেরা— জানলা-দরজা অবশ্য থাকবে। কেউ ভাবতে পারেন, এ আবার বেশি কথা কী? ঘর বানাতে হলে চারদিকে চারটে দেওয়াল তো থাকবেই।

    কিন্তু না। সচরাচর তা হয় না। ইনডোরে, অর্থাৎ ফ্লোরের মধ্যে ঘর সাধারণত বসানো হয় তিন দেওয়ালের, ইংরিজি ‘ইউ’-এর মতো আকৃতি। আর একটা দেওয়াল ছেড়ে রেখে দেওয়া হয় নানা রকম লাইট, ট্রলি, ক্রেন আর ক্যামেরা বসাবার জন্যে। এটা না করলে তখন ঘরের ভেতরেই এগুলোকে বাধ্য হয়ে ঢুকিয়ে আনতে হয়। তার ফলে ঘরের অনেকটা জায়গা খেয়ে যায়, অর্থাৎ দৃশ্যে সেসব কোনও কাজে লাগে না। তা ছাড়া নড়াচড়ার জায়গায় টান পড়ে। উপরন্তু ট্রলির লাইন, ক্রেন, এসব বসানো সমস্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই সচরাচর তিন-দেওয়ালের অর্থাৎ ‘ইউ’ আকৃতির সেটই বানানো হয় কাজের সুবিধের জন্যে। যদি দৈবাৎ উল্টোদিকে ক্যামেরাকে বসাতেই হয়, তখন সেট-এর ফাঁকা দিকটা এক টুকরো ‘ফোর্থ ওয়াল’ বসিয়ে কাজ-চালানোর বুদ্ধি বের করা দরকার হয়ে পড়ে।

    কিন্তু, আমাদের কোর্টরুমের সেটটা ‘ফোর ওয়াল’ সেট। অর্থাৎ ঘরের চার-চারটে দেওয়াল পাকাপোক্ত ভাবে তৈরি। ক্যামেরা, লাইট, ট্রলি কোথায় কোথায় বসবে, সে সব আগে থাকতেই হিসেব করা। সেই সেট-এ শক্তিশালী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা হাজির। বিচারকের আসন আলো করে বসে আছেন ছবিদা।

    যেমন আগেই বলেছি, তিনদিনের মধ্যে দু’দিন জজসাহেবকে শুধু ‘অর্ডার’ ‘অর্ডার’ বলা ছাড়া আর কোনও অভিনয়ের সুযোগ দেওয়া গেল না। অথচ আর সবাই চুটিয়ে অভিনয় করছেন। এ অবস্থায় যে কোনও জাতশিল্পীই পাল্লা দিয়ে অভিনয় করার জন্যে মুখিয়ে থাকবেন। সে উপায় না থাকলে ভেতরটা তাঁর ছটফট করাই স্বাভাবিক। ছবিদার বেলাতেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? দু’দিন ধরে তিনি মনে মনে ফুঁসছেন, যদিও বাইরে তার কোনও প্রকাশ নেই।

    তৃতীয় দিন লাঞ্চ পর্যন্ত একই জিনিস চলল৷ লাঞ্চের পর ছবিদার হাতে চার পাতার ডায়ালগ-শিট ধরিয়ে দিয়ে বললাম,

    — ‘একবার চোখ বুলিয়ে নিন। এর পর আপনার পালা। আর গোটাটাই কিন্তু আমরা এক শটে নেব।’

    শুনে উনি এমন ভাবে তাকালেন আমার দিকে, আমি তো অবাক। ইংরিজিতে ‘ডিসডেন’ বলে একটা শব্দ আছে, যার বাংলা হচ্ছে ‘ঘৃণা-মিশ্রিত অবজ্ঞা’— অবিকল তাই। বললেন,

    — ‘এতটা?’

    — ‘হ্যাঁ।’

    — ‘এক শটে?’

    — ‘বললাম তো।’

    — ‘ইমপসিব্‌ল।’

    — ‘সে কী?’

