ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • মশগুল : পর্ব ২

    বরুণ চন্দ (January 25, 2025)
     

    রোববারের আড্ডা ও মানিকদা

    সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্কে সাধারণভাবে মানুষের ধারণা, তিনি সকলের সঙ্গে কথা বলতেন না, খানিক ‘অ্যালুফ’, গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সেকথা আপাতদৃ্ষ্টিতে সত্যিই। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটো বিষয় কাজ করত। এক, উনি নিজের একটা বর্ম তৈরি করে রাখতেন, সকলের সঙ্গে সব বিষয়ে কথা বলতে চাইতেন না। দ্বিতীয়ত, স্বভাবগতভাবে সত্যজিৎ রায় ছিলেন কিছুটা লাজুক। অনেকেই হয়তো জানেন একথা, ওঁরই লেখা থেকে, স্কুলে থাকতে পুরস্কার বিতরণের দিন উনি যেতেন না। যদি পুরস্কার পান, তবে তো সেই পুরস্কার গ্রহণ করতে যেতে হবে, এবং সকলের সামনে কিছু না-কিছু বলতে হবে! এই দুই কারণেই ওঁর এই রাশভারী ইমেজটা তৈরি হয়েছিল হয়তো। কিন্তু, মনের মতো মানুষ পেলে তিনি কথা বলতে ভালওবাসতেন।

    ওঁর বাড়িতে রোববার সকালে বসত আড্ডাটা। সেই আড্ডা নিয়ম করে, সকাল দশটা-সাড়ে দশটায় শুরু হত, শেষ হত একটা-দেড়টায়। সকাল সকাল স্নান সেরে নিতেন, আর ওই একটা-দেড়টার পর ছিল ওঁর মধ্যাহ্নভোজের সময়। কিন্তু এই নির্ধারিত সময় ছাড়াও ওঁর কাছে কিন্তু লোকজন আসত, সন্ধেবেলাতেও কখনও কখনও। তবে, তাঁদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া থাকত। তখনও অনেক বিদগ্ধ মানুষ আসতেন। সমান বুদ্ধিমত্তার লোক পেলে কিন্তু সত্যজিৎ রায় মন খুলেই কথা বলতেন।

    আরও পড়ুন : গানে আড্ডা মাতিয়ে রাখতেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়,
    হিরণ মিত্রর কলমে পড়ুন মশগুল : পর্ব ১

    রোববার দিনটা ছিল সত্যজিৎ রায়ের আয়েসের দিন। রোববার প্রায় কাজ করতেনই না। অন্যান্য দিন আড্ডা বা কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকেই স্কেচ কিন্তু করে যেতেনই। অলসভাবে বসে থাকতে প্রায় দেখা যেতই না। তাই রোববারটা নিজেকে একটু ছেড়ে রাখতেন মানিকদা। ওঁর কিছু কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল, যাঁদের উপস্থিতি আড্ডায় হয়তো সেভাবে নিয়মিত ছিল না, কিন্তু তাঁরা আসতেন। যেমন আর পি গুপ্ত, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ওরফে শাঁটুলবাবু। কফিহাউজ, ফিল্ম সোসাইটির বন্ধুরাও ছিলেন। ক্ল্যারিয়নের পুরনো বন্ধুরাও ছিলেন। এখনই মনে পড়ছে যেমন ইন্দুভূষণ দাশগুপ্তর কথা। ইন্দুভূষণবাবু ছিলেন মানিকদার কিছুটা সিনিয়র। মনে আছে, ‘মানিক’ নামেই উনি ডাকতেন ওঁকে। একসঙ্গে অনেক বছর কাজ করেছিলেন ওঁরা। ঝড়-জল-বৃষ্টি যা-ই হোক, ইন্দুভূষণবাবু আসতেনই। পৃথিবী রসাতলে না গেলে মানিকদার রোববারের আড্ডায় ওঁকে দেখা যাবেই! বয়স হয়ে গিয়েছিল তখন, খানিক ঝিমুনি আসত। তৎক্ষণাৎ হয়তো আড্ডায় কোনও হাসির রোল উঠেছে, উনি ঝিমুনি কাটিয়ে তাতে শামিল হতেন। মানিকদা সেটা খেয়ালও করতেন। বাকিরাও দেখতেন। কিন্তু কেউ কোনওদিন হাসিঠাট্টা করেনি তাই নিয়ে। মানিকদারও ওঁর প্রতি একটা হালকা প্রশ্রয় ছিল। সমীহও করতেন খুবই।

    আড্ডায় সত্যজিৎ রায় ছিলেন একেবারে অন্য মানুষ

    অমল ঘোষ মাঝেমধ্যে আসতেন মনে পড়ে। কোনও কোনওদিন হয়তো সৌমিত্রদা (চট্টোপাধ্যায়) আসতেন, কোনওদিন রবি ঘোষ, কামুদা (মুখোপাধ্যায়) হাজির হতেন। একবার মনে আছে, বসন্ত চৌধুরী এসে ওঁর সেই বিখ্যাত স্ট্যাম্প এবং কয়েনের কালেকশন দেখাচ্ছিলেন মানিকদাকে। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা! রোববার কেউ না কেউ আসতেনই। প্রোডাকশনের লোকজন, ওঁর সহকারীরাও আসতেন। সৌমেন্দু রায় আসতেন মাঝেমধ্যেই, মনে আছে। সাত-আট জন হয়ে যেত কোনওদিন, কোনওদিন হয়তো দশ-বারো জন। যেদিন যেদিন কামুদা আর রবিদা একসঙ্গে থাকতেন, সেদিন আড্ডায় হাসির রোল উঠত, মানিকদারও হাসি বাঁধ মানত না। ওঁর একটা অভ্যাস ছিল। গরদের, সম্ভবত অহমিয়া, মটকাজাতীয়, সিল্কের কাজ করা, একটি চাদর ছিল ওঁর। সেটার খুঁটটি মুখে ধরে মানিকদা হাসতেন কোনও মজার কথা হলেই। হাসতে হাসতে কখনও কখনও চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। অমন গুরুগম্ভীর মানিকদা হো হো করে হাসতেন, শিশুসুলভ ভঙ্গিতে, ওই দৃশ্য কিন্তু রোববারই দেখা যেত।

    মনে পড়ছে যেমন ইন্দুভূষণ দাশগুপ্তর কথা। ইন্দুভূষণবাবু ছিলেন মানিকদার কিছুটা সিনিয়র। মনে আছে, ‘মানিক’ নামেই উনি ডাকতেন ওঁকে। একসঙ্গে অনেক বছর কাজ করেছিলেন ওঁরা। ঝড়-জল-বৃষ্টি যা-ই হোক, ইন্দুভূষণবাবু আসতেনই।

    মানিকদা সকলকেই যে ঠিক ‘বন্ধু’ মনে করতেন, তা কিন্তু নয়। আমার একটি আশ্চর্য স্মৃতি আছে। একদিন সন্ধেবেলায়, দিল্লির এক প্রখ্যাত বাঙালি সাংবাদিক এসেছেন মানিকদার বাড়িতে। আমিও গিয়েছি সেদিন। ওঁরাই মূলত কথা বলছিলেন, আমি শুনছিলাম। হঠাৎই মানিকদা আমাকে আলাপ করিয়ে দিলেন সেই সাংবাদিকের সঙ্গে, ‘আমার বন্ধু বরুণ চন্দ’ বলে। সেই সাংবাদিক চলে যাওয়ার পরেই আমি প্রশ্ন করলাম, ‘আমাকে বন্ধু বলে পরিচয় করালেন মানিকদা?’ তাতে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বয়স কম বলে কি বন্ধু হতে পারো না?’

    সীমাবদ্ধ’-র শুটিংয়ে

    ‘সীমাবদ্ধ’-র অনেকটা আগে থেকেই আমার ওঁর বাড়িতে যাতায়াত। প্রথম আলাপ একটি সাক্ষাৎকারের সূত্রে। সেসব ঘটনা আমার ‘সত্যজিৎ রায়: দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’-এ লেখা রয়েছে। আমার ধারণা, তখন থেকেই আমাকে নিয়ে ওঁর ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছিল। যাঁকে দিয়ে অভিনয় করাতে চাইতেন, তাঁর কথাবার্তার স্টাইল, ম্যানারিজম খুব মন দিয়ে, নীরবে লক্ষ করতেন। পরবর্তীতে বুঝেছি, সেজন্যই রোববারের আড্ডায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রথমে। এর শুরুটাও মনে আছে। এক সোমবার ক্ল্যারিয়নের স্টুডিওয় ইন্দুভূষণবাবুর সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল গতকাল মানিকদার বাড়ির আড্ডায়?’ ওঁর বাড়ির ওই আড্ডা নিয়ে তখন অনেকেরই কৌতূহল। আমারও ছিল। ইন্দুভূষণবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমাকে কিন্তু খাওয়াতে হবে!’ আমি আরও কৌতূহলী হলাম। ইন্দুভূষণবাবু বললেন, ‘কাল মানিকদা বললেন, বরুণ নামে একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। বেশ চটপটে! স্মার্ট।’ কামুদা নাকি তখন বলেছিলেন, খানিক রসিকতা করেই, ‘ওরম অনেক দেখেছি। খুব সপ্রতিভ, কিন্তু ক্যামেরার সামনে পড়লেই হয়ে গেল!’ মানিকদা নাকি বলেছিলেন, ‘ওঁকে চেনো না! তাই এরকম বোলো না।’ ওই একবারই বোধহয় মানিকদা কামুদার রসিকতাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করেননি। ইন্দুভূষণবাবু আমাকে এই ঘটনা জানিয়ে বললেন, ‘তোমার হবে!’

    এরপর একদিন হঠাৎই ফোনে বললেন, ‘রবিবার সকালগুলো কী করো?’ আমি বললাম, ‘তেমন কিছুই না!’ বললেন, ‘আসো না কেন? চলে এসো!’ এইভাবেই শুরু!

    ওই আড্ডায় সিনেমার কথা বিশেষ হত না। মানিকদার ক্যানভাসটা তো অনেকটা বড় ছিল। ওঁর আগ্রহের বিষয় ছিল বিচিত্র। ফলে, কথা নানাদিকে যেত। কামুদা এলে নানা শুটিংয়ের মজার গল্প বলতেন। হয়তো আউটডোর শুটিংয়ে গিয়ে যাঁর পাশে শুয়েছেন, তাঁর কাশির শব্দে ঘুম হয়নি। তাঁর কাশির আওয়াজ খড়কাটা কলের মতো। সেই আওয়াজ নকল করেও দেখাতে পারতেন! আর মানিকদার হাসি আর ধরত না।

    শেষের দিকে, মূলত ‘ঘরে বাইরে’-র পর থেকে কমিয়ে দিয়েছিলাম যাওয়া। বুঝতে পারছিলাম, আস্তে আস্তে ওঁর দুর্বলতা বাড়ছে। ভেতরে ভেতরে তখন ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছেন শারীরিকভাবে। প্রথমে হার্ট. তারপর কিডনি— পরপর আক্রান্ত হল। মনে আছে, একদিন গিয়েছি ওঁর বাড়ি। আর কেউ নেই। বসে বসে খানিক তন্দ্রাতেই চলে গিয়েছিলেন। আমাকে দেখে চমকে উঠলেন প্রায়। তারপর বসতে বললেন। বুঝেছিলাম সেদিন, ওঁর শরীর আর দিচ্ছে না। মনটা ভয়ংকর খারাপ হয়ে গেল। এমন একটা ঋজু লোক, যেন কেমন সংকুচিত হয়ে গেলেন। কথায়-বার্তায় যে ধার ছিল, সেটাও কমে আসছিল। চোখের ওপর এটা দেখা যাচ্ছিল না। আমার নায়ক এরকম হয়ে গেলেন! ভেবেই বিষণ্ণ হয়ে গেলাম।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook