ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছায়াবাজি : পর্ব ৩৩


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (December 10, 2024)
     

    সাড়ে তেত্রিশ

    কিছু কিছু মিউজিকাল সিনেমা হয়, যেখানে চরিত্রেরা যখন-তখন গান ধরে, কথাগুলোই যেন আচমকা গান হয়ে গেছে, লাইনগুলো অন্ত্যমিল ছন্দ বা কাব্যের ধার ধারে না, এমনকী সুরেলা গলায় তা গাওয়া হচ্ছে কি না তারও তোয়াক্কা করা হয় না, যেন যে-কোনও চরিত্র কম্পিউটারে টাইপ করতে-করতে বা বেসিনে মুখ ধুতে-ধুতে কিংবা আলুপটল কিনতে-কিনতে গান গেয়ে উঠতেই পারে আবার ইচ্ছেমতো হট করে থেমেও যেতে পারে। তার পাশে বা পিছনে একটা ভিড় নাচতেও পারে, আবার না-ও পারে, এমনকী কিছু লাইনে নাচছে আর কিছু লাইনে নাচছে না— তাও হতে পারে। গান ফিসফিস করে গাওয়া যায়, গুনগুন করে গাওয়া যায়, চিৎকার করে অঙ্গভঙ্গি করেও গাওয়া যায়। বাজনার সঙ্গে গাওয়া যায়, না-বাজলেও ক্ষতি কী? সাজানো-গোছানো ঘটাপটা করা গানঋদ্ধ ছবির চেয়ে এই গোছের ছবি কখনও বেশি উত্তেজকও লাগতে পারে। ফরাসি ছবি ‘এমিলিয়া পেরেজ’ (চিত্রনাট্য, পরিচালনা: জাক অডিয়া, ২০২৪) এই ধরনেরই মিউজিকাল। হুটহাট গান ধরাধরিতে আামাদের গোড়ায় চমক জাগে, আর তারপর কাহিনিতে এতগুলো মোচড় দেওয়া হয়, আমরা ক্রমাগত অবাক হই, এবং মানতেই হবে, ইদানীং সিনেমা দেখতে গিয়ে বিস্মিত হওয়ার অভ্যাস কমে এসেছে, কারণ মোটামুটি সবরকম আখ্যান ও আঁকবাঁক আমাদের জানা। একমাত্র ভয়ানক ঘোরালো কল্পবিজ্ঞানমূলক ওয়েব-সিরিজের প্লট ছাড়া আমরা সবই দেখেমেখে গিলে-চিবিয়ে ও ঢেকুর তুলে হজম করে ফেলেছি, চলচ্চিত্র ও তার তুতো-ভাইদের নাগাড়ে গণ-ভোজনের ফলে আমরা যা-ই দেখি মনে হয় ‘ওঃ, এটা তো ওইটার মতো’, বা ‘এখানে তো ক ও খ গুলে দিয়েছে, অংশ-গ নিয়েছে।’

    সেই ময়দানে সিনেমা বানিয়ে মানুষকে টানা অপ্রত্যাশিতের গত্তে ফেলা চাট্টিখানি কথা না। কিন্তু মুশকিল হল, একটা ছবি শুধু স্টাইলের ও দড়াম-ঘটনার চমকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, যদি না সেটা আধঘণ্টার ছবি হয়। এর বেশি হলে, মানুষ প্রাথমিক বিস্ময়ের হাঁ না-বুজেই প্রশ্ন শুরু করবে: তাতে কী হল? চমকগুলো যদি চরিত্রকে বা গল্পকে কোথাও আকর্ষণীয় না-করে তুলে শুধু দর্শকের মগজটাকে ক্রমাগত গুলিয়ে দেয়, তখন তার মূলত সুঠাম-গল্পলোভী মনটা বিদ্রোহ করে। পাশাপাশি যদি দর্শনের জোগানও না থাকে, তাহলে সেই চমক-সিরিজ মুখ থুবড়ে পড়বে। এই ছবি কান-এ জুরি পুরস্কার পেয়েছে বটে (এবং অভিনয়ের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন এই ছবির চার অভিনেত্রী), কিন্তু দেখেশুনে মনে হয় যেন কেউ অনেকটা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারপরে খুব কম ফসল ফলাল, রাজনীতিবিদ বা দামি রেস্তরাঁর মতো।

    প্রথমে আমরা দেখি এক মহিলা-উকিলকে (এখন সে অন্য উকিলের জুনিয়র) একটা কেস লড়তে, যেখানে সে জানেই যে মক্কেল মিথ্যে কথা বলছে। কেসটা জেতে তারা, আমরা ভাবি উকিলের বিবেক নিয়ে ছবিটা হবে। তারপরেই উকিলকে অপহরণ করে এক মাফিয়া ডন, সে একটা প্রস্তাব দেয়। ডন কী এমন প্রস্তাব দিতে পারে, যাতে আমরা স্তম্ভিত হয়ে মুচ্ছো যাব? সে কি বলে অমুক প্রতিদ্বন্দ্বীকে টাইট দেব, বা তমুক অপরাধীকে বেকসুর খালাস পাইয়ে দিতে হবে? না। সে বলে, আমি নারী হতে চাই, তুমি সব বন্দোবস্ত করে দাও। উকিল তখন কোন দেশে কোথায় সেক্স-বদল অপারেশন হয়, কত টাকা নেয়, কোন ডাক্তার তাড়াতাড়ি করে দিতে রাজি, এইসব খোঁজখবর করে, ডনের বউ আর সন্তানদের অন্যদেশে রেখে আসার বন্দোবস্ত করে, তার বিনিময়ে প্রচুর টাকা পায়। মানে, এখানে সে ইভেন্ট ম্যানেজারের কাজ করে। সংবাদমাধ্যমে রটিয়ে দেওয়া হয়, ডন মারা গেছে।

    এরপর মেয়ে-হয়ে-যাওয়া ডনের সঙ্গে উকিলের আবার দেখা হয় চার বছর পরে। ডন কেন তার সঙ্গে দেখা করে? কারণ তার ছেলেমেয়ের জন্যে খুব মন-কেমন করছে, তাই উকিলকে তাদের বুঝিয়েসুঝিয়ে এনে রাখতে হবে ফের মেক্সিকোয়, বলতে হবে তাদের এক পিসি তাদের দেখাশোনা করবে, আর পিসি সেজে তাদের সঙ্গেই জীবন কাটাবে ডন, যে এখন নারী, তারই নাম এমিলিয়া পেরেজ। তাহলে ছবিটা কী নিয়ে হবে? পূর্বাশ্রম আর সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিরোধ? পুরুষ এখন নারী হয়ে নিজের পরিচয় দিতে পারছে না অথচ নিজের পরিবারের সঙ্গেই থাকছে— তা থেকেই প্রচুর সংকট উদ্ভূত হবে? সন্তানেরা বলবে বাবার জন্যে তাদের কান্না পায়, আর বাবা-কাম-পিসি সেই জেনে চোখের জলে ভাসবে? বউ বলবে বিবাহিত জীবনের অ্যাফেয়ারের কথা, আর ননদ-কাম-স্বামী তাই শুনে ক্রোধে ভাজা-ভাজা হবে? সেসব কতকটা হয়, কিন্তু সেগুলো পেরিয়ে জুড়ে বসে এক সামাজিক সমস্যা: মেক্সিকোয় প্রতি বছর যে হাজার-হাজার অপহৃত মানুষকে মুক্তিপণ না পেয়ে খুন করা হয়, তাদের ও তাদের আকুল আত্মীয়দের দুর্দশার কাহিনি। এমিলিয়া উকিলের সাহায্যে একটা এনজিও গোছের সংস্থা খুলে বসে, যারা জেলখানায় কয়েদিদের পয়সা দিয়ে জেনে নেয় তারা কোথায় লোকগুলোকে খুন করেছিল বা মৃতদেহের টুকরোগুলো ছড়িয়ে দিয়েছিল বা গণ-কবর দিয়েছিল, তারপর সেসব মৃতদেহ বা তার অংশ খুঁজে আত্মীয়দের জানায়। ফলে প্রচুর মানুষ হারানো প্রিয়জনের খোঁজ পেতে তাদের কাছে আসে।

    একটা ছবিকে আকর্ষণীয় করার জন্য সাড়ে-তেত্রিশ-ভাজার ওপর উদ্দাম বিটনুন ছড়িয়ে দিতে হবে, এ খুব উদ্ভট সিদ্ধান্ত। অনেকগুলো স্রোত খাবলে এনে একটা ছবির মধ্যে গুঁজড়ে দিলে, সেগুলো সাধারণত গোলকধাঁধায় ঘুরতে-ঘুরতে ধাক্কাধাক্কি করে মরে। এখানেও তাই হয়েছে।

    তাহলে কি ছবি ব্যক্তিগত থেকে সহসা সমষ্টিগত ব্যাপারস্যাপারে পাড়ি দিল? অনুতপ্ত মাফিয়া-প্রধান কি নারী-শরীর পেয়ে সমবেদনা আয়ত্ত করল ও এবার প্রাক্তন-সত্তার কুকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে মানুষের বেধড়ক উপকার করবে? এই গল্প তবে আত্মশোধনের? এই সংস্থার বৃদ্ধির জন্যে যাদের কাছে টাকা চাওয়া হয়, সেই সমাজের-মাথা ধনী ক্ষমতাবানেরা যে আসলে ঠগ-জোচ্চোর মানুষবিরোধী, তা নিয়ে গানও হয়। তবে কি এই গল্প তাদের মুখোশ-উন্মোচনের? ইহা সামাজিক স্যাটায়ার? ও হরি, এর মধ্যে এমিলিয়া একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করে। তাহলে কি নারী-নারী কামারাদারির কাহিনি শুনব, যার হিড়িক এখন আর্ট ফিল্মে চলেছে? না, তাও নয়, ডনের স্ত্রীও এদিকে অন্য পুরুষের সঙ্গে প্রেম করছে এবং তার সঙ্গে ঘর বেঁধে সন্তানদের নিয়ে চলে যাবে, তা নিয়ে প্রবল বিতণ্ডা শুরু হয়। এত ঘনঘটার মধ্যে উকিলের কী কাজ? শুধু এমিলিয়ার সমস্যার সমাধানে প্রাণপাত করা। কেন সে নিজের জীবনের দিকে তাকায় না? উত্তর নেই। এরপর কী হয়? জেনে লাভ কী? ঝামেলা হয়, গোলাগুলি চলে, ক্লাইম্যাক্সে গাড়ি দুর্ঘটনাও আছে।

    একটা ছবিকে আকর্ষণীয় করার জন্য সাড়ে-তেত্রিশ-ভাজার ওপর উদ্দাম বিটনুন ছড়িয়ে দিতে হবে, এ খুব উদ্ভট সিদ্ধান্ত। অনেকগুলো স্রোত খাবলে এনে একটা ছবির মধ্যে গুঁজড়ে দিলে, সেগুলো সাধারণত গোলকধাঁধায় ঘুরতে-ঘুরতে ধাক্কাধাক্কি করে মরে। এখানেও তাই হয়েছে। গল্পকে প্রত্যাখ্যান করা যেতেই পারে, কিন্তু অতিগল্প তার একটা উপায় নয়। ছবিটায় এমনকী এমিলিয়া পেরেজের ব্যক্তিগত আবেগগুলো বোঝাবার জন্য খুব বেশি সময় বা দৃশ্য অবধি ব্যয় করা হয়নি। তাড়াহুড়ো করে আরও একটা খাতে ছবিটাকে বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। তাহলে কি ছবিটার কোনও মূল্য নেই? তা নয়। পাতি ছবির চেয়ে অনন্যতা-প্রয়াসী ছবির মূল্য বেশি, সেই নতুনতা-কামী ছবি যদি ব্যর্থ হয়, তবুও।

    একটা ঘরানা থেকে অন্য ঘরানায় টপকে-টপকে বিচরণের উৎসাহ এখন কিছু ছবিতে লক্ষ করা যাচ্ছে, এমন ছবিও আছে যা সামাজিক সমালোচনায় শুরু হয়ে মিউজিকালে ঘুরে হরর-এ থিতু, কিন্তু বহু প্রাণীকে এক গাড়িতে জুতে দেওয়ার জন্য যে গ্যালপিং-গাড়োয়ানগিরি প্রয়োজন, সে-সারথ্য সবার মধ্যে সম্ভবে না। তবু এই চেষ্টা দামি, বিশেষত সারা পৃথিবী জুড়ে শুধু মনোমুগ্ধকর গল্প বলার কর্তব্যে চলচ্ছবিকে বেঁধে রাখার যে-প্লাবন চলেছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্যই। যদি নিতান্ত সাধারণ ও ব্যবহৃত হতে হতে ছিবড়ে পিৎজা হয়ে যাওয়া কাহিনি অবলম্বন করে, অতি পাতি ধরনে পাতি সুখদুঃখের পৌষ-ফাগুনের পালা বাঁধার জন্য সিনেমা তৈরি হয়, আর তা বিশাল ফেস্টিভ্যালে খুব বড় পুরস্কার পায়, তাহলে যে-ক্ষতি হয়, তার চেয়ে এই নিরন্তর-ঝুঁকি-নেওয়া ফিল্ম পুরস্কার পেলে, তা অন্তত শিল্পটার পক্ষে মঙ্গলজনক। কারণ যদি কোনও শিল্প খুব অন্যরকম হওয়ার চেষ্টা করে, এবং তা না-পারে, তা থেকে পারুয়া শিল্পী, বা ভাবী-পারুয়া-শিল্পী, প্রেরণা ও সাহস সংগ্রহ করে নিজের সার্থক শিল্প তৈরি করতে পারেন, যা দিগন্ত সত্যিই ভাঙবে। সেই সম্ভাবনা জাগাবার জন্য কিছু নম্বর এ-ছবিকেও দিতে হবে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook