নীলকণ্ঠ

Scene from 'Jukti Takko ar Gappo'

চলচ্চিত্র জগতে প্রায় পাঁচ দশকের কাজের অভিজ্ঞতায়, বহু মেধাবী পরিচালক, জ্ঞানী-স্বনামধন্য মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। এঁদের মধ্যে অন্যতম ঋত্বিক ঘটক, এ-বছরে যিনি শতবর্ষে পা রাখলেন; তাঁর সিনেমা কিংবা কাজের অন্য পরিসরের উৎকর্ষতা নিয়ে আলোচনা করা, আমার মতো মানুষের কাছে ঋত্বিক নামের সমুদ্রে এক আঁজলা জল মাপার সমান। এই নিবন্ধে আমি ভাগ করে নেব তাঁর সঙ্গে কাজের একটি অভিজ্ঞতা, যে-স্মৃতি আমার কাছে আজীবন অমলিন হয়ে থাকবে।


বিজ্ঞাপন

ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে যে-বয়সে কাজ করার সুযোগ এসেছিল, সে-সময়ের সমাজ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও কাজের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার নিরিখে বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। ছবিটির নাম ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। মূল স্মৃতিতে প্রবেশের আগে, একটু আগের কথা বলা দরকার।

আরও পড়ুন: ঋত্বিক ও রামকিঙ্করের আশ্চর্য যুগলবন্দি প্রত্যক্ষ করেছিলাম! লিখছেন সুশোভন অধিকারী…

ষোলো-সতেরো বছর বয়স থেকে আমার চলচ্চিত্র, থিয়েটার শিল্প-মাধ্যমগুলির প্রতি আগ্রহ জন্মায়। সে-সময়ে আমার আত্মীয় হিরণ্ময় সেন-এর সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে আমি এই জগতে প্রবেশ করি। রমেশ যোশীর সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁর সূত্রেই আমার প্রথম ছবি সম্পাদনার কাজে আসা।

সে-সময়ে নকশাল আন্দোলন মধ্যগগনে; এদিকে চলছে, ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’র সম্পাদনার কাজ। রমেশ যোশী সে-ছবি সম্পাদনার দায়িত্বে রয়েছেন, রয়েছেন অনু বাবুও। অনু বাবু, অর্থাৎ অমলেশ সিকদার। ইনি আবার সম্পর্কে কেতকী দত্তের ভাই।

সে-সময়ে রমেশ যোশীর ব্যস্ততা চলছে নানা কাজে, এদিকে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র কাজে একজন সহায়কের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। রমেশ যোশী আর অনু বাবু-ই আমাকে সুপারিশ করলেন ঋত্বিক ঘটকের ছবিটিতে কাজের জন্য।

প্রথমদিনের কাজে যখন আলাপ হল, আমার কাজ দেখে খুব আপন করে নিলেন। আমাকে ডাকতেন ‘ম্যাজিশিয়ান’ বলে। সব সময়ে লক্ষ করতাম, কাজের সময়ে কী আশ্চর্য তাঁর মনোযোগ। অন্য সময়ে বেহিসেবি জীবন, মদ্যপান এইসমস্ত দিক থাকলেও, কাজের সময়ে সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ! কিন্তু কাজে যদি একবার মন বিগড়ে যায়, তখন আবার অন্য রূপ।

এমনই একদিন, কাজের সময়ে, হঠাৎ দু’জন ছেলে দরজা ঠেলে ঢুকল এডিট-ঘরে। বোঝা গেল তারা নকশাল, পুলিশের তাড়া খেয়ে আশ্রয় নিতে এসেছেন। ঋত্বিকদা সঙ্গে-সঙ্গে ওঁদের দু’জনের হাতে দুটো রিল ধরিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য এই যে, ওরাও এডিট-টেবিলের ইউনিট মেম্বার, সেইটা বুঝিয়ে পুলিশদের ধোঁকা দেওয়া। যথারীতি খানিক পরে পুলিশ এল, এবং প্রত্যাশিতভাবেই বলল এ-ঘরে দু’জন নকশাল ছেলে লুকিয়ে আছে।

এমনই একদিন, কাজের সময়ে, হঠাৎ দু’জন ছেলে দরজা ঠেলে ঢুকল এডিট-ঘরে। বোঝা গেল তারা নকশাল, পুলিশের তাড়া খেয়ে আশ্রয় নিতে এসেছেন। ঋত্বিকদা সঙ্গে-সঙ্গে ওঁদের দু’জনের হাতে দুটো রিল ধরিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য এই যে, ওরাও এডিট-টেবিলের ইউনিট মেম্বার, সেইটা বুঝিয়ে পুলিশদের ধোঁকা দেওয়া। যথারীতি খানিক পরে পুলিশ এল, এবং প্রত্যাশিতভাবেই বলল এ-ঘরে দু’জন নকশাল ছেলে লুকিয়ে আছে। ঋত্বিকদা সঙ্গে-সঙ্গে গালাগাল দিয়ে বললেন, ওরা ইউনিটেরই ছেলে, পুলিশ ভুল বলছে ইত্যাদি। ঋত্বিকদার মুখের ভাষা তো খুব খারাপ ছিল, যখন-তখন যেখানে-সেখানে গাল দিয়ে বসতেন। এদিকে নকশাল আন্দোলন দমনের কেন্দ্রও উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ঋত্বিকদা যেহেতু ইন্দিরা গান্ধীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, কেউ ওঁকে বিশেষ ঘাঁটাত না। পুলিশরা আর বাক্যব্যয় না করে চলে গেলেন। আমরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কাজ শেষে, ছেলে দু’জনকে বলা হল, ওদেরকে আমরা বাড়ি পৌঁছে দেব, কারণ রাস্তায় পুলিশ ওঁত পেতে থাকতে পারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ওরা বলল, পাঁচিল টপকে ঠিক বাইরে বেরিয়ে যাবে। তাই-ই করল। কিন্তু আমাদের আশঙ্কাকে সত্যি করে পুলিশ অপেক্ষায় ছিল ওদের বেরোনোর। একজনকে পাঁচিল টপকে পালানোর মুহূর্তেই গুলি করল পুলিশ, আরেকজনকে গ্রেপ্তার! কিচ্ছু করতে পারলাম না আমরা। ঋত্বিকদার চোখ থেকে সেদিন— রাগ ঝরেছিল, নাকি জল, সে-খবর জানি না। খুবই অনুভূতিপ্রবণ মানুষ ছিলেন তো, দুঃসহ সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা, যা মানুষের ধর্মের পরিপন্থী, সেসব ওঁকে খুব আঘাত করত! হয়তো বারবার এই আঘতের কারণেই খানিক স্ববিরোধও জন্ম নিয়েছিল ওঁর মনে। তবে সেই স্ববিরোধ সচেতন মনে নাকি অবচেতনে, তা নিয়ে সংশয় আছে। তখন তো টালিগঞ্জ অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নানা বস্তি, একদিন দেখি ঋত্বিকদা মদ খেয়ে রাস্তায় বস্তির মানুষদের গাল দিতে-দিতে আসছিলেন, আর মাঝে-মাঝেই ঝুপড়িগুলোতে আঘাত করছিলেন। বড় অবাক হয়েছিলাম সে-দিন। ওঁকে বলেছিলাম, আপনি তো ঘরছাড়া নিরন্ন মানুষদের নিয়ে ছবি বানান, তাঁদের কথাই বলেন, তাহলে এই বস্তির মানুষদের আঘাত করছেন কেন! কোনও উত্তর দেননি ঋত্বিকদা। উদাস, শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।