উত্তমকুমারের মৃত্যুদিন, ২৪ জুলাই তারিখটা এলেই আমার তাঁর কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে, ১৯৮০ সালের ২৫ জুলাই ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-সহ সবক’টা বাংলা কাগজের প্রথম পাতায় আট কলাম জুড়ে ছিল উত্তমকুমারের ছবি-সহ বিস্তারিত মৃত্যুসংবাদ। আর পাঁচ পাতার এককোণে ছোট্ট একটা ডাকটিকিট মাপের ছবি-সহ ছিল পাঁচ/ছয় লাইনে তাঁর মৃত্যুর খবর। পরবর্তী সময়ে মোবাইল বা ফেসবুক আসার পর সেই ২৪ জুলাই দিনভর গোটা ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুধুই উত্তমকুমার। ক’জন এঁকে স্মরণ করেন? বেশিরভাগই একবারও এঁর নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করেন না।
তিনি বিনয় ঘোষ।
আট বছর আগে তাঁর জন্মশতবর্ষ পূর্তি হয়ে গিয়েছে। না, বাঙালি তাঁকে মনে রাখেনি। একটি সংবাদপত্রের রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রে সুধীর চক্রবর্তীর একটা প্রবন্ধ ছাড়া আর কোথাও তেমন কিছু চোখেই পড়েনি।
আরও পড়ুন : নাটকের স্বার্থে রবীন্দ্রনাথের হাতে দড়ি বাঁধতেও পিছপা হননি প্রমথনাথ বিশী!
লিখছেন অরুন্ধতী দাশ…

কিন্তু এই অবহেলা তাঁর প্রাপ্য ছিল না মোটেই। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, আঞ্চলিক ইতিহাস, লোকসংস্কৃতিকে তিনিই সহজ গদ্যে সাধারণ পাঠকের কাছে তুলে নিয়ে এসেছিলেন। বাংলার সংস্কৃতিকে তিনিই প্রথম সু-লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বিনয় ঘোষের শতবর্ষে সুধীর চক্রবর্তী লেখেন, ‘তাঁর সাংবাদিক সত্তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর সরেজমিন গবেষণা-জাত কাজগুলি, তেমনই বারবার পড়ে মুগ্ধ হতে হয় তাঁর গ্রামজীবী, বঙ্গজীবনের শিল্পকলা, উৎসব, পরব, মেলা, ব্রত, লোকসংস্কৃতি, চণ্ডীমণ্ডপ, পটুয়া ও পটশিল্প, ঢোকরা শিল্পীসমাজ, মৃৎশিল্পী ও গ্রাম গঠনের কাঠামো বিষয়ে অনুচিকীর্ষা দেখে। নগর ও গ্রামের স্পষ্ট পরিধি ও বৈপরীত্য বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, শাহরিক সংস্কৃতি ও অটোমেটিক যাপনরীতি, ক্রমক্ষীয়মাণ লোকশিল্প, জনসংস্কৃতির স্ববিরোধ— এতসব বিচিত্র ও বিভাজিত প্রসঙ্গে স্বচ্ছন্দ পদাতিক ও গর্বিত বাঙালি বিনয় ঘোষকে আমরা যদি মনে না রাখি তবে তাঁর স্নেহার্দ্র নম্র সৃজনশীল ভাবাবেগকে হালফিল জীবনের সঙ্গে আমরা অঙ্গীভূত করব কী করে?’
ছাত্রজীবন থেকেই বিনয় ঘোষ ছিলেন মার্কসবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ নেননি। তিনি মনে করতেন, নিজস্ব চিন্তা দলগত চিন্তাধারার প্রভাবে বিকশিত বা প্রস্ফুটিত হয় না। যেখানে কোনও গতিশীল জীবন্ত আদর্শ মানুষকে দলবদ্ধ হয়ে সমাজকর্মে উদ্বুদ্ধ করে না, জীর্ণ, বিকৃত, আদর্শ নীতির খোলস আঁকড়ে ধরে যাঁদের জীবনের কাজ আরম্ভ করতে হয়, তাঁদের চলার শক্তি বৃদ্ধি পায় না, স্থায়িত্ব হয় না।
ইতিহাস ও সমাজ-নৃতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে নিজের আর্থিক উন্নতির কথা কখনও ভাবেননি। তাই অনবরত এক থেকে অন্য কর্মান্তরে পৌঁছে গিয়েছেন। তবে মোটামুটি তাঁর নির্ভরতা ছিল সাংবাদিকতা এবং সেই সময়ের ঘটনাবহুল বিষয়-বৈচিত্রের দিকে। যদিও নানা কাজের মধ্যেও তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল, এই বিচিত্র ও বহুমাত্রিক পশ্চিমবঙ্গকে সরেজমিনে দেখা ও বোঝা। নানা পর্যবেক্ষণের যে অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়েছিল, তার মূলে শক্তিশালী ভিত ছিল পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে গ্রামে গাঁথা স্বদেশের হৃদয়কে আবিষ্কার করার আত্মকর্তব্য।


১৯৩৮-’৩৯ সালে তাঁর ২০ বছর বয়সে লেখা প্রবন্ধগুলি সংকলন করে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘শিল্প, সংস্কৃতি ও সমাজ’। তিনি জানান, এই বইয়ের প্রায় প্রত্যেকটি প্রবন্ধ মার্কসবাদ-সম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা। তখনকার মার্কসবাদ তৎকালীন ঐতিহাসিক সামাজিক প্রতিবেশে একটা নিটোল পরিপূর্ণ আদর্শ ছিল। সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত তরুণের লেখা সেইসব প্রবন্ধ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি (১৯৪১), সোভিয়েত সভ্যতা, দুই খণ্ডে (১৯৪১-’৪২), ফ্যাসিজম ও জনযুদ্ধ (১৯৪২)— ক্রমপর্যায়ে প্রকাশিত এই বইগুলির নামেই বোঝা যায়, সেই সময়ের কয়েক দশকের বাংলা সাহিত্য ও সমালোচনার ধারাটি।
যদিও সাংবাদিকতার হাত ধরেই তাঁর লেখার জগতে প্রবেশ। সুভাষচন্দ্র বসু সম্পাদিত ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজের মাধ্যমে তাঁর প্রথম পর্বের শুরু। দ্বিতীয় পর্বে শুরু করেন সাহিত্য-সমালোচনা। তৃতীয় পর্বে বাংলাদেশে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতিফলন কীভাবে ঘটে, তার বিবরণ লিখেছিলেন ‘বাংলার নবজাগৃতি’ বইতে। চতুর্থ পর্বে বিষয় হিসেবে বেছে নেন কলকাতার সংস্কৃতি। ইতিহাসের প্রেক্ষিতে নতুন রূপে, নতুন ব্যাখ্যায় শহরটিকে আবিষ্কার করেন। কলকাতা-সংক্রান্ত প্রবন্ধ, পরে বইগুলি লিখতে লিখতেই বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালির মনকে মন্ত্রমুগ্ধ করে এসেছে শহর কলকাতা। বাংলার সাহিত্যিক, লেখক ও রাজনীতিবিদদের অনেকেই কলকাতা কালচারে প্রভাবান্বিত হওয়ার কারণে, বাংলা মানে ‘কলকাতা’— এই বিভ্রান্তিকর ধারণার শিকার হয়েছেন। কলকাতার বাইরে যে আর একটা বাংলা বিরাজমান, তাঁদের সংকীর্ণ দৃষ্টি তা তাঁদের দেখতে দেয়নি। এই কারণেই কলকাতা বিষয়ে বইগুলি লেখার পর তিনি হাত দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বাংলার সংস্কৃতি খোঁজার কাজে। বাংলার সমাজ, লোকাচার, লোকনীতি বিষয়ে অমূল্য সব গ্রন্থ আকরের স্থান পেয়েছে। পরবর্তী সময়ে সংকলন করেছেন পুরনো সংবাদপত্রের বিষয়ভিত্তিক সংবাদ। শেষ পর্বে লিখেছেন বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য পাঠ্যপুস্তক। যদিও প্রাজ্ঞ বিনয় ঘোষ শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে সংস্কৃতিবিজ্ঞানী রূপেই রয়ে গিয়েছেন।
যদিও সাংবাদিকতার হাত ধরেই তাঁর লেখার জগতে প্রবেশ। সুভাষচন্দ্র বসু সম্পাদিত ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজের মাধ্যমে তাঁর প্রথম পর্বের শুরু। দ্বিতীয় পর্বে শুরু করেন সাহিত্য-সমালোচনা। তৃতীয় পর্বে বাংলাদেশে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতিফলন কীভাবে ঘটে, তার বিবরণ লিখেছিলেন ‘বাংলার নবজাগৃতি’ বইতে।
তিনিই দেখিয়ে দিয়েছিলেন দেশের প্রাকৃতজনের প্রাণবন্ত ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে কীভাবে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে সেখানকার কারুশিল্প। তিনিই আজ থেকে ৬০-৬৫ বছর আগে সাবধান করে দিয়েছিলেন, বাঙালির জীবনের সঙ্গে শিল্পকর্মের প্রত্যক্ষ ঘনিষ্ঠ সংযোগ ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বাংলার লোকশিল্প দ্রুত নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাচ্ছে। তাঁর ভবিষ্যৎবাণী আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি।
আমি ছিলাম তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত। মানে, তাঁর লেখার। যখনই যা পেতাম, গোগ্রাসে গিলতাম। ওঁর অনেক বই তখন অপ্রাপ্য ছিল। এখনও তাই। বাংলা ও ইংরেজিতে মোট ৩৮খানি মৌলিক বই লিখেছেন। সম্পাদনা করেছেন আরও পাঁচটি বই। তবে আশার কথা ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ এবং ‘কালপেঁচা’-র কয়েকটি বইয়ের সংকলন পাওয়া যায়।



আগেই উল্লেখ করেছিলাম, ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মাত্র ৬৬ বছর বয়সে কলকাতাতেই তাঁর প্রয়াণ হয়। জন্মেছিলেন কলকাতার মনোহরপুকুরে ১৯১৭ সালের ১৪ জুন।
তাঁর কয়েকটি কাজের বিষয়ে আমার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল। সেসব লেখার জায়গা এটা নয়। তবে একটা ব্যাপার জানাতে চাই। বিনয় ঘোষের গ্রন্থসংগ্রহ ছিল ঈর্ষনীয়। বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানের বই। কিন্তু তিনি জীবিত থাকতেই সংগ্রহের সিংহভাগ অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এটা কেন করেছিলেন তিনি? আমি জানি না। সুধীর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘জীবনের শেষ দিকে অর্থনৈতিক চাহিদার বাধ্যতায় তাঁর বিপুল গ্রন্থসংগ্রহের অনেকটা বিক্রি করে দেন এক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে।… তিনি নাকি পশ্চিমবঙ্গের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র পঁচিশ হাজার টাকায় সেই বইগুলি কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়দু’টি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। এটাও নিতান্ত সময়ের অভিশাপ।’
কিন্তু এই ঘটনা কতটা সত্য, তা আমার জানা নেই।
ছবি সৌজন্য : লেখক