ছায়াবাজি: পর্ব ৪১

nightbitch

মা ও কুকুর

ছবিটা একেবারে গোড়াতেই মাতৃত্বের গোড়া ধরে টান মারে। ‘নাইটবিচ’ (Nightbitch) (চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: মারিয়েল হেলার, ২০২৪) ছবির প্রথম দৃশ্যেই, একজন মা তার বাচ্চা নিয়ে ডিপার্টমেন্ট স্টোরে কেনাকাটা করছে, পরিচিত এক মহিলার সঙ্গে দেখা। মহিলা জিজ্ঞেস করে, সারাক্ষণ বাচ্চাটার সঙ্গে বাড়িতে কাটাতে কেমন লাগে? নিশ্চয় খুব ভাল? উত্তরে মা বলে, ‘ভাল লাগলে তো খুশিই হতাম, কিন্তু তার বদলে মনে হয় আমি নিজের তৈরি একটা জেলখানায় বন্দি। যেখানে আমি নিজেকে অত্যাচার করি, আর তারপর কান্না চাপতে মাঝরাত্তিরে গাদাগুচ্ছের মিষ্টি বিস্কুট খাই। আমার মনে হয় সমাজের রীতিনীতি, মেয়েদের কাছে সমাজের চাহিদা, আর চিরকালীন এই জীবতত্ত্ব— যা ঠিক করেছে মেয়েরাই বাচ্চাদের জন্ম দেবে— এরা সবাই মিলে আমায় চেপেচুপে এমন একটা মানুষ করে ছেড়েছে, যাকে আমিই আর চিনতে পারি না। আমার সারাক্ষণ রাগ হয়, সত্যি, সর্বক্ষণ। আমি ভাবি, এই বন্দোবস্তগুলোর সমালোচনা করে কয়েকটা শিল্প সৃষ্টি করব, কিন্তু বাচ্চা হওয়ার আগে আমার মাথা যেমন কাজ করত, এখন একেবারে করে না, আমি বোকা হয়ে গেছি। আর ভেতর থেকে একটা ভয় হয়, আমি বোধহয় আর কখনও বুদ্ধিমতী, সুখী, আর রোগা হতে পারব না।’ তারপরেই অবশ্য আমরা দেখি, সে এই উত্তরটা মনে-মনে ভাবছিল, আসলে সে বলে, হ্যাঁ, আমি মা হওয়াটা খুব উপভোগ করছি। সিনেমার নায়িকা এই মা, যে সব নতুন-মা’র মতোই চমকে বুঝতে পারে (বাচ্চার বয়স এখন বছর আড়াই), কী অবিশ্বাস্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম, একঘেয়েমি ও নিদ্রাহীনতার মধ্যে দিয়ে একজন মা’কে যেতে হয়। এবং নিজত্বকে প্রতি মুহূর্তে কেমন সমূলে পুঁতে দিতে হয়। একজন বুদ্ধিমতী শিল্পী হওয়ার দরুন, নায়িকা এই ব্যাপারগুলোয় মহিমা না আরোপ করে, মানুষকে ক্রমশ ক্ষইয়ে দেওয়ার উপাদান হিসেবে এগুলোকে চিহ্নিত করে।

বাবা চাকরিসূত্রে ঘুরে বেড়ায়, যখন বাড়িতে আসে ছেলেকে আদর-টাদর করে, কিন্তু ঘুম পাড়ানো বা চান করানোয় তেমন অংশ নেয় না, বরং ভিডিও গেম খেলতে ভালবাসে। সে বউয়ের প্রতি নির্বিকার নয়, কিন্তু বলে, তুমিই তো বলেছিলে চাকরি ছেড়ে বাচ্চা মানুষ করবে। এখন যদি একটা পার্টটাইম চাকরি নাও, তার মাইনে তো আয়াকে দিতেই বেরিয়ে যাবে। কথাটা ভুল নয়, কিন্তু নায়িকা ফাঁদ থেকে বেরোবে কী করে? পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তরাঁয় গিয়ে, এবং তারা শিল্পে নিমজ্জিত আছে দেখে, নায়িকা ভাবে, এখন সে যেমন একটা বিস্বাদ স্যালাড খাচ্ছে, সেরকমই স্তূপীকৃত শাকপাতার তলায় তার প্রতিভাময়ী সাহসী আমি-টা দম আটকে মরে গেছে। একটা তিতিবিরক্ত ফাঁপা ক্লান্তিধ্বস্ত জীবন যাপন করতে-করতে নায়িকা ছটফট করে, আবার ছটফট করছে বলে অপরাধবোধে ভোগে, এবং প্রতিনিয়ত বুঝতে পারে, বাচ্চাটাকে সে খুব ভালবাসে বটে, কিন্তু এই জীবন চলতে থাকলে সে আর নিজেকে ভালবাসতে পারবে না। কাজে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে স্বামী যখন তাকে বলে, অ্যাক্কেবারে রুটিন করে পুরো জীবনটার একটা স্ট্রাকচার করে নাও, হ্যাপিনেস ইজ আ চয়েস— তখন নায়িকা তাকে টেনে এক থাপ্পড় মারে। তারপরেই অবশ্য দেখি, এই থাপ্পড়ের কথাটা সে মনে-মনে ভাবছিল। আসলে বলে, চেষ্টা করব।

আরও পড়ুন: দম্পতির সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার কি ঠিক করে দেবে রাষ্ট্র? লিখছেন চন্দ্রিল ভট্টাচার্য…

এবং পাশাপাশি, নায়িকার মনে হয়, সে একটা কুকুরে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। তার ঘ্রাণশক্তি অনেকটা বেড়ে গেছে, দাঁত ধারালো হচ্ছে, ছ’টা বাড়তি স্তনবৃন্ত গজাচ্ছে পেটের কাছে, এবং ল্যাজ গজাচ্ছে পায়ুর ওপর। সে পার্কে গেলে কিছু কুকুর কোত্থেকে তার কাছে ছুটে আসে। রাত্রে সেই কুকুরেরা বাড়ির সামনে এসে তাকে ডাকে, ছোট-ছোট মরা জন্তু ভেট দেয়। লাইব্রেরি থেকে নায়িকা বই আনে, যেখানে লেখা আছে বিভিন্ন পুরাণ ও লোককথা, যেখানে কোনও মেয়ে-গোষ্ঠী বদলে গেছে পাখিতে, বা কোনও দেবীকে কুকুরের জননী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। নায়িকা কখনও রাত্রে কুকুরদের সঙ্গে বেরিয়ে যায়, কখনও বাগানে কুকুরের মতো মাটিতে মুখ ঘষে ও গর্ত খোঁড়ে, মনে-মনে সে বলে, আমি একজন বালিকা, নারী, স্ত্রী, জননী, আর এখন এ-ই। অর্থাৎ, জন্তু। মানে, মুক্ত। যার স্নান করার দায় নেই, বা কাঁটা-চামচ দিয়ে খাবার খাওয়ার দায় নেই। সে আর তার বাচ্চা খেলার ছলে কখনও বাটিতে মুখ দিয়ে খায়, বাচ্চা আজকাল কুকুরের বিছানায় ঘুমোয়, তাই মা একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে। সঙ্গমের সময়ে নারী স্বামীকে বলে, আমার গলাটা কামড়ে ধরো।

এবং নায়িকার মনে পড়ে, তার মাও এই বন্দিত্বের মধ্যে দিয়ে গেছেন। তিনি একবার বলেছিলেন, তিনি হতে পারতেন ইউরোপের এক খ্যাতনাম্নী গায়িকা, কিন্তু তার বদলে সন্তানের জন্ম দিয়ে সংসার করেছেন। নায়িকার মনে হয়, এক রাতে সে মা’কে দেখেছিল কোথায় বেরিয়ে যেতে, পিছু ডেকেছিল কিন্তু তিনি ফেরেননি, বোধহয় তিনিও অন্ধকারে চার পায়েই হাঁটছিলেন। এবং বোধহয় একদিন রান্না করেছিলেন উদ্ভট সব জিনিসপত্র মিশিয়ে, তার মধ্যে কী যেন ছোট জন্তুর থাবার কঙ্কালও ছিল। তবে কি তার মা ছিলেন ডাইনি, তিনিও কি রাতে হয়ে যেতেন কুকুর, তিনিও কি চাইতেন রক্ত আর দাঁত আর আদিম বাঁধনছাড়া মুক্তির ব্যাকরণে সর্বশক্তিমতী হয়ে উঠতে? তাই কি নায়িকা একদিন দেখেছিল, তিনি বাগানে শুয়ে কাঁদছেন? তার ইচ্ছে হয়, সে ফিরে গিয়ে মা’কে বলে, কীভাবে তুমি তোমার রাগ আর হতাশা চেপে রাখতে, কেন তুমি জেদ করে তোমার আনন্দকে বজায় রাখোনি, তাতে শুধু তোমার উপকার হত না, আমারও হত।

স্বামী ভাল লোক, সে স্ত্রীকে অত্যাচার করতে চায় না, কিন্তু এক সময়ে ঝগড়া লেগে যায়। পোষা বেড়ালটা মরে গেছে (নায়িকাই মেরে ফেলেছে— কুকুর হয়ে, কিন্তু স্বামী সে-কথা জানে না), এখান থেকে ঝামেলাটা শুরু হয়, স্ত্রী এক সময়ে বলে, আমি যখন তোমায় বলেছিলাম শিল্প করা ছেড়ে দেব (একটা জাদুঘরে স্বামীর পাশে বসে বলেছিল, একজন শিল্পী হিসেবে প্রতিদিন যা করার, তা তো আমি করছি না, ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। তার চেয়ে, শিল্পের কথা না ভেবে, আমি যদি যা যেটা করছি সেটায় মনোযোগ দিই, একজন খুব ভাল মা হয়ে উঠি, তা-ই তো চমৎকার। স্বামী বলেছিল, তা… তুমি বলছ যখন…), তুমি তক্ষুনি লাফিয়ে উঠে সহমত হলে, একটুও প্রতিবাদ করলে না, তর্ক করলে না, বললে না কেন শিল্প ছাড়বে, বা, তুমি তো ভাল শিল্পী, নিশ্চয় শিল্পের কাছে ফিরতে পারবে। আসলে তুমি চেয়েছ বাচ্চা মানুষ করার এক বিনিপয়সার আয়া, যেমন তোমার মা ও তাঁর মা ছিলেন। জবাবে স্বামী বলে, আমারও তো আমার মা’র সঙ্গে বিবাহিত থাকতে ভাল লাগে না। সেই মেয়েটা কোথায় গেল, যাকে আমি বিয়ে করেছিলাম? যে ছিল খুব দৃঢ়, প্রাণবন্ত, নতুন-নতুন জিনিস নিয়ে উত্তেজিত, যে আমাকে উৎসাহ দিত, বলত সব সংকটেরই মোকাবিলা করা যায়, আমার সেই বউ কোথায়? উত্তরে নারী বলে, সে বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে মরে গেছে।

‘বিচ’-এ কুকুর-নারীর ক্রোধ ও ক্ষোভ আছে, আর ‘নাইটবিচ’-এ আছে তার সঙ্গে নতুন করে ও অনেকটা খুঁড়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার থরথর ও শিরশির। হতেই পারে, ‘বিচ’ থেকে ‘নাইটবিচ’ কিছুটা প্রভাবিত (যদিও ‘নাইটবিচ’ ছবিটি যে-বইটি অবলম্বনে, তা লিখেছেন র‍্যাচেল ইয়োডার, বই প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালে), কিন্তু তাতে এটা মিথ্যে হয় না যে, ‘নাইটবিচ’ সব অর্থে অনেক ভাল ছবি, তার চিত্রনাট্য অভিনয় আলোকচিত্র ও পরিচালনা ঝকঝকে, বিশেষত নায়িকার ভূমিকায় এমি অ্যাডামস অনবদ্য। সবচেয়ে বড় কথা ‘বিচ’ ছবিটি একমাত্রিক ও উপদেশধর্মী, আর ‘নাইটবিচ’ কৌতূহলী অনেকধর্মী ঝলমলে।

