প্রথমে এসেছিল অসওয়াল্ড নামে এক খরগোশ। ১৯২৭ সালে সে কেরামতি দেখিয়েছিল ‘অসওয়াল্ড দ্য লাকি রাবিট’ নামে অ্যানিমেটেড ছবিতে। ছবিটি জনপ্রিয় হল ঠিকই, কিন্তু প্রযোজক ইউনিভার্সাল স্টুডিয়োর সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে অসওয়াল্ডের সৃষ্টিকর্তা ওয়াল্ট ডিজনি তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের ওপর স্বত্ব হারালেন। এরপর চলমান ট্রেনের কামরায় বিমর্ষ ডিজনি-র রেখায় জন্ম নিল একটি ইঁদুর, মর্টিমার। ডিজনি-র স্ত্রী লিলিয়ান যার নাম পালটে করলেন ‘মিকি’। মিকি মাউস। সেভাবে দেখতে গেলে, মিকি মাউস এক শিল্পীর ব্যথিত হৃদয়ের ফসল। ১৯২৮ সালে মিকি মাউস পেল দু’টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের অ্যানিমেটেড ছবি। ‘প্লেন ক্রেজি’ আর ‘দি গ্যালোপিং গাউচো’। এরপরেই মিকিকে নায়কের ভূমিকায় দেখা গেল ‘স্টিমবোট উইলি’ (১৯২৮) ছবিতে। ভীষণ জনপ্রিয় হল ছবিটি এবং সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে শিশু-বিনোদনকে ছাড়িয়ে মিকি এক সময়ে পরিণত হল আমেরিকান পপুলার কালচারের অন্যতম আইকনে।
তিরিশের দশকে ব্যাপ্তি পাচ্ছিল ডিজনি স্টুডিও। ডিজনি ও তার সহযোগী কর্মঠ অ্যানিমেটরদের পরিশ্রমে জীবন্ত হয়ে উঠছিল বিড়ালের আড়মোড়া, শুয়োরের ঘোঁত-ঘোঁত, ঝুঁটি-ফোলা মোরগের রাগ, হাঁসের ডুব দেওয়া, হরিণের লম্বা লাফ আর গাছের ডালে বাঁদরের দোল। ডিজনি ভালবাসতেন রূপকথা আর পশুপাখি, তাই তাদের নিয়ে এক বিকল্প বাস্তবতার জগৎ নির্মাণ করতে চাইতেন। ডিজনি-র ‘ফ্যান্টাসিয়া’ (১৯৪০), ‘ডাম্বো’ (১৯৪১), ‘বাম্বি’র (১৯৪২) মতো জনপ্রিয় অ্যানিমেটেড ফিচার ফিল্ম দেখলেই তা বোঝা যায়। এক সময়ে মিকির জনপ্রিয়তাতেও ভাগ বসাতে চলে আসে আরেকটি চরিত্র, এবং একটু আকস্মিকভাবেই। ঠিক আজকের দিনে, ৯ জুন।
আরও পড়ুন: ডিজনি-র স্নো ওয়াইট মারফত খুলে গিয়েছিল এমন এক দিগন্ত, যা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ছিল কল্পনার অতীত! লিখছেন সৌকর্য ঘোষাল…
সালটা ১৯৩২। ডিজনি-র তত্ত্বাবধানে মজার ঢঙে আঁকা পশুপাখিদের চলমান জগতকে জীবন্ত করে তোলার জন্য সংযোজিত হচ্ছিল ধ্বনি ও কন্ঠস্বর, অ্যানিমেশন নিয়ে চলছিল নতুন-নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা। ঠিক এই সময়েই ‘মেরি হ্যাড আ লিটল ল্যাম্ব’ ছবিতে ক্ল্যারেন্স ন্যাশ নামে এক নেপথ্য শিল্পীর গলার স্বর শুনে আগ্ৰহী হয়ে উঠলেন ডিজনি। অভিনব এই স্বরটিকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয় ‘Psudobulbar Dysarthia’। ক্ল্যারেন্স ন্যাশের এই কণ্ঠস্বরকে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু স্বর তো পাওয়া গেল, স্বরের মালিককে সৃষ্টি করতে হবে যে! এই অভিনব গলার আওয়াজ কোন প্রাণীর ওপর খাপ খাবে? হাতি, সিল, গাধা, কুমির, হরিণ, শুয়োর, গরু ইত্যাদি প্রাণির ছবি এঁকে পেনসিল টেস্ট আর ভয়েস টেস্ট করা হল। না, তেমন জুতসই হচ্ছে না। অবশেষে আঁকা হল একটি Pekin হাঁস। দারুণ মানিয়ে গেল সেটা এই কণ্ঠস্বরের সঙ্গে। তৈরি করা হল একটি চরিত্রের খসড়া। হাঁসই বটে, তবে মজাদার হাঁস। পেনসিল চালিয়ে পেটটা করা হল গোল, ঠোঁটটা আরেকটু চ্যাপটা, পায়ের পাতা আরেকটু চ্যাটালো। দেওয়া হল পোশাক। নীল নাবিক স্যুট, নাবিকের টুপি এবং কালো বা লাল বো টাই পরা হাঁসটির নিম্নাঙ্গের জন্য দেওয়া হল না কোনও ট্রাউজার্স! ভেবেচিন্তে হাঁসটির নাম দেওয়া হল ডোনাল্ড। পুরুষ হাঁসকে ইংরেজিতে বলা হয় ড্রেক। তাই ঠিক হল এই নতুন কার্টুন চরিত্রের নাম হবে ডোনাল্ড ড্রেক। নাহ্, হাঁসকে হাঁস বলাই ভাল। ডোনাল্ড ডাক নামটাই ঠিক শোনাচ্ছে।


এই ডোনাল্ডকে হতে হবে অমায়িক ইঁদুর মিকি মাউসের একেবারে বিপরীত। মিকি ভালমানুষ, সে যা পারে না তা এই হাঁসকে দিয়ে করাতে হবে। মিকি তো রেগে গেলে ‘shucks ছাড়া তেমন কোনও জোরদার সংলাপই দিতে পারে না! তাই এই ডোনাল্ড হবে বেশ খিটখিটে ও কুচুটে। ডিজনি পরে স্বীকার করেছিলেন, যেসব মানুষদের তিনি তেমন পছন্দ করেন না, ডোনাল্ড ডাক যেন তাদেরই এক মিলিত প্রতিচ্ছবি (ডিজনির ‘দ্য ডোনাল্ড ডাক স্টোরি’ ছায়াচিত্রে এই শুরুর গল্পটি খুব সুন্দরভাবে ধরা আছে, যা দিব্য দেখা যায় ইউটিউবে)।
তারিখটা ছিল ১৯৩৪ সালের ৯ জুন। ডোনাল্ডের আগমন ঘটল ‘দ্য ওয়াইজ লিটল হেন’ অ্যানিমেশন ছবিতে, যা ডিজনির বিখ্যাত ‘সিলি সিম্ফনিজ’ সিরিজের একটি অংশ (এই ৯ জুনই পরে ডোনাল্ডের জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়)। ওই বছরেই মুক্তি পেল ডোনাল্ডকে নিয়ে দ্বিতীয় ছবি ‘অরফ্যানস বেনিফিট’। দেখতে-দেখতে ডোনাল্ড ডিজনির চরিত্রচিত্রশালায় বেশ জাঁকিয়ে বসল। ১৯৪০ সালেই প্রায় ১২৮টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে মূল চরিত্র হিসেবে স্থান পেয়ে সে মিকিকেও ছাড়িয়ে গেল। ডিজনি মজা করে বলতেন যে, সে হচ্ছে ‘ডিজনির আস্তাবলের ক্লার্ক গেবল’ (‘Gable of the Stable’)। উল্লেখ্য, সেই সময়ে সুপারস্টার ক্লার্ক গেবল হলিউডে জনপ্রিয়তম ব্যক্তিত্ব।
এইভাবেই ধীরে-ধীরে ডোনাল্ড পেয়ে গেল তার নিজের কমিকস, যা চিত্রায়িত করতেন কার্ল ব্যাঙ্কস, টেড অসবোর্ন আর ডন রোসার মতো প্রখ্যাত শিল্পীরা (উল্লেখ্য, কমিকসের ডোনাল্ড কিন্তু ফিল্মের ডোনাল্ডের তুলনায় অনেক মৃদুভাষী, স্থিতধী)। ডোনাল্ড রোজ উঁকি দিয়ে যেতে লাগল সংবাদপত্রের সিন্ডিকেটেড কার্টুনে, টিভিতে ছোটদের বিভিন্ন চ্যানেলে (১৯৮৩ থেকে ডিজনির নিজস্ব চ্যানেলে) এবং অবশ্যই তার প্রবল উপস্থিতি ঘটল ডিজনিল্যান্ড নামক সেই লস এঞ্জেলেসের পৃথিবীবিখ্যাত থিম পার্কে৷ ১৯৩৭ সালে ‘ডন ডোনাল্ড’ ছবিতে ডোনা ডাকের হৃদয় জিতে নেবার জন্য পরিশ্রম করতে দেখা যায় তাকে। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে ডোনাল্ড আমেরিকার সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। তুমুল জনপ্রিয় হয় ‘ডোনাল্ড গেটস ড্রাফটেড’। সেনাবাহিনীর নথিতে সে লেখায় তার পুরো নাম, Donald Fauntleroy Duck। ১৯৪৩ সালে হিটলারকে ব্যঙ্গ করে আসে ডোনাল্ডের কাণ্ডকারখানা সমন্বিত ‘ডার ফ্যুয়েরারস ফেস’। দেশপ্রেমিক ডোনাল্ড আমেরিকানদের উদ্ধুদ্ধ করে বন্ড কিনে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় সাহায্য করতে, যদিও অক্ষশক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে জাপানিদের বিশ্রীভাবে উপস্থাপন করার জন্য নির্মাতারা কিছুটা সমালোচিত হন। ১৯৩৭ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী একটি স্টুডিয়ো তৈরি করে ‘ড্যাফি ডাক’কে। কিন্তু সে অনেক লাফঝাঁপ করেও ডোনাল্ডের মতো জনপ্রিয়তা কখনওই পায়নি।

১৯৩৭ সালে লুই, হুই আর ডিউই নামে তিন খুদে ভাইপো চলে আসে ডোনাল্ডকে সঙ্গ দিতে। ১৯৪৭-এ আসেন ডোনাল্ডের ধনকুবের ও হাড়কিপটে কাকা স্ক্রুজ। দেখা যায়, ডোনাল্ডের যমজ বোন ডেলা ডাককে। ১৯৫৩ সালে তাকে সঙ্গ দেবার জন্য আসে বান্ধবী ডেইজি ডাক। ১৯৮৭ থেকে শুরু হয় ডোনাল্ডের সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে টিভি সিরিজ ‘ডাকটেইলস’। ১৯৫৪ সালে ডোনাল্ড অ্যাকাডেমি আ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানে একজন ঘোষক হিসেবে কাজ করে।
১৯৫৬ সালে অ্যানিমেটেড চরিত্র ও মানুষ কলাকুশলীদের ব্যবহার করে নির্মিত হয় ‘আ ডে ইন দ্য লাইফ অফ ডোনাল্ড ডাক’। সেখানে দেখানো হয়, রক্তমাংসের নামী ব্যক্তিত্বরা ডোনাল্ডের ফ্যান ও তার সাক্ষাৎপ্রার্থী। যত দিন এগোয়, গল্পের বৈচিত্র্যের নিরিখে ডোনাল্ড মিকির থেকে সামান্য হলেও এগিয়ে থাকে। ডোনাল্ড ডাককে মিকির তুলনায় আরও বেশি নানা পেশায় নিয়োজিত হতে দেখা যায়। বিভিন্ন ছায়াছবি ও কমিকসে সে ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা, গোয়েন্দা, সৈনিক, শিকারি, ডাক বিভাগের কর্মী, দক্ষ পাইলট এবং এই বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন পেশাগত কাজ করতে গিয়ে নানা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে হাস্যরস উৎপাদন করে চলে আরও পাঁচটি কমিকস চরিত্রের মতো।

১৯৮৪ সালে, লস অ্যাঞ্জেলেসের মেয়র টম ব্র্যাডলি ডোনাল্ডের ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে ৯ জুনকে জাতীয় ডোনাল্ড ডাক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিনটি এখন সারা বিশ্বের ডোনাল্ড ভক্তরা উদযাপন করেন। তবে সত্যিই কি ৯ জুনকে ডোনাল্ডের জন্মদিন বলা চলে? ১৯৪১ সালে ডোনাল্ডকে নিয়ে লেখা হয় একটি বই, ‘লাইফ অফ ডোনাল্ড ডাক’। ডোনাল্ড ডাক সম্পর্কে যাবতীয় তথ্যের ভাণ্ডার এই বইটি আমাদের জানায় যে, সকলের প্রিয় কাল্পনিক হংসটির জন্মদিন হল শুক্রবারের ১৩ তারিখ। ১৯৪৯ সালে তৈরি ‘ডোনাল্ডস হ্যাপি বার্থডে’ ছবিতে দেখানো হয়েছে ডোনাল্ডের জন্মদিন ১৩ মার্চ। ‘থ্রি ক্যাবালেরোজ’ ছবিতেও ওই তারিখটিরই সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে।
ডোনাল্ডের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ডিজনি সংস্থার পরিধি। ডিজনি এখন একটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক সংস্থা। এবিসি, ডিজনি চ্যানেল, ইএসপিএন, এ+ই নেটওয়ার্কস, এবিসি ফ্যামিলি ছাড়াও বিভিন্ন প্রকাশনা, পণ্যদ্রব্য সংস্থা এবং আরও ১৪টি আলাদা বিনোদন পার্কের মালিক এবং পরিচালক এই ডিজনি গোষ্ঠী। এই ডোনাল্ড ডাক তথা মিকি মাউসকে সামনে রেখে যে-ডিজনি সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে, তার পেছনে কি একমাত্র কারণ মানুষের নির্মল বিনোদনের চাহিদা? ডিজনি কোম্পানির ডোনাল্ড ডাক, মিকি মাউস, গুফি, প্লুটো, চিপ অ্যান্ড ডেল— এগুলি কি কেবলই রাজনীতিবর্জিত শিশুতোষ আমোদ?
১৯৭১ সালে আরিয়েল ডর্ফম্যান ও আর্মান্দ ম্যাটেলার্ট লেখেন ‘হাউ টু রিড ডোনাল্ড ডাক’। তিন বছর পরে চিলি থেকে প্রকাশিত বইটির ওপর আসে সে-দেশের সরকারের নিষেধাজ্ঞা। সেই সময়ে সবেমাত্র সমাজতান্ত্রিক আলেন্দে সরকারের পতন হয়েছে। চিলির সেনাবাহিনী তৃতীয় সংস্করণের সব বই বাজেয়াপ্ত করে সমুদ্রে ফেলে দেয়। এবং প্রথম দু’টি সংস্করণের যা বই হাতে আসে, তাও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে আমেরিকায় বইটি প্রবেশের অনুমতি পেলে ডিজনি সংস্থার উকিলবাহিনী কপিরাইট লঙ্ঘনের দায়ে প্রায় চার হাজার বইকে কোর্টে আবেদন করে আটকে রাখে যাতে এটি আমেরিকান পাঠকদের কাছে না পৌঁছতে পারে। পরবর্তীতে সে-দেশে মাত্র বারোশো বই বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া হয়। বহুদিন পর্যন্ত কোনও প্রকাশক সংস্থা এই বইটি যুক্তরাষ্ট্রে ছাপানোর সাহস দেখায়নি।

সারভান্তেস, শেক্সপিয়র, উমবের্তো একো ও গ্ৰামশি পড়া দুই অধ্যাপক চেষ্টা করেছেন বইটিকে যথাসম্ভব আঁতলামো আর জারগনবর্জিত রাখতে। খুব সহজ ভাষায় এই বইতে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ডোনাল্ড ডাক তথা অন্যান্য চরিত্ররা নয়া উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের এক সাংস্কৃতিক হাতিয়ার। কীভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমেরিকান কনটেন্টের বিপুল চাহিদা তৈরি করে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে, সেই সূত্রে পুঁজির বৃদ্ধি ও বাজার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে শেষপর্যন্ত বিপুল মুনাফা অর্জন করা হচ্ছে এবং সেই উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ জীবনাদর্শের প্রচার ঘটানো হচ্ছে… এসবই আলোচিত হয়েছে এই বইতে। অধ্যাপকদ্বয় দেখিয়েছেন, এইসব কার্টুন চরিত্রগুলির নিরীহ গল্পগুলির মধ্যে ভাল করে খুঁজলে সূক্ষ্ম যৌন ইঙ্গিত অমিল নয়। যেমন ডেইজি ডাক ডোনাল্ডকে বলে, ‘তুমি আমাকে স্কেটিং করতে শেখালে তুমি যেটা চাইছ আমি তোমাকে সেটা দেব।’ সাহিত্যের পরিভাষায়, একে বলে ইনুয়েনডো। ‘কী বলতে চাইছ?’ ডোনাল্ড বলে ওঠে। ডেইজি জবাব দেয়, ‘তোমার ১৮৭২ সালের কয়েনটা চাই আমার।’ আরেকটি গল্পে, ডোনাল্ডের খুদে ভাইপোরা জীবনে কে কী হতে চায় তা বলে। জানা যায়, কেউ হতে চায় ব্যাঙ্কার, কেউ-বা ব্যবসাদার, কেউ অনেক জমির মালিক যা বিক্রি করে অনেক টাকা কামানো যায়।
ডোনাল্ডদের জগতে সম্পদ সৃষ্টি হয় শ্রমিক বা কর্মীদের মিলিত পরিশ্রমে নয়, ধনকুবেরদের বিনিয়োগের মাধ্যমে। গল্পের কার্টুন-চরিত্ররা সবচেয়ে খুশি হয় নতুন কোনও পণ্যের মালিক হতে পারলে। এও দেখানো হয়েছে যে, ডিজনির গল্পে তৃতীয় বিশ্বের চরিত্ররা মারাত্মকভাবে স্টিরিওটাইপিংয়ের শিকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের দেখানো হয়েছে নির্বোধ ও খলনায়ক হিসেবে। একটি গল্পে এক অনুন্নত দেশের ওঝা বলে ওঠে যে, তার দেশ বেশ আধুনিক কারণ সেখানে টেলিফোন আছে। সমস্যা হল, মাত্র একটি টেলিফোনেই তার সংযুক্ত আছে ও সেটি বিশ্ব লোন ব্যাঙ্কের সাথে সরাসরিভাবে হটলাইনে যুক্ত!
খুব সাম্প্রতিককালে আমেরিকায় গোঁড়া দক্ষিণপন্থীদের ক্ষমতায় ফেরা, পুঁজিবাদের আরও বেশি করে প্রকাশ্য আস্ফালন, শ্বেতপ্রভুত্ববাদী গোষ্ঠীর উত্থান, মিলিটারি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বাড়বাড়ন্ত ও অস্ত্র বেচার স্বার্থে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ রপ্তানি করা, মেক্সিকান-মুসলিম-নিগ্ৰো ও অন্যান্য অভিবাসী ও শরণার্থীদের ওপর নেমে আসা বৈষম্য, হেনস্থা ও আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বইটি নিয়ে আবার উৎসাহ ফিরে এসেছে। ১৯৭৫ সালে বইটির ইংরেজি সংস্করণের মুখবন্ধে ডর্ফম্যান লেখেন, ‘মিস্টার ডিজনি, আমরা তোমার হাঁসকে ফিরিয়ে দিচ্ছি— তবে সব পালক ছাড়িয়ে আর ভালভাবে রোস্ট করে… ডোনাল্ড, বাড়ি যাও!’ বহু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমেরিকায় এটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে প্রকাশক সংস্থা ‘অর বুকস’, বইটি অনূদিত হয়েছে সতেরোটি ভাষায়।

বর্তমান সময়ে অ্যাকাডেমিক দুনিয়ায় পপুলার কালচার নিয়ে নিরন্তর গবেষণা হয়ে চলেছে, লেখা হচ্ছে অগুনতি রিসার্চ পেপার ও বই। কিন্তু আলোচ্য বইটির রচনাকাল ও পরবর্তী হইচই-বিতর্ক সবটাই সত্তর দশক জুড়ে। সেই সময়ে কিন্তু এইসব কার্টুন, কমিকস বা শিশুদের চলচ্চিত্রকে গবেষণার বিষয়বস্তু হবার মতো ‘কুলীন’ মনে করাই হত না, সমালোচনা তো দূরের কথা! সেদিক দিয়ে ডর্ফম্যান ও ম্যাটেলার্টের বইটি পথিকৃৎ, কারণ পরবর্তীকালে এই বিষয়গুলি নিয়ে বহুমুখী ধারায় গবেষণা শুরু হয়।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, যে-ডিজনি কর্পোরেশনকে আক্রমণ করে সত্তরের দশকে বইটি লেখা হয়েছিল, সেই ডিজনিকেও আজকে নারীবাদী, সংখ্যালঘু অ্যাকটিভিস্ট ও প্রগতিশীল রাইটস আ্যাডভোকেসি গ্ৰুপ ইত্যাদি গোষ্ঠীর চাপে পড়ে কিছুটা নমনীয় হতেই হয়েছে। এমনকী সমকামী ও বিকল্প যৌনতার অনুসারীদেরকেও (LGBTQ) ঢোঁক গিলে স্বীকৃতি দিতে হয়েছে। আগের গল্পগুলিতে ডেইজি ও ডেলা ডাক প্রভৃতি মহিলা চরিত্ররা বেশিরভাগ সময়েই তাদের প্রসাধন ও অন্যান্য মেয়েলি ছোটখাট বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকত। এই একপেশে জেন্ডার স্টিরিওটাইপিংকে এড়িয়ে কিন্তু নতুন গল্পগুলিতে তাদের আরও গুরুত্বপূর্ণ পেশা ও কাজে দেখা যাচ্ছে। ডিজনি-র কর্তাব্যক্তিরা হয়তো এখন জানেন যে, আগের মতো স্থূলভাবে বইটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলে বইটির ব্যাপক প্রচারেই সাহায্য করা হবে।
রেডিয়ো-টিভির যুগ পেরিয়ে ডোনাল্ড আজ ব্যাপকভাবে হাজির ডিভিডিতে, নেট দুনিয়ায়, ইউটিউবে। ডোনাল্ডদের কাছে এখন মোবাইল ফোন অধরা নয়। এমনকী ডোনাল্ড ও তার পরিবারের সদস্যরা ‘কোয়াকচ্যাট’ প্ল্যাটফর্মে যুক্ত (যেটি ‘স্ন্যাপচ্যাট’ শব্দটিকে অনুকরণ করে বানানো)। কিন্তু এইসব পরিবর্তন সত্ত্বেও ছ-দশক পরেও বইটি প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি— কারণ ক্ষমতা, রাষ্ট্র ও পুঁজির মূল চরিত্র ও কাঠামো খুব বেশি বদলায়নি।
বর্তমান সময়ে ডোনাল্ড চরিত্রটি আবার অন্যভাবে উচ্চারিত হচ্ছে, কিছুটা রাজনীতির মোড়কে। আমেরিকার তিনবারের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ডোনাল্ড ডাকের মিল ও অমিল নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ও মিমের দুনিয়া সরগরম। রসিক আমেরিকানদের মতে, দু’জনেরই ধনী আত্মীয় রয়েছে, দু’জনেই হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে ক্যাঁওম্যাঁও করে কী বলে তা বোঝা যায় না, দু’জনেই উৎপত্তিগতভাবে ‘কার্টুন’ এবং দু’জনের কেউই প্রেসিডেন্ট হবার যোগ্যতা রাখে না। অমিলের মধ্যে— ডোনাল্ড ডাক বর্ণবিদ্বেষী নয়, নারীবিদ্বেষী নয়, টিভিতে অনেক বেশি জনপ্রিয়, অনেক বেশি দেশপ্রেমিক কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাকে ‘ডাক কমান্ডো’ হিসেবে লড়তে দেখা গেছে এবং পুতিনের মতো তার কোনও রাশিয়ান বন্ধু বা মুরুব্বি নেই। এবং ডাক তার নেমসেক ট্রাম্পের চেয়ে অনেক বেশি গ্ৰহণযোগ্য ও সহনীয়। আমেরিকার অনেক মানুষ ট্রাম্প আর ডাকের মধ্যে আকৃতিগতভাবেও অদ্ভুত সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। একটু নেট সার্চ করলেই দেখা যায় ডোনাল্ড ডাক আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিশ্রণে তৈরি রাবারের পুতুল ঢেলে বিক্রি হচ্ছে আমেরিকা জুড়ে! ট্রাম্পের ওপরে ক্ষিপ্ত কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো প্রকাশ্যেই বলে ওঠেন যে, ‘ডোনাল্ড ডাক’ তার নাগরিকদের পর্যটন ভিসা নাকচ করে দিয়েছে!