    — ‘বললাম তো। এক কথা আমি দু’বার রিপিট করি না।’

    — ‘বললে তো হবে না। আপনাকে এক শটেই দিতে হবে।’

    আমাদের নকল বাক্‌যুদ্ধ যখন এইভাবে জমে উঠছে, তখন আশেপাশের দু-একজন শিল্পী তো অবাক। কোথায় ছবি বিশ্বাসের মতো মহীরুহ, আর কোথায় আমার মতো তুচ্ছ এক নবযুবক! উৎপল দত্ত, যিনি পাবলিক প্রসিকিউটরের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন, হাত ধরে আমাকে একপাশে টেনে চাপা গলায় বললেন,

    — ‘করছেন কী? ওঁর মেজাজ বিগড়ে গেলে তো শুটিংয়ের বারোটা বেজে যাবে।’

    — ‘কিছু হবে না’, বলে আবার আমি ছবিদার কাছে এসে বললাম,   

    — ‘ট্রলি-লাইন বসে গেছে। ক্যামেরাও রেডি। যতক্ষণ লাইট হচ্ছে দু’বার চোখ বুলিয়ে নিন ডায়ালগ-শিটে।’

    মরা ইঁদুরকে লেজ ধরে যেমন করে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় লোকে, ঠিক তেমনি আলপিনে-গাঁথা চার পাতার ডায়ালগ-শিটের শেষ পাতাটার এক কোণ ধরে আমার সামনে ফেলে দিয়ে উনি বললেন,

    — ‘ইমপসিব্‌ল, বললাম তো।’

    এবার বাধ্য হয়ে গলার সুর পাল্টাই। অনুনয়ের সুরে বলি,

    — ‘কেন এমন করছেন বলুন তো? সময় বয়ে যাচ্ছে। ওই দেখুন, লাইটও রেডি। এমনি করলে যে আমাদের লোকসান হয়ে যাবে।’

    — ‘হোক। তাতে আমার কী?’

    — ‘তার মানে আপনি বলবেন না?’

    — ‘উঁহু।’

    — ‘কেন জানতে পারি?’

    — ‘আমার বয়েস হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো মেমোরি আর নেই।’

    জানতাম, এটা হচ্ছে ছবিদার নির্ভেজাল অনৃতভাষণ। এমন স্মৃতিশক্তি নিয়ে খুব কম লোকই জন্মান। যে কোনও ডায়ালগ দু’বার কি তিনবার দেখেই উনি কমা-ফুলস্টপসুদ্ধু গড়গড় করে বলে দেবার ক্ষমতা রাখেন। আমরা বলতাম ‘ফোটোগ্রাফিক মেমরি’।

    সেই মানুষটা কিনা আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করছেন?

    উনি তো চাইলেই পারেন। যেমনটা আমরা বলছি।

    হঠাৎ আমার মাথাতেও একটা বুদ্ধি খেলে গেল৷ জিজ্ঞেস করলাম,

    — ‘ঠিক আছে। এতটা আপনাকে মুখস্থ করতে হবে না। কতটা মনে রেখে বলতে পারবেন সেটা বলুন।’

    — ‘ম্যাক্সিমাম আট লাইন। বড়জোর দশ লাইন।’

    — ‘ঠিক আছে। ওতেই কাজ চলে যাবে। নাউ প্লিজ গেট রেডি।’

    রীতিমতো অবাক কণ্ঠের প্রশ্ন ভেসে এল,

    — ‘কাজ চলে যাবে কীরকম? চার পাতার ঠাসা ডায়ালগ, মোটে দশ লাইন বললেই কাজ চলে যাবে?’

    — ‘হ্যাঁ। প্রথম পাঁচ লাইন আর শেষের পাঁচ লাইন মুখস্থ করুন। বাকিটা দেখে দেখে বলবেন।’

    — ‘দেখে দেখে বলব মানে?’

    প্ল্যানটা এই রকম। ভিড়ে ঠাসা কোর্টরুমে বহু চরিত্রের সমাবেশ। কেউ আসামিদের কাঠগড়ায়, কেউ সাক্ষীর কাঠগড়ায়। পাবলিক প্রসিকিউটর আর ডিফেন্স কাউন্সেল— সঙ্গে তাদের সহকারীরা— যে যার জায়গায়। এছাড়াও পেশকার, পুলিশ, আর চিত্রনাট্যের প্রায় প্রত্যেকটি চরিত্র। সবাই উদ্‌গ্রীব। কী রায় দেবেন জজসাহেব?

    দৃশ্যটা শুরু হবে জজসাহেবের মুখ থেকে। তিনি বলতে শুরু করলেই ক্যামেরা ট্রলিতে একটু পিছিয়ে আসবে। তারপর সরে আসবে জজসাহেবের মুখ থেকে— ডান থেকে বাঁ-দিকে। জজসাহেব ফ্রেমে নেই। ক্যামেরা ঘুরে চলেছে একটার পর একটা চরিত্রের মুখের ওপর দিয়ে— তাদের আগ্রহ, উৎকণ্ঠা, আবেগ, এই বিচারপর্ব ঘিরে তাদের প্রবল উত্তেজনা— এসব দেখাতে। শেষ পর্যন্ত তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে ক্যামেরা আবার এসে থামবে জজসাহেবের মুখে। একটুখানি এগিয়ে যাবে। আমরা দেখব, অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ বিচারক তাঁর রায়ের শেষ কথাগুলো বলছেন।

    ছবিদাকে বললাম, ‘আপনি প্রথম পাঁচ লাইন মুখস্থ করে নিজের মতো বলবেন৷ তারপর যেই ক্যামেরা আপনার মুখ থেকে সরে আসবে, আর মুখস্থ করার দরকার নেই। আপনার টেবিলের ওপরে যে কাগজ থাকবে, তাতে বাকি সংলাপগুলো গোটা করে লেখা থাকবে। আপনি তাই দেখে পড়লেই চলবে! একেবারে শেষে, ক্যামেরা পুরো কোর্টরুমটা ঘুরে আবার যখন আপনার ওপর ফিরে আসবে তার সামান্য একটু আগে থেকে রায়ের বাকিটুকু— অর্থাৎ শেষ পাঁচ লাইন, যেটা আপনাকে মুখস্থ করতে বলছি, সেটা অভিনয় করে বললেই, ব্যস, আর কিছু করতে হবে না, আমাদের দৃশ্যগ্রহণ শেষ। কী? তাতে অসুবিধে নেই তো?’

    প্ল্যানটা শুনে ছবিদা কুপোকাত।

    এমন একটা মুখভঙ্গি করে চেয়ে রইলেন, যেন খোলা রাস্তায় হঠাৎ কেউ তাঁর বস্ত্রহরণ করেছে। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,

    — ‘অলরাইট। পাঁচ মিনিট সময় দে। দেন টেক দ্য শট।’

    যথাসময়ে ‘স্টার্ট, সাউন্ড অ্যান্ড ক্যামেরা’ বলে উঠলাম। ভারী মিচেল ক্যামেরা, শব্দহীন। তার পরের নির্দেশ,

    — ‘অ্যাকশন!’

    ছবিদা শুরু করলেন ওঁর সেই অননুকরণীয় ভঙ্গিতে, যেটা একমাত্র ছবি বিশ্বাসের পক্ষেই সম্ভব। ক্যামেরা পিছিয়ে এল। তারপর ছবিদাকে ছেড়ে বাঁ-দিকে প্যান করতে শুরু করল। আমি নিশ্চিন্ত। বেশ কিছুক্ষণ উনি আর ফ্রেমে থাকবেন না। সামনের কাগজ দেখে নিজের মতো অ্যাক্টিং করে যাবেন। আমাদের নজর পরের শিল্পী এবং তার পরের শিল্পীর ওপর— যাঁদের ওপর ক্যামেরা এখনও এসে পৌঁছয়নি কিন্তু এক্ষুনি এসে পৌঁছবে— তাঁরা ঠিকঠাক অভিব্যক্তি নিয়ে তৈরি কি না। লম্বা শট, কেউ একজন ভুল করলেই আবার গোড়া থেকে আরম্ভ করতে হবে। স্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করলাম, প্রত্যেকেই তৈরি, একেবারে ঠিকঠাক অভিব্যক্তি দিয়ে চলেছেন। এদিকে কানে ভেসে আসছে ছবিদার গলা, তাঁর অভিনয়— যে-অভিনয় সম্পর্কে কিছু বলা বাহুল্যমাত্র।

    এদিকে ক্যামেরা ঘুরে চলেছে নব্বই থেকে একশো আশি ডিগ্রির দিকে, তারপর আরও— একশো আশি পেরিয়ে দুশো সত্তর— হঠাৎ আমার ছবিদার ওপরে চোখ পড়ল।

    ওঁর ওপর ক্যামেরা পৌঁছতে তখনও অনেকটা দেরি, এখন ওঁর কাগজ দেখে সংলাপ বলার কথা।

    কিন্তু কোথায়? ওঁর চোখ তো কাগজে নেই! উনি অভিনয় করে চলেছেন ওঁর নিজের মতো— সামনের দিকে চেয়ে, যেন ক্যামেরা ওঁর ওপরেই। একটু পরে ক্যামেরা যখন ওঁর ওপরে এসে পৌঁছল, অন্তর্দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ এক অসহায় বিবেকবান বিচারকের সেই অভিনয় দেখে আমাদের মুখের সব কথা হারিয়ে গেল।

    পর্ব ৪

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook