গাট্টুর দুনিয়া

Representative Image

বিজ্ঞাপনে ম্যাসকটের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চলছে। ভারতে খুব কম ম্যাসকটই গাট্টুর মতো দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তা ও সাংস্কৃতিক অবস্থান পেয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে গাট্টু এশিয়ান পেইন্টসকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। প্রশ্ন হল: কীভাবে একটি হাতে আঁকা দুষ্টু ছেলের ছবি ভারতের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট ব্র্যান্ডগুলির একটির প্রতীক হয়ে উঠল?

স্বাধীনোত্তর ভারতের পাঁচের দশক। এই দশকই ছিল বলতে গেলে এদেশে বিজ্ঞাপন জগতের এক নতুন রূপান্তরের সময়কাল। এই দশক জুড়ে স্বাধীন দেশ তার নিজ ভূমিতে নির্মিত শিল্পপণ্যকে শুধু মাত্র পণ্য হিসেবে দেখাতে চায়নি। দেশের নতুন ভাবনা ছিল শিল্পপণ্যকে মধ্যবিত্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত করা। এই রাস্তা ধরেই দেখতে হবে এশিয়ান পেইন্টসের সুপরিচিত লোগো গাট্টুকে।

১৯৪২ সাল। সময়টা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল মুহূর্ত। এরকম সময়ে সহসা দেখা গেল যুদ্ধের কারণে বহু আন্তর্জাতিক রঙ প্রস্তুতকারী সংস্থা ভারত থেকে তাদের পাত্তাড়ি গুটিয়ে ফেলছে। চলে যাচ্ছে এদেশে নিজেদের ব্যবসা তুলে নিয়ে। সেই শূন্যস্থান পূরণের সুযোগেই এ-দেশের মানচিত্রে একটি রঙ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশ করল। উদ্যোগী ছিলেন মুম্বাইয়ে চার বন্ধু— চম্পকলাল চোকসি, চিমনলাল চোকসি, সুর্যকান্ত দানি এবং অরবিন্দ বকিল। শুরুটা ছোট্ট পরিসরে, কিন্তু দূরদর্শী স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার। এই রঙ প্রস্তুতকারী সংস্থার অভিনব ব্র্যান্ড কৌশলের পথ ধরেই ১৯৫৪ সালে গাট্টুর আত্মপ্রকাশ। স্রষ্টা প্রথিতযশা কার্টুনিস্ট আর কে লক্ষ্মণ। তার কল্পনায় দুষ্টুমিতে ভরপুর এক খুদে চরিত্র গাট্টু। গাট্টু একেবারে সাধারণ সমাজ পরিসর থেকে উঠে আসা এক বালক। মাত্র কয়েক বছর হল দেশ স্বাধীন হয়েছে এরকম সময়ে এই বালক সংস্থাটির পরিচয়কে দেশের অগণিত সাধারণ পরিবারের কাছে পৌঁছে দিল সহজেই। শুধু রঙ নয়, এই বালক দেশের বিপুল সংখ্যক সাধারণ পরিবারের সঙ্গে আবেগের সংযোগও তৈরি করে দিল।

আরও পড়ুন: বিজ্ঞাপন কি মেয়েদের দেখায় পুরুষের চোখ দিয়েই? যে-প্রশ্ন তুলে ধরে ‘বিজ্ঞাপনে মেয়েরা’ বইটি! লিখছেন অর্পণ ঘোষ…

আর কে লক্ষ্মণের আঁকা গাট্টু চেহারায়, ফ্যাশনে একজন সাধারণ, খেলুড়ে, সহজবোধ্য চরিত্র যে, এক ঝটকায় ‘এশিয়ান পেইন্টসকে’ সাধারণ মানুষের বাড়ির ভেতরে নিয়ে এল। সঙ্গে পকেটে গোঁজা রঙিন স্বপ্নের হদিশ। আর তখন থেকেই গাট্টু শুধুমাত্র একটি বিজ্ঞাপনী প্রতীক রইল না, সে হয়ে উঠল একটি সাংস্কৃতিক পাঠ। যেখানে কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং, জনপ্রিয় সংস্কৃতি ও স্বাধীনোত্তর আধুনিকতার স্বপ্ন একসঙ্গে যুক্ত হল। তাই গাট্টু হল এমন একটা ভিস্যুয়াল যা প্রতীকী অর্থে দেশের ইতিহাস এবং উত্তরাধিকারকে বিশ্লেষণ করে।

গাট্টুর স্রষ্টা আর কে লক্ষ্মণ তখন তাঁর ‘কমন ম্যান’ কার্টুনের জন্য খ্যাতির শীর্ষে। এই শিল্পীর কালি-কলমের ছবিতে তখন যুক্ত হয়েছে ভারতের রাস্তাঘাট, ভিড় আর দুষ্টু শিশুদের পর্যবেক্ষণ। গাট্টু উঠে এলো সেই জগতেরই এক প্রতিনিধি হিসেবে। অগোছালো চুল, বড় ব্রাশ আর মুখে লেগে রয়েছে এক আশ্চর্য কৌতুকময় হাসি। প্রকৃত অর্থে, গাট্টু হল আর কে লক্ষ্মণের চেনা রাস্তার জীবনের সারাংশ। শৈশব ও খেলাধুলোর মধ্যে গাট্টু প্রথা ভেঙেছে। তার কাছে খেলা মানে হল লাইন ভেঙে রঙ করা। আর তার ক্ষমতা বলতে অতিরিক্ত বড় একটি ব্রাশের মালিক সে। সেই ব্রাশ হাতে নিয়ে সে বলতে চায় সাধারণ মানুষের কাছে উৎসব এলে রঙ করা মানে— আর শুধু চুন-গোলা সাদা নয়। এখন থেকে সাধারণ মানুষও নিজের ঘর রঙিন করে তুলতে পারে নিজের সাধ্যের মধ্যেই। সাজাতে পারে নিজের মতো করে। আর গাট্টুর দুষ্টুমি মানে হল রঙ করা বা আঁকিবুঁকি করা। এভাবেই সে স্বতন্ত্র। সে চায় প্রথা ভেঙে সাধারণ চিন্তায় পরিবর্তন আনতে। রঙিন আধুনিকতা বলতে গাট্টু বলতে চাইল যখন ঘর রঙ করা ছিল সাধারণ পরিসরে, কেবল বিলাসিতা তখন ‘সবার জন্য রঙ’-এর কথা। আর গাট্টুর নাম তাও এসেছে দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই। এশিয়ান পেইন্টস একটি ‘নেম দ্য ম্যাসসকট’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এবং ৪৭,০০০ নাম জমা পড়ে। সেখান থেকেই নির্বাচিত নাম— ‘গাট্টু’ যা ছিল এক কথায় দেশীয়, সহজ এবং সবার মুখে মানানসই। এভাবেই গাট্টু শুধু একটি রঙ কোম্পানির প্রতীক না থেকে হয়ে উঠেছিল দেশের সকল মানুষের ‘ঘরের ছেলে’। রোলাঁ বার্ত-এর ভাষায়, গাট্টু এক ‘মিথিক চিহ্ন’—সে শুধু রঙ বিক্রি করে না, বরং স্বাধীন ভারতের আকাঙ্ক্ষার গল্প বলে। তাই যখন ৯০-এর দশকে সমালোচনা শুরু হয় যে এক শিশু ব্রাশ হাতে মানে কি শিশু শ্রমের প্রতীক? তখন কোম্পানি পরিষ্কার করে বলেছিল যে গাট্টু কোনও শ্রমিক নয়, সে খেলাধুলায় মত্ত এক দুষ্টু বালক। ২০০২ সালে এশিয়ান পেইন্টস আনুষ্ঠানিকভাবে গাট্টুকে অবসর দিলেও আজও দেশের জন পরিসরে গাট্টুর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অমলিন। আজও গাট্টু দেশের মানুষের স্মৃতিতে সজীব। সে ভারতের বিজ্ঞাপনের ইতিহাসে আমুল গার্ল বা এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজার মতোই এক প্রতীকী চরিত্র। গবেষকরা গাট্টুকে দেখেন ‘রঙের গণতন্ত্রীকরণ’-এর দেবশিশু হিসেবে।

এভাবেই গাট্টু প্রমাণ করে যে ম্যাসকট শুধু মাত্র বিজ্ঞাপন নয়, সে সাংস্কৃতিক পাঠ্যও হতে পারে। লক্ষ্মণের সৃষ্ট এই দুষ্টু বালক শিখিয়েছে রঙ মানে আনন্দ, স্বাধীনতা, আর স্বপ্ন। যদিও তাকে বিদায় দিতে হয়েছে তবুও গাট্টু রয়ে গিয়েছে ভারতের রঙিন স্মৃতিতে। সেই দুষ্টু ছেলে দেয়াল আর হৃদয় রঙ করে গিয়েছে দুষ্টুমির আনন্দে। সেই কারণেই ১৯৮৫ সালে যখন তার কোম্পানি শারদ সম্মানের ঘোষণা করল তখন গট্টু ফর্ম হাতে নিয়ে বলেছিল সাধারণ পায়ে হেঁটে মণ্ডপ দেখা মানুষও বিচারকদের একজন। মূল পুরষ্কারের তিনটি ভাগ। যথা প্রতিমা, মণ্ডপ আর আলোকসজ্জা। একটি সম্পূর্ণ বিজ্ঞাপনের সঙ্গে এই তিনটি বিষয়ের ইশারা দিয়ে তিনটি আলাদা বিজ্ঞাপন প্রকাশ হয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। সেই ইশারাতে প্রতিমা, মণ্ডপ ও আলোকসজ্জার যে ছবি রয়েছে, সেখানেও ছিল পরম্পরা বাহিত শিল্পের প্রতি গাট্টুর স্পষ্ট ইঙ্গিত ও শ্রদ্ধা। পুজো আসলে পরম্পরার প্রতি শ্রদ্ধা। তাকে সযত্নে বহন করা। সেখানে গণ পরিসরে শিল্পীরা শিল্পের আপন কথা রচনা করেন। এটাই দস্তুর। আর তাই সেই শিল্পের অন্যতম সম্মাননীয় বিচারক মণ্ডপের দুয়ারে ঢল নামা সাধারণ মানুষ। একথাই বলেছিল আর কে লক্ষণের পথ বালক গাট্টু।