ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ৪২


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (September 23, 2024)
     

    সোদপুর থেকে রণেনের এয়ারোগ্রাম এসে পৌঁছল, ৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সকালবেলা। মিতার বাবার তখনকার কোয়ার্টার দিল্লির রঞ্জিত সিং রোডের বাড়িতে। এনভেলপের ওপর লেখা—

    মিতা,                                                            সোমবার ৩১.১.৪৯

    কাল রাত্রি ৮.৩০ মিঃ সময়ে ব্লাড প্রেশারের স্ট্রোকে দু’ঘণ্টার মধ্যে রাত্রি ১০.৩০ মিঃ বাবা হঠাৎ মারা গেছেন। বাড়িতে কেউ নেই। এমনকি মা পর্য্যন্ত বাড়ি নেই। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।

    রণেন

    পুঃ সকলকে আনতে পাঠিয়েছি। খুকিকে কলকাতা থেকে আর মেজদিকে কুষ্ঠিয়া থেকে। রাস্তার গোলমালে, কালকের আগে মা বোধহয় বাড়ি এসে পৌঁছতে পারবেন না।

    চিঠিখানা হাতে নিয়ে, সাধারণ পোস্ট নয় দেখেই মিতার মুখ শুকিয়ে গেল; এখন সেটা পড়ে তো হাত-পা কাঁপছে। তবু ভাল যে, তার ভাইবোন বা অন্য কারোর হাতে এ-চিঠি পড়েনি। ইদানীং রণেনের চিঠি আসা নিয়ে, একমাত্র মা ছাড়া, বাড়ির আর সকলে খুবই বিরক্ত; এমনকী তার ছোট ভাইবোনেরাও। কারণ, বাড়ির সর্বময় কর্তা, অর্থাৎ মিতার বাবা ভূতেশ একেবারেই চান না যে, মিতার সঙ্গে রণেনের কিছুমাত্র যোগাযোগ থাকুক। যদিও রণেনের বাবা, রায়সাহেব, তরঙ্গনাথকে তিনি নিজেই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, মিতার আগে তার যে-দুই দিদি, তাদের কোনও একজনের সঙ্গে রণেনের বিয়ে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু চাকরি থেকে অবসর নিয়ে যেদিন ওই রায়সাহেব তাঁর কর্মস্থল থেকে আবার সোদপুরে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে ফিরে এলেন, মিতার বাবা ভূতেশের সে-ইচ্ছেও উড়ে গেল। আরও একটা বড় কারণ হল, তরঙ্গনাথের মতো কৃতী পুরুষের একমাত্র ছেলে হয়েও রণেনের উপার্জনহীনতা; সরকারি আর্ট কলেজের শেষ পরীক্ষা না-দিয়েই সে মুম্বই চলে যায়; কমার্শিয়াল আর্ট তার বিষয় হওয়ায় প্রথমেই সে কাজ পায় পাঞ্চালী আর্ট প্রোডাকশানে; কিছুদিন পরেই এই কোম্পানি ছেড়ে সে যোগ দেয় ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে। পরে সেসবও ছেড়েছুড়ে আপাতত বাড়িতেই; ভূতেশের ভাষায়, ‘বাবার পেনশন ধ্বংস করে, কালচারের ডুগডুগি বাজাচ্ছেন।’ বছর চৌত্রিশের রণেন তো মিতার থেকে অনেকটাই বড়। কম করে চোদ্দো বছর তো হবেই। সদ্য বিএ পাশ করা, বাইশ বছরের সুন্দরী-মেধাবী মেয়ে মিতা যে ওই স্কাউন্ড্রেল রণেনের প্রেমে হাবুডুবু খাবে, এ তো ভূতেশের কাছে অকল্পনীয়। দিল্লি-এলাহাবাদের সম্পন্ন এবং উচ্চশিক্ষিত পরিবার থেকে তাঁর মেয়ে মিতার কত সম্বন্ধ আসছে! অধ্যাপক, অ্যাটর্নি না সিভিল সার্ভেন্ট— কাকে ফেলে কাকে রাখবেন— এমন সব বাছাইতে যখন মেতে আছেন ভূতেশ, সেখানে কিনা তনুদার ওই দায়িত্বজ্ঞানহীন, উন্মার্গগামী ছেলে! ওই বেনোজল রণেন! ভূতেশ বেশ বুঝতে পারছেন যে, মিতাকে উস্কানি দেবার একটা বড় দলও জুটে গেছে। যার মধ্যে প্রধান হলেন রণেনের উচ্চশিক্ষিত সেই বড়দি। বালবিধবা হয়েও, মেলা লেখাপড়া করে, বর্ধমানের একটা রেসিডেন্সিয়াল ইশকুলের প্রিন্সিপাল হিসেবে, নিজের বাড়ি ছেড়ে তিনি এখন সেখানেই থাকেন; কী কাজে দিল্লিতে এসে, তিনিও ভূতেশকে জ্ঞান দিয়ে গেছেন, মিতাকে এত শাসনে না রাখতে। খুব সতর্ক এবং বুদ্ধিমতী বলেই, বিয়ের কথাটা সরাসরি পাড়েননি। রণেনের ছোটবোন লীলার মদত থাকলেও, তার অ্যাটর্নি স্বামীর তো একেবারেই মত নেই। কলকাতা থেকে, এ-ব্যাপারে চিঠি লিখে তিনিই তো সব জানিয়েছেন ভূতেশকে। আর জানিয়েছে, সোদপুরেই থাকা, রণেনের এক তুতো ভাই; মানে তনুদার মাসতুতো ভাই এবং এককালে ভূতেশের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়া সেই হরশঙ্করের বড় ছেলেটি। তার অবশ্য মতলব, মিতাকে নিজের বউ করা। কারণ সে একজন সম্ভাবনাময় সরকারি কেরানি; অন্তত রণেনের মতো আখাম্বা বেকার তো সে নয়!

    ১৯৩৯ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হয়রানি, ’৪২-এর মন্বন্তরে দিল্লি, ’৪৬-এর দাঙ্গায় কলকাতা এবং আবার দিল্লিতে বসেই দেখা দেশভাগ এবং গান্ধীহত্যা— এসব অভিজ্ঞতায় মিতার বুকজুড়ে যেন দাপাদাপি করে বেড়ায় শুধুই ভয় আর উদ্বেগ। আশুতোষ কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দেবার পর পরই মিতার আলাপ হয় রণেনের সঙ্গে। ছুটিতে সোদপুরের বাড়িতে এসেই সে শোনে যে, পাশের পাড়ায় রায়সাহেবের বাড়িতে ‘তপতী’ নাটকের মহড়া চলছে। নির্দেশনায় তাঁর  চিত্রশিল্পী ছেলে রণেন। মিতার পিসতুতো বোনকে নেওয়া হয়েছে গানের দলে। বিকেলের দিকে বোনের সঙ্গে ওই বাড়িতে গিয়ে মিতা দেখল যে, নানা বয়সের একদল ছেলেমেয়ে হইহই করে মহড়া দিচ্ছে। তাদের মধ্যে সব থেকে আকর্ষক-দীর্ঘদেহী এক যুবা মিতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে, চোখ নামিয়ে নিল মিতা। তারপরেই, রণেন নামে সেই যুবা, একজনের আবৃত্তির সঙ্গে বাঁশি বাজাতেও শুরু করে দিল। মোহাবিষ্ট মিতার চোখদুটো কেমন আপনিই বুজে এল আবেশে। ভাড়া করা দলের নাটক সে দেখেছে, পাড়ায় এবং ক্লাবে; কিন্তু এমন একটা মহড়া তো মিতা কখনও দেখেইনি। ইশকুল-কলেজেও সে এসবে যোগ দেয়নি কখনও; একটা বাড়ির একতলার ঘরে এতজন মানুষকে জুটিয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে মাতামাতি চলছে— এ তো মিতা ভাবতেই পারে না। বাড়ি ফেরার পথে তার বোন জানাল, যে-মেয়েটি রনুদার আবৃত্তির সঙ্গে নাচছে, সে কলকাতায় থাকে; তার সঙ্গেই রনুদার বিয়ে হবে। ওই মহড়ার আমেজ নিয়েই, দিন দুয়েক পরেই মিতা ফিরে গেল, তাদের দক্ষিণ কলকাতার বাসাতে। মিতার বাবা দিল্লিতে থাকলেও, বাকি সকলে সোদপুরে না-থেকে, এখন ল্যান্সডাউন-পদ্মপুকুরে একটা ভাড়াবাড়িতে এসে উঠেছে। ভাইয়েরা ভর্তি হয়েছে, মিত্র ইন্সটিটিউশনে আর পরের দুই বোন, কমলা গার্লস ইশকুলে। মিতাও এখন কিছুদিন কলকাতাতেই থাকবে।

    দিন পনেরো পর মিতা আবার সোদপুরে এল, ‘তপতী’ নাটকের মঞ্চায়ন দেখতে। সকালবেলা কৃপানাথের মন্দিরে প্রণাম করে উঠেই সে দেখল যে, মন্দির-চাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে, অপলক তাকেই দেখছে রণেন। বিদ্যুতের চমকে যেন আলো হয়ে গেল তার সমস্ত শরীর। মিতাকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই, রণেন এগিয়ে গেল সামনের রাস্তায়। বিকেলে বড় মাঠের কাছে পৌঁছে মিতা দেখল, অসাধারণ করে সাজানো এক মঞ্চ। সামনের সারিতেই বিশিষ্ট সব মানুষদের সঙ্গে এসে বসেছেন, রায়সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী তরুলতা। কোথায় বসাটা ঠিক হবে বুঝে উঠবার আগেই, অচেনা একজন এসে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেল মিতাকে। রণেনের ছোটবোন লীলাদি তাকে ডেকে বললেন যে, দাদা তাকে বলেছে, সাজঘরের কাছে থাকতে। অন্ধকার মঞ্চে ধীরে-ধীরে আলো জ্বলে উঠল… কসটিউমের গুণে পিতলের মূর্তির মতো লাগছে সেই মেয়েটিকে… আর তার নাচের সঙ্গে আবৃত্তি করছে রণেন, ‘ভস্ম অপমান শয্যা ছাড়ো, পুষ্পধনু… হে অতনু, বীরের তনুতে লহ তনু…।’ প্রথম দৃশ্য শেষ হতে, আবার সব অন্ধকার হয়ে গেলে মিতার খেয়াল হল যে, সেই দীর্ঘদেহী যুবা রণেন, তার নিজের বাঁ-হাতে স্ক্রিপ্টটা ধরে রেখে, ডান হাতটা রেখেছিল মিতার বাঁ-কাঁধে; মিতা ঠিক ঠাওর করতে পারল না, কখন যে তারা মঞ্চের ঠিক নীচেই, এত কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে!

    সারারাত না-ঘুমিয়েও ক্লান্ত লাগছে না মিতার। ভোরবেলা হাঁটতে-হাঁটতে গঙ্গার পাড়ে এসে দাঁড়াল সে। গতকালের কথা ভাববার আগেই তার চোখে পড়ল, দূর দিয়ে কে যেন একজন ভেসে যাচ্ছে, মাঝনদী-বরাবর। পাড়ে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ মিতাকে লক্ষ করেই বলে উঠলেন, ‘তনুদার ছেলে রণেন; আমরা যেমন ছাদে বা মাঠে শুয়ে-শুয়ে চিৎপাত হয়ে আকাশ দেখি, ঠিক তেমনই রনু শুয়ে থাকে, ভোরবেলার নির্জন গঙ্গায়। ঘুমিয়ে পড়লেও সে বোধহয় ডুববে না। দারুণ সাঁতার জানে বলেই হয়তো এমনটা ভেসে থাকতে পারে।’ মিতাকে এখানে আর কে চেনে! বা হয়তো কেউ-কেউ চেনে ভূতেশের মেয়ে বলেই। বাড়ি ফেরার পথে, একজন মহিলা তাকে নিজে থেকে ডেকেই জানতে চইলেন, কোন পাড়ায় ভাড়া এসেছে তারা? পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতেই সে দেখতে পায় যে, তার পিসতুতো বোনও সেদিকেই আসছে; রাস্তাতেই মিতাকে সে বলে দিল যে, তাদের রনুদা নাকি মিতাকে ডেকে পাঠিয়েছে; আর সেটা, ওইদিন বিকেলেই। দ্বিধান্বিত মিতা কোনও উত্তর না দিয়েই বাড়ি ঢুকে গেল। সেই থেকে মিতারও কেবলই মনে হতে থাকল যে, এত দেরি করে কেন বিকেল হয়!

    মিনিট কুড়ির পথ মিতা যেন পাঁচ মিনিটেই পেরিয়ে এল। একতলার খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে, দোতলায় উঠেই তার মনে শুরু হয়ে গেল গুঞ্জন, এখান থেকে আর কোনওদিন কি ফিরে যেতে পারবে সে? একজন বয়স্থা পরিচারিকা ইশারায় দেখিয়ে দিলেন, বাঁ-দিকে ঘুরেই তিনতলার সিঁড়ির দরজাটা। আরও গোটা দশেক সিঁড়ি উঠেই, বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মিতা। রণেন দাঁড়িয়ে আছে, গঙ্গার দিকে মুখ করে, একটা খোলা জানলার সামনে। পশ্চিমের ওই পুরো দেওয়ালটাই খান দশেক জানলা দিয়ে সাজানো। কোনও আসবাব নেই। এক কোণে, মস্ত একখানা ইজেল আর আঁকার জিনিসপত্র। অন্যদিকে একটা ছোট তোশকের ওপর যে কটকি চাদর পাতা বিছানা, তার সামনে রাখা একটা কালো জলচৌকি; তার পায়াগুলো কী সুন্দর করেই না আঁকা! সেটারই আর এক পাশে একটা মস্ত তামার থালায় রাখা এটা-ওটা টুকিটাকি। নীচে থেকে কেউ একজন চা খেতে ডাকলে, হুঁশ ফিরল রণেনের। মিতাকে দরজার গোড়ায় দেখতে পেয়ে, তার কাছে গিয়ে, হাত ধরে ঘরে এনে, তাকে বসতে বলল রণেন। জানলার ধাপিতেই বসে পড়ল মিতা। কতক্ষণ যে কেউ কোনও কথা বলেনি! স্তব্ধতা ভেঙে, বাঁশিটা টেনে নিয়ে বাজাতে শুর করল রণেন; সেই সু্‌র, যেটা শুনে, মহড়ার দিন আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল মিতা। সন্ধে লাগতেই ঘরের ভেতরে অন্ধকার নেমে এলেও, একটু-একটু করে আলো হয়ে গেল, গঙ্গার ওপারটা। একটা বিকেল, অঞ্জলি ভরে যেন ধারণ করে রাখল তার গর্ভে, এক অনাগত প্রেমের ভ্রূণ। ছটফট করে মিতা উঠে পড়লে, এক নিবিড় আধিপত্যে রণেন তাকে উপহার দিল স্ক্রিপ্টের সেই অংশটা; ব্রাউন পেপারের ওপর যার এক দিকে লেখা ‘ভস্ম অপমান…’ আর অন্যদিকটায় রণেনের আঁকা রঙিন নকশা। মিতার মনে হল, সহস্র ডানায় ভর দিয়ে, আকাশ সাঁতরে, বাড়ির পথে সে যেন চলেছে তো চলেছেই। আর কি তার কোথাও ফেরার আছে?

    কী মনে হতে, একদিন সর্দারজিদের মতো পাগড়ি পরে, ছেলে সেজে রণেনদের বাড়ি গেল মিতা; বয়স আন্দাজে হালকা-রোগা শরীরের মিতাকে তেমন কেউ চিনতে না পারলেও, একজন ঠিকই চিনলেন। ঢোকার মুখেই রায়সাহেব! বিকেলে বেড়িয়ে তিনিও বাড়ি ফিরছেন। মিতার আগেই ওপরে গিয়ে স্ত্রীকে বললেন, ‘রনুকে বল নীচে নামতে; ভূতেশের মেয়েটি এসেছে।’ রণেনের কাছে সে-কথা শুনে, মিতাও অবাক! রণেন একটা মেক-আপ বক্স দেখিয়ে মিতাকে বলল, ‘শুধু সর্দার কেন! ওড়িয়া, গুজরাটি, মারাঠি, ইংলিশ— সবরকম সাজিয়ে দিতে পারি; কিন্তু তুমি ছেলে সাজলে কেন বলো তো?’

    ‘বাবা যে বলেন আমি তাঁর ছেলে! তাছাড়া দিদিদের মতো লাবণ্যও তো নেই আমার!’

    ‘বাবা বললেই তুমি ছেলে হয়ে যাবে বুঝি! বুদ্ধির যে লাবণ্য হয়, তা বোধহয় তুমি জানোই না!’

    ‘দিদিরা গান শিখলেও, আমি যে তবলা শিখি!’

    ‘তুমি গান ভালবাসো? এখন যদি গাও তো, আমি সঙ্গত করতে পারি।’

    মিতার অন্তর থেকে বেরিয়ে এল একটাই গান, ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে…’। গানের কথা শেষ হয়ে গেলেও, ওই সুরটাই বাঁশিতে বাজাতে লাগল রণেন; ঠিক ততক্ষণই, যতক্ষণ না তার পুরোপুরি থামতে ইচ্ছে করে। মিতা শিখেছে, সময় মেনে সব কাজ করতে; এবং সিলেবাস ধরে পড়া করেই, ভাল নম্বর পেয়েছে; এই প্রথম সে দেখল এমন একজনকে, যার বিচারে সময় বা অসময় বলে কিছু নেই। রঙে, রেখায়, সুরে, শব্দে সমানেই খেলা করে চলেছে সে; সবই যেন সে তৈরি করে নিতে পারে তার নিজের মতো করে; যে তাসের ম্যাজিক দেখাতেই, মিতা না জেনেই তোলে Queen of Heart; যার নিঃসংকোচ হাত কাঁধের ওপর থাকলেও মনে হয় না যে এক ঝটকায় সরে যাই; যার মুগ্ধ দৃষ্টি দেখেও মনে হয় না যে, এ তো এক জাত-হ্যাংলা পুরুষ! এক অসীম ঐশ্বর্যের উপহারে লাবণ্যময়ী নারী হয়ে উঠল মিতা। ওই স্টুডিওঘর, ওই Queen of Heart, ওই নির্জন নিবিড়তা— সব মিলিয়ে এমন কিছু মিতাকে দিল যে, তার মনে হল এ-জীবনে হিসেবের বাইরেও এমন অনেক প্রাপ্তি ঘটে, যা একেবারেই প্রাপ্য ছিল না; অথচ তো ঘটেই চলে এবং চমক লাগায়।


    রণেনের সেই এয়ারোগ্রাম আকস্মিকভাবে পাবার পরেই, উত্তরে মিতা যে কী লিখেছিল তার সেই চিঠিতে সে তো আর মনেই নেই; সে-চিঠির কোনও জবাবও আসেনি রণেনের কাছ থেকে। এমনিতে রণেন এত চিঠি লেখে যে, মিতাকে মাঝে-মাঝে লজ্জায় পড়ে যেতে হয়; ভাইবোনেদের তির্যক মন্তব্যে সে বুঝতেও পারে, সুযোগ পেলেই চিঠি খুলে তারা যে সেগুলো পড়ে; আবার আঠা লাগিয়ে বন্ধ করে মিতাকে দেয়; ফলে বাবার কানেও সবই যায়। এরই মধ্যে মিতার বিএ পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। বড় জামাইবাবুর প্রভাবেই মিতা ইংরেজি অনার্স নিয়েছিল। হাই-সেকেন্ড ক্লাস নম্বর পেয়ে সে উত্তীর্ণ হয়েছে। বাবাও আবার সপরিবারে কলকাতা ছেড়ে, দিল্লি ফিরে এসেছেন। দিল্লি ফেরত গিয়ে ভাইবোনেরা বেজায় খুশি। ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হলেও, পরিস্থিতি যে খুব স্বাভাবিক হয়েছে এমন নয়। নানা স্তরে হস্তান্তরের এখনও অনেক বাকি। বিশেষ করে বাবার চাকরিজীবনে। স্বাধীন ভারত মানে তো স্বাধীন পাকিস্তানও। ফলে Indian Army-তে সে ভাগাভাগিটাই বা কীভাবে হবে! ১৯৪৭ সাল থেকে নানা পর্যায় পার করে, শেষ অবধি রফা হল তিনটি বিভাগ তৈরি করার। Indian Army, Pakistan Army এবং সেই সঙ্গে অস্থায়ী ভাবে Supreme Commander’s Head Quarters (India and Pakistan)। স্বাধীনতার আগেই ভারত-পাকিস্তানের Joint Defense Council তৈরি করে যত না দু’দেশের মিলিটারি সংগঠনকে মজবুত হতে সাহায্য করার পরিকল্পনা হয়েছিল, তার থেকে বেশি নজর তাদের ছিল, ব্রিটিশ আর্মিতে থাকা সাহেবদের নিরাপদে নিজেদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া। ফলে আর্মির বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত, এ-দেশের প্রায় লক্ষাধিক মানুষের জীবনে নেমে এল অনিশ্চয়তা এবং সংকট। অবশেষে দু’দেশের মধ্যে আর্মি হস্তান্তর, আদিবাসীদের সঙ্গে রফা, জেলে আটক INA-সৈন্যদের যথাসম্ভব মুক্তি, কাশ্মীর ও হায়দ্রাবাদকে ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা এবং সীমানাচিহ্নের ক্ষেত্রে দুই শীর্ষ Authority— নেহেরু-জিন্না যুদ্ধের নিষ্পত্তি; এমন সব সংকট কিছুটা কাটিয়ে এবং কিছুটা সঙ্গে নিয়েই, Sir Francis Robert Roy Bucher তাঁর সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন K. Madappa Cariappa নামে ভারতীয় আর্মি অফিসারের হাতে। ১৯৪৯ সালের ১৫ জানুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তরের এই দিনটিকে ঘোষণা করা হল Indian Army Day হিসেবে। ভূতেশ ঠিক যেভাবে সাহেবদের গুনগান করতেন, মিতার কাছে গল্প প্রসঙ্গে ঠিক সেভাবেই প্রশংসা করতে লাগলেন কারিয়াপ্পার; কারণ তার পুরো ট্রেনিংটাই হয়েছে সাহেবদের হাতে। মিতা শুধু ভাবতে লাগল যে, সাহেবরা এদেশ ছেড়ে, তাদের অতদূরের স্বদেশে ফিরে যেতে পারল; কিন্তু তার বাবা, এই স্বাধীন জমানাতেও তাঁর নিজের দেশে থেকেও, দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরতে পারলেন না চাকরির কারণেই!

    এমনিতে রণেন এত চিঠি লেখে যে, মিতাকে মাঝে-মাঝে লজ্জায় পড়ে যেতে হয়; ভাইবোনেদের তির্যক মন্তব্যে সে বুঝতেও পারে, সুযোগ পেলেই চিঠি খুলে তারা যে সেগুলো পড়ে; আবার আঠা লাগিয়ে বন্ধ করে মিতাকে দেয়; ফলে বাবার কানেও সবই যায়। এরই মধ্যে মিতার বিএ পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। বড় জামাইবাবুর প্রভাবেই মিতা ইংরেজি অনার্স নিয়েছিল।

    মিতা এখন বুঝতে পারছে না যে, কী তার ভবিষ্যৎ। সমানেই পাত্র দেখা হচ্ছে। আরও উচ্চশিক্ষার ভাবনা যত-না তার মাথায়, তার থেকেও বেশি সময় সে ভাবে, রণেনকে নিয়ে। এটুকু সে বুঝেছে যে, রণেনের সঙ্গে বিয়ে হলে রায়সাহেবের পেনশনের আর একজন ভাগিদার বাড়বে; কারণ আয় করার দিকে তেমন কোনও চাড়ই রণেনের নেই; সারাদিন সে মেতে থাকে নিজের খেয়ালে। মিতা জানে না যে, রণেনের বাবা এবং মা এ-ব্যাপারে তাকে কী বলেন। মিতা শুধু এটুকু বুঝেছে যে, রণেনের কাছে থাকলেই, তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে অন্য একটা স্বাধীন মেয়ে; তার ফলে তার যেন মুক্তি ঘটে সমস্ত রকম চাপ এবং বিরক্তি থেকে।

    রণেনের দ্বিতীয় চিঠিটা এল, প্রায় আড়াই মাস পরে, এপ্রিলের গোড়ায়। সেটা পড়েই মিতা ঠিক করে ফেলল যে, রণেনের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যাপারে বাবাকে সে রাজি করাবেই। বাবার খাওয়ার কাছে বসে মিতা বলল, ‘রণেনকে বিয়ে করতে চাওয়াতে আপনার আপত্তি কেন?’

    ‘তোমার দুরবস্থার একশেষ হবে তাই; আমার সব থেকে দামি মেয়েটাকে, জেনেশুনে এমন ঘোলা জলে ফেলে দিতে পারব না যে! অন্য কাউকে বিয়ে করতে না চাইলে, এমএ পড়ো। সেটা পড়ানোয় আমার আপত্তি নেই।’

    কথা না বড়িয়ে চুপ করে বসে রইল মিতা। খাওয়া শেষ করে, ভূতেশ উঠে চলে গেলেন। দিনে-রাতে ভেবেও যেন কূল-কিনারা করতে পারল না মিতা যে, কী তার করণীয়! তার মনে পড়ল, মেজদিদির বিয়ের কথা। আকৈশোর মেজদির যে-প্রেম, তা নিয়ে তাদের দুটো বাড়ির মধ্যে কত না উচ্ছ্বাস ছিল! হঠাৎই একদিন দেনা-পাওনার প্রশ্নে, দুই-বাড়ির দুই জবরদস্ত কর্তার মধ্যে একদিনের মতান্তরে সে-বিয়ে ভেঙে গেল। দুজনেরই বিয়ে হল অন্যত্র; কিন্তু চরম কষ্ট পেয়ে অসুখী হল দুজনেই। ভূতেশের জেদ এবং রাগ, কিছুটা হলেও তো মিতা পেয়েছে। ফলে মেজদিদির সঙ্গে বাবা যে-অন্যায় করেছেন, সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি তার নিজের জীবনে কিছুতেই ঘটতে দেবে না সে। পরদিন সকালবেলা, মাকে একটা চিঠি লিখে, হাতে থাকা সোনার বালাজোড়া খুলে রেখে, মায়ের বাক্স থেকে কিছু টাকা নিয়ে একবস্ত্রেই বেরিয়ে পড়ল মিতা। হাওড়ার ট্রেন ধরে, একেবারে কলকাতা। মনে-মনে ভাবল, যা হবার হোক।         

    আমি মিতা রণেনকে বিয়ে করে ভবিষ্যতের দারিদ্র্য নিয়ে ভয় এবং উদ্বেগ দুটোই থাকলেও, আমার প্রতি রণেনের ভালবাসা নিয়ে তো কোনও শঙ্কা নেই আমার বাড়ির ওই দমবন্ধ করা পরিবেশ, নিদারুণ অপমানে  প্রায় প্রতিদিন মায়ের চোখের জল পড়া এবং অন্যান্য ভাইবোনেদের সঙ্গে আমার মানসিক দূরত্ব— এসব থেকে একমাত্র যে মুক্তি দেয়, সে তো রণেন! রণেন তো অপেক্ষা করে আছে সেই মিতার জন্যই, যাকে সে নিজেই তৈরি করেছে; সেই মিতাকে আমিই-বা কতটুকু চিনি!

    বাড়ি থেকে বেরনোর সময়ে, একটা ছোট সুটকেসে দু’চারটে শাড়ি-সায়া-ব্লাউজের সঙ্গে আরও একটা পুঁটলিতে গুছিয়ে নিয়েছি— আমাকে লেখা আমার মাস্টারমশাই, প্রিয় দুই জামাইবাবু এবং রণেনের চিঠিগুলো অভিভাবক হিসেবে এঁরাও আমার নির্বাচনে ভয় পেয়েছেন তবে বাবার মতো ‘স্কাউন্ড্রেল’ বলেননি রণেনকে বরং প্রসঙ্গ বদলে প্রস্তাব দিয়েছেন, উচ্চশিক্ষার— মানে এমএ পড়বার কথা ভাবতে

    ট্রেনে বসে থেকে অবধি সমানেই ভাবছি, আমার এক বছরের ছোটবোনের কথা, মায়ের কথা; এমনকী ভাবছি বাবার কথাও রণেনের বাড়ির কথাও মনে আসছে ওই দু’একবার দেখাতেই, রায়সাহেব তরঙ্গনাথ নাকি আমাকে পছন্দ করেছিলেন তবে ভূতেশের মেয়ে বলে তাঁর স্ত্রীর খুঁতখুঁত ছিল প্রায় আমার মায়ের বয়সি, রণেনের বড়দিদি তো আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন; বোধহয় ভাইয়ের থেকেও বেশি আর তার ছোটবোন লীলাদির তো আমিই একজন বড় ভক্ত! এত পড়ুয়া আর অমন মিষ্টি ব্যবহার খুব কমই দেখা যায় 

    মনে পড়ল যে, রণেনের শেষ চিঠিটা তো হ্যান্ডব্যাগেই আছে ভাল করে আর একবার পড়ে দেখি মনে যদি কোনও খিঁচ লাগে তো এলাহাবাদে নেমে উলটোদিকের ট্রেন ধরে আবার নাহয় দিল্লিই ফিরে যাব

    মিতা,                                                                  ২৫ মার্চ, ১৯৪৯

                                                                          সোদপুর— পঃ বাংলা

    আগের দিন রাতে চলে গেলেও, মা তখনও বর্ধমান থেকে না ফেরায়, বাবার দাহকাজ স্থগিত রাখা হয়েছিল যানবাহন বিভ্রাটে বিধ্বস্ত মা, বাড়িতে ঢুকেই বরফের ওপর শোয়ানো বাবাকে দেখে, দিশেহারা হয়ে যান বাবার জন্য আনা কমলালেবুর টুকরিটা হাত থেকে খসে পড়ে গেলে, কিছু লেবু মাটিতেই গড়িয়ে যায় মায়ের চেতনা আসতে সময় লাগে কুষ্ঠিয়া থেকে মেজদির আসতেও বেলা হয়ে যায় মা একটু ধাতস্থ হলে, তাঁর অনুমতি নিয়ে শ্মশানযাত্রা শুরু হয় দাহকাজ শেষ হতে-হতে সূর্যও ডুবতে থাকে ধীরে চিতাটা যখন দাউ-দাউ করে জ্বলছিল, আমি তখন সিঁড়ির সেই ধাপটাতেই বসেছিলাম মনে করে দেখো, এক বিকেলে ঠিক যেখানে বসে সূর্যাস্তের রং-বাহার দেখিয়েছিলাম তোমাকে! বলেছিলে, সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত— এমন দুটো ছবি আঁকলে, এক দেওয়ালেই পাশাপাশি সাজিয়ে রাখবে তুমি!  

    গত ৮ ফেব্রুয়ারি পারলৌকিক কাজ হল মাকে দেখে কি আর চিনতে পারবে? নিরাভরণ সাদা থান পরা, যেন এক নিঃস্ব রমণী মাথা কামিয়ে ন্যাড়া করে ফেলতে চেয়েছিলেন; আমি বাধা দিয়ে থামিয়েছি   

    আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হারিয়ে গেল আমাদের বাড়ি থেকেই উবে গেল, ফুলের বাগান আর বাবার সেই দরাজ গলার গান আগে হয়তো অনেকবার পাশে চেয়েছি, তোমাকে; স্বপ্নও দেখেছি, সংসার সাজাবার কতবার যে ‘বউ’ বলে মনে-মনে ডেকেছি! আজ সেই আমিই বলছি, মিতা তুমি আর এসো না এই শূন্য বাড়িতে তোমাকে কোথায় আঁটাব বলো তো! আমার আর মায়ের যেমন করে হোক চলে যাবে; কিন্তু যে-তুমি কোনওদিন দারিদ্র্য দেখোনি, অনটন দেখোনি, সেখানে তোমাকে টেনে এনে কোন সুখ দিতে পারব বলো!

    বাবার পেনশনও তো আর নেই দুজন কাজের লোকেদেরই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সামান্য কিছু শেয়ারের টাকা আসে বলে, কোনও রকমে চলে যাচ্ছে আমি বোধহয় কোনওদিনই উপার্জনের উপযুক্ত তেমন কিছু কাজেও নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারব না

    আমার মতো এই উদ্ভট মানুষটার সঙ্গে জুটে, নিজের জীবনটা নষ্ট করে ফেলো না, মিতা।

    তোমার কোমল স্পর্শ সারাজীবন আলো দেবে আমাকে গান গাওয়া ছেড়ো না কিন্তু

    চিঠিটা হাতে নিয়ে দুর্জয় জেদে ঠোঁট কামড়ে বসে রইলাম চোখের সামনে এলাহাবাদ স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াল বেশ অনেকক্ষণ আবার আমাকে নিয়েই প্ল্যাটফর্ম ছাড়াতে-ছাড়াতে সে-ট্রেন এগিয়েও চলল সামনের দিকে কই নামলাম না তো, বাড়ি ফিরে যাব বলে?

    ভাবলাম যে, মানুষ কি শুধু অন্যকেই কথা দেয়! নিজেকে দেয় না? জীবনে এই একবার নাহয় নিজের কাছেই,  নিজেকে দেওয়া কথাটা রাখলাম। ‘রণেন’ আর এই ‘রমিতা’— এরা কি সত্যিই আলাদা?

     ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook