অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স

Ranjhnaa Last scene

২০১৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল আনন্দ এল রাইয়ের ‘রাঞ্ঝনা’। দু’হাত তুলে, আউলা হয়ে, একসময়কার প্রেমিকার পিছনে পড়ে থেকে, তার জীবনটা ভাজা-ভাজা করে দেওয়ার পর, নিজেই কষ্টমষ্ট পেয়ে, দর্শকদের হাউহাউ কাঁদানো এক টক্সিক প্রেমিকের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন দক্ষিণী তারকা ধনুশ। ‘রাঞ্ঝনা’ ছবিটি তাঁকে রাতারাতি গোটা দেশের সামনে অভিনেতা হিসেবে এক বিরাট স্বীকৃতি দিয়েছিল। কারণ আমরা সকলেই জানি, যতদিন না বলিউডের ছাপ্পা পিছনে পড়ছে, ততদিন তুমি ‘লোকাল’। কিন্তু কথা সেটা না। কথা হল, ‘রাঞ্ঝনা’ ছবির শেষে এই জাতের যে কোন প্রেমিকের মতোই ধনুশও মরে যায়। শেষ দৃশ্যের সেই ‘অব শালা কৌন…’ সংলাপখানা সিনেমা হলে বসে শুনলে, আজকালকার ‘সাইয়ারা’-বিশারদরা আবেগ ধরে রাখতে না পেরে যে কোন জাতের নাকের জলে-চোখের জলে হুস্তুনপুস্তুন জুড়তেন, সে-কথা ভাবলে আতঙ্কে শিউরে উঠতে হয়। কিন্তু এটাও কথা নয়। কথা হল, কৃত্রিম মেধা, অর্থাৎ, এআই (AI)-ভাইটিকে কাজে লাগিয়ে ‘রাঞ্ঝনা’ ছবিটি আবারও মুক্তি পাচ্ছে এত বছর বাদে। এইবার, ধনুশের চরিত্রটি আর মরে না। একেবারে ড্যাবড্যাব করে বেঁচে থাকে।

পাঠক, আপনার নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে, কেন কেউ এরকম একটা কাজ হঠাৎ করছে? তার উত্তর হচ্ছে, মানুষ পারে তাই! আর ঠিক এইজন্যই এআই (AI)-কে ভয় পাওয়ার তেমন কোনও কারণ আমি দেখি না। আরে মানুষ যদি একবার চায়, তাহলে তার চাইতে অপূর্ব উদ্ভট চিন্তাভাবনা করা, ও শুধু চিন্তাভাবনাতেই সীমিত না থেকে বাস্তবায়নের দিকেও নিয়ে যাওয়ার পরিধিটা এতটাই বেশি, এআই (AI)-এর পক্ষে তার ধারে-কাছে যাওয়া সম্ভব না। কারণ এআই যুক্তিতে চলে, আর মানুষ বিটিএসের গান শোনে। 

আরও পড়ুন: ‘ইন্টারস্টেলার’ ঠিক কীভাবে দেখে ভারতকে?
লিখছেন সৌকর্য ঘোষাল…

এবার ধরা যাক আপনি মানবজাতির উকিল। মানুষ যা যা করে, মানে পরমাণু বোমা বানানো থেকে যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলা— এই সবকিছুর উত্তর আপনার কাছে মজুত। মানে কেউ যদি বলে, ‘প্লাস্টিকের স্ট্র ব্যবহার করিস না রে বাবা, ওগুলো কচ্ছপের নাকে ঢুকে কচ্ছপগুলো মরে যায়’ তখন আপনি উত্তর দেন, ‘যে কচ্ছপ এত বছর জলের মধ্যে খলবল করার পরেও একটা স্ট্র এড়িয়ে সাঁতার কাটতে পারে না, তেমন বলদ কচ্ছপের দরকার বা কী?’ তাহলে আপনার পক্ষে ছবিটির এই বদলের সমর্থনে মত দিতে সুবিধা হবে৷ আপনি বলবেন, ‘যখন করা যাচ্ছে তখন করবে না কেন? এত বছর বাদে একটা ছবি আবার রিলিজ করছে যার কিনা ক্লাইম্যাক্স বদলে দেওয়া হয়েছে। অর্ধেক দর্শক তো ওই দেখতেই আসবে! তাই এক ছবি থেকে যদি দু’বার লাভ করা যায়, তাহলে করবে না কেন?’

হক কথা! সহি বাত। কিন্তু করা যায় বলেই করতে হবে এরকম কোনও ব্যাপার নেই। ধরা যাক, এইবার আপনি তাদের মধ্যে একজন। তাহলে এইবার আপনি বলবেন, ‘সিনেমা মূলত একটা আর্ট ফর্ম।’ হ্যাঁ আর্টের একমাত্র শর্ত হচ্ছে এখানে কোনও দায় চাপানো যাবে না। আমার যা প্রাণ চায়, আমি সেটাই করব। কিন্তু আমি তো একপিস ময়দার লেচির ওপর আরেকপিস আটার লেচি থেবড়ে দিয়ে ও হো, কী নিদারুণ ভাস্কর্যই হল! হ্যাঁ হতেই পারে, অন্য কারও কাছে সেটা আর্ট। কিন্তু সেটা ভাস্কর্য নয়।  এক্ষেত্রেও ঠিক তাই হচ্ছে। আমি এসব বলছি না, কিন্তু আপনি বলছেন!

ধনুশবাবুও বিষয়টা নিয়ে বিশেষ খুশি হননি। একদম পরিষ্কার বিবৃতি দিয়ে উনি জানিয়েছেন যে, ছবির এই বিকল্প শেষ দেখে ওঁর মনে হয়েছে, যথার্থ অর্থেই ছবিটাকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি শিল্পের যে অন্তর্নিহিত আত্মা থাকে, সেটিকেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এবার ধরুন, আপনি তো ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু আমার কোনও কাজ নেই। এই আমার মতো আরও হাজার-হাজার মানুষ আছে, তাদেরও কোনও কাজ নেই। ফলে, আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক অনেকদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছি, যেটার মূল উপপাদ্য হল, এআই আশীর্বাদ না অভিশাপ। কেউ আশীর্বাদে মত দিয়েছে, কেউ অভিশাপে, কারও আবার কিছু যায়, আসে না কারণ ব্রক লেসনার ফিরে এসেছে ইত্যাদি।

কথা হল, ‘রাঞ্ঝনা’ ছবির শেষে এই জাতের যে কোন প্রেমিকের মতোই ধনুশও মরে যায়। শেষ দৃশ্যের সেই ‘অব শালা কৌন…’ সংলাপখানা সিনেমা হলে বসে শুনলে, আজকালকার ‘সাইয়ারা’-বিশারদরা আবেগ ধরে রাখতে না পেরে যে কোন জাতের নাকের জলে-চোখের জলে হুস্তুনপুস্তুন জুড়তেন, সে-কথা ভাবলে আতঙ্কে শিউরে উঠতে হয়। কিন্তু এটাও কথা নয়। কথা হল, কৃত্রিম মেধা, অর্থাৎ, এআই (AI)-ভাইটিকে কাজে লাগিয়ে ‘রাঞ্ঝনা’ ছবিটি আবারও মুক্তি পাচ্ছে এত বছর বাদে। এইবার, ধনুশের চরিত্রটি আর মরে না। একেবারে ড্যাবড্যাব করে বেঁচে থাকে।

কিন্তু যে পাঠক এই লেখাটি পড়তে শুরু করেছিলেন একটি জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ, সিরিয়াস লেখা হিসাবে তিনি তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন, তাই না? তা এবার যদি তার কাছে সুযোগ থাকে এআই ব্যবহার করে নিজের নষ্ট হয়ে যাওয়ার সময়টুকু আবার জন স্নো করে নেওয়ার, তাহলে কি তিনি তা করবেন না? যে আগুনখোর বিপ্লবীর ‘রাঞ্ঝনা’ ছবিটিকে আদ্যোপান্ত পেট্রিয়ার্কাল ম্যানিফেস্টো মনে হয়, তার হাতে ক্ষমতা থাকলে কি তিনি এআই ব্যবহার করে গোটা ছবিটিকেই অন্যভাবে বানাবেন না? ওই নভেম্বরে যে মিটিওরটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে সেটা কি সত্যিই মিটিওর নাকি এলিয়েন-শিপ? এমন নানা প্রশ্ন ভিড় করে মানুষের মনে। কেউ কেউ সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় গুগল করে, আর কেউ কেউ এআই ব্যবহার করে নিজের মনস্কামনা মেটায়। সেটা রোগা চেহারার ছবিতে পেশি জুড়ে দেওয়াই হোক অথবা এই ছবিটার মতো কোনো একটা ঘটনা। এআই আমাদের পাশবালিশ হয়ে গেছে। এবার আপনি সেটাকে কীভাবে ধামসাবেন, ওয়ার পরাবেন, না পরাবেন না— সেটা আপনার ওপর। আসলে একথা তো আমরা সকলেই জানি যে, কুন্দনের পায়জামার দড়ি একটুও ঢিলে নয়।

তাই আশা রাখছি খুব শিগগিরই শোলে বইতে এআই (AI) এর সাহায্যে জেগে উঠবে জয়। ঠাকুরবাবু দাঁড়িয়ে থেকে জয় সঙ্গে বিয়ে দেবেন তার বিধবা বৌমার। আর ঠিক তখন যে ব্যক্তিটি প্রতিবাদ করে উঠে বলবে  – ‘এসব আমাদের সংস্কৃতিবিরুদ্ধ’, তখন আমরা তাকে এআই (AI) ব্যবহার করেই প্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দেবো। কী দারুণ ব্যাপার তাই না?