ডিজনি-র ফিল্মগুলিতে কোনও গভীরতর সামাজিক বার্তা বা শ্রেণিচেতনা আছে বলে মনে না করলেও প্রখ্যাত রুশ চলচ্চিত্রকার সের্গেই আইজেনস্টাইন ছিলেন ডিজনি-র কাজের ভক্ত। তাঁর মতে, ডোনাল্ড ডাক চরিত্রটিকে ভাল বা খারাপের সংজ্ঞায় সীমায়িত করা যায় না (‘Beyond good and bad’)। তার ভাল লেগেছিল ডোনাল্ডের ‘সেল্ফ কন্ট্রোল’ (১৯৩৮) নামে ছবিটি, যেখানে দেখা যায় ডোনাল্ড প্রাণপনে চেষ্টা করছে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে। ডোনাল্ডের রেডিয়োতে ভেসে আসছে সুললিত কণ্ঠে রাগকে নির্মূল করার উপদেশাবলি, যা ডোনাল্ড মেনে চলার চেষ্টা করেও অসফল হচ্ছে। একটা হ্যামকে শুয়ে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করেও একটি কাঠঠোকরার সশব্দ উপস্থিতি তাকে তিতিবিরক্ত করে তোলে। শেষমেশ রেডিয়োটা সে আছড়ে ভেঙে ফেলে। আইজেনস্টাইন এর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন রাষ্ট্র বা কর্তৃপক্ষের শুকনো উপদেশ, যা অসহায় ও বিপর্যস্ত নাগরিকদের কানে নিরন্তর বর্ষিত হচ্ছে, এবং যা তার মূল সমস্যাগুলির কোনও সমাধান করতে পারছে না।
আমার মনে আছে, স্কুলজীবনে রবিবার অধীর আগ্ৰহে ‘ডিজনি আওয়ার’-এর জন্য অপেক্ষা করে থাকা— মিকি ডোনাল্ড, প্লুটো, গুফিদের সঙ্গে কিছু সময় কাটানো। পরবর্তীকালে দূরদর্শনে ‘ডাকটেলস’ দেখে আনন্দ পাওয়া। হাতে কিছু পয়সা জমলে আগ্ৰহ নিয়ে এরপর ডোনাল্ড ডাকের কমিকস সংগ্ৰহ করা (ডায়মন্ড কমিকসের বানান বিপর্যয়ে যেখানে ডোনাল্ড হয়ে গিয়েছিল ডুনাল্ড)। অধুনালুপ্ত সিডির দোকানে বা স্টলে ডিজনি-র ছবির পাইরেটেড সিডি কেনা।
এখন পরিণতমস্তিস্ক আপাতনিরীহ কমিকস ও অ্যানিমেটেড মুভির মধ্যে কিছু বক্তব্য, কোনও দর্শনের ইঙ্গিত বা গভীর কিছু আবিষ্কার করতে চায়— এ যেন এক মজার খেলা, যেটা প্রৌঢ়-হতে-চলা একটি প্রজন্মের অনেকেই বার বার খেলতে ভালবাসে। টিনটিনের সূক্ষ্ম ও ডুনসবারির সোচ্চার রাজনৈতিক বক্তব্য, ক্যালভিন অ্যান্ড হবসের দর্শন ও আ্যাসটেরিক্সের ইউরোপীয় রসবোধ ও কটাক্ষ— এসব কখনওই ডিজনি-র কমিকস বা ফিল্মে পাওয়া যাবে না। কিন্তু যাঁরা মন দিয়ে দেখবেন, কিছু-কিছু দৃশ্য বা মুহূর্ত ভাবনার খোরাক জোগাবে না, এ-কথা বলা যায় না। উদাহরণ, ‘ডার ফ্যুয়েরারস ফেস’ ছবিতে দেখা যাচ্ছে নাৎসি-শাসিত জার্মানিতে রাত্রে ডোনাল্ড দেওয়ালে একটি ছায়া দেখে আঁতকে ওঠে। এক দীর্ঘকায় মানুষ যেন হিটলারি কায়দায় হাত বাড়িয়ে অভিবাদন করছে। শত্রুদেশে আসন্ন আক্রমণের আশঙ্কায় সে খুব ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে বোঝা যায়, আমেরিকার স্ট্যাচু অফ লির্বাটি-র একটি রেপ্লিকা এমনভাবে রাখা ছিল যে, পেছন থেকে আলো এসে এইরকম ছায়া তৈরি করে ডোনাল্ডের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটিয়েছে!