এক সময়ে স্বামী জিজ্ঞেস করে, তোমার কি আফশোস হয় বাচ্চাটা হয়েছে বলে? নারী বলে, না, শুধু মনে হয়, ওকে মানুষ করার ক্ষেত্রে একটা সমান-সমান দায়িত্ব ভাগের নিয়ম থাকলে ভাল হত। এরপর ঠিক হয়, স্বামী-স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হবে, এবং স্বামী যখন বাচ্চাকে তার কাছে নিয়ে রাখে, মেয়েটি একা সময় কাটানোর (এবং শিল্প নিয়ে ভাবার) সময় পায়, সে মাতৃত্ব নিয়েই অনেকগুলো ছবি আঁকে, ভাস্কর্য করে, এবং তারপর একটা বড় প্রদর্শনী করে, সেটা বেশ সফল হয়। (প্রদর্শনী সাজাতে গিয়ে মেয়েটি ভাবে, মৃত্যু ছাড়া, মাতৃত্ব হল নারীর জীবনের সবচেয়ে হিংস্র ঘটনা। তাকে আক্ষরিক ভাবে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় এই অভিজ্ঞতা, এবং সন্তান তার প্রথম নৃশংস ক্রিয়া জননীর বিরুদ্ধেই করে। তাই মাতৃত্ব শুধু সূর্যালোক আর সুগন্ধী পাউডারের গল্প নয়, তা নিষ্ঠুর আখ্যানও বটে)। প্রদর্শনী হয়ে যাওয়ার পরে, স্বামী নারীর কাছে ক্ষমা চায়। সে আগে বলেছিল, তুমি মুখে না বললে আমি বুঝব কী করে তুমি অসুখী, আমি তো অন্তর্যামী নই। এবার বলে, আমি দুঃখিত, আমার ভুল হয়েছে, বোঝা উচিত ছিল, তোমায় বাড়িতে বন্দি করে দেওয়ার ফলে তুমি কী অসামান্য ভাবনা ও কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছিলে। আমার তোমাকে শিল্প থেকে দূরে রাখা উচিত হয়নি। স্বামী-স্ত্রীর মিলন ঘটে। ছবি শেষ হয় নারীর দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের দৃশ্যে।

ছবিটার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল, ছবিটা তীব্র, কিন্তু তিক্ত নয়। বরং কৌতুক-ঝিকমিক। প্রশ্নসংকুল, কিন্তু দরদি। এখানে স্বামীকে ভিলেন (পুরুষতন্ত্রের একবগ্গা প্রতিনিধি) হিসেবে আঁকা হয়নি, একটু অবুঝ, কিন্তু অনুতপ্ত হওয়ার প্রসার-সম্পন্ন হিসেবে গড়া হয়েছে। মাতৃত্ব ব্যাপারটা মন্দ নয়, এই ছবিতেই সংলাপ আছে, আমরাই (মানে মায়েরাই) ঈশ্বর, কারণ আমরা পৃথিবীতে জীবন আনছি। আবার এ-সংলাপও আছে, প্রজাবিস্তারের জন্য আমরা যুগ-যুগ ধরে আত্মত্যাগ করে চলেছি। আবার এই গোছের নেপথ্যভাষও আছে: বালিকাবয়স থেকে তোমার মধ্যে যে-আগুন জ্বালিয়ে ও রক্ষা করে এলে অ্যাদ্দিন ধরে, তার মাধ্যমে তুমি একটা নতুন মানুষ হয়ে উঠতে পারো, আবার একটা নতুন মানুষকে এ-বিশ্বে ঠেলেঠুলে বেরও করতে পারো, যে কিনা নির্বিকার ভাবে তোমার মুখে পেচ্ছাপ করে দেবে। মুশকিলটা সুবিদিত: নিজে নতুন মানুষ হয়ে ওঠা আর নবজাত মানুষের কাঁথা বদলে দেওয়ার মধ্যে ঠোকাঠুকি বেধে যায়। মাতৃত্ব ও নিজত্বের যে অবধারিত দ্বন্দ্ব, তা শুধু শিল্পী নয়, যে-কোনও সংবেদী মহিলার জীবনেই একটা বিরাট গর্ত, যা থেকে হাঁচড়পাঁচড় করে ওঠা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়, কিন্তু গর্তটার অস্তিত্বটাকে অস্বীকার করা, বা গর্তটায় ধড়াম করে পড়ে যাওয়াটাকে জীবনের সেরা অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্ণনা করার মধ্যে একটা ভণ্ডামি আছে। এই ছবি খুব বুদ্ধিদীপ্ত ও মজাঋদ্ধ ভঙ্গিতে সেই ধাস্টামিকে চিরে দেয়। নায়িকা কুকুর হয়ে যখন রাজপথে প্রাণপণে ছুটতে থাকে, আমরা তার সাময়িক ছুটির স্বাদ, টাটকা অনুভূতির স্পর্শ টের পাই। নায়িকার যখন ল্যাজ গজায়, সে বিস্মিত হলেও বিপন্ন হয় না, বরং তার মুখে একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে: বাহ্‌, বেশ একটা নয়া ব্যাপার তো, দেখা যাক আর কী হয়! এ-ছবিতে কুকুর মানে হতে পারে বকলশ ছিঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সমাজ-সংসারের এবং নিজের ভাবমূর্তির তোয়াক্কা না করে স্বাদু খরগোশের ঘাড় মটকাবার সাহস, হতে পারে নিজের প্রকৃত কাজের (এখানে শিল্পসৃষ্টির) তাগিদের ডাক, হতে পারে সব ক’টাই। সব মহিলা সেতার বাজাতে না চাইলেও, চারদিন বেড়াতে যেতে তো চায়। কিংবা নিশ্চিন্ত ও ঝরঝরে দেহমন নিয়ে যৌনতা করতে। সেইসব চাহিদাকে একটুও প্রশ্রয় না দিয়ে, শুধু একটা ছুটিহীন নিদ্রাহীন পারিশ্রমিকহীন (এবং নালিশহীন!) চব্বিশ ঘণ্টার দাসত্বের ছক বানিয়ে রাখলে, তা মনুষ্যত্বেরই অপমান। কিন্তু খাঁজকাটা চক্রটার ওপর যেহেতু ‘ওগো তোমরা মায়ের জাত, পেন্নাম ঠুকে বাজিমাত’ কচুপাতার ঢাকনা পরানো আছে, তাই চট করে চোখে পড়ে না।

ছবিটা দেখতে দেখতে ‘বিচ’ (Bitch) (চিত্রনাট্য, পরিচালনা: মারিয়ানা পালকা, ২০১৭) ছবির কথা মনে পড়তেই পারে, সেখানে এক নারী আচমকা একদিন কুকুরের মতোই ব্যবহার শুরু করে, শেষে বাড়ির বেসমেন্টে নিজের পেচ্ছাপ-পায়খানা মাখা ও ঘৌ-ঘৌ রত অবস্থায় তার স্থান হয়। তাকেই চার সন্তান মানুষ করতে হত, গোটা গেরস্থালি সামলাতে হত, আর তার স্বামী অফিস করত ও সেখানেই অন্য মেয়ের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে বেড়াত। স্ত্রীর ছবি আঁকার শখ ছিল, স্বামী সেটাকে পাত্তাই দিত না। বাগানে একটা কুকুর এসে প্রায়ই বসে থাকত, রান্নাঘরের জানলা থেকে স্ত্রী দেখত, কুকুর তার দিকেই ঠায় তাকিয়ে। একদিন মেয়েটি সন্তানদের কথায় আর সাড়া দেয় না, গরগর করতে থাকে, তারপর তাকে ওই কুকুর-অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু ছবি এই নারীকে নিয়ে নয়। তার স্বামীকে নিয়ে, যে এবার সংসার চালাতে গিয়ে দ্যাখে, সে বাচ্চাদের ইস্কুলের নামও জানে না। প্রথমে সে রেগে ফুটতে থাকে, স্ত্রীর নামে নিরন্তর অভিযোগ করে, তাকে বেইমান বলে, বিবাহ-অঙ্গুরী ফেলে দেয়, এবং সংসার চালাতে গিয়ে চাকরিটা অবধি খোয়ায়। এদিকে স্ত্রীকে সে উন্মাদাগারেও দেবে না, তাতে পরিবারের নাম ক্ষুণ্ণ হবে। ক্রমে বুঝতে পারে, কতটা স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে সে স্ত্রীকে লাগাতার উপেক্ষা করেছে, এবং সংশোধিত হয়। তার গোঁয়ার্তুমি কমে, সে আর অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে না, প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করতে শেখে, সংসারের কাজ করে, বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটায়। ফলে নায়িকার ভূমিকা এই ছবিতে কম, সে অনুপস্থিতির মাধ্যমেই স্পষ্ট। কিন্তু ‘নাইটবিচ’ ছবি পুরোপুরি নায়িকা-কেন্দ্রিক, ছবি তার ভাবনাস্রোত ও উপলব্ধি নিয়ে, তার আত্মকেন্দ্র খুঁজে পাওয়া নিয়ে, নিজের প্রকৃত কাজের প্রতি তার শৃঙ্খলমুক্ত দৌড় নিয়ে। সেখানে সমাজ-সংসারের সঙ্গে বোঝাপড়ার দায়িত্ব নারীই নেয়, এবং আলোচনা ও তর্কের, নিজের সময় আদায়ের প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে সেই গন্তব্যে পৌঁছয়, শুধু অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে ও আত্ম-প্রত্যাহারের সাহায্যে নয়। ‘বিচ’ ছবিতে কুকুর মানে যাকে অবহেলা করা হয়, অপমান করা হয়। আমাকে তোমরা যেভাবে দ্যাখো, তাতে আমি কুকুর ছাড়া আর কী— এই থিমে মেয়েটি নগ্ন ও পুরীষ-আবৃত থাকে। আর ‘নাইটবিচ’-এ কুকুর সে, যে বকলশ ছিঁড়ে টেনে দৌড় দিতে পারে, আর চিৎকার করে উঠতে পারে চাঁদ ফাটিয়ে। ‘বিচ’-এ কুকুর-নারীর ক্রোধ ও ক্ষোভ আছে, আর ‘নাইটবিচ’-এ আছে তার সঙ্গে নতুন করে ও অনেকটা খুঁড়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার থরথর ও শিরশির। হতেই পারে, ‘বিচ’ থেকে ‘নাইটবিচ’ কিছুটা প্রভাবিত (যদিও ‘নাইটবিচ’ ছবিটি যে-বইটি অবলম্বনে, তা লিখেছেন র‍্যাচেল ইয়োডার, বই প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালে), কিন্তু তাতে এটা মিথ্যে হয় না যে, ‘নাইটবিচ’ সব অর্থে অনেক ভাল ছবি, তার চিত্রনাট্য অভিনয় আলোকচিত্র ও পরিচালনা ঝকঝকে, বিশেষত নায়িকার ভূমিকায় এমি অ্যাডামস অনবদ্য। সবচেয়ে বড় কথা ‘বিচ’ ছবিটি একমাত্রিক ও উপদেশধর্মী, আর ‘নাইটবিচ’ কৌতূহলী অনেকধর্মী ঝলমলে। নারীবাদী শিল্প জ্যালজ্যালে টেক্সটবইয়ের ছিন্নপাতা হতে হবে কেন, তাকে মজাভর্তি ও উত্তেজক পাত্রে ঢেলে নিলে লাভ বেশি।