ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছবিদা— ছবি বিশ্বাস: পর্ব ২


    তরুণ মজুমদার (March 5, 2021)
     

    পর্ব ১

    আগে আমাকে হাতকড়া পরান

    ছবিদাকে নিয়ে অনেক গল্প আছে। বলে শেষ করা যাবে না। একটা বিশাল বটগাছ যেমন ছায়া দিয়ে ঘিরে রাখে, উনিও তাই, ওঁর স্নেহের ছায়ায় আমাদের ঘিরে রাখতেন। বিশেষ করে জুনিয়র টেকনিশিয়ানদের। ওদের দুঃখকষ্ট, ব্যথাবেদনার কথা শোনবার লোক ছিল না। কিন্তু ছবিদা ছিলেন। কোথাও কিছু অন্যায় বা অবিচার হচ্ছে টের পেলেই এসে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। ওঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে পড়ে অন্যায়কারীরা কেঁচোর মতো গুটিয়ে যেত।

    একটা গল্প বলি। গল্প নয়, ঘটনা— নিজের চোখে দেখা।

    তখন ছিল ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইট ফোটোগ্রাফির যুগ। পর্দায় আমরা ছবি দেখতাম সাদা-কালোয়। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকতে হত। ধবধবে সাদা কোনও কিছু সেট-এ ব্যবহার করা যাবে না। করলেই তা এমন কটকট করত যে চোখ রাখা যেত না তার ওপরে। যাকে বলে ‘ব্লিচ’ করা। এই সমস্যা এড়াবার জন্যে যা কিছু সাদা— যেমন সাদা দেওয়াল, সাদা ফার্নিচার কি বিছানার চাদর— এসব আমাদের এড়িয়ে চলতে হত। তার বদলে হালকা ধূসর, নীল অথবা সবুজের প্রলেপ দিয়ে কাজ চালাতে হত। শিল্পীদের পোশাকেরও বেলায়ও তাই। চোখে সহনীয় করে তোলার জন্যে সাদা ধুতি-শাড়ি-পাঞ্জাবি অথবা গেঞ্জি ইত্যাদি হালকা গেরুয়া অথবা সবুজ রং-এ রাঙিয়ে ব্যবহার করা হত। একমাত্র তখনই পর্দায় সেটা সাদা বলে মনে হত।

    আমাদেরই একটা ছবিতে ছবিদার সঙ্গে আরও অনেক শিল্পী কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে একজন, সঙ্গত কারণেই তাঁর নাম বলা যাবে না, ধরা যাক সুরেশবাবু, একেবারেই মাঝারি ওজনের শিল্পী— তিনি তাঁর চড়া মেজাজের জন্যে বিখ্যাত। কারণ-অকারণে চোটপাট করা ছিল ওঁর স্বভাব। বড়দের সামনে চুপ করে থাকতেন। কিন্তু একটু নীচের দিকে যারা, তাদের ধমকানি-দাবড়ানিতে তটস্থ করে রাখতে ওঁর জুড়ি আর দ্বিতীয়টি ছিল না।

    সেদিন শুটিং শুরু হবার আগে আর্টিস্টরা সবাই মেক-আপ নিচ্ছেন। একটু দেরিতে কাজ বলে ছবিদা তখনও এসে পৌঁছননি। হঠাৎ এক কাণ্ড!

    তিন নম্বর মেক-আপ রুম থেকে সুরেশবাবুর গলার আওয়াজ ভেসে এল, প্রচণ্ড চটে গিয়ে আমাদের ড্রেসারকে বলছেন, ‘ইডিয়ট! ভেবেছ কী? অন্যের ব্যবহার করা জিনিস আমাকে পরাবে? এত বড় স্পর্ধা তোমার?’

    ড্রেসার ছেলেটি, পচা নাম, মিনমিন করে বলার চেষ্টা করল, ‘না সুরেশদা, বিশ্বাস করুন—’

    কথা শেষ করতে না দিয়েই সুরেশবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ড্যাম ইওর বিশ্বাস! বোকা নাকি আমি? বুঝতে পারি না? ছোটলোক, স্টুপিড— আবার মুখে মুখে তর্ক করছ!’

    এই বলে সবেগে মেক-আপ রুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসারের দেওয়া ধুতি আর গেঞ্জিটা সজোরে ছুড়ে ফেললেন। মেক-আপ রুমের বারান্দা পেরিয়ে ওগুলো গিয়ে পড়ল বাইরের বাগানে— গন্ধরাজ গাছটার তলায়।

    এখন এই পচা ছেলেটা সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। একেবারে নেহাতই নিম্ন-মধ্যপরিবারের ছেলে— চেতলার দিকে থাকে। কিন্তু এমন গুণী, এমন বিনীত, আর এতটাই মন দিয়ে কাজ করে যে, হাজার চেষ্টাতেও ওর কোনও জুড়ি মিলবে না। আমাদের ছবিতে তো বটেই, এমনকী সত্যজিৎবাবুর ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’-এর ওইসব বিচিত্র পোশাক-আশাকের ঝামেলা সামলেছে সে।

    সেই পচার সঙ্গে এই রকম ব্যবহার!

    সুরেশবাবু আবার সবেগে ঘরে ঢুকে গেলেন। আর পচা বেরিয়ে এল শুকনো মুখে। আমি ব্যাপারটা সামলাতে যাব, তার আগেই হঠাৎ সে করিডোরের দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ঠুকতে ফুঁপিয়ে উঠল।

    এমন সময় বাইরে থেকে ছবিদার প্রবেশ।

    পচাকে অমন করতে দেখে কয়েক সেকেন্ড থমকে থেকে, কাছে এসে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে রে পচা? কী হয়েছে? বাড়ি থেকে কোনও খারাপ খবর?’ এই বলে যেই না ওর কাঁধে হাতখানা রেখেছেন, সহানুভূতির ছোঁয়া পেয়ে পচা এবার ঝরঝর করে কেঁদেই ফেলল। উচ্ছ্বসিত সেই কান্না।

    — ‘দেখুন না ছবিদা’, কাঁদতে কাঁদতেই বলে সে, ‘আমি নিজের হাতে আপনার আর সুরেশবাবুর নতুন ধুতি আর গেঞ্জি রং করে, শুকিয়ে, আপনাদের যার যার ঘরে রেখে দিয়েছি আর উনি আমাকে ‘ইডিয়ট’, ‘ছোটলোক’, ‘ইস্টুপিড’— কী না কী বললেন। আমি কাজ ছেড়ে চলে যাব।’

    — ‘দাঁড়া!’ হঠাৎ একটা অন্য রকম আওয়াজ বেরিয়ে এল ছবিদার মুখ থেকে। মুহূর্তে ওঁর চেহারা পালটে গেল। তিন নম্বর মেক-আপ-রুম, যেখানে সুরেশবাবু আছেন, তার দরজার কাছে গিয়ে চাপা কিন্তু গম্ভীর গলায় ডাকলেন— সুরেশ!

    ভূত দেখার মতো সুরেশবাবুর তড়াক করে চেয়ার থেকে উঠে কাছে এগিয়ে এলেন।

    — ‘ছবিদা! আপনি?’

    — ‘হ্যাঁ, আমি। তার আগে বলো, গরিব হলেই যে মানুষ মিথ্যেবাদী হবে, এ কথা শিখলে কোথায়?’

    — ‘না, মানে, আমি—’

    — ‘চো-প্‌!’ এমন বজ্রগম্ভীর আওয়াজ, এমন উত্তেজিত চেহারা যে আমরা অবধি চমকে উঠলাম।

    বাইরের গন্ধরাজ গাছটার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, ‘যাও। কুড়িয়ে নিয়ে এসো। নিজের হাতে কুড়োবে আর নিজের হাতে পরবে। মাই অর্ডার!’

    সুরেশবাবু মাথা নিচু করে সেইদিকে পা বাড়ালেন৷

    এই হচ্ছেন ছবিদা। ওঁর আরও গল্প আছে।

    একবার উনি আমাদের ফ্লোরে শুটিং করছেন— ছবির নাম ‘স্মৃতিটুকু থাক’। দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি হঠাৎ ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োর কিছু ছেলে, অর্থাৎ ওখানে যারা কাজ করে, হুড়মুড় করে এসে হাজির। একটা খবর ওরা জানাতে এসেছে ছবিদাকে। কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে বেশ কিছুদিন ওদের দ্বন্দ্ব চলছিল স্টুডিয়োর মালিকপক্ষের সঙ্গে। আজ হঠাৎ সেই মালিকরা স্টুডিয়োর মেন গেট-এ তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ, কর্মীদের আর চাকরি বলে কিছু রইল না। শুধু তাই নয়, পুলিশ স্টেশনে খবর গেছে যে কর্মীদের একাংশ উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছে। অতএব তাদের গ্রেফতার করা হোক। পুলিশের গাড়ি এসে পড়ল বলে।

    তখনকার দিনে ফিল্মের কলাকুশলীদের একটা দারুণ সংগঠন ছিল— ‘সিনে টেকনিশিয়ান্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল’, সংক্ষেপে সি.টি.এ.বি। বড় বড় পরিচালক থেকে শুরু করে ছোটখাটো টেকনিশিয়ান পর্যন্ত সবাই এই সংগঠনের সভ্য। সংগঠনের এতটাই গুরুত্ব ছিল যে একবার এর বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করতে এসেছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডক্টর মেঘনাদ সাহা।

    যাই হোক, যারা এসেছে তারা ছবিদাকে জানাল যে স্টুডিয়োর কর্মীদের কাছেও খবর পাঠানো হয়েছে। ওরাও এসে পড়ল বলে। কিন্তু পুলিশ যদি এসে পড়ে আর কাউকে গ্রেফতার করতে চায়, তাহলে বড় ধরনের গোলমালের আশঙ্কা। এই সব ভেবে এরা এসে পড়েছে ছবিদার কাছে, কারণ তাঁকেই তারা টেকনিশিয়ানদের প্রকৃত অভিভাবক বলে মনে করে।

    ব্যাপারটা শুনে কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন ছবিদা। তারপর ধীর পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এসে বললেন।

    — ‘আজকের বাকি কাজটা আর আমায় দিয়ে হবে না, বুঝলি?’

    — ‘তারপর?’

    — ‘তারপর আর কী? তোরাও চলে আয়। ওদের পাশে দাঁড়ানো তো আমাদের কর্তব্য, না কি?’

    ছবিদা নিজের গাড়ি করে বেরিয়ে গেলেন। আমরা পদব্রজে। গিয়ে দেখি, সে এক দৃশ্য!

    বড়রাস্তার পাশে, ইন্দ্রপুরীর বন্ধ গেটের সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছেন ছবিদা। তাঁর দু’পাশে, মাটিতে বসে, রাজ্যের টেকনিশিয়ান। রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে বাস যাচ্ছে, রিকশাও। পথচারীরা কেউ কেউ অবাক হয়ে বলাবলি করছে, ‘আরে! ছবি বিশ্বাস রে! ছবি বিশ্বাস!’

    ছবিদার গ্রাহ্য নেই।

    এমন সময় সত্যি-সত্যিই পুলিশের গাড়ি এসে হাজির। একটা জিপ, একটা ভ্যান। ওরা ঝপাঝপ নেমে এগিয়ে আসছে। সবার সামনে ও.সি.সাহেব— ভ্রুকুটি-কুঞ্চিত মুখ নিয়ে। হঠাৎ ওই অবস্থায় ছবিদাকে দেখতে পেয়ে, ইংরিজিতে যাকে বলে ‘পেট্রিফায়েড’ অর্থাৎ প্রস্তরীভূত— তাই হয়ে গেলেন। তারপর হাত কচলাতে কচলাতে এগিয়ে এসে অমায়িক হাসি হেসে বললেন,

    — ‘স্যার! আপনি?’

    — ‘হ্যাঁ৷ আপনাদের অভ্যর্থনা জানাতে। আমার এই ছেলেগুলোকে অ্যারেস্ট করতে এসেছেন তো? স্বাগতম। কিন্তু একটা কথা। এদের ছোঁয়ার আগে আমার হাতে হাতকড়া পরাতে হবে।’

    বলে শান্তভাবে নিজের হাতদুটো বাড়িয়ে ধরলেন ও.সি. সাহেবের সামনে।

    লজ্জায় লাল হয়ে ও.সি. সাহেবকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। কর্মীদের দাবি-দাওয়ার অনেকটা মেনে নিয়ে স্টুডিয়োর গেট আবার খুলতে হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে।

    পর্ব ৩

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook