ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • খুচরো খাবার: পর্ব ৫


    অর্ক দাশ (Arka Das) (February 5, 2022)
     

    আমার এ-কুল, ও-কুল

    বাগ্দেবীর প্রসাদী-কুলে ঠিক কী মধু আছে, সেটা আমি আজ অবধি বুঝে উঠতে পারলাম না। ছোটবেলায় বন্ধু-ভাই-দাদা-দিদিদের দেখেছি নিয়ম করে সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি সেরে প্রসাদের কুল হাতে বিজয়গর্বে ঘুরে বেড়াতে। সেটা ভোরে উঠে স্নান-টান সেরে উপোসের পরে অবশেষে পেটে কিছু পড়ার আনন্দে, না ‘ঠাকুরের কুল’, ‘পুজোর কুল’, ‘প্রসাদের কুল’ ইত্যাদি ভয়ঙ্কর কিছু বিধি-নিষেধ মেনে, যথাযথ আচার-নিয়ম সম্পন্ন করে দেবীকে সন্তুষ্ট রাখার প্রচেষ্টায় সফল হতে পারার জন্য, জানি না। 

    সরস্বতী পুজোর ঘনঘটায় কুলের দাপট ব্যাপারটা আমার কাছে খুব একটা ইন্টারেস্টিং নয়। তার প্রধান কারণ, দেবীর উপাসনায় যে কুলটা ঢেলে উৎসর্গ করা হয়, সেই নারকোল কুলটা বস্তুত শুধুই মিষ্টি, এবং তাই একটু পানসে, একটু বেশিই ফর্মাল, একটু নিয়মসর্বস্ব। আমি এ-কুলে নেই। আছি, অবশ্যই, টোপা, এবং বুনো কুলে; ইলেকট্রিক, বা কারেন্ট নুন-মাখানো কাগজের ঠোঙায়, অথবা আঠা-আঠা আচারে— যার আধা-বয়াম আমি এক সিটিং-এ যে-কোনো দিন সাবড়ে দিতে পারি। ইংরেজি ভাষায় এ-সব কুলেরই নাম ‘জুজুবে’, Jujube। কী বোরিং! 

    এখন যেমন বাসন্তী শাড়ি এবং হলুদ পাঞ্জাবি একটু বেশিই ‘চলছে’, আমাদের উঠতি বয়সে হঠাৎ হিড়িক উঠেছিল পাড়ায়-পাড়ায় কুচোকাচাদের সরস্বতী পুজো করার। বছর নয় থেকে শুরু করে ১৩-১৪, পিসিদের ছেলেপুলে ধরে ভাইরাই ছিলাম গোটা চারজন, এর সঙ্গে বন্ধু, এবং তাদের ভাইয়েরা। আর যাই হোক, ‘সরস্বতী পুজো করছি’ বললে বাড়িতে মার্ক্সীয় বাবার সন্ধ্যা ছ’টার কারফিউটা একটু হলেও লাঘব হত, আর টুকটাক চাঁদাও তুলে ফেলা যেত। ১১-১২ বছর বয়সে (গুরুজন সহযোগে) পুজোর আগের রাতে বাজারে গিয়ে লিস্টি ধরে পুজোর সামগ্রী, ‘মন্ডপ’ (মানে কারো বাড়ির গ্যারেজ) সাজানোর সরঞ্জাম, ফুল থেকে কুল কেনার একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ আছে, আছে পরের দিন শাড়ি-পরা, অন্যরকম দেখতে লাগা রুম্পা-লায়লির অবাক চোখে আমাদের সেই পুজো দেখা (‘এই সব কিছু তোরা করেছিস?’)। সরস্বতী-বাসন্তী শাড়ি-প্রেম-টেমের মাঝে দু-একটা টোপা, মায় নারকোল কুলও, আমি চেখে দেখেছি, পরীক্ষার নম্বরে খুব একটা এফেক্ট হয়েনি।             

    এখন সময়টা দুমদাম বদলে গেল আর তাতে কোভিড এসে তো দুর্ভাগ্যের ষোলোকলা। আমাদের ছেলেমেয়েরা নিতান্ত হতভাগ্য যে মাঠ-ঘাটের, গ্যারেজের, প্যান্ডেলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। একে তো ভিডিও-গেমের রমরমা, তার উপরে অতিমারী এসে মাঠে-বনে-বাদাড়ে দল বেঁধে খেলার বিপক্ষে একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

