ঈশ্বর-বিরোধিতা না কি দ্বৈত ঈশ্বরের মধ্যে বিরোধ? সর্বকালীন সেরা সাংগীতিকদের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকা অন্যতম শিল্পী জন লেননের হত্যার পটভূমি ইঙ্গিত করে দুই দিকেই। লেনন হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন এমন এক ঈশ্বর, যিনি জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রিয়জনও বটে। গানে এবং নির্ভীক বক্তব্যে তাঁর কণ্ঠ বারবার দাঁড়িয়েছে দাম্ভিক রাষ্ট্রের নির্বিচার সামরিকতার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রের কাছে বিষয়টা হয়ে উঠেছিল এতটাই প্রকট, এবং কার্যত চক্ষুশূলও বটে, যে লেননের মৃত্যু-পরবর্তী তদন্তে পাওয়া যায় সিআইএ-র তৎকালীন ডিরেক্টরের প্রতি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পাতার পর পাতা চিঠি, জন এবং ইয়োকো ওনো-কে নজরবন্দি করে রাখার অনুরোধে। জন লেনন তা জানতেন; তাঁর নিরাপত্তাহীনতা, দল থেকে সরে আসা, সাতের দশকে তাঁকে বিছিন্ন করে তোলে ডাকোটা অ্যাপার্টমেন্টের এক কামরায়। তবে এসব অনেক পরের কথা। তার আগে দেখে নেওয়া যাক, কী সেই আখ্যান, যা লেননকে করে তুলেছিল প্রবাদপ্রতিম এক কিংবদন্তি, যার ফলস্বরূপ তিনি নিজেকে জেসাস-এর থেকেও জনপ্রিয় বলে দাবি করেছিলেন।
সালটা ১৯৫৮। লিভারপুল শহরের ষোড়শবর্ষীয় কিশোর জন নেহাতই গানবাজনার ঝোঁকে শুরু করেন ‘দ্য কোয়ারিমেন্’ নামক এক ব্যান্ড। কার্যত এখানেই দানা বাঁধতে শুরু করেছিল সেই ছটফটে যুবকদের ভাবী গানের দলের সম্ভাবনা, যা পরবর্তীতে ‘বিটলস’-ম্যানিয়া হয়ে আচ্ছন্ন রাখবে নতুন প্রজন্মকে। কোয়ারিমেনদের দ্বিতীয় শো-এর পরে পরেই পলের সঙ্গে পরিচয় লেননের। ষোড়শবর্ষীয় লেনন তাঁর সমবয়সি পলের গিটার-দক্ষতায় অভিভূত হয়ে তাঁকে আহ্বান জানান কোয়ারিমেন-এ যোগদান করার জন্য। এই জুটি প্রাথমিকভাবে ‘স্কিফল’ ঘরানার সংগীত বানালেও পরবর্তীতে জর্জ হ্যারিসন যখন যোগ দিলেন, এই কিশোররাই ঝুঁকলেন রক এন্ড রোল মিউজিকের দিকে। চার্চ, স্কুল, এবং নাইটক্লাবের শো পেরতে পেরতেই তৈরি হল নবীনদের এই গানের দল— ‘দ্য বিটলস’। কয়েক বছরের মধ্যেই ম্যানেজার ব্রায়ান এপস্টেইন এবং ড্রামার রিংগো স্টার হয়ে উঠলেন অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং শুরু হল বিটলস-উন্মাদনার অধ্যায়। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে একের পর এক হিট অ্যালবাম তাদের পৌঁছে দিল খ্যাতির শীর্ষে। মূলত লেনন এবং ম্যাককার্টনির লেখনীতে ‘প্লিজ, প্লিজ মি’ (১৯৬৩) দিয়ে রক এন্ড রোলের যে যাত্রা শুরু, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তারিত হল আরও পরীক্ষামূলক অ্যালবামে। তৈরি হল ‘সার্জেন্ট পেপারস লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ডস’, যা শ্রোতাকে পরিচিত করল কনসেপ্ট অ্যালবামের ধারণার সঙ্গে। এরপর এল ‘এবি রোড’, ‘হোয়াইট’, এবং বিটলস-দের সর্বশেষ অ্যালবাম ‘লেট্ ইট বি’।
তবে সার্জেন্ট পেপারের সাফল্যের পরে ব্রায়ান এপস্টেইনের মৃত্যু নাড়িয়ে দিল বিটলস-এর ভিত। এই সময় পল হয়ে উঠছেন সামনের সারির বিটল। পরবর্তীতে বিবাদ বাধল সেখানেই; এপস্টেইনের মৃত্যুর পর পল চেয়েছিলেন তার সঙ্গিনী লিন্ডা-র বাবা দায়িত্ব নিন বিটলসের, যা লেনন চাননি একেবারেই। অন্যদিকে ‘হোয়াইট’-এর প্রোডাকশনের সময় জন-ও প্রতিদিনই প্রায় স্টুডিও-তে আনতে শুরু করলেন তার ‘লুসি ইন দ্য স্কাই’ ইয়োকো ওনো-কে, যা ছিল পলের অপছন্দ। এই রেষারেষি প্রথমে প্রচ্ছন্ন, এবং পরে প্রকটই হয়ে উঠল দুই কিশোরবেলার বন্ধুর মধ্যে। মূলত ‘এবি রোড’-এর সময় থেকেই জন একটু একটু করে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তার দলের থেকে, তবে ভাঙনের পথে প্রথমে পা বাড়ালেন পল-ই; ১৯৭০-এ ভেঙে গেল কিংবদন্তি এই বয়েজ ব্যান্ড, বোধ করি ‘বয়েজ’-রা খানিক বড় হয়ে যাওয়ার দরুনই। কেবল বয়সেই বড় না, বরং সত্তা এবং পরিমাপেও বড়, যা আঁটল না হলুদ সাবমেরিনের পরিসরে।
তবে এই ভাঙন জনকে তাঁর বিটলস-কেন্দ্রিক চিরকালীন কৈশোর থেকে হাত ধরে পৌঁছে দিল জীবনের অন্য এক মোড়ে। তিনি হয়ে উঠলেন প্রতিবাদী জন লেনন, যিনি ‘ইমাজিন’ করলেন এমন এক দুনিয়া, যেখানে নেই কোনও দেশ-সীমারেখা, নেই কোনও রক্তপাত, কোনও ধর্ম-জাতি-ভাষার বিরোধ, কেবল আছে মানুষের পাশাপাশি মানুষের বেঁচে থাকা। তিনি তুচ্ছ করলেন স্বর্গ ও নরকের অস্তিত্ব, বরং বললেন যে, এই পৃথিবীই হয়ে উঠতে পারে বিবাদহীন স্বপ্নের এক দেশ। ‘ইমাজিন’ জনসমক্ষে আসে ১৯৭১ সালে, যখন ভিয়েতনামে আমেরিকার আঘাত ক্রমাগত রক্তক্ষরণ করে চলেছে। ছয়ের দশকের শেষ দিক থেকেই জন এবং ইয়োকো শুরু করেন তাঁদের অ্যান্টি-ওয়ার প্রোটেস্টস, যা পরিণতি পায় এক অন্যতম পারফরম্যান্স প্রোটেস্ট ‘বেড ইনস ফর পিস’-এ, যেখানে জন এবং ইয়োকো আমস্টারডাম ও মন্ট্রিয়েল শহরে তাঁদের মধুচন্দ্রিমার সময়ে প্রচার করেন বিশ্বশান্তির বার্তা; ভিয়েতনামের যুদ্ধ বন্ধ করা হোক, এই মর্মে বারবার এই দম্পতি হেঁটেছেন মিছিলে, হাজার জনতা তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে ‘গিভ পিস আ চান্স’-এর সুরে। রাজনৈতিকভাবে টালমাটাল এই সময়ে স্বভাবতই নিক্সনের সরকার ভাল চোখে দেখেননি এই অকুণ্ঠিত, সোচ্চার বার্তা। জন এবং ইয়োকোকে নজরবন্দি করে এফবিআই, এবং প্রচেষ্টা শুরু হয় লেননকে দেশ থেকে বহিষ্কার করার। লেননের মৃত্যু অবিসংবাদিতভাবে বিতর্কিত; তাঁর মৃত্যুর পর এই ধারণা বহুল-প্রচলিত হয় যে, এই মৃত্যুর পিছনে রাষ্ট্রের হাত থাকা অসম্ভব কিছু না। যদিও এই ঘটনার সত্যতা থেকে যায় প্রমাণসাপেক্ষ, কিন্তু লেননের হত্যাকাহিনির যে সত্য সামনে আসে, তা হতবাক করে দেয় আপামর জনসাধারণকে।
তবে সার্জেন্ট পেপারের সাফল্যের পরে ব্রায়ান এপস্টেইনের মৃত্যু নাড়িয়ে দিল বিটলস-এর ভিত। এই সময় পল হয়ে উঠছেন সামনের সারির বিটল। পরবর্তীতে বিবাদ বাধল সেখানেই; এপস্টেইনের মৃত্যুর পর পল চেয়েছিলেন তার সঙ্গিনী লিন্ডা-র বাবা দায়িত্ব নিন বিটলসের, যা লেনন চাননি একেবারেই। অন্যদিকে ‘হোয়াইট’-এর প্রোডাকশনের সময় জন-ও প্রতিদিনই প্রায় স্টুডিও-তে আনতে শুরু করলেন তার ‘লুসি ইন দ্য স্কাই’ ইয়োকো ওনো-কে, যা ছিল পলের অপছন্দ। এই রেষারেষি প্রথমে প্রচ্ছন্ন, এবং পরে প্রকটই হয়ে উঠল দুই কিশোরবেলার বন্ধুর মধ্যে।
লেননকে হত্যা করে ঠান্ডা মাথার আততায়ী মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান। হাওয়াইয়ের বাসিন্দা মার্ক নিউ ইয়র্ক আসে সুপরিকল্পিতভাবে এই কার্য সম্পন্ন করতেই। ৮ ডিসেম্বর বিকেলে লেনন যখন বেরচ্ছেন রেকর্ডিং-এর উদ্দেশ্যে, বহু স্বাক্ষরপ্রার্থী অনুরাগীদের মতোই চ্যাপম্যানও তাঁর অপেক্ষা করেছিল। তার হাতে ছিল ‘ডাবল ফ্যান্টাসি’ অ্যালবাম, যাতে সেইদিনই স্বাক্ষর করেন জন লেনন। তবে এরপরেও চলে যায়নি চ্যাপম্যান। অপেক্ষা করেছিল সারা সন্ধে। বিল্ডিং-এর কনসিয়ার্জের উত্তরে বলেছিল, সে অপেক্ষা করছে ইয়োকো-র; তাঁরা ফিরলে তাঁর অটোগ্রাফ নিয়ে তবেই সে যাবে। রাত ১০:৫০। জন এবং ইয়োকো সেদিন ফিরছিলেন জ্যাক ডগলাসের সঙ্গে, এক রেকর্ডিং সেশন থেকে। প্রথমে লিমুজিন থেকে নামেন ইয়োকো, এবং তার পরেই জন। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, অপেক্ষারত মার্ক উচ্চারণ করে দু’টি শব্দ— ‘জন লেনন।’ এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরপর পাঁচবার সে টানে তার হাতে থাকা বন্দুকের ট্রিগার। মোট চারটি বুলেট বিদ্ধ করে লেননের দেহ, আর-একটি দিকভ্রষ্ট হয়ে চূর্ণ করে ডাকোটা অ্যাপার্টমেন্টেরই একটি জানলার কাচ। ডাকোটা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে লুটিয়ে পড়েন জন; কেউ কেউ ভাবেন, হয়তো ছবির শুটিং, কিন্তু আশেপাশে দেখা যায় না কোনও ক্যামেরা।

আততায়ী কিন্তু পালায় না ঘটনাস্থল থেকে, বরং ওভারকোটের পকেট থেকে বের করে জে ডি সালিঙ্গেরের ‘ক্যাচার ইন দ্য রাই’। সেভেন্টি সেকেন্ড স্ট্রিটেই অপেক্ষা করে পুলিশ আসা অবধি। পুলিশ স্টেশনে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, সে তার অপরাধের গুরুত্ব বুঝেছে কি না, তিনি বলেন ‘আমিই জন লেনন। আমি নিজেকে মেরে ফেলেছি।’ এটি মার্ক চ্যাপম্যানের প্রথম বক্তব্য; পরবর্তীতে সে আরও বলে যে, ‘ক্যাচার ইন দ্য রাই’ বইয়ের প্রচার করার জন্যই সে হত্যা করেছে লেননকে। যে-কোনও কাউকেই হত্যা করতে পারত সে, সে চেয়েছিল পল-কেও হত্যা করতে, চেয়েছিল ডেভিড বাওয়াইকে হত্যা করতে। কিন্তু শেষমেষ তার পয়েন্ট থার্টিএইট রিভলভারের সামনে পড়েন লেনন। লেননকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রুজভেল্ট হসপিটালে; কিন্তু কোনও প্রচেষ্টাতেই তাঁকে আর ফিরিয়ে আনা যায়নি জীবনে। ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তরে কয়েকবার বিস্রস্ত সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করতে করতেই চিরঘুমে তলিয়ে যান শিল্পী জন লেনন।
কার্যত, সালিঙ্গেরের বইয়ে বর্ণিত কিশোর হোল্ডেনের চোখে দেখা যে-কোনও ‘ফোনি’, অথবা নকল মানুষকে পৃথিবী থেকে সরাতে চেয়েছিল চ্যাপম্যান। জনের বিখ্যাত উক্তি ‘অল ইউ নিড ইজ লাভ’-এর পরিপ্রেক্ষিতে চ্যাপম্যানের উত্তর ছিল, ‘লাভ এন্ড টু হান্ড্রেড এন্ড ফিফটি মিলিয়ন ডলার্স’। বিশ্বশান্তির বাণী প্রচার করতে গিয়ে জন নিজের জীবনেও সম্মুখীন হয়েছেন এই ‘প্রিভিলেজ’-ধর্মী বিতর্কের। তাঁর বিখ্যাত ‘বেড-ইন’ প্রটেস্টে প্রতিদিনই বিছানা গুছিয়ে দিতেন পরিচারিকাবৃন্দ। সাধারণের থেকে এই দূরত্বই কি হয়ে দাঁড়ায় লেননের মৃত্যুর কারণ?
জন তাঁর হত্যার দিনে প্রোডিউসার লরি কে-কে বলেছিলেন যে, মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তার কাজ পূর্ণতা পাবে না। তবে কি জনের হত্যাই জনের তত্ত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে? মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান নিজেও ছিলেন লেনন-অনুরাগী। যে ট্যাক্সিচালক তাঁকে ছেড়ে দিয়ে যায় ডাকোটা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে, তাঁকে তিনি বলেন যে, তিনি বিখ্যাত পত্রিকা ‘রোলিং স্টোন’-এর কর্মী, এবং তাঁর কাছে খবর আছে যে, বিটলস-রা আবার একসঙ্গে হয়েছেন। এর পর ট্যাক্সি থেকে নামার সময় তিনি চালককে জানান নিজের নাম, এবং বলেন যে, এই নাম তিনি সারাজীবন মনে রাখবেন। মনস্তাত্ত্বিকভাবে দেখতে গেলে, হয়তো তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এটিই— অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠার এক অদম্য খিদে। জন লেননের থেকে বড় কে হতে পারেন? যিনি লেননকে মুছে দেওয়ার দুঃসাহস করেন— এমনটাই হয়তো ভেবেছিলেন চ্যাপম্যান।
টেক্সাসের ফোর্ট ওআর্থ শহরে মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যানের শৈশব, ও কৈশোর কাটে দমবন্ধ করা পারিবারিক সহিংসতার পরিমণ্ডলে। চ্যাপম্যানের বাবা ছিলেন এয়ারফোর্সের সদস্য, যাঁর উপস্থিতি গোটা ছেলেবেলা জুড়ে চ্যাপম্যানের মননে কেবলই ভীতির উদ্রেক করেছে। এমতাবস্থায় মানুষ চায় আশ্রয়, এবং বহুলক্ষেত্রেই সেই আশ্রয়ের পথ হিসেবে তারা বেছে নেয় পলায়নমূলক প্রবৃত্তি। অতএব, চ্যাপম্যান বেছে নিল সর্বোচ্চ দুই পলায়নবৃত্তি— নেশাচ্ছন্নতা এবং ধর্ম। চোদ্দ বছর বয়স থেকেই প্রথমে মারিজুয়ানা, পরে মেসকালিন, এবং তারও পরে বেহিসেবি ডোজের এলএসডি হয়ে দাঁড়ায় তার নিত্যদিনের সঙ্গী। চ্যাপম্যানের বয়স যখন ষোলো, সে যোগ দেয় প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ-এ। তাঁর তৎকালীন বান্ধবী জেসিকা ব্ল্যাংকেনশিপ জানান যে, চ্যাপম্যান এই সময়ে কয়েকটি বিষয়ের ওপর চূড়ান্ত নির্ভরশীল এবং আসক্ত হয়ে পড়েন। নেশা বাদ দিয়ে এগুলি ছিল জে ডি সালিঙ্গেরের ‘ক্যাচার ইন দ্য রাই’, এবং জন লেনন। চ্যাপম্যানের সন্ত্রস্ত, ভীত, বেড়ে ওঠার জগতে এগুলি হয়ে ওঠে তার অবলম্বন; তবে বিবাদ বাধে, যখন চ্যাপম্যানের কানে আসে লেননের কুখ্যাত সেই উক্তি ‘আই অ্যাম মোর পপুলার দেন জেসাস।’ ইতিমধ্যে চ্যাপম্যান তার বান্ধবীকে জানিয়েছে যে, একদিন উচ্চ ডোজের এলএসডি নেওয়ার পর তিনি স্বয়ং ‘জেসাস’-কেই দেখতে পেয়েছে। শৈশব থেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগ চ্যাপম্যানের ‘বিগ আদার’ হয়ে উঠেছিল ‘জেসাস’; তাঁর ভীতিতে, সন্ত্রস্ত পরিস্থিতিতে এই চার্চই হয়ে ওঠে চ্যাপম্যানের একমাত্র আশ্রয়। লেননের বেপরোয়া উচ্চারণ তার মনস্তত্ত্বে তৈরি করল এক ধরনের কগনিটিভ দূরত্ব— তাকে হয়তো সত্যিই বেছে নিতে হত ব্যক্তিগত ঈশ্বর লেনন এবং সার্বিক ঈশ্বর জেসাস— এই দু’জনের একজনকে। অপরদিকে, লেননও কি হারিয়ে ফেলেছিলেন তার সংবেদনশীলতা? সাধারণের কাছে তার আবেদন? তার উক্তির মধ্যে, তার খ্যাতির শীর্ষে থাকার মৌজে কি ক্রমাগত বেড়ে উঠেছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক অহংকারের প্রকাশ? যে লেনন সোচ্চার দাবি জানান মনুষ্যধর্মে একীভূত এক পৃথিবীর, তাঁর যীশুর চেয়ে বেশি খ্যাতিমান হওয়ার মোহ সম্ভবত কিছু বেমানানই লাগে।
তবে কারণ যাই হোক, চ্যাপম্যানকৃত লেননের হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত। চ্যাপম্যান অক্টবরের শেষের দিকেই কিনে রাখে সেই বন্দুক, যার গুলি ঝাঁঝরা করে দেবে জন লেননকে। গ্রেপ্তারের পরে পুলিশ যখন শেরাটন হোটেলে তার কামরার তল্লাশি করে, তখন টেবিলের ওপর অন্যান্য সামগ্রীর মধ্যে দেখতে পায় একটি বাইবেল, যা খোলা আছে ‘গসপেল অ্যাকর্ডিং টু জন’-এর পাতায়। তদন্ত চলাকালীন, মার্ক চ্যাপম্যান কখনওই খারিজ করে না যে, সে-ই লেননকে হত্যা করেছে। যদিও তার আইনজীবীরা আত্মপক্ষ সমর্থন হিসেবে তুলে ধরেন মানসিক ভারসাম্যহীনতার যুক্তি, শেষ পর্যন্ত চ্যাপম্যান কোর্টরুমে স্বীকার করে যে, সে-ই এই হত্যার জন্য দায়ী। সে আরও জানায় যে, স্বয়ং ঈশ্বর এসে তাকে এই স্বীকারোক্তি প্রদানে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অন্যান্য বহু বিতর্কের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে যে, এই হত্যার পিছনে আছে সিআইএ-র হাত, কারণ চ্যাপম্যানের হিপনোটিস্ট হিসেবে তার আইনজ্ঞ বোর্ড নিযুক্ত করে ড. মিল্টন ভি ক্লাইনকে, যিনি ছিলেন সিআইএ-র কুখ্যাত ‘মাইন্ড কন্ট্রোল প্রোজেক্ট’ ‘এমকে-আল্ট্রা’-র অন্যতম পরামর্শদাতা।

দীর্ঘ শুনানির পর ১৯৮১ সালের ২৪ অগাস্ট কোর্ট রায় জানায় জন লেনন হত্যা মামলার। আততায়ী চ্যাপম্যানের কারাদণ্ড হয় কুড়ি বছরের। কুড়ি বছর পার করার পর যখন তার মুক্তির সময় আসন্ন, ইয়োকো ওনো জানান যে, চ্যাপম্যান সংশোধনালয়ের বাইরে এলে তিনি এবং জনের সন্তানরা নিরাপদ অনুভব করবেন না। এছাড়াও, সম্ভবত কোনও সরকারই জন লেননের আততায়ীকে মুক্তি দেওয়ার রাজনৈতিক গুরুভার বইতে সক্ষম হয়নি। তাই বারংবার অনুতাপ প্রকাশের পরেও কোনও প্যারোলেই আজও মুক্তি পায়নি মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান। এ-বছরেই তার চোদ্দোতম প্যারোলের শুনানি হয়, এবং পরবর্তী প্যারোলের তারিখ ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। চ্যাপম্যান তার বয়ানে বারংবার বলে যে, এই হত্যার নেপথ্যে কাজ করেছিল তার বিখ্যাত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা; সে ছুঁয়ে ফেলতে চেয়েছিল লেননের আকাশচুম্বী উচ্চতা, কিন্তু লেনন নিজেই হয়তো এই উচ্চতার শীর্ষে থেকেও চেয়েছিলেন শুধুমাত্র মাটির কাছে থেকে মাটিরই গান গাইতে। নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে ব্রুস কেলি ২.৫ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলেন লেননের স্মৃতিসৌধ। না, এখানে শায়িত নেই তিনি; সৎকারের পরে তার অবশেষ রাখা আছে এমন এক জায়গায়, যা জনসাধারণের কাছে গোপনই রাখতে চেয়েছেন ইয়োকো। স্যালভেশন আর্মি হোমের বাগানে কাটানো শৈশবস্মৃতির আধারে লেখা ‘স্ট্রবেরি ফিল্ডস ফরএভার’ গানের নামে এই স্মৃতিসৌধের নামকরণ ‘স্ট্রবেরি ফিল্ডস’, যার কেন্দ্রে একটিই শব্দ লেখা— ‘ইমাজিন’।
জন লেননের হত্যা ইতিহাসের পাতায় অন্যতম এক রক্তক্ষরণ। তবে ইয়োকো নিশ্চিত করেছেন যে, এই রক্তপাত, এই মৃত্যু যেন এগিয়ে নিয়ে যায় লেননের জীবন ও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকেই। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময়ে তাঁর চশমার কাঁচে ছিটকে এসে লেগেছিলো যে রক্ত, ইয়োকো নিজের অ্যালবাম কভারে ব্যবহার করেন রক্তাক্ত সেই চশমার ছবি। জনের মৃত্যুর পর থেকে ইয়োকো ওনো সক্রিয়ভাবে আমেরিকার বেহিসেবি ‘গান পলিসি’-তে বদল আনার দাবিতে লড়েছেন, নেতৃত্বে থেকেছেন অগুনতি বন্দুকবিরোধী ক্যাম্পেনের। লেনন ভিয়েতনামের মাটি থেকে যে মেশিন ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, সেই মেশিনই এসে আঘাত হানল তার বুকে। হয়তো গলদটা মেশিনের নয়, শেষমেশ মানুষের হিংস্রতারই। চ্যাপমানের শৈশব যদি হত অন্যরকম, তার হাতে যদি থাকত শুধু সালিঙ্গের-এরই বই, বন্দুকের ট্রিগার নয়, হয়তো আমরা ‘ইমাজিন’ করতে পারতাম অন্যরকম এক বিশ্বের, যেখানে ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইন, লেবাননের গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটে না, যেখানে ক্লাসরুমে চলে না এলোপাথাড়ি গুলি।
লেননের মৃত্যুর দিনে ‘রোলিং স্টোন’ পত্রিকার প্রচ্ছদের জন্য লেনন ও ইয়োকোর ছবি তুলতে আসেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী অ্যানি লেবোভিৎজ। চিরন্তন হয়ে থাকা এই ছবিতে লেনন সম্পূর্ণ নগ্ন; শিশুর মতো জড়িয়ে আছেন ইয়োকোকে। তবে এই ছবিতে না আছে কোনও আসক্তি, না আছে কোনও যৌন আবেদন। বরং সন্তর্পণে সঞ্চিত আছে এক সজীব কোমলতা, সারা বিশ্বের মানুষের কাছে সেই জন লেননের নিজের স্পর্শকাতরতাকে মেলে ধরার অকুণ্ঠিত এক প্রয়াস, যিনি কেবল ঈশ্বরপ্রতিম শিল্পীই নন, বরং আর সকলের মতোই নশ্বর এক মানুষ।

লেননের মৃত্যুদিন ফিরে আসে প্রতি বছরই, প্রতি বছরই অসংখ্য অনুরাগী সারা পৃথিবী জুড়ে এই দিন স্মরণ করেন দীর্ঘশ্বাসের মতো— পল মককার্টনির কথায়, ‘ড্র্যাগ, ইজন্ট ইট’!



