আনার ডায়েরির অন্দরে

Anne Frank

২০১৯ সালে দিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে, একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। আনা ফ্রাঙ্কের কিছু দুর্লভ ছবি, তাঁর বিখ্যাত ডায়েরির লাইন এবং হলোকস্টের কতিপয় অংশ দেখানো হয় নেদারল্যান্ডসের ভারতীয় দূতাবাসের পক্ষ থেকে। এই প্রদর্শনী দেখার শেষে, একটি সাদা বোর্ড রাখা হয়েছিল অতিথিদের উদ্দেশে; ফ্রাঙ্কের জীবনের সঙ্গে পরিচিতি বা ডায়েরির কিয়দংশ পড়ার পর, তাঁদের মনে ঠিক কী প্রতিক্রিয়া হল, তা যদি অতি সংক্ষেপে লিখে ফেলা যায়।

ভাবনাটি বেশ অভিনব, সাদা বোর্ডে মার্কার দিয়ে দর্শকরা লিখে যাচ্ছেন, ‘There is no limit’, কেউ বা লিখছেন, ‘be hopeful’, আবার কারও কলমে, ‘Together we can’-এর মতো উদ্ধৃতি। ছ’-বছর আগে হয়ে যাওয়া, এই প্রদর্শনী থেকে বোঝা যায় যে, আনা ফ্রাঙ্ক নামটি আজকের দিনে কী অর্থ বহন করে জনমানসে! একজিবিশনে আসা পুরুষ ও মহিলারা, ফ্রাঙ্কের ডায়েরি থেকে বেছে নিয়েছেন, ‘optimism’ বা আশার বাণী।

এই ঘটনার কয়েক বছর আগে, ‘দ্য গার্ডিয়ান’ হলোকাস্ট ডে পালন করার নিমিত্তে, ফ্রাঙ্কের ডায়েরি থেকে বেছে নিয়েছিল, দশটি অত্যন্ত প্রভাবশালী উদ্ধৃতি। সেখানেও দেখতে পাই, আনা নির্দ্বিধায় বলছে, ‘মানুষ নিজে ভাল থাকলেই অপরকে ভাল রাখতে পারে’ কিংবা ‘আমি দুঃখের কথা ভাবি না, আমি দেখি জীবন কত সুন্দর।’ এই উদ্ধৃতিগুলি সত্যিই অনুপ্রেরণা দেয়, শিশুপাঠ্য হিসেবে অবশ্যই তা কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু কৈশোর পেরিয়ে যদি প্রশ্ন জাগে যে, একজিবিশন, সেমিনার বা পত্রিকার এমন নির্বাচন কতটা স্বতঃস্ফূর্ত? জেনোসাইড তো জীবনের মাধুর্যের কথা বলে না! তাহলে এই অত্যন্ত পরিচিত ব্যাখা, গত ৭০ বছরের এক কালচারাল কনস্ট্রাকশন বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক নির্মাণ নয়তো?    

আরও পড়ুন: রিয়েলিটি শো-গুলো জিততে যখন শিশুরা প্রাণপাত পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়, তখন কোন আইন তাদের সুরক্ষা দিতে পারে? লিখছেন ভাস্কর মজুমদার

আজ আনা ফ্রাঙ্কের জন্মদিন, সারা বিশ্বে বিভিন্নভাবে পালিত হবে, বীভৎস সময়ে দাঁড়িয়ে, খুদে মেয়ের লড়াই করার কাহিনি। কিন্তু এই প্রবন্ধে, আমরা ফ্রাঙ্কের আত্মচরিতের একরৈখিক কোনও চিত্র আঁকব না। বলা ভাল যে, তাঁর স্মৃতিকথাকে ঘিরে যে নীতিবোধ সামনে রাখা হয়, সেই নির্দিষ্ট পাঠ নির্মাণের কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করাই এই লেখার উদ্দেশ্য। কেন এই বইটি যুগ-যুগ ধরে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে, তা বহুল-চর্চিত, কিন্তু আমরা যদি অনুসন্ধান করি যে, ফ্রাঙ্কের ডায়েরি কীভাবে ধীরে-ধীরে ক্লাসিকে পরিণত হল? এই জার্নি বা অভিজ্ঞতা অনুধাবন করে, কোনও বৃহত্তর প্রশ্নে আমরা পৌঁছে যেতে পারি কি?

যেমন ধরুন, যদি পুনর্বিবেচনা করা যায় যে, আনা ফ্রাঙ্কের জীবন নিয়ে যাবতীয় কাটাছেঁড়া, সিনেমা থেকে নাটক— এ-সবই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, আমেরিকানদের প্রচেষ্টায়। তাঁর ডায়েরি প্রথম প্রকাশিত হয় ডাচ ভাষায়, ১৯৪৭ সালে, প্রথম মুদ্রণে ১৫ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। তিন-চার বছরের মধ্যে, যথাক্রমে জার্মান, ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজি ভাষায় বইটি প্রকাশিত হলেও, বহু মানুষের মধ্যে তখনও এই আত্মচরিত সেভাবে আলোড়ন তৈরি করেনি।

আজ আনা ফ্রাঙ্কের নাম বা তাঁর ডায়েরি যেভাবে একটি ধ্রুপদী টেক্সট হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, তার একটি

কালানুক্রমিক ইতিহাস রয়েছে। ছোটবেলায় ইংরেজি বই পড়া শিখলেই আত্মীয়রা উপহার দিতেন এই ডায়েরি, কখনও বা অনুবাদ সাহিত্যে আনা ফ্রাঙ্ক। আমার থেকে কত দূরের, বেশভূষা, জাতি, বর্ণ, অন্য সময়ের এক কিশোরীর গল্প পড়তাম আগ্রহে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, এই ডায়েরিকে একটি কালচারাল আইকন হিসেবে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, অনেকটাই দায়ী আমেরিকান লেখক-গোষ্ঠী, হলিউড ফিল্ম ও মার্কিন নাটক। মেয়ার লেভিন, ফ্রান্সেস গুডরিচ এবং অ্যালবার্ট হ্যাকেট— এই তিনজনের নাম এক্ষেত্রে উল্লেযোগ্য। লেভিন একজন আমেরিকান ঔপন্যাসিক, যিনি প্রথম ফ্রাঙ্কের ডায়েরিকে চিত্রনাট্যের রূপ দেন। পরবর্তীকালে গুডরিচ এবং হ্যাকেট (আমেরিকান দম্পতি), যাঁরা নিজেরাও অভিনেতা ছিলেন, ফ্রাঙ্কের ডায়েরিকে কেন্দ্র করে নাটক মঞ্চস্থ করেন। এর কিছুদিন পরেই, তাঁরা পুলিৎজার প্রাইজ পান, আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি নিয়ে সিনেমা তৈরি করেন জর্জ স্টিভেন এবং আজ এই ডায়েরির বিশ্বজোড়া খ্যাতি অনেকটাই নাটক, সিনেমা বা পপুলার কালচারে বইটিকে অ্যাডাপ্টেশনের ফলাফল। 

অ্যালেক্স সাগানের মতো অধ্যাপকরা (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের) কয়েক দশক আগে দেখিয়েছেন যে, কীভাবে একটি টেক্সটকে তার ‘wholeness’ বা সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে, খণ্ডে-খণ্ডে ভাঙা যায়, তারপর তার একটি খণ্ড তুলে নিয়ে কোনও এক প্রোপাগান্ডা বা তথাকথিত দেশের দর্শন হিসেবে পেশ করা যায়। এটিকে বলা হচ্ছে, ‘আমেরিকানাইজেশন অফ আনা ফ্রাঙ্ক’। মানে পুরো ডায়েরি থেকে কিছু অংশকে বেছে নিয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া, যেমন ধরুন ত্রয়োদশী ইহুদি বালিকা, হলোকস্টের মৃত্যুমিছিলের মধ্যে দাঁড়িয়ে লিখছেন: 

‘এত সবকিছুর পরেও আমি বিশ্বাস করি যে মানুষ প্রকৃতপক্ষে ভাল।’

হ্যাকেট-গুডরিচ রচিত নাটকের মঞ্চায়ন

পরবর্তীকালের সিনেমা বা নাটকেও এই ধরনের চূড়ান্ত আশাবাদ প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। যে কোনও ঐতিহাসিক ঘটনার জনপরিসরে মুখ্য অবয়ব কী হবে, অর্থাৎ, তার মেইনস্ট্রিম পাবলিক ইমেজটা কীরকম হতে পারে, তার সঙ্গে যোগাযোগ আছে তৎকালীন রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং সামাজিক পক্ষপাতের। এক্ষেত্রে একদল গবেষক মনে করেন যে, ফ্রাঙ্কের জীবনদর্শনের এই ইতিবাচক দিককে সামনে আনার মধ্যে, হলোকস্টের বীভৎস, সাম্রাজ্যবাদী লড়াই বা পাশবিক নির্যাতনের ইতিহাসকে গৌণ করার এক সূক্ষ্ম প্রয়াস আছে।

এই আশাবাদ আসলে, পাঁচের দশকের আমেরিকার মূল্যবোধ যেমন ব্যক্তিস্বাধীনতা বা অর্থনৈতিক উদারনীতিবাদের সঙ্গে খুবই মানানসই। সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয় যে, ফ্রাঙ্কের ডায়েরির নিবিড় পাঠে উঠে আসে, মৃত্যুভয়, দৈন্য এবং প্রতিদিনের ব্যর্থতা, যা কিন্তু অনেক বছর ধরে সাহিত্যিক আলোচনায় জায়গা পাইনি। 

এলি উইজেল

এক বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়ের কৌতূহল, অবদমন ও নানা লিঙ্গ প্রসঙ্গের দলিল এই বই। মিশিগান ইউনিভার্সিটির এক গবেষক জানাচ্ছেন যে, আনা ফ্রাঙ্কের মতোই হলোকস্টের জীবন্ত দলিল দিয়েছিলেন, এলি ইউজেল নামক এক ইহুদি ব্যক্তি। ফ্রাঙ্কের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য এটাই যে, তিনি ছিলেন হলোকস্ট সার্ভাইভার। ডায়েরি শেষ করার তিনদিন পরে আনা এবং তার পরিবারকে গেস্টাপো আটক করে, কারারুদ্ধ হয়ে শেষে মৃত্যুবরণ। কিন্তু উইজেল বেঁচে গিয়েছিলেন, যিনি সারা পৃথিবীতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প সার্ভাইভার রূপে বিখ্যাত হন। ইডিশ ভাষায় লেখেন ‘Night’ নামে তাঁর স্মৃতিকথা, যা ছিল ফ্রাঙ্কের ডায়েরির একটি বিকল্প ভাষ্য। আনা যদি দেখায়, লুকিয়ে থাকা ভীত-সন্ত্রস্ত জীবন, তাহলে ইউজেলের বই ক্যাম্পে থাকার লড়াইকে সামনে নিয়ে আসে। ঐতিহাসিক দেখাচ্ছেন যে, এই ভিকটিম এবং সার্ভাইভারের দ্বন্দ্ব কীভাবে তৎকালীন মূল স্রোতের জেন্ডারের ধারণার সঙ্গেও হুবহু মিলে গিয়েছিল। বালিকা আনা যেখানে নির্যাতনের বলি, উইজেল সেখানে মৃত্যুঞ্জয়ী। আনা যেখানে কঠিন দিনে দাঁড়িয়েও ‘লাভ’ বা ‘কমপ্যাশন’-এর কথা বলে, ইউজেলের লেখায় দাঁত কামড়ে পড়ে থেকে, শেষ দিন পর্যন্ত বেঁচেবর্তে যাওয়ার মানসিকতা প্রকাশ পায়। এই লড়াকু আর দয়া-ক্ষমার বৈপরীত্য কি চিরকালীন পুরুষ-নারীর গল্প নয়? রাষ্ট্রের দাঁত-নখ বের হতে দেখলেও, যে মেয়েটি অবশেষে বলবে সে মানুষকে বিশ্বাস করে প্রবলভাবে, এই ভাষ্যকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে বারবার, কখনও ফ্রাঙ্কের লেখার মধ্য থেকে এই বাক্যটি তার কনটেক্সট বা প্রসঙ্গের বাইরে এনেও প্রচার করা হয়েছে।

বইটি যুগ-যুগ ধরে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে, তা বহুল-চর্চিত, কিন্তু আমরা যদি অনুসন্ধান করি যে, ফ্রাঙ্কের ডায়েরি কীভাবে ধীরে-ধীরে ক্লাসিকে পরিণত হল? এই জার্নি বা অভিজ্ঞতা অনুধাবন করে, কোনও বৃহত্তর প্রশ্নে আমরা পৌঁছে যেতে পারি কি?

গত কয়েক বছরে যদিও এই ক্লাসিক টেক্সটকে নতুনভাবে দেখা বা পড়ার প্রয়াস সামনে এসেছে। যেমন, জার্মানিতে আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বর্তমানে গবেষণার নজির মেলে। যে জার্মানদের সমর্থনে আউশভিৎজ, বার্গেন বেলসেন বা ওয়ারশ-তে সারি সারি মৃত্যুক্যাম্প তৈরি হয়েছিল, তারা কীভাবে অভ্যর্থনা জানাল কিশোরী ইহুদির ডায়রিকে? ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে জার্মানির আটটি জায়গায় একই সঙ্গে ‘আনা ফ্রাঙ্ক’ নাটকটি মঞ্চস্থ করা হয়। সাংবাদিকদের বয়ান অনুযায়ী, আমেরিকা বা অন্যান্য জায়গায় ফ্রাঙ্কের ডায়েরিকে সহজেই যেভাবে আশাবাদের প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, জার্মানদের পক্ষে এতটা সরলীকরণ সম্ভব ছিল না। সেখানকার মানুষ, মার্কিনিদের মতো হাততালি দিয়ে হল থেকে বেরতে পারেনি, তারা ছিল বাকরূদ্ধ। জার্মান পত্রপত্রিকা বা ম্যাগাজিনে এই নাটক দেখার পর শিরোনাম প্রকাশিত হত— ‘Are We Guilty?’ বা ‘No One Accuses Us, We Accuse Ourselves.’ বলা হয়, আমেরিকান দম্পতি হ্যাকেট ও গুডরিচের নাটক জার্মানদের দেখানোর ক্ষেত্রে একটা আলাদা সুবিধা ছিল। সেই নাটকে ইহুদি নির্যাতন খুব বেশি দেখানো হয়নি, এমনকী, একদম শেষে আনা ফ্রাঙ্কের গ্রেপ্তারিও ছিল উহ্য, পুরো নাটকে শুধুমাত্র আনার ইতিবাচক ও আশাবাদী বাক্যগুলোর ওপরই জোর দেওয়া হয়েছিল, তাই এটি দেখতে-দেখতে নাৎসি সমর্থকের কোনও উত্তরসূরির অনুশোচনা হওয়ার জায়গা নেই। 

আউশভিৎজ-এর মূল ফটক

২০১৯ সালে এই ডায়েরির আবার পুনর্মুদ্রণ হয়। সম্প্রতি নতুন প্রতর্কে উঠে আসছে যে, এক বয়ঃসন্ধির মেয়ের নিজস্ব অনুভূতি, আবেগ বা ভাবনা চিন্তার জগৎ কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এই গ্রন্থে। বাবার সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা, পিটার ভ্যানের সঙ্গে বন্ধুত্ব, রাগ, অভিমানের কথা রয়েছে এখানে। এই ডায়েরিকে অনেক সময় জুভেনাইল লিটারেচার বলা হয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিভিন্ন স্কুলে পাঠ্যবই হিসেবে রাখা হয় আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। নির্বাসনে থাকার সময় একটি শিশু বা বয়ঃসন্ধির মেয়ের জীবন ঠিক কীভাবে বদলে যায়; নিজের নাম, ধর্ম, পদবি বদলে ফেলে নকল পরিচিতি নিয়ে দিনের পর দিন বিভিন্ন জায়গায় লুকনোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা যেভাবে এক প্রাপ্তবয়স্ককে প্রভাবিত করে, তার থেকে একটি শিশুর বিভ্রান্তি ও বিহ্বলতা অনেক বেশি। মৃত্যুভয় ছাড়াও এখানে যুদ্ধের আবহে ইহুদিদের বারবার দোষারোপ করবার প্রবণতা লক্ষ করা যায়, ফ্রাঙ্কের ডায়েরিও সে-কথা বলেছে। অর্থোডক্স ক্যালভিনিস্ট চার্চ থেকে ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট প্রায় সকলেই মনে করেছিলেন, ‘Jews had murdered Jesus Christ, they were on the wrong path.’ এই গিল্ট বা অপরাধবোধ আনার মতো বালিকাদের মনে ছড়িয়ে গিয়েছিল খুব কম বয়স থেকেই। এছাড়া ইহুদি নিধন নিয়ে শোনা যেত নানা গুজব। কোন তথ্যটি সঠিক আর কোনটা রটনা, তা সেক্লুশনে থাকা পরিবারের সদস্যরা সবসময় বুঝতে পারত না। এই দোলাচল বা দ্বিধাও হলোকস্টের ইতিহাসের অন্যতম দিক। 

আনার ডায়েরির দুটো ভার্সন পাওয়া যায়, একটি, যা সে প্রথম থেকে লিখতে শুরু করে। কিছুদিন পর, রেডিওতে ডায়েরি বা চিঠিপত্র যুদ্ধকালীন আর্কাইভ হিসেবে সংরক্ষিত হবে শুনে আলাদাভাবে নিজের অভিজ্ঞতা লিখতে উদ্যোগী হয় সে। খুদে মেয়ের লেখিকা হওয়ার শখ ছিল ষোলো আনা, নিজের ডায়েরিকেও সে সম্বোধন করেছে ‘কিটি’ বলে। সর্বোপরি আনার লেখাতে আমরা এক অনুসন্ধিৎসু মন খুঁজে পাই, নিজের ইহুদি সত্তা নিয়ে কৌতূহলী মেয়েটি কখনও-কখনও যথেষ্ট ক্রিটিক্যাল অভিমতও প্রকাশ করেছে, নিজের আইডেন্টিটিকে কেন্দ্র করে। ত্রয়োদশী বালিকার আত্মানুসন্ধান, নিজেকে বিশ্লেষণের নানা পদ্ধতি ডায়েরির পাতায়-পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে। বীভৎস গণহত্যার সময়ে দাঁড়িয়ে, এই অন্বেষণ আলাদা অর্থ বহন করে। এর কোনও একরৈখিক নিষ্পত্তি হতে পারে না।

আনা ফ্রাঙ্কের জীবনকে নিয়ে পাশ্চাত্য দেশগুলির homogenous প্রতিরূপ দেখলে মনে পড়ে যায়, মালালা ইউসুফজাই বা ‘white men’s burden’-এর মতো তত্ত্বের কথা। মালালার ক্ষেত্রেও ‘পাশ্চাত্য রক্ষাকর্তার’ বয়ান খাড়া করা হয়। তাঁর লড়াইকে ‘appropriate’ করার কথা ওঠে। ঠিক যেমন, একশো বছর আগে, ঔপনিবেশিক দেশগুলির ক্ষেত্রে ‘white men’s burden’-এর মতো তত্ত্ব সামনে আনা হয়েছিল। এই প্রত্যেক পর্বেই নির্যাতনের ইতিহাস কিছুটা ফিকে পড়ে যায় আশাব্যঞ্জক বা উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে গিয়ে। তারপর মনে হয় শক্তিশালী দেশ, তাদের নিজের প্রয়োজনে কেটে, বেছে, খানিকটা ফেলে দিয়ে বাকি অর্ধেকটা আত্মসাৎ করে কোনও মেনস্ট্রিম ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে কি? আর সেখানেই আত্মজীবনী হোক বা হলোকস্টের ইতিহাস, আবারও প্রথম থেকে, নতুনভাবে পড়ে দেখা, বিশ্লেষণ করার দরকার আছে, যেমন আজ আনা ফ্রাঙ্কের মূল লেখাতে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আর তাঁর ডায়েরি, যা আমাদের সকলের ছেলেবেলায় অবশ্যপাঠ্য ছিল, আজ ১২ জুন, তা আবার পুরোনো বুকর‍্যাক থেকে হাতে নিয়ে, পড়ে দেখার এক উপযুক্ত দিন।