    গাছ থেকে কুল, পেয়ারা পেড়ে খাওয়ার যে আনন্দ তা মল-এর প্লাস্টিক মোড়া, স্টিকার লাগানো ফল খেয়ে ছেলেপুলেরা আর কী-ই বা বুঝবে! বছরে দু-বার চাকুলিয়ায় জেঠুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার নিয়ম ছিল আমাদের। আনন্দের হাট। বড়, টানা দালানের একতলা বাড়ি, টানা লম্বা ছাদ যেখানে ওঠার কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই, এবং বাড়ির বাইরে দু-পা বাড়ালেই বিশাল মাঠ, যার একধারে জঙ্গল, যেখানে একটা-দুটো নয়, বেশ কিছু বুনো কুলের গাছ। রীতিমত পরিশ্রম করে, গাছের গায়ের এবং ডালের কাঁটা বাঁচিয়ে সেই কুল পেড়ে, তাকে কাসুন্দি-বিটনুনে মেখে ছোটদের নিজস্ব মিনি-পিকনিকের প্রধান আকর্ষণ হিসাবে পেশ করায় যে আনন্দ ছিল, তা সুবর্ণরেখার তীরে, টিলার উপর এলাহি খাবারের চড়ুইভাতিকেও যেন হার মানাতো।   

    শীতকাল এসে গেলেই আমাদের পৈতৃক বাড়ির ছাদে দুটি বস্তু প্রায় সারাদিন চোখে পড়ত— এক রাশ বিছানো মাদুর, আর তার উপর বয়াম-ভর্তি, দুপুর-রোদে জারানো আচার, যার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল টোপাকুলের রকমফের, কিছু কাঁচা আমের, কখনও বা পাতিলেবুর। ঢাকা বিক্রমপুর-জাত আমার পিতামহী টক-মিষ্টি আচার বানাতেই পছন্দ করতেন, প্রধানত দুই ধরনের— গুড় সহযোগে একটু ঝোলা-ঝোলা, চাটনির মতো, আর একটা একটু বেশি মিষ্টি এক রকমের আচার। এ ছাড়াও একটা আচার তৈরি হত যা টক-ঝাল, মাখা-মাখা, একটু বাজখাঁই ধরনের। এই শেষের জিনিসটা থেকে আমাকে সরিয়ে রাখা ভার হত; পরবর্তীকালে ইস্কুলের বাইরে পসরা সাজিয়ে দাঁড়ানো বুড়োদার আচারে এই একই স্বাদ পেয়ে আমি প্রায় রোজকার খদ্দের হয়ে উঠি।       

    রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রোববারের বাজার’ বইতে যে ‘বন্ধু’, ‘সহজিয়াদা’ বা ‘চাচাজি’ নামের কুলওয়ালা বা কুল-কাকুদের কথা লিখেছেন, পাঠভবন হাই-স্কুলের বাইরে সকাল-বিকেল ছুটির সময় দাঁড়ানো বুড়োদা তাঁদের চেয়ে খুব আলাদা ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। বুড়োদা বুড়োই ছিলেন; একমাথা পাকা চুল, তেলচিটে শার্ট-প্যান্ট, পান-খাওয়া লাল বড়-বড় ফাঁকের দাঁত। চোখে একটা ঘোলাটে চশমা সত্ত্বেও, এক ঝাঁক ছোট-মাঝারি-একটু বড়, ইস্কুল শেষের ছেলেমেয়ের মধ্যে কার আলুকাবলি চাই, কার আমসি, কার মাখা কুল, কার আচার, সে-দিকে চোখ-কান তীক্ষ্ণ। বালিগঞ্জ প্লেসের ইস্কুলের বাইরে বেতের ডুগডুগির উপরে বসানো একটা বড় কাঠের ট্রে-তে বুড়োদার স্বর্গীয় পসরা, সে-ইস্কুলের প্রায় সব ছেলেমেয়েই– ক্লাস ফাইভ থেকে টুয়েলভে পড়াকালীন– কোনও না কোনও সময়ে চেখে দেখেছে। আচার-আমসি-হজমি-পেপারমিন্ট সিগারেট প্লাস আলুকাবলি তো বটেই, বুড়োদার বয়াম-ভর্তি বুনো কুল আর টোপাকুলের আচারের অদম্য আকর্ষণ শুধু ইস্কুল-পড়ুয়া ছেলেমেয়ে নয়, রীতিমতো প্রাপ্তবয়স্কদেরও ওই ডুগডুগি অবধি টেনে আনত। 

    এই ঘটনাটার একটা উপসংহারও আছে। কুলের ঝালনুনে মাদকদ্রব্য মেশানোর গুজবটা কোনও কারণে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কানে ওঠে, এবং কিছুদিনের জন্য বুড়োদার ইস্কুলের বাইরে দাঁড়ানো নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তারপর একদিন, ইস্কুলেই অঙ্ক স্যারের টিউশন সেরে একটু দেরি করে বাড়ি ফেরার পথে দেখা যায়, ঘাড়-অবধি ছোট চুলের, ছোট্টখাট্টো কিন্তু বেজায় ডানপিটে চেহারার পিটি টিচার মেনকাদি ইস্কুলের উল্টোদিকের গলিতে বুড়োদার ডুগডুগির সামনে একাই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তারিয়ে-তারিয়ে আচার খাচ্ছেন, এবং আমাদের দেখেই চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, ‘নো প্রবলেম! নো প্রবলেম!’

    কালো, একটু মুশকো, মোটামুটি ক্লাস সেভেন থেকেই বডিবিল্ডিং নিয়ে মেতে থাকা (এবং এই সব করতে গিয়ে যথারীতি পড়াশোনা গোল্লায় দেওয়া), দৃশ্যত সুপুরুষ নয় এমন দেখতে অমিতাভ দেওয়ান ক্যারাটে করত, এবং তারই ক্লাসমেট সহেলীকে ভালবাসত। সহেলী অসামান্যা সুন্দরী না হলেও, মিষ্টি দেখতে, এবং একটু টমবয় গোছের। দেওয়ান সম্ভবত সারা স্কুলজীবন ভেবে গেছিল ঠিক কীভাবে সহেলীর থেকে একটু পাত্তা পাওয়া যায়। এই চক্করে তার ‘বন্ধু’রা (আমিও তাদের মধ্যে একজন) তাকে একবার হাওড়া থেকে গড়িয়া কালো গোলাপের খোঁজে পাঠিয়েছিল। যাই হোক, সহপাঠী হলেও সহেলী যখন এক সময়ে দেওয়ানের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয় না, অত্যন্ত ফাজিল শান্তনু চন্দ অমিতাভকে বোঝায় যে এর একমাত্র সমাধান হল বুড়োদার মাখা কুল। এই অদম্য আকর্ষণের একটা ছোট্ট ব্যাকগ্রাউন্ড আছে এবং তা হল বুড়োদা যে ঝালনুনটা দিয়ে রুল মাখত, তাতে ড্রাগস মেশানো থাকত নাকি! উদ্দেশ্যটা ছিল এ রকম যে, প্রথমে সহেলীকে নেশাটা ধরিয়ে দেওয়া হবে, তারপর দেওয়ান যা বলবে, সহেলী শুনতে বাধ্য। এরপর, ভালোবাসার প্রমাণ হিসাবে, দেওয়ানই সহেলীকে নেশাটা থেকে আস্তে-আস্তে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসবে। 

    এ-সব শুনে দেওয়ান প্রায় কুড়ি টাকার কুলমাখা কেনে। কিছু আমরা খাই, কিছু সহেলীর সহেলীরা। দেওয়ান আর কোনোদিন শান্তনুদের সঙ্গে কথা বলেনি, তবে শুনেছি বহু বছর পরে, কলেজ-জীবনে একবার রাজনৈতিক বিবাদের দোহাই দিয়ে শান্তনুকে দু-চার ঘা ক্যারাটে চপ বসিয়েছিল, যাতে বোধহয় শান্তনুর হাত-টাত ভেঙে যায়। 

    এই ঘটনাটার একটা উপসংহারও আছে। কুলের ঝালনুনে মাদকদ্রব্য মেশানোর গুজবটা কোনও কারণে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কানে ওঠে, এবং কিছুদিনের জন্য বুড়োদার ইস্কুলের বাইরে দাঁড়ানো নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তারপর একদিন, ইস্কুলেই অঙ্ক স্যারের টিউশন সেরে একটু দেরি করে বাড়ি ফেরার পথে দেখা যায়, ঘাড়-অবধি ছোট চুলের, ছোট্টখাট্টো কিন্তু বেজায় ডানপিটে চেহারার পিটি টিচার মেনকাদি ইস্কুলের উল্টোদিকের গলিতে বুড়োদার ডুগডুগির সামনে একাই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তারিয়ে-তারিয়ে আচার খাচ্ছেন, এবং আমাদের দেখেই চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, ‘নো প্রবলেম! নো প্রবলেম!’; অর্থাৎ কুল-আচার-আমসি, কোনোটাতেই কোনও দোষ নেই। অল ক্লিয়ার!   

    থার্ড ওয়েভের শেষ বেলায় এসে বন্ধু-সহজিয়াদা-চাচাজি-বুড়োদাদের কথা খুব মনে হচ্ছে। এই লেখাটার জন্যেই কাল ক্যামেরা হাতে মহানন্দে বেরিয়ে পড়েছিলাম, নিজের ইস্কুলের সামনেই এতদিন পর আবার ইস্কুল খোলার ছবি এবং সঙ্গে কুলওয়ালা-ফিরিওয়ালাদের ছবি তুলবো বলে। ছবিটা তোলা গেল না, কেননা ইস্কুল ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখেও খোলেনি। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook