ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • বাজার সরকার

    জয়ন্ত সেনগুপ্ত (February 14, 2021)
     

    আমার প্রথম বাজার করার অভিজ্ঞতা বছর আটেক বয়সে, যখন শখ করে একদিন আমাদের মফস্‌সল শহরের বাসা থেকে বাবার সঙ্গে মাইল দুয়েক হেঁটে গেলাম রবিবারের বাজার। বাবার হাতে একটা মাঝারি সাইজের থলি শাকসবজির জন্য, আর মাছের জন্য একটা ছোট সাইজের। নিম্নবিত্তের ঘরে ফ্রিজ তো দূরস্থান一 কয়লা, ঘুঁটে, গুল সহযোগে উনুন, নিজের মাছ নিজে কেটে রান্না করে সারাদিনের জন্য মিটসেফে রেখে রাত্তিরে কেরোসিনের স্টোভে গরম করে নেওয়া। বাবার সঙ্গে গিয়ে সে-বার দেখেছিলাম, টুকটাক বাজার করা হচ্ছে বটে, কিন্তু দোকানি-মেছুনি-প্রতিবেশী-সহকর্মী মুখচেনা হাজার লোকের সঙ্গে ভ্যানতারা টাইপের কথাবার্তা হচ্ছে অনেক বেশি। আস্তে আস্তে বুঝি, দেশের বাজারে সামাজিকতার পরিসর অনেক বেশি, তাই ‘লেনদেন’-এর চেহারা সেখানে অন্য রকম। পশ্চিমি দুনিয়ার পেল্লায় সাইজের সুপার মার্কেটে এই খুচরো আড্ডা মারার সুযোগ কোথায়一 সেখানে তো কাউন্টারে বারকোড স্ক্যানিং-এর বিরামহীন পিঁপ-পিঁপ ছাড়া কোনও আওয়াজই নেই। তাই দেশের বাজারে ঘুরে ঘুরে এক বিমিশ্র জীবনের ধারাপাত লক্ষ করি, কথাবার্তাও বলতে চেষ্টা করি দু’চারটে। না হলে ভুগতে হয়, সে কথা জানি ছেলেবেলা থেকেই। ক্লাস সিক্স না সেভেনে পড়ার সময় দু’দিন ধরে বাবার জ্বর, অগত্যা আমিই বাজারে গেলাম মাছ কিনতে, বাবার পইপই করে বলে দেওয়া খগেন মাছওয়ালার কাছ থেকে কাতলাও বাড়ি এল, কিন্তু ভাজার সময়ে হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ল ঈষৎ পচা গন্ধ। পরের দিন বাবার কথামতো নালিশ করায় খগেন বিস্তর ধমক দিল আমাকে, কেন আগের দিন বলিনি আমি অমুকবাবুর ছেলে? সত্যিই তো, পিতৃপরিচয়হীন, নির্বাক এক বালকের ভাগ্যে পচা মাছ ছাড়া আর কী-ই বা জোটার কথা?

    এই সোশ্যাল ক্যাপিটালের গুরুত্ব শুধু ছোট মফস্‌সল শহরেই মালুম হয়নি, পরে কলকাতাতেও দেখেছি তার দাপট। অনেক সংগ্রামের সৈনিক শরণার্থীদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিজয়গড় বাজারে যেমন বরিশাল বা ফরিদপুরের ‘বাঙাল’ অ্যাকসেন্ট জানা থাকলে মাছের বাজারে একটু বাড়তি সুবিধে পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কী, দাপুটে মাছওয়ালাদের গুমোরই আলাদা। পাড়ার ফুটপাথের এক পরাক্রান্ত মৎস্যবিক্রেতাকেও দেখেছি প্রায় প্রত্যেক ক্রেতাকেই উইলস নেভিকাট সিগারেট অফার করতে। জ্বলন্ত সিগারেট মুখে, ‘আরে মাছ তো নয়, চম্পাহাটির নারকোল’ বলতে বলতে তিন কিলো সাইজের কাতলার ধড়মুড়ো এক ভীষণাকৃতি আঁশবঁটিতে অবলীলায় আলাদা করে দেওয়া ছিল তার বিশেষত্ব। বেশ কিছু বছর আগে একবার এক অচেনা ভদ্রমহিলা ষাট টাকা কিলোর মাছ চল্লিশ টাকা দর দিতে চাইলে, সে এক হিমশীতল ঔদাসীন্যে ধোঁয়ার রিং ছাড়তে ছাড়তে বলে, ‘দিদি, ডাল আছে বাড়িতে? ধরুন সোনামুগ? আজকে একটু মুগডাল আর আলুসেদ্ধ দিয়ে চালিয়ে নিন, কালকে চল্লিশ টাকার মাছ আসতেও পারে।’ ভদ্রমহিলার করুণ নিষ্ক্রমণ মনে গেঁথে আছে। তবে এ সবই হল পরাক্রান্ত ও প্যাট্রিয়ার্কাল মাছওয়ালাদের কথা, কলকাতার বাজারে সেই গোত্রের মধ্যে মহিলাদের দেখতে পাবেন না প্রায়, তাঁরা বসেন বঁটি আর এক বাটি ছাই নিয়ে মাছ কাটতে, অথবা মূল বাজারের প্রান্তে থোড়-মোচা-কচুর শাক, আরও হরেক রকম লতা পাতা শাক নিয়ে। ভোর তিনটে বাহান্নর লোকাল ধরে শহরে এসে বিবিধ প্রাকৃতিক বেগের টুঁটি টিপে সবজি বিক্রি করে দৈনিক শ-দেড়েক টাকা আর বিকোলাই-ইকোলাই ইনফেকশন অর্জন করেন যে মধ্য- ও বৃদ্ধবয়সি মাসিরা, তাঁদের সঙ্গেই নির্মম দরাদরি করে দু’চারটে জিনিস কিনি আমরা। তবে, পুরীর মন্দিরের অনতিদূরে বিখ্যাত মাছের বাজারের অবিসংবাদী মালকিন মহিলারা, কারণ পুরুষরা সারা রাত মাছ ধরেন, সাতসকালে বাজারে বসা তাঁদের পোষায় না। ললনাশ্রিত সেই মাছের বাজারের মৎস্যকন্যাদের ছবি একবার তুলতে গেলে তাঁরা হুমদো সাইজের রুই-ভেটকি আমার দিকে তাক করে উঁচিয়ে ধরে হেসে গড়িয়ে পড়েছিলেন, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে সুকঠিন ও কোলাহলমুখর সেই জীবনপ্রবাহের মধ্যে দাঁড়িয়ে ফঙ্গবেনে টাইপের ক্যামেরা নিয়ে ও-সব মেনিমুখো ইয়ার্কি এখানে চলবে না। 

    ভোর তিনটে বাহান্নর লোকাল ধরে শহরে এসে বিবিধ প্রাকৃতিক বেগের টুঁটি টিপে সবজি বিক্রি করে দৈনিক শ-দেড়েক টাকা আর বিকোলাই-ইকোলাই ইনফেকশন অর্জন করেন যে মধ্য ও বৃদ্ধবয়সি মাসিরা, তাঁদের সঙ্গেই নির্মম দরাদরি করে দু-চারটে জিনিস কিনি আমরা।

    আমার প্রাক্তন সহকর্মী, পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আমেরিকায় প্রবাসী এক রসায়নের অধ্যাপক, দু’তিন বছর অন্তর কলকাতায় তাঁদের সাউথ সিটির ফ্ল্যাটে আসতেন। একদিন তাঁর প্রিয় লুঙ্গি আর ফতুয়াটি পরে তিনি যোধপুর পার্ক বাজারে গেলেন, বৃহৎ সাইজের বাগদা চিংড়ি দেখে দাম জিজ্ঞেস করায়, মৎস্যবিক্রেতা তাঁকে আড়চোখে জরিপ করে বলেছিল, ‘ও অনেক দাম, আপনি কিনতে পারবেন না।’ পাশেই সুবিন্যস্ত রাখা ছিল ধড়হীন গলদা চিংড়ির পেল্লায় সাইজের মাথাগুলি শুধু, দাদা সবিস্ময়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এ কী, মাছের বডি কোথায়?’ দোকানি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, ‘বডি ফরেনে এক্সপোট হয়ে গেছে।’ কোথায় ‘এক্সপোট’ হয়েছে, এই প্রশ্নের উত্তরে দাদা শুনলেন এক জলদগম্ভীর ঘোষণা一 ‘আমেরিকায়’। ওই দেশটির আসল মাহাত্ম্য বোঝার জন্য নিরভিমান দাদাটিকে পাড়ি দিতে হয়েছিল ‘প্রবাস’ থেকে ‘স্বদেশ’-এর কয়েক হাজার মাইল দীর্ঘ পথ।

    তিরিশ বছরেরও বেশি নিয়মিত বাজার করতে করতে লক্ষ করেছি, আমাদের এই একদা-দৈনন্দিন অভ্যাসটির হরেক বদল। মাছ কাটার ‘সার্ভিস’ না থাকায়, উনুন জ্বালিয়ে খানিক ছাই জমিয়ে বাড়িতে রোজকার মাছ আর অন্যান্য কুটনো কুটে অফিসের ভাত ধরিয়ে দেওয়া一 কখনও কই-মাগুর-শিঙি মাছের কাঁটার আঘাতে যন্ত্রণায় ছটফট করা ছিল গৃহিণীদের প্রাত্যহিক ভবিতব্য। কয়লার উনুনের পরিবর্তে গ্যাসের আভেনে রান্নার প্রচলনের প্রায় এক সঙ্গেই ফ্রিজ বাঙালির ঘরে ঘরে ঠাঁই পেতে শুরু করায়, বাজারের অভ্যাস প্রথমে দু’তিন দিন পর পর, তার পর সাপ্তাহিক, অবশেষে পাক্ষিক বা তারও বেশি এক বিলম্বিত অভ্যাসে পরিণত হতে শুরু করে। মাসমাইনে হাতে পেয়েই বড় মনোহারি দোকান থেকে বড় করে মাসকাবারি বাজারের চল কমতে শুরু করল তার পর-পরই। আর গত এক বছরে অতিমারীর প্রকোপ আমাদের বাজারু স্বভাবকে টেনে বসাল অনলাইন মুদিখানা আর কাঁচা বাজারের দোরগোড়ায়। ভার্চুয়াল শপিং বাস্কেটে আগেভাগে রেখে দিন চাল-ডাল-তেল-নুন থেকে শুরু করে রকমারি আনাজ বা শাকপাতা, মায় গাং-মৌরলা বা ধুয়ে-কেটে সাফসুতরো করা কাঁকড়া অব্দি, যাতে সকাল-সকাল উঠে ডেলিভারি স্লট ফাঁকা পেলেই ঝাঁ করে অর্ডার দিয়ে তার পরে সকালের চায়ে চুমুক দেওয়া যায়। করোনাতঙ্কের দুনিয়াজোড়া কাঁপুনির মধ্যেও রোজ সকালে দেখতাম, মলিন মুখের বেশ কিছু যুবক বিবর্ণ বাইকে করে বড় বড় ব্যাগ নিঃশব্দে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির সামনে, যাতে আমরা বাজারে না গিয়েও বেঁচেবর্তে এবং রসেবশে নিজেদের রাখতে পারি ঘরের ভিতরে। ওঁদের বাড়ির জন্য, পরিবারের জন্য বাজার কে করে, সে চিন্তা খুব একটা মাথায় আসেনি। এই দুনিয়ায় সেটাই ভবিতব্য। আমরা আমাজনের বনসম্পদ বাঁচানোর জন্য হাঁটব, চেঁচাব, হ্যাশট্যাগে হামলে পড়ব, আর অন্য এক আমাজন এক মদালস বোয়া কন্সট্রিক্টরের মতো আস্তে আস্তে গিলে খাবে আমাদের সমস্ত হাটবাজার। অনলাইন শপিং বাস্কেটের দিকে তাকিয়ে ক্রেডিট কার্ডের পিন নম্বর বসাতে বসাতেও দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবি, না-চাইতেই ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’-র এই দেদার মোচ্ছবের মাঝে, ফুটপাথের মাসিদের সঙ্গে পিড়িং শাকের দর নিয়ে হিংস্র দরাদরির ওই নির্মল আনন্দটুকু তা হলে আর পাব কোথায়?

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook