ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শেষ নাহি যে...


    দেবারতি গুপ্ত (May 25, 2024)
     

    বাকি শিল্পের কথা বলতে পারি না, তবে সিনেমা-করিয়েদের পৃথিবী দু-ভাগে বিভক্ত। একদল খুব জোরের সঙ্গে মনে করেন পৃথিবীতে নতুন কিছু বলার বাকি নেই। তাই কী ভাবে বলা হচ্ছে, সেটাই আসল। আরেক দল পুরনোপন্থী; যারা এখনও মনে করেন কী ভাবে ছবি বানানো হচ্ছে তা মুখ্য নয়— কী বলা হচ্ছে তা আজও প্রাসঙ্গিক কারণ নতুন অনেক কিছুই বলার আছে। মহামান্য কেন লোচ এই পুরনোপন্থীদের দলে সম্ভবত অগ্রগণ্য। সেইজন্যেই বোধহয় তারুণ্যের ভোরবেলা উঠে দেখা বিলি ক্যাসপারকে আজও বাড়ির পাশের ঝোড়ো বস্তির দুষ্টু ছেলেদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রায় ষাট বছর হয়ে গেল, লোচ— ক্যাথি, বিলি, জো, কার্লা, ড্যানিয়েলদের গল্প বলে যাচ্ছেন, যারা প্রথম বিশ্বের মানুষ। তবু তাদের আর্থ-সামাজিক অসহায়তা দেখলে এই তৃতীয়-দুনিয়ায় বসেও নিজেকে একজন সুবিধেভোগী মানুষ ভেবে লজ্জা হয়। ২০১৬ সালে বানানো ‘আই ড্যানিয়েল ব্লেক’ ছবির ফুডব্যাঙ্কের সেই মর্মান্তিক দৃশ্য মনে পড়লে চরম অস্বস্তির মধ্যেও মনে হয় এ তো ইংল্যান্ড! যারা আমাদের দুশো বছর গোলাম বানিয়ে রেখেছিল। সেই রাজার দেশেও এমন হয়! অসহায় কেটির হাতে বেক্‌ড বিনের ক্যান খোলার কড়কড় শব্দ, আর তারপরেই ক্যান থেকে বিন বার করে নিজের মুখে পুরে দেওয়া কিন্তু তারপরেও সেটা গিলতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়া। খিদে। ড্যানিয়েল তার দিকে ছুটে এলে, কেটি লজ্জায় কাঁদতে-কাঁদতে বলে ভীষণ খিদে পেয়েছিল, তাই…       

    ‘আই, ড্যানিয়েল ব্লেক’ সে-বছর Palme d’or পেয়েছিল। তারপর পরিচালক আরও দুটি ছবি করেন। গিগ অর্থনীতির ডেলিভারি শ্রমিক রিকি টার্নারের দিনযাপন নিয়ে ‘সরি, উই মিসড ইউ’ আর গত বছরের ‘দ্য ওল্ড ওক’। ধরে নেওয়া হচ্ছে অশীতিপর ‘তরুণ’ পরিচালক কেন লোচ একটি ট্রিলজি শেষ করলেন তার সাম্প্রতিক ছবিটি দিয়ে। এই ছবিটি গত বছরের কান চলচ্চিত্র উৎসবে Palme d’or প্রতিযোগিতায় ছিল। আজকের বিশ্ব-রাজনীতিতে ডাইনে-বাঁয়ে ঘেঁটে যাওয়া পরিস্থিতিতে কেন লোচের মতো পরিচালকের সগর্বে ছবি করে যাওয়া এক অতি আশ্চর্য ঘটনা বলে মনে হয়। কোনও বিরাট কিছুর সঙ্গে যোগ তৈরি হওয়ার আশা জোগায়। বিশ্বাস জোগায়। সেই আশা আর বিশ্বাসের কথাই ‘দ্য ওল্ড ওক’-এ বলা হয়েছে। ২০১৬-র ব্রেক্সিটকালীন ইংল্যান্ড। বছর পাঁচেক আগে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ বিদ্ধস্ত অভিবাসীদের আশ্রয় দিতে শুরু করেছে। তাই নিয়ে ডারেম শহরের উপকণ্ঠে খনি-এলাকাস্থিত গঞ্জশহরের বাসিন্দাদের মধ্যে তুমুল অসন্তোষ শুরু হয়েছে। ছবির শুরুতেই এরকম এক অশান্তি দেখি আমরা। তরুণী ফোটোগ্রাফার ইয়ারা তার পরিবার নিয়ে সিরিয়া থেকে এসেছে। তার স্টিল ক্যামেরায় সে তার পরিবারের বিস্থাপনের প্রতিটা মুহূর্ত নথিবদ্ধ করে রাখছে। হয়তো ক্যামেরার লেন্স দিয়ে দেখলে রূঢ় বাস্তব কিঞ্চিৎ সহনীয় লাগে। কিন্তু সেটুকুও সহ্য হয় না কারও-কারও। স্থানীয় কিছু গুন্ডা প্রকৃতির ছেলে ইয়ারার ক্যামেরাটা ছিনিয়ে মাটিতে আছড়ে ফেলে। লেন্সটা ভেঙে যায়। গোলমাল লাগার আগে দ্য ওল্ড ওক বারের মালিক টি জে ব্যালেন্টাইন এসে ওদের ঝামেলা মেটায়। কিন্তু ইয়ারার ভাঙা ক্যামেরার কী হবে? ছিন্নমূল হয়ে আসা ইয়ারার ওই ক্যামেরার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত স্মৃতি আর শিকড়। ক্যামেরাটা ইয়ারাকে ওর বাবা দিয়েছিল, যে সিরিয়ায় স্বৈরাচারী আসাদের সরকারি জেলে বন্দি। পরদিন বারের মালিক টি জে ব্যালেন্টাইন ইয়ারার ক্যামেরা সারিয়ে তাকে ফেরত দিতে আসে। মধ্যবয়সি টি জে বিবাহবিচ্ছিন্ন। তার একমাত্র ছেলে তার সঙ্গে কথা বলে না। বারের নিত্য খদ্দেররাই টি জে-র সঙ্গী। তারা দুই পুরুষ ধরে এই ছোট খনিশহরে আছে। এক সময়ে খনিশ্রমিকদের জীবনেও স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। টি জে-র বারের পিছনের হলে নিত্য আনন্দ-উৎসব হত। কিন্তু এখন এই শহরটার মতো দ্য ওল্ড ওকের ব্যাকরুমটিও শ্রীহীন হয়ে পড়ে আছে। টি জে খেয়াল করে, নতুন আসা সিরিয়ার অভিবাসীদের নিয়ে টি জে-র পুরনো খদ্দেরদের মধ্যে চাপা সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ঢিমে আঁচে ফুটতে শুরু করেছে। স্থানীয় সমাজকর্মী লরা আর ইয়ারা টি জে-কে অনুরোধ করতে আসে যে ওর ব্যাকরুমে যদি পুরনো বাসিন্দা আর নতুন অভিবাসীদের একসঙ্গে সাপ্তাহিক বিনামূল্যে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা যায় তবে এলাকার মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য বাড়বে। কিন্তু টি জে রাজি হয় না। কারণ সে আঁচ করতে পারে তার ছোটবেলার এইসব বন্ধু প্রতিবেশীরা যারা এক সময়ে সুখী গৃহস্থালির স্বপ্নে জীবন শুরু করেছিল আজ সায়াহ্নে তারা দেশের একপেশে অর্থনীতির শিকার। তাদের সংসার শ্রীহীন। তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ধোঁয়াটে। এ হেন অসুখী আর অনিশ্চিত জীবনের সমস্ত হতাশা, রাগ, আক্ষেপ একজোট হলে যে তীব্র হিংসা তৈরি হয়, তা এই মানুষগুলো নতুন বহিরাগতদের ওপর উগরে দিতে চায়। অথচ তারাই ওল্ড ওকের গুটিকয় গ্রাহক।         

    ‘দ্য ওল্ড ওক’ দেখে অপার্থিব বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে ওঠে ঈশ্বরকে যে তৈরি করেছে, সেই সর্বশক্তিমান মানুষের ওপর। সমাজবাস্তবতার ছবি স্বপ্ন দেখার সাহস দিয়ে তৈরি করেছেন পরিচালক; যে ভাবে গত ৬০ বছর ধরে করে আসছেন। কুর্নিশ।     

    তবে নতুন করে কৌম গড়ে তোলার ডাক বেশিদিন উপেক্ষা করতে পারে না টি জে। তার বন্ধ ব্যাকরুমের দেয়ালে এখনও টাঙানো আছে ১৯৮৩-’৮৪ সালের শ্রমিক আন্দোলনের ছবি। টি জে তখন কিশোর। তার কাকার তোলা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে টি জে-র মনে পড়ে যায় তার এই ছোট্ট গঞ্জশহরের সমস্ত খনিশ্রমিক একজোট হয়ে এক সময়ে মিছিলে হেঁটেছিল, আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। তবে আজকের পৃথিবীতে বাস্তুহারাদের সঙ্গে বিত্তহারাদের এত কোন্দল হবে কেন? তারা দেশ-ধর্মের বিভেদ ভুলে একজোট হতে পারবে না কেন? আর কিছু না হোক, একসঙ্গে কমিউনিটি ভোজনে অসুবিধে কোথায়! টি জে-র দেয়ালে একটা পুরনো ছবিতে দেখা যায়, ‘ইফ উই ইট টুগেদার, উই স্টিক টুগেদার।’ ট্রেড ইউনিয়ন আর লরার মতো কিছু স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগে শুরু হয় সাপ্তাহিক কমিউনিটি লাঞ্চ। কিন্তু কৌমবোধ যেখানে অনুপস্থিত, যেখানে লাঞ্ছিতদের চোখের সামনে ভুল রাজনীতির কুয়াশা— যাতে বন্ধু আর শত্রু গুলিয়ে যায়, সেখানে এই কমিউনিটি লাঞ্চ কদ্দিন চালানো যায়! সিরিয়ার অভিবাসীরা কি এবার মসজিদ বানাবে এই পুরনো ক্যাথিড্রাল শহরে? এই বহিরাগতগুলো আমাদের প্রতিবেশী কী করে হতে পারে? ওরা বিদেশি। আর যেহেতু মুসলমান, অতএব ওদের প্রত্যেকের ঘরে-ঘরে একটি করে জেহাদি জঙ্গি লুকিয়ে আছে। এই কল্পিত শত্রু তৈরি করে না নিলে নিজেদের না-পাওয়া থেকে গজানো ক্ষতর মলম আসবে কোত্থেকে? অতএব অযথা প্রতিহিংসা আর পিঠে ছুরি মারার শিকার হয় দ্য ওল্ড ওক। ঠিক যেভাবে সর্বকালে সর্বহারাদের জোট বিফলে গেছে, খানিকটা তেমনই। এই হয়তো নিয়ম আর এই বুঝি নিয়তি।   

    কিন্তু এত অন্ধকারও বোধহয় নেই পৃথিবীতে। দীর্ঘ অন্ধকার যখন চোখে সয়ে যায়, তখন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাওয়া যায়। সেই এগিয়ে যাবার ভরসা জোগান ৮৭ বছরের কেন লোচ। শুরুতেই যে-আশা জাগানোর কথা বলেছিলাম, ইয়ারা এক সময়ে টি জে-কে বলে, ‘আশা জিইয়ে রাখতে অনেক শক্তি লাগে যা ওরা খর্ব করে দিতে চায়। আর আশা জিইয়ে রাখতে লাগে বিশ্বাস।’ কেন লোচের এই বিশ্বাস ঈশ্বরের ওপর বর্তায় না। ‘দ্য ওল্ড ওক’ দেখে অপার্থিব বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে ওঠে ঈশ্বরকে যে তৈরি করেছে, সেই সর্বশক্তিমান মানুষের ওপর। সমাজবাস্তবতার ছবি স্বপ্ন দেখার সাহস দিয়ে তৈরি করেছেন পরিচালক; যেভাবে গত ৬০ বছর ধরে করে আসছেন। কুর্নিশ।     

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook