ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং : পর্ব ৫৩


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (March 16, 2024)
     

    ফিরে এসো চাবুক

    তত্ত্ব প্রণয়ন খুব শক্ত, আরও শক্ত তাকে পৃথিবীর মেশিনে ফিট করে দেখা, চাকা আদৌ চলছে কি না। অধিকাংশ সময়েই চলে না। ছাপা হরফে যা ভয়াবহ উত্তেজক লাগে, বক্তৃতায় যা পৌনে-প্রমাণ সোয়া-প্রমাণ সাড়ে-প্রমাণ করে ছাড়া যায়, তা যেই পিচরাস্তায়, টিউকলে, বা প্রসূতির পুষ্টিকর খাবার যোগানে রত ৫২টা লরি-তে অনুবাদ করা হয়, দেখা যায় সব কমা সেমিকোলন উৎপ্রেক্ষা ও অনুপ্রাস গলন্ত পিচে মুখ ঘষটাচ্ছে। যেই মনে হয় অমুক সরকারের জঘন্য পরিচালনাকে বাতিল করে নতুন মুখ নতুন প্রতিশ্রুতিকে দায়িত্ব দিলেই স্বর্ণযুগ ড্রপ খাবে এবং প্রভাতকুসুম নব আনন্দে পোজ দেবে, অমনি দেখা যায় নতুনরা পুরনোদের চেয়েও বাইসেপ আছড়াচ্ছে এবং কিছুতেই নর্দমার মুখ বোজাচ্ছে না। নেপালে অনেক লোক এবার মিছিল-টিছিল করছে, রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হোক। দিনে-দিনে সেই মিছিলে লোক বাড়ছে, অনেক বাড়িতে বা দোকানে ফের রাজার ছবি ঝোলানো হচ্ছে। রাজা মানে জ্ঞানেন্দ্র শাহ, যাঁকে ১৬ বছর আগে জনগণ বিদ্রোহ করে সিংহাসনচ্যুত করেছিল। ২০০৫-এ জ্ঞানেন্দ্র সমস্ত ক্ষমতা নিজের হস্তগত করেন, সরকার আর সংসদ বাতিল করে দেন, বহু রাজনীতিবিদ আর সাংবাদিককে জেলে পোরেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সেনাবাহিনী দিয়ে দেশ শাসন করতে থাকেন। তার আগের তিন বছরেও তিনি প্রধানমন্ত্রী বাতিল করেছিলেন তিনবার, তাঁরা মাওবাদীদের দমন করতে পারছেন না এবং সাধারণ নির্বাচন করতে পারছেন না বলে। ২০০৫-এ তাঁর স্বৈরাচার যখন একেবারে অফিশিয়াল তকমা পেয়ে যায়, যখন জ্ঞানেন্দ্র এ-কথাও বলেন, ‘গণতন্ত্র আর প্রগতি পরস্পরবিরোধী… মুক্তচিন্তার সন্ধানে আমাদের স্বভাবের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ শৃঙ্খলাকে উপেক্ষা করা চলে না’, তখন হাজার-হাজার মানুষের প্রতিবাদ শুরু হয়, জ্ঞানেন্দ্র পরের বছরেই ফের সংসদকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। তার দু-বছর পর, ২০০৮-এ, রাজতন্ত্র জিনিসটাকেই নেপাল বাতিল করে দেয়। রাজপ্রাসাদ ছেড়ে জ্ঞানেন্দ্রকে চলে যেতে হয়। তারপর ১৩টা সরকার এসেছে, এবং নেপালের বহু লোকজনের এবার মনে হচ্ছে, ধুর, এর চেয়ে রাজা থাকাই ভাল। ‘রাজা ফিরে এসো, দেশ বাঁচাও’, ‘আমরা রাজতন্ত্র চাই’ স্লোগান তুলে তাই এখন মিছিল, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবার বিদ্রোহ।

    ঝামেলা এটাই, মানুষ চায় স্বচ্ছন্দ জীবন। চায় ভাল রাস্তা, চমৎকার নিকাশি ব্যবস্থা, পরিষ্কার পানীয় জল, চাকরিবাকরি করে মোটামুটি বেঁচে থাকার বন্দোবস্ত, রাত্তিরবেলাও নিরাপদে ঘোরাফেরা করার পরিস্থিতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলে তা থামাবার দক্ষতাসম্পন্ন পুলিশ। সাংঘাতিক মোটা বইয়ে কী ভাল ফুটনোট লেখা আছিল রে— এই ইউফোরিয়ায় সাধারণ মানুষ মথিত হয় না। তাই হ্যানো তন্ত্রের চেয়ে ত্যানো তন্ত্র অনেক ভাল, অ্যাদ্দিন দর্শনগুলো হোলসেল ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছে আর আমার দর্শন সুইচ অন হলেই সব পালটে দেবে— এসব আস্ফালন এবং জটিল গণিত সম্মুখে পষ্ট লটকালেও কারও কিস্যু এসে যায় না, যতক্ষণ না তুমি ক্ষমতায় এসে দেখাতে পারছ যে ভাল-ভাল ডাক্তার গরিব পাড়ায় বসছেন এবং কম পয়সায় চিকিৎসা করছেন। মুশকিল হল, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ, এবং যদি-বা কেউ রাবণ না-ও হয়, কুম্ভকর্ণ হয়ই, অর্থাৎ ঘুম ভেঙে কিছুতে উঠে বসতে পারে না। যে-কোনও কাজ শুরু করার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে কাজটা শুরু করে দেওয়া। সে-অভ্যাস মানবসমাজে আসতে ঢের দেরি। প্রায় যে-কোনও রাজনৈতিক দল অপদার্থ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই, তারা যখন গদি দখল করে দ্যাখে, পুঁথির সংজ্ঞা অনুযায়ী অমুক দর্শন বহাল হলেই আপনা থেকে ধুলোয় ঝাঁট পড়ে যায় না, তার জন্য গতর নাড়াতে হয়, পরিকল্পনা করতে হয়, তা রূপায়িত করার চেষ্টা চালাতে হয়, বাস্তবে তা প্রয়োগ করা যাচ্ছে না দেখলে ফের টেবিলে বসে মাথা খাটিয়ে নতুন হিসেব-নিকেশ করতে হয়, তখন তাকধাঁধা লেগে যায়। সেই কাজগুলো করার ক্ষমতা যদি না থাকে, বা তা আছে কি না বোঝার আগেই অনেক টাকা গাপ করার খাবলাখাবলি লেগে যায়, তাহলে দেশ চালানো যায় না।

    ‘চল চল, অত্যাচারীদের প্রাসাদে গিয়ে লগা দিয়ে ঝাড়লণ্ঠন ভাঙি’ শুনে সমষ্টি যত প্রাণপণ উৎসাহী হয়, ‘চল চল, বস্তিতে গিয়ে ইট-কাঠ বয়ে গরিবদের জন্য কলঘর গড়ে দিই’ শুনে ততটা সাড়া দেয় না। কারণ ধ্বংসের মধ্যে যতটা সহজ আনন্দ রয়েছে, ভিলেনকে নিকেশের পেল্লায় তৃপ্তি রয়েছে, নিজের বিষ উগরে দেওয়ার লোভ রয়েছে, তা গড়ে তোলায় নেই।

    আরও সমস্যা হল, কোনও কিছুর প্রতি ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানানোর সময়ে, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময়ে, সাধারণ মানুষকে ডাকলেই যতটা অটোমেটিক ভিড় গজিয়ে যায়, কোনও কিছু গঠন বা নির্মাণের সময়ে অত সহজে সেই জটলা জন্মায় না। ‘চল চল, অত্যাচারীদের প্রাসাদে গিয়ে লগা দিয়ে ঝাড়লণ্ঠন ভাঙি’ শুনে সমষ্টি যত প্রাণপণ উৎসাহী হয়, ‘চল চল, বস্তিতে গিয়ে ইট-কাঠ বয়ে গরিবদের জন্য কলঘর গড়ে দিই’ শুনে ততটা সাড়া দেয় না। কারণ ধ্বংসের মধ্যে যতটা সহজ আনন্দ রয়েছে, ভিলেনকে নিকেশের পেল্লায় তৃপ্তি রয়েছে, নিজের বিষ উগরে দেওয়ার লোভ রয়েছে, তা গড়ে তোলায় নেই। গড়ে তোলা অনেক কঠিন, উত্তেজনাহীন, নিরস এবং তার জন্যে শ্রম দিতে হয়। আর, তা সময়সাপেক্ষ। তক্ষুনি হয় না, একটা গড়গড় ঢাল বেয়ে ক্রমে গতি বাড়িয়ে চলে না। তাই জনগণকে সঙ্গে নিয়েই বিপ্লবে এগিয়ে চলতে হবে— এ-কথা ততক্ষণ অবধি তবু বহাল থাকে, যতক্ষণ যুদ্ধ চলে, কিন্তু যুদ্ধের পর যখন ধ্বংসস্তূপ সাফ করতে হয়, সে-ধৈর্য এবং সদিচ্ছা জনগণের মধ্যে খুব দেখা যায় না। বস্তির বাথরুম গড়ে দেওয়ার প্রস্তাবে এমনকী বস্তির লোকেরও খাটাখাটনির ইচ্ছে দেখা যায় না। তারা বলে, তাহলে তোমাকে মসনদে বসালাম কেন? তুমি সব কিছু করে দাও। আমরা দাঁড়িয়ে দেখি আর হাততালি দিই। তাই যে-সরকার ভেবেছিল, বাপ রে, আমাদের অ্যাত্ত ঢালাও সমর্থন, বোধহয় ১০০ বছরে আর সরছি না, তারা মাসছয়েক পরেই টের পায়, আগের সরকারকে গালাগাল দেওয়া যত সহজ ছিল, এখন পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোটা অতটা সহজ মনে হচ্ছে না, আর চালে কিলবিলে কাঁকর থাকলে কালকের সমর্থন-হিস্টিরিয়া আজ উদ্দাম খিস্তিতে বদলে যেতে ক-সেকেন্ড মাত্তর লাগবে।

    এবং জনতা যখন দ্যাখে একের পর এক সরকার আসছে আর যাচ্ছে, তাদের হ্যান আদর্শ ত্যান মূল্যবোধ ব্যান ম্যানিফেস্টো ধ্যান ধর্মগ্রন্থ কিচ্ছু হাঁকড়েই একটা স্বাভাবিক সহজ সুস্থ জীবন কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না, তার তখন মনে হয়, বোধহয় আগেকার জীবনটাই ছিল ভাল, বাপ রে পেঁয়াজের তো এত দাম ছিল না, কই হুট বলতে বস তো চাকরি খেত না। সত্যিই সেই জীবনটা এর তুলনায় বেশি সহনীয় ছিল, না কি স্মৃতি আজ অনেকটা তথ্য গুলিয়ে দিয়েছে, এ খতিয়ে দেখার মানসিকতাও তার নেই, তদুপরি বর্তমান ও প্রায়-বর্তমানের প্রতি এমন বিছুটি-খ্যাপা রাগ ধরেছে যে অতীতকে বাই ডিফল্ট প্রিয় মনে করার খেলা তার কাছে একমাত্র পলায়ন-সরণি। সব মিলিয়ে সে রাজতন্ত্রকে ডাকছে। আসলে অতীতকে ডাকছে। সে কোনও তন্ত্রের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়, তার বক্তব্য, ভাই, কাজ করো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। আর গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভয়ানক স্বৈরাচারী হাবভাবের লোক দেখে দেখে তার এমন বিরাগ জন্মে গেছে, ইদানীং মনে হয় বুক বাজিয়ে ‘আমি স্বৈরাচার করব’ হাঁকড়ানো লোকটা অন্তত সৎ ছিল। তাই তারা বলে, খাতায়-কলমে রাজতন্ত্র খারাপ হোক, শিক্ষিত গণতন্ত্রের ফর্মা তো বহুত দেখলাম, এবার সব ব্যাটা চুলোর দোরে যাক, আগের ব্যাটা আসুক।

    সেইজন্যেই, কোনও রাজ্যে কোনও সরকার যদি দুর্নীতির দরবারে নাচতে-নাচতে, তত্ত্বের থামে হেলান দিয়ে বলে, ‘আমায় ভোট না দিলে কাকে দেবে, ওরা তো দাঙ্গাবাজ’, তখন লোকে বলতেই পারে, ‘কিন্তু ওরা ঝাড়েবংশে চোর নয়, আমার কষ্ট করে জমানো টাকা নিজের বৈঠকখানার মাদুরে স্তূপ করে রাখে না, তাই ওদের ভোট দেব, কারণ আমরা চাকরি চাই ডিএ চাই, সেটা যদি ওরা দেয়, তখন আমি ওদের আদর্শ নিয়ে মাথা ঘামাব না।’ লোককে তুমি যদি তখন বোঝাতে যাও, ছি ছি, চুরির চেয়ে দাঙ্গা অনেক খারাপ, দুর্নীতির চেয়ে সাম্প্রদায়িকতা খারাপ, ভাল-আদর্শের চোর অনেক ভাল, খারাপ-আদর্শের দক্ষ প্রশাসকের চেয়ে— কেউ মানবে না। তারা বলবে, আমরা ডুবন্ত মানুষ, কাণ্ডারি যদি আমাকে উদ্ধার করে, মৌলবাদী না ওরা মানববাদী ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? সেইজন্যেই চারটে বই আর এক-দলা ইচ্ছে যথেষ্ট নয়, পাঁচটা পেটোয়া বুদ্ধিজীবী আর সাতটা রূপ-ঝলসানো সিনে-তারকা যথেষ্ট নয়, রাজনৈতিক দলকে হতেই হবে জাগ্রত ও কর্মনিপুণ। কিন্তু তাদের বয়ে গেছে, তারা ভাবে, পুলিশ আমাদের হাতে, গুন্ডা আমাদের হাতে, জনতা আমার কী করবে? কী আবার করবে, প্রতিবাদ-টতিবাদ জানিয়ে টান মেরে ধুলোয় ফেলে দেবে, তারপর তুমি হেদিয়ে মরো আর পিটপিটিয়ে ওয়েটিং-লিস্ট দ্যাখো, বছর-ষোলো কেটে গেলে, যদি তোমার দাপট ও দাঁতের স্মৃতি জনমানসে ফিকে হয়ে আসে, ফের তোমার জন্যে গলা ফাটাবে’খন